বাঁক ( ২য় পর্ব )
এখন মৃদু বাতাসের সঙ্গে শ্লথ গতিতে বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে বাজারে আসতে শুরু করেছে৷ কারও হাতে ছাতা আবার কারও পরনে রেইনকোট।
নিঃশব্দে খানিক্ষণ কেটে গেল তাদের। নীরবতা ভেঙে পুনরায় মেয়েটিই বললো,
– ‘আমার নাম মানহা জান্নাত।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।’
মৃদুল মাথা তুলে তাকায়। মানহাকে ভালোভাবে পরখ করে সে। অচেনা একটা মেয়ে তার সঙ্গে এভাবে আচরণ করার কারণ কী হতে পারে? মোবাইল নাম্বারই বা কেন চাচ্ছে? এগুলো মানহাকেই জিজ্ঞেস করা যায়। কেউ তার কাছে নাম্বার চাইলে প্রয়োজনটা কী তার জানার অধিকার আছে। কিন্তু মৃদুল ভীষণ সতর্ক। অধিক ঘাটাঘাটি করতে যাবে না সে। তাই অবিকৃত চেহারায় বললো,
– ‘আমার মোবাইল নেই ম্যাডাম।’
– ‘ফকির।’
– ‘কি?’
– ‘এক কথা একবার বলি।’
মৃদুল কিছু না বলে কেবল দাঁত কটমট করে তাকায়। খানিক পর বলে,
– ‘প্লিজ আপনি এবার যান। দোকানের মালিক চলে আসবে।’
– ‘মালিককে এতো ভয় পান? আপনি একটা নিবীর্য পুরুষ।’
মৃদুল এবার রূঢ় গলায় বলে,
– ‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।’
মানহা ফিক করে হাসে,
– ‘আচ্ছা আজ যাচ্ছি আবার দেখা হবে।’
এই কথা বলে মানহা চলে যায় সেদিন। এরপর প্রায়ই দোকানে আসে। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে তাকে বিপর্যস্ত করে চলে যায়। আজ সকালেও এসেছিল। তাকিয়ে দেখলো মালিক আসেনি। একা বসে আছে মৃদুল। মানহা রিকশা বিদায় করে নিঃসংকোচে পা টিপে টিপে দোকানে আসে। মৃদুল শঙ্কিত চেহারায় চেয়ে থাকে কেবল৷
– ‘মালিক আসেনি এখনও?’
– ‘না।’
– ‘সকালের নাস্তায় কী খেলেন?’
সে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললো,
– ‘আপনি প্রতিদিন এসে কি শুরু করেন বলুন তো।’
– ‘কী শুরু করি?’
মৃদুল কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। মানহা পুনরায় বললো,
– ‘একদিন নির্জন কোথাও গিয়ে বসি?’
– ‘কেন?’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘অবিবাহিত ছেলে-মেয়েরা নিভৃতে কী করে?’
– ‘জানি না, তবে আমার কোথাও যাবার সময় নেই। দোকানে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয়।’
– ‘বেতন কত দেবে?’
– ‘আপনি জেনে কী করবেন?’
– ‘ভাবছি আপনাকে চাকরিই তো দেয়ার কথা না৷ তাই বেতন দেয় কি-না জানতে চাচ্ছি।’
মৃদুল মূক হয়ে তাকিয়ে রইল। মানহা পুনরায় বললো,
– ‘আমাকে ভয় পাবেন না। বরং আমি উল্টো আপনার অনেক সমস্যাই সমাধান করে দিতে পারি।’
– ‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’
– ‘এই দোকান ছেড়ে দিন। পদে পদে ঝামেলা থেকে আমি একটা চাকরি দেবো আর ঝামেলায় পড়বেন না।’
– ‘কে আপনি? আমি কেন ঝামেলায় পড়বো?’
মানহা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘এতো যুক্তিতর্ক, দ্বিধা, শঙ্কা বাদ দিয়ে উপকারীর উপকার নেন। আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।’
মৃদুলের গলা শুকিয়ে আসছিল। তবুও সে ব্যগ্র গলায় বললো,
– ‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?’
– ‘শুনুন, আপনি আমার ডেন্টাল কেয়ারে সহকারী হিসেবে যোগ দিন৷ এখন যে ছেলে আছে তার সঙ্গেই আপনি কাজ করবেন। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু শিখে নিবেন আপনি। এক সময় ওই ছেলেটিকে বাদ দিয়ে শুধু আপনাকে রাখবো।’
– ‘আপনার লাভ কী এখানে?’
– ‘বেশি ঘাটের জল খেলে এই এক সমস্যা। মানুষ তখন লাভ ক্ষতিই সবকিছুতে খুঁজে। আমি আপনার মতো বেশি ঘাটের জল খাইনি।’
– ‘আমার উপকার করার তো একটা কারণ থাকবে, তাই না?’
– ‘আপনার সঙ্গে আমি প্রেম করবো। আপনাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে এটাই কারণ।’
– ‘মিথ্যে কথা।’
মানহা উচ্চস্বরে হেঁসে বললো,
– ‘তাহলে নিজেই বলুন কারণটা কী?’
মৃদুল সতর্ক হয়ে গেল৷ তারপর কথা না বাড়িয়ে বললো,
– ‘আমি ভেবে দেখবো।’
– ‘অযথা পালাবেন না। আমার কাছে আপনি সেইফ।’
মূদুল বোকার মতো কেবল ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। মানহা মুচকি হেঁসে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে ক্ষীণস্বরে বলে,
– ‘আপনার মালিককে এভাবে বলতে পারেন। আপনি ডেন্টালের এক বছরের কোর্সে ছয় মাসের মতো পড়ে টাকার সমস্যার কারণে বাদ দিয়েছিলেন। যন্ত্রপাতির নাম অল্প অল্প জানেন। পুরোপুরি কাজ শেখার জন্য মানহা ডেন্টাল কেয়ারে যাবেন তাই দোকান ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন।
মালিক যদি বলে এগুলো শিখে সার্টিফিকেট ছাড়া সহকারীর চাকরি পাবি না। তাহলে আপনি বলবেন থানা টাউনের মতো ছোটখাটো বাজারে কাগজ ছাড়া কাজ জানলেই সহকারী হিসেবে রাখে। আপনি আগেও অন্য জায়গায় করেছেন।’
– ‘মালিককে এতকিছু বলার কী দরকার?’
– ‘কারণ এ অঞ্চলের সবাই দেখবে আপনি আমার ওখানে কাজ করেন। তাই মালিককে একটু ডিটেইলসে বলে যাওয়াই ভালো। অন্যরা আপনার সম্পর্কে মাঝে মাঝে উনাকে জিজ্ঞেস করবে। তখন আপনি মালিককে যে তথ্যগুলো দিয়ে যাবেন। উনিও সেগুলো অন্যদের বলবেন।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘ঠিকাছে আমি এবার যাচ্ছি।’
– ‘দাঁড়ান।
– ‘কী?’
– ‘আপনার নাম্বার বলুন।’
মুচকি হেঁসে মানহা নিজের নাম্বার বলে। মৃদুল কাগজে লিখে রাখার পর সে চলে যায়।
‘গ্যাটর গ্যাটর’ শব্দ করে আবার ফ্যান চলতে শুরু করেছে।
বরকত মিয়া বিড়ি টানার ইস্তফা দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। কোণার দিকের ছেলেটির এখনও ফোনালাপ চলছে।
মৃদুল আবার তেল চিটচিটে বালিশে মাথা পেতে ভাবছে মেয়েটি কে হতে পারে? তার নানাবাড়ির না-কি দাদার বাড়ির কেউ? চেনার পরও যেহেতু বলছে তাকে ভয় পাবার কিছু নেই, তাহলে ওর সঙ্গে কাজ করা উচিত। অন্তত সব জায়গায় নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে লুকোচুরি করে থাকতে হবে না। আচ্ছা মেয়েটি তাকে যেহেতু চিনে ওর কাছে কী তার মা, বোনের খবর জানা যাবে? তারা এখন কোথায় আছে? আদৌও কী বেঁচে আছে? ফোনটা বেজে উঠল তার। মনে পড়ে গেল মানহাকে মিথ্যে বলেছিল মোবাইল নেই।
ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না ভেসে এলো।
খানিক্ষণ কান্নার সুযোগ দেয় মৃদুল। তারপর মিষ্টি করে বলে,
– ‘ফাতিহা।’
ওপাশে কান্নার তোড় খানিকটা কমে আসে। তারপর নিজেকে সামলে বলে,
– ‘হু।’
– ‘কান্নাকাটি করতাছো ক্যান?’
– ‘কী আর করমু আমি কও, হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল।’
– ‘বাড়ির সবাই ভালা আছেনি?’
– ‘ভালা।’
– ‘ছবি দেইখা কেউ সন্দেহ করছেনি আমারে?’
– ‘পুলিশরে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু মুরব্বি অনেকেই বলাবলি করছে এইটারে দেখতে পুরাই মৃদুলের মতো লাগে। মৃদুল এই গ্রামে যখন আইছিল এইরকম ছিল।’
– ‘আইচ্ছা আগে কও তো তুমি শিওর বুচ্ছিলা ক্যামনে আমি ওই ছবির ছেলে?’
– ‘আমি তোমারে চিনমু না কও? সেই যে গ্রামে আইছিলা দাদা ভাইয়ের লগে। এরপর থাইকা আমরা এক লগেই বড়ো অইছি। আমি চিনমু না? আর তোমার গ্রামের বাড়ির কথা আর কেউরে না কইলেও আমারে কইছিলা কতবার। মা বইনের কথা বইলা কত কান্নাকাটি করছো সবই তো আমার ধারে বইয়া।’
– ‘বুচ্ছি ফাতিহা। আইচ্ছা ওই ছবির লগে আমার মিল কী?’
– ‘তোমার ডাইন চুউক্ষের নিচে কালা তিল। ছবিতেও আছে। এখন আরও বড়ো অইছে তিলটা। আর গঠনও সেইম।’
– ‘আইচ্ছা ফাতিহা তুমি কী তারপরও বিশ্বাস করো আমারে?’
– ‘হু, কিন্তুক আমি চাই আমারে তুমি সবকিছু খুইলে বলো।’
– ‘হু, কইমু সময় আইলে ফাতিহা৷ আইচ্ছা কেউ যদি বলে তোর জামাই কই৷ কইবা শহরে কামে গেছে। বিয়ার পর তো আর দাদা ভাইয়ের কাম কইরা সংসার চলতো না। তাই শহরে পাঠাইছি।’
– ‘হু।’
– ‘তুমি আমার লক্ষী বউ।’
– ‘কোনে আছো তুমি?’
– ‘এগুলো জানার দরকার নাই ফাতিহা। আমি আছি৷ ভালাই আছি। এখন রাখি ফোন।’
– ‘হু।’
– ‘ভালা থাইকো, রাখলাম।’
কল কেটে মৃদুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটির কথা। যেদিন একটা কিশোরের জীবন নদীর মতোন বাঁক নিয়েছিল।
২০০৪ সাল। বয়স বারো-তেরো হবে। সে কাঁদতে কাঁদতে পালাচ্ছে। কোথায় যাবে সে জানে না। শুধু জানে তাকে পালাতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। যেখানে তাকে কেউ চিনবে না। অন্ধকারে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামের পর গ্রাম পেছনে ফেলে যাচ্ছে। আচমকা লঞ্চের ডাক শুনে। বুঝতে পারে সে সুন্দরপুর লঞ্চঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে। এই লঞ্চ ধরতে পারবে না সে। রাত আটটায় শেষ লঞ্চ ভাটি অঞ্চলের দিকে যাবে। সেটাই তাকে ধরতে হবে। খাল-বিল হাওর পেরিয়ে সুন্দর পুর লঞ্চঘাটে গিয়ে দাঁড়ায়। কাদামাখা হাত-মুখ কী একটু ধুয়ে নিবে? উত্তাল কুশিয়ারার দিকে তাকিয়ে সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না সে। চারধারে অন্ধকার। নদীতে কেবল বাতি জ্বালিয়ে ছোট ছোট নৌকা এদিক-ওদিক যাচ্ছে। ঘাটে যাত্রী কম। চা’র স্টলে হারিকেনের আলো জ্বলছে। চা খেতে খেতে কয়েকজন গল্প-গুজব করছে। সে দূরে দূরেই থাকলো। কাছে গেলেই নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। তখনকার ছোট্ট মৃদুল বুঝে নিয়েছিল জীবন নদী যেদিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে মানুষের কাছাকাছি থাকার নিয়ম নেই। দূরে থাকাই মঙ্গল, ঝুঁকি কম।
খানিক পরেই নদীর পাড়ের শীতল বাতাসের কারণে মৃদুলের কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।
সে ঘাস দেখে বসে পড়ে। মশা বারবার চাদরের মতো ঢেকে দিচ্ছে তাকে। শরীর নাড়া দিলে আবার বিরক্তিকর সুর তুলে সব পালিয়ে যায়। দূরে কোথাও দলবেঁধে শেয়াল ডাকছে। পাশের কোনো গ্রামে ‘এই তৈয়ব’ বলে কেউ হাঁক দিলো। নদীর কিনার ঘেঁষে গান বাজিয়ে একটা নৌকা যাচ্ছে। গাঁজার কটু গন্ধ ভেসে এলো সেই নৌকা থেকে। তাদের চোরা আলোয় একটা মেয়েকেও দেখা ফেললো মৃদুল।
অপেক্ষার প্রহর শেষে রাতের সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ফালাফালা করে লঞ্চের ডাক শোনা গেল তখনই। ক্ষীণ সময় পরেই খানিক আগের নৌকা লঞ্চের ছুড়ে মারা আলোয় দৃশ্যমান হয়ে গেল। মেয়েটি মুখ ডেকে নিল চাদরে। কিন্তু চোখের পলকে ঘটে গেল বিপত্তি। আঁতকে উঠল মৃদুল।
—চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam