বাঁক ( ১৭ পর্ব )
____________
মানহার সঙ্গে মৃদুলও চোখবুজে গান শুনে। মানটা তার নিমিষেই যেন শান্ত স্নিগ্ধ হয়ে গেছে। গানের মানে সে খুব একটা বুঝে না৷ তবুও গায়কের মিষ্টি সুর আর গীতিকারের কথা মিলে যতটুকু বুঝতে পেরেছে কবি যেন অভিমানে টইটম্বুর হয়ে এই গানটি লিখেছেন। হঠাৎ একটা কথা মৃদুলের মনে পড়ে গেল,
– ‘মানহা।’
চোখবুজেই জবাব দিলো,
– ‘হু।’
– ‘আমার সঙ্গে যখন বের হচ্ছিলে ফার্মেসি থেকে তোমার মামা কেমন করে যেন তাকালেন, কারণ কী?’
– ‘বলতে চাইছিলাম না। তবুও বলে ফেলি। আসলে গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। ওইদিন রাতে আমরা বের হইছিলাম না? কে জানি দেখে মামাকে বলে দিয়েছে।’
মৃদুলের বুকটা কেঁপে উঠলো। একটা মেয়ে এই কথাগুলো এতো সহজভাবে বলছে কীভাবে?
– ‘তাও আজ আবার তুমি আসলে যে আমার সঙ্গে?’
– ‘তোমার প্রয়োজনে আমি আসবো না বলো? সামান্য এই বাঁধা আঁটকে ফেলবে আমাকে তা কী হয়?’
মৃদুল আর কিছু বললো না।
পুনরায় প্রথম থেকে গান শুরু হয়েছে। এবার সে একটা জায়গায় থমকে গেল, আগে বিশেষভাবে খেয়াল করেনি।
“চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে –
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।”
মৃদুল চোখ মেলে মানহার মুখের দিকে তাকায়। ওর চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। চোখের পাতা নড়ছে৷ কী নিষ্পাপ লাগছে দেখতে। রাস্তার পাশের জমিগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবুডুবু করছে৷ তার চোখও ভরে এলো জলে। বুকে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভব হচ্ছে। এই কয়েকটা লাইন যেন মানহার ব্যক্তিগত। তাকে উদ্দেশ্য করেই মানহার বলা। আসলেই তো মানহার সঙ্গে তার স্বীয় স্বার্থের লেনা-দেনা এক সময় মিটে যাবে। তখন কী আর মানহা নামের মেয়েটির কাছে সে আসবে? কখনও কি তারার পানে চেয়ে চেয়ে মানহার কথা ভাববে? মৃদুলের এবার ফাতিহার প্রতি অকারণ রাগ হলো। রাগ হচ্ছে নিজের ভাগ্যের উপরেও। ভুল সময়ে কেন মানহা নামের এই পবিত্র ফুলের সঙ্গে তার দেখা হলো? ফাতিহার জন্যেই বা কেন সেদিন এতো বড়ো ত্যাগ স্বীকার করতে গেল সে? যদি জানতো মানহার মতো এক রূপবতী মায়াবতী নারী শৈশব থেকে তার জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে কী এই ত্যাগ স্বীকার করে নিতো সে?
ফাতিহা আর সে এক সঙ্গেই খেলাধূলা করে বড়ো হয়েছে। অনেকটা সমলিঙ্গের মতো ছিল তারা। কখনও মৃদুল অন্য নজরে দেখেনি। তবুও একসময় তাদের মাঝে দূরত্ব আসে। ফাতিহা বড়ো হয়, নিজের সহপাঠীদের সাথে মিশে। মৃদুল দাদাভাইয়ের সঙ্গে নানান কাজে ব্যস্ত। ফাতিহা তখন নাইনে পড়ে। অথচ বয়স হয়ে গেছে ওর প্রায় সতেরো৷ গায়ে-গতরেও অনেক বড়ো। এর কারণ সে প্রাইমারির কয়েক শ্রেণিতে ফেইল মেরেছে। একদিন মৃদুলকে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘মৃদুল ভাই স্কুলের সামনে একটা কাপড়ের দোকান আছে না?’
মৃদুল বললো,
– ‘হ্যাঁ আছে, শরৎ সুন্দরী বস্ত্র বিতান নাম।’
– ‘এই দোকানে একটা ছেলে আছে না তাকে এই কাগজ দিতে পারবে গিয়ে? কেউ যেন আবার না দেখে?’
মৃদুল ওর মাথায় ঘাট্টা মেরে বললো,
– ‘কিরে প্রেম-টেম করছিস না-কি?’
ফাতিহা মুচকি হেঁসে পুরো ঘটনা তাকে বললো। ছেলেটি দু’দিন আগে প্রথম চিঠি দিয়েছে। সেটার জবাব দিয়েই ফাতিহার আজকের চিঠি। এরপর থেকে মৃদুল প্রায়ই তাদের চিঠি আদান-প্রদানের দায়িত্ব পেয়ে গেল। এগুলো নিয়ে সে খুব একটা গভীরভাবে ভাবতে যায়নি। ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক বছর তিনেক এভাবে ছিল। হুট করে একদিন ফাতিহা তার গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানায় দোকানের ছেলেটি তাকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে৷ ওর বাড়ি আরও বাটিতে। দোকানে কর্মচারী হিসাবে কাজ করতো।
মৃদুল হালকাভাবে নেয় বিষয়টি। সান্ত্বনা দেয় খানিক্ষণ। কিছুদিন পরই সে বুঝতে পারে ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ফাতিহা সবকিছু উজাড় করে ভালোবেসেছিল পরদেশী ছেলেটিকে। পেট যখন প্রকাশ পেতে শুরু করে ফাতিহা তখন তাকে জানায়। বাড়িতে বিয়ে প্রস্তাব দিতে বলে। এসবের কারণেই ছেলেটি হুট করে দোকান ছেড়ে পালিয়েছে৷ এদিকে দাদা ভাই ছাড়া ফাতিহার মা আর দাদি বুঝে গেছেন। এলাকার মানুষ জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মান-ইজ্জত সবকিছু শেষ। ভেতরে ভেতরে এগুলো নিয়ে বাড়িতে হট্টগোল চলছিল। একদিন দাদি মৃদুলকে নিয়ে সবকিছু খুলে বললেন। এখন ইজ্জত সেইই রক্ষা করতে পারে একমাত্র। তাকেও বুঝান সে যেহেতু অনাথ। কেউ নেই তার। সুতরাং ফাতিহাকে বিয়ে করে তাদের পরিবারের একজন হয়ে এখানেই থাকতে পারবে।
– ‘কী ভাবছো এতো?’
মানহার কথায় তার স্মৃতি রোমন্থনে ব্যাঘাত ঘটে।
– ‘পেটে চিমটি মারলে কেন?’
– ‘কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলে তাই চিমটি মেরে আমার কাছে ফিরিয়ে আনলাম।’
মৃদুল মুচকি হাসে। তারপর মানহার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কিছু না, কিন্তু তোমার চোখ এতো লাল কেন? ঘুম পাচ্ছে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ ঘুম পাচ্ছে অনেক। কিন্তু সিএনজিতে তো ঘুমানো যাবে না।’
মৃদুল খানিক্ষণ ভেবে ড্রাইভারকে বললো,
– ‘একটু পর্দা ফেলে দিন তো।’
– ‘বৃষ্টি তো নেই।’
– ‘ওর ঘুম পাচ্ছে তো পর্দা থাকলে আলো লাগবে না।’
ড্রাইভার আর কিছু না বলে পর্দা ফেলে দিল টান মেরে।
– ‘তোমার ভ্যানিটিব্যাগ পেছনে রেখে ইয়ারফোন কানে দিয়ে মোবাইল আমার হাতে দাও।’
মানহা বাধ্য মেয়ের মতো মুচকি হেঁসে তাই করলো। তারপর মৃদুল পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘এবার তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাও।’
মানহা কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো, ‘হুট করে এতো আদর করছো কেন?’
মৃদুল চোখ দিয়ে শাসিয়ে ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করে। যার অর্থ হলো ড্রাইভার শুনবে। মানহা ফিক করে হেঁসে পরম শান্তিতে চোখবুজে নেয়।
মৃদুলের ডাকে মানহা চোখ মেলে তাকায়।
– ‘বাবা এতো ঘুম তোমার।’
– ‘চলে এসেছি?’
– ‘হ্যাঁ, নামো।’
দু’জন সিএনজি থেকে নামে। মানহা ভাড়া দিয়ে বললো,
– ‘চলো আগে স্টেশন দেখি।’
দু’জন স্টেশনে গিয়ে খুঁজে দেখে। মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য খোঁজা। এভাবে ঘণ্টা তিনেক তারা কলোনি, আবাসিক হোটেলে ছুটে কাটিয়ে দিল৷ কী বলে লোকদের জিজ্ঞেস করবে? ছবিও নেই তাদের কাছে। মৃদুলও চিনবে কি-না জানে না। তবুও খুঁজতে হয় বলে খোঁজা। ক্লান্ত মানহা বললো,
– ‘চলো ব্রিজের ওপারে যাই।’
– ‘হ্যাঁ, চলো।’
রিকশা ডেকে দু’জন ব্রিজের ওপারে এলো।
– ‘এখন কী করবে? ইরফানের বাসায় চলে যাবে?’
– ‘তিনটা হয়ে গেছে এখন যাওয়া যায়, তার আগে ওই পার্কে গিয়ে খানিক্ষণ বসে জিরিয়ে নিই। পিপাসাও লেগেছে। এই নাও টাকা, তুমি ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসো।’
মৃদুল রাস্তার অপর পাশের দোকান থেকে পানি নিয়ে এলো। দু’জন ঢুকলো জালালাবাদ পার্কে। গাছের ছায়া দেখে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে তারা।
মৃদুল বোতলের ছিপি খুলে বাড়িয়ে দিল মানহার দিকে।
– ‘তুমি আগে খেয়ে নাও।’
– ‘কেন?’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘আমি বোতলে মুখ না লাগিয়ে পানি খেতে পারি না৷ তাছাড়া মুখও ধুতে হবে আমার।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মৃদুল পানি খেয়ে তাকে বোতল দেয়। তখনই মানহার ফোন বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ইরফান কল দিয়েছে৷
– ‘তুমি কথা বলো।’
মৃদুল কল রিসিভ করে,
– ‘হ্যালো।
– ‘হ্যাঁ মানিক ভাই কোথায় এখন তোমরা?’
– ‘আমরা জালালাবাদ পার্কে বসে আছি।’
– ‘তাহলে এখানে থাকো, আমি পার্কে আসছি। সমস্যা হলো আমার বাসার কাজের মেয়েটা সুন্দর পুরের। আবার গ্রামের একজন সিলেট ডাক্তার দেখাতে এসে আমার বাসায় উঠেছে। তাই বাসায় তোমাদের নিতে চাচ্ছি না। চিনে ফেললে গ্রামে বলে বেড়াবে।’
– ‘আচ্ছা তাহলে আসো এখানে।’
ফোন রেখে দিল মৃদুল। মানহা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,
– ‘ক্ষুধা পায়নি তোমার? চলো খাই কিছু।’
– ‘না ইরফান আসুক তারপর কোনো রেস্টুরেন্টে বসেই কথা বলে নিব।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘ওইযে বাদাম ওয়ালা আসছে ডাক দেবো?’
– ‘তুমি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিলে ডাকতে পারো।’
মৃদুল মুচকি হেঁসে ডাক দিলো। বাদাম ওয়ালার থেকে এক প্যাকেট বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে মানহাকে দেয়া শুরু করলো।
মানহা খেতে খেতে গল্প করছে। হঠাৎ মৃদুলের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে ব্রেঞ্চে
রেখে বললো ওই গাছ থেকে ফুল এনে দাও।
– ‘আরে না ফুল ছিঁড়া নিষেধ।’
– ‘কেউ নাই আশেপাশে চলো তো।’
– ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’
মানহাও পিছু পিছু গেল। তারা গাছের অনেকটা আড়ালে চলে এসেছে। মৃদুল উঁকি দিয়ে গাছের ডাল খানিকটা নামিয়ে ফুল ছিঁড়ে এনে বললো,
– ‘এই নাও।’
– ‘এভাবে কেউ প্রেমিকাকে ফুল দেয়?’
– ‘আমি এসব পারবো না।’
– ‘কেন?’
– ‘ফুল নিলে নাও, না হলে ফেলে দিচ্ছি।’
– ‘আচ্ছা নিচ্ছি ফুল, কিন্তু তাকিয়ে দেখো আশেপাশে কেউ নেই।’
– ‘তো কী হয়েছে?’
‘কিছু না’ বলে মানহা চলে যাচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে। মৃদুল ওর হাত ধরে আঁটকে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মানহার চোখে জল চলে এলো৷ কী সিনেমাটিক একটা দৃশ্য। নায়ক নায়িকার হাত ধরে আটকাচ্ছে৷ মানহার সিনেমাটিক ব্যাপারগুলো ভীষণ ভালো লাগে। মৃদুল তাকে টেনে নিজের কাছে নেয়। মানহা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। মৃদুল পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘এতো অভিমান কেন?’
– ‘এগুলো বুঝবে না তুমি, তুমি হচ্ছ পাথর মানব।’
– ‘রক্ত মাংশের মানব হতে হলে কী করতে হবে?’
– ‘তুমি ফুল নিয়ে প্রপোজ করতে পারতে, তাও করোনি। পার্কে আড়ালে-আবডালে প্রেমিক প্রেমিকারা কী করে? তুমি একবার জড়িয়েও ধরো না, চুমু তো অনেক দূর।’
মৃদুল আচমকা ছেড়ে দিল তাকে। ম্লান মুখে চলে গেল ব্রেঞ্চে। হঠাৎ ওর এই আচরণের কোনো কারণ বুঝতে পারে না মানহা। ওর পাশে গিয়ে বসে বললো,
– ‘হঠাৎ কী হলো? এমন মলিন মুখ হয়ে গেল কেন? আমি ভুল কিছু বলেছি না-কি?’
– ‘না কিছু হয়নি, তবে এসব চুমু জড়াজড়ি আমি পারবো না।’
মানহার লজ্জায় কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুলো যেন। সে কী অতিরিক্ত নির্লজ্জ হয়ে গেছে।
– ‘আচ্ছা তোমার এসব করতে হবে না সরি।’
– ‘সরি বলার কিছু হয়নি, ইরফানকে কল দাও অনেক্ষণ হলো আসে না কেন?’
– ‘হ্যাঁ তাইতো, দাঁড়াও কল দিয়ে দেখি।’
মানহা কল দিয়ে অবাক হয়ে বললো,
– ‘আরে ওর মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে কেন?’
– ‘কী বলো একটু আগেই তো কথা হলো, আবার কল দাও।’
মানহা আবার কল দেয়। কিন্তু মোবাইল বন্ধ দেখায়।
– ‘কী হলো বুঝতে পারছি না বন্ধ দেখাচ্ছে তো মোবাইল।’
– ‘আরও কিছু সময় পর দিয়ে দেখো।’
– ‘আচ্ছা তাই করি।’
আরও কিছু সময় পর কল দিয়েও মোবাইল বন্ধ দেখালো।
____চলবে___