বাঁক (১ পর্ব )

0
731

‘ডাক্তার মেয়েটি গোয়েন্দাদের মতো আমাকে ফলো করছে কেন? আমার কাছে কী চায় সে? কোনোভাবে কী আমার আসল পরিচয় জেনে গেছে? জানার তো প্রশ্নই আসে না৷ আর জেনে গেলেও নিশ্চয় পুলিশকে খবর না দিয়ে এতদিন বসে থাকতো না? তবুও মেয়েটির কথাবার্তা আর চাহনিতে কিছু একটা আছে। যার কারণে বুকে ভয় ধরে যায়।’

এসব বিক্ষিপ্ত ভাবনা মৃদুলের চোখ থেকে রাতের ঘুম তাড়িয়ে দিয়েছে। অতি উৎসুক এই ডাক্তারনির কারণে বোধহয় এখান থেকেও তাকে পালাতে হবে। অবশ্য গোপনে সন্ধান চালিয়ে ডাক্তারনির সম্পর্কে সে অল্প-বিস্তর জানতে পেরেছে। মেয়েটি এখনও বিয়ে করেনি। থাকে মামার বাসায়। খুব বেশিদিন হয়নি পড়ালেখা শেষ করে রূপসা গলির মাথায় ওর মামার ‘মামণি ফার্মিসি’র পাশে ডেন্টাল চেম্বার দিয়েছে। নাম ‘মানহা ডেন্টাল কেয়ার’৷ সিলিং ফ্যান হঠাৎ ‘গ্যাটর গ্যাটর’ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার রুম। কোণার দিকে কেউ একজন ঘন্টা তিনেক ধরে নিম্নস্বরে প্রণয়িনীর সঙ্গে ফোনালাপ করে যাচ্ছে। ফ্যানের শব্দে এতক্ষণ তার কথাবার্তা অনেকটা গোঙানির মতো শোনা যাচ্ছিল।কেউ একজন গলা খাঁকারি দিয়ে বিছানায় উঠে বসে বিড়ি ধরিয়েছে। অন্ধকারে বিড়ির লাল অংশ খানিক পর পর তীব্র হতে দেখা যাচ্ছে।
ভ্যাপসা গরম সহ্য করতে না পেরে মৃদুলও বিছানায় উঠে বসে বললো, ‘বরকত চাচানি?’

– ‘হ, হালার পুতেরা কারেন্ট নিয়া গেল।’

– ‘হ চাচা, গরমে তো আর ঘুমানো যাইব না।’

– ‘জানালা খুইলা দেও মিয়া।’

– ‘দাঁড়াও দিতাছি।’

মৃদুল জানালা খুলে দিতেই শীতল হাওয়া হুড়মুড় করে তার গায়ে এসে আছড়ে পড়লো। বৃষ্টি আসবে বোধহয়। বাইরে বাতাস দিচ্ছে। এই ঘরে প্রচুর গরম। অনেকটা হলরুমের মতো দেখতে। এটা তার মালিকের কসমেটিকসের দোকানের উপরের তলা। এই ঘর অনেকদিন পরিত্যক্ত ছিল। মালিক এখন পুনরায় ঠিকঠাক করে ভাড়া দিয়েছে। নানান হোটেল, দোকানের কর্মচারীরা শুধু রাতে এসে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমায়।
মাস শেষে হাজার-পাঁচশ টাকা ভাড়া দিলেই হয়।

– ‘বাইরে যাইবানি মিদল।’

– ‘না চাচা, বৃষ্টি আইব মনে অয়।’

– ‘ও আইচ্ছা।’

বরকত মিয়ার মাধ্যমেই ডাক্তারনির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মৃদুলের। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাকে বললো,
– ‘বাইরে যাইবানি মিদল। চলো বিড়ি নিয়া আসি।’

মৃদুল তার সঙ্গে বাইরে যায়।
বিড়ি নিয়ে আসার পথে বরকত মিয়া ‘এশিয়া কমিউনিটি সেন্টার’ দেখিয়ে বলে, ‘কাল এইখানে ডিউটি আছে।’

মৃদুল অবাক হয়ে বললো,

– ‘তুমি না হোটেলে কাম করো?’

– ‘হোটেলে কাল নাইট ডিউটি। তাই দুপুরে সেন্টারে যাব।’

– ‘কত পাইবা?’

– ‘একশো করে দিব সবাইরে, তুমি যাইবা না-কি?

– ‘হ, লোক লাগলে বইল।’

– ‘তোমার না দোকান আছে।’

– ‘সমস্যা নাই মালিক যাইতে দিব৷ বেশি সময় তো আর লাগবে না।’

– ‘আইচ্ছা তাইলে জুম্মা বাদে লইও আমার লগে।’

সেদিন মৃদুল গিয়েছিল। এর আগে হোটেলে ওয়েটারির কাজ করেছে। এতটুকুনই তার অভিজ্ঞতা। বিয়ের খাবার পরিবেশন শুরুর আগে টেবিল ভাগ করে দেয়া হলো। সে আর বরকত মিয়া একই টেবিলে। তার কাজ হচ্ছে তরকারির বাটি টেবিল পর্যন্ত এনে দেয়া। আর মেহমানদের প্লেটে ভাত-তরকারি তুলে দেবে বরকত মিয়া। কিন্ত খাবার পর্ব শুরু হতেই তাড়াহুড়ায় কীভাবে জানি তাদের নিয়ম ভেঙে গেল। বরকত মিয়া চলে গেল ভাত আনতে আর সে গোশতের বাটি হাতে দাঁড়িয়ে রইল টেবিলের কাছে। অতি রূপসী এক শাড়ি পরিহিতা যুবতিকে দেখিয়ে একজন বললো,
– ‘ম্যাডামকে তরকারি দাও।’

মেয়েটিও ‘হ্যাঁ দাও তো অল্প একটু’ বলেই মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।
মৃদুল তরকারির বাটি নিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটি অপলক তাকিয়ে রইল তার দিকে। এভাবে তাকানোর কোনো কারণ বুঝতে পারলো না মৃদুল। তার অস্বস্তি বেড়ে গেল ভীষণ। অস্বস্তি আর আনাড়ি হাতে তরকারি দিতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। ঘাড়ের উপর দিয়ে হাত নেয়ার সময় কীভাবে জানি নাড়া খেয়ে বাটি থেকে ঝোলের ধারা বেয়ে পড়ে গেল মেয়েটির ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের পুরুষটি ধমক দিয়ে বললো, ‘এই ব্যাটা লগে কি চোখ নাই তোর? কয়দিন থাইকা ওয়েটারি করছ?’

মেয়েটি শান্ত স্নিগ্ধ গলায় ‘বাদ দিন’ বলে লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেঁসে মৃদুলকে বললো ‘শান্তভাবে বাটি টেবিলে রেখে আমাকে টিস্যু থাকলে দিন।’

সে তাড়াতাড়ি টিস্যু এগিয়ে দিল। এতক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বরকত মিয়া। মৃদুলকে ধমকের স্বরে বললো, ‘ম্যাডামের হাতে টিস্যু দিতাছো ক্যান, নিজে মুছে দেও। টিস্যু আরও লাগলে নেও আমার কাছ থাইকা।’

মেয়েটি পুনরায় শান্ত স্বরে বললো,

– ‘আপনারা অস্থির হবেন না। আমার হাতে টিস্যু দেন, তারপর নিজের কাজে যান।’

আড়ালে যেতেই বরকত মিয়া ‘খ্যাকখ্যাক’ করে হেঁসে বললো,

– ‘হালার ব্যাটা করছো কি? অন্য কেউ হইলে আজ নির্ঘাত মাইর খাইতা। ডাক্তারনি ভালা মানুষ তাই বাইচা গেলা।’

– ‘মাইর দিব ক্যান? আমি কি ইচ্ছা কইরা ফেলছি নি?’

– ‘হ, মাইর না দিয়া তোমারে সালাম দিব৷ বিয়েতে মানুষ আসে নতুন জামা-কাপড় পরে সাজগোছ কইরা। ঝোল পড়লে তখন মাথা খারাপ হইয়া যায়।’

– ‘হ বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি এখানে কেন তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে যাও।’

বরকত মিয়া চলে গেল। মৃদুল আবার ছুটে গেল নিজের কাজে। এরপর যতবার ডাক্তারনির সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে মৃদুল।
এর কয়েকদিন পর একদিন রাতে বরকত মিয়া বিড়ি টানতে টানতে বললো, ‘আইজ রাস্তায় ওই ডাক্তারনি আমারে পাইয়া তোমার কথা জিগাইল।’

মৃদুল অবাক হয়ে বলল,

– ‘কি জিগাইল?’

– ‘রিকশায় আছিল। হঠাৎ আমারে দেইখা রিকশাওয়ালাকে থামাইয়া বললো ওইদিন সেন্টারে আপনে আছিলেন না? আমি কইলাম হ আছিলাম৷ তারপর জিগাইলো আপনের সাথের জন কই থাকে? আমি কইলাম ইদ্রিস ম্যানশনের কসমেটিকসের দোকানের কর্মচারী। ওইখানের উপরেই থাকে।’

– ‘আমার কথা জিগাইল ক্যান ডাক্তারনি?’

– ‘কি কইমু কেন জিগাইল। তাছাড়া ডাক্তারনি তো প্রত্যেকদিন এদিক দিয়াই রিকশা কইরা যায়। তোমারে দেখে না?’

– ‘খেয়াল করেনি মনে অয়।’

বরকত মিয়া খ্যাক খ্যাক করে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘মিদইল্লা ডাক্তারনির কইলাম তোমার উপর বদ নজর পড়ছে৷ বিয়ে-শাদি করে নাই। তোমার লগে কয়দিন প্রেম-পিরিত করবো মনে অয়।’

– ‘ধুরো মিয়া কি ফালতু কথা কও? দেশে কি ছেলের আকাল পড়ছেনি আমার লগে পিরিত করবো?’

কথাটি বলে মৃদুল নিজের বিছানায় চলে যায়।
পরেরদিন সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। সে দোকান খুলে বসলো গিয়ে আটটায়। মালিক কল দিয়ে বলেছে আসতে দেরি হবে। সে যেন একা দোকান খুলে বসে। নয়টার দিকে একটি রিকশা ইদ্রিস ম্যানশনের সামনে এসে থামে। মৃদুল মাথা তুলে তাকাতেই তার পিলে চমকে উঠলো।
সাদা এপ্রোন পরা ডাক্তারনি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে নীল ছাতা টাঙিয়ে এদিকে আসছে। সে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘কিছু নিবানি ম্যাডাম।’

ডাক্তারনি মিষ্টি হেঁসে বললো,

– ‘বৃষ্টির তাড়া খেয়ে রিকশা থেকে নেমে আসলাম। আগে তো বসার জন্য কিছু দিন।’

মৃদুল অতি লজ্জিত চেহারায় বললো,

– ‘সরি ম্যাডাম খেয়াল করিনি।’

তারপর কাছে এসে চেয়ারটা মুছে দিয়ে বললো,

– ‘বসুন ম্যাডাম।’

ডাক্তারনি ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আপনি এতো ম্যাডাম ম্যাডাম করছেন কেন? আমি আপনার বয়সে ছোট হব।’

গজদন্ত মুখের ভুবন ভোলানো মিষ্টি
হাসিতে মৃদুল প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে গেল। মেয়েটির গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। খোঁপা ছাড়া কৃষ্ণকেশের একগোছা চুল ডান গালের পাশ বেয়ে পড়ায় ডাক্তারনির কাঠিন্যতা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে চেহারায় তারুণীর চঞ্চল ভাব ধরে রেখেছে। শরীর থেকে আসছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের রঙ কি বেগুনি? হ্যাঁ, বেগুনিই এটা। মৃদুল ছোটবেলা থেকে যে কোনো ঘ্রাণ বা নামকে কল্পনায় একটা রঙে ফেলতে পারে।

– ‘এইযে মিস্টার কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? বৃষ্টির মধ্যে একা একটা মেয়েকে পেয়েই বদ চিন্তা শুরু করে দিছেন তাই না?’

মৃদুলের লজ্জা আর বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। ডাক্তারনি কি বলে এসব? এভাবে কেউ সরাসরি বলতে পারে? লজ্জায় তার কান গরম হয়ে গেল। বদ মতলবে তাকায়নি এটা আর প্রমাণ করার চেষ্টা না করে নিজের চেয়ারে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
ক্ষীণকাল পর চোরা চাহনিতে দেখতে পেল মেয়েটি চেয়ার থেকে উঠেছে।
তার ডেস্কের সামনে এসে অস্ফুটে বললো,
– ‘কি নেয়া যায়।’

মৃদুল কিছু বললো না। থুতনি যথা সম্ভব বুকে লাগিয়ে মাথা নীচু করে বসে রইল। মেয়েটি এবার তাকে সরাসরি বললো,

– ‘ভাইয়া কি নেয়া যায় বলুন তো।’

সে থুতনি না তুলেই জবাব দিলো,

– ‘দেখুন আমার মাথার উপরেই বডি স্প্রে আছে।’

– ‘হোয়াট, আমাকে আপনি বডি স্প্রে সাজেস্ট করছেন কেন? আমার গা থেকে কি আপনি গন্ধ পাচ্ছেন?’

সে মাথা তুলে আহত নয়নে অতি বিনয়ী চেহারায় বললো,

– ‘ম্যাডাম আমি এটা বুঝাতে চাইনি।’

– ‘তাহলে বুঝাতে চাচ্ছেনটা কি?’

– ‘আপনিই তো বললেন কি নেয়া যায় বলতে তাই বললাম।’

– ‘আচ্ছা দেন বডি স্প্রে।’

– ‘কোনটা দেবো বলুন।’

– ‘যেটায় স্মৃতিশক্তি বাড়ে।’

– ‘বুঝিনি ম্যাডাম।’

– ‘বুঝলেন না কেন? কালা না-কি আপনি? আমি ভাই দাঁতের ডাক্তার কানের না।’

– ‘ম্যাডাম আবার বলুন প্রথমে বুঝতে পারিনি।’

– ‘আমি এক কথা একবার বলি। বুঝেননি শেষ। আর বলবো না। এবার বলুন আপনার নাম কি?’

সে খানিক ইতস্তত করে বললো,

– ‘আমার নাম মৃদুল।’

– ‘মিথ্যুক।’

– ‘কি বললেন?’

– ‘আগেই তো বললাম আমি এক কথা একবার বলি।’

মৃদুলের এক সঙ্গে রাগ, হাসি, ভয় হচ্ছে৷ এই মিশ্র অনূভুতির পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। সে কিছু না বলে আবার চুপচাপ বসে রইল।

পুরো উপন্যাসের ধারাবাহিক লিঙ্ক পেতে ক্লিক করুন: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=323369269421940&id=100273578398178

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here