বাঁক ( ৩০ পর্ব )

0
111

বাঁক ( ৩০ পর্ব )
_____________

ইরফান কিছু বলতে চেয়েও বললো না। ড্রাইভার আর আফতাব না থাকলে জরুরি কথাগুলো সেরে নিতো সে। হাত ঘড়ি দেখে বললো,

– ‘আজ তাহলে উঠি, আমারও কিছু কাজ আছে।’

মানহা আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আমার মনে হয় আমাদের একান্তে একবার বসা দরকার।’

– ‘হ্যাঁ সেটাই, কাল যখন ইশি আসবে তখন আমাকে কল দিয়ো।’

– ‘আচ্ছা।’

মৃদুল বুঝতে পারে একান্তে বসে ওরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে ইশি যেন পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এ ব্যাপারে ইরফানকে হয়তো মানহাই আড়ালে বুঝিয়েছে।
তাকে আনমনা দেখে মানহা বললো,

– ‘আমরা উঠি না-কি? তাদের বিদায় দেই।’

– ‘হ্যাঁ।’

চা’র বিল চুকিয়ে দিয়ে সবাই উঠে দাঁড়ায়।

ইরফান বললো,
– ‘কাল তো আর দেখা হচ্ছে। তাহলে আমি এখন যাই।’

মানহা আর মৃদুল সম্মতি জানায়। ইশির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আজকের আনন্দের দিনটাও কেমন যেন বেদনার লাগছে। ইরফান ভাইয়ের সঙ্গে তো কাল দেখা হবে না৷ এই প্রতারণা কীভাবে করবে সে? মৃদুল ভাই কেন তাদের এতো অবিশ্বাস করছে?
ইরফানের প্রস্থানের পথে সে জল টলমল নয়নে তাকিয়ে রইল।

– ‘চল তোদের বিদায় দেই।’

মৃদুলের কথায় যেন ইশি চেতনা ফিরে পেল। আফতাব আর ড্রাইভার সিএনজিতে চলে গেছে। মৃদুল মা’কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মানহা আর সে পাশাপাশি। নেহারা বেগম সিএনজিতে উঠে গেলেন।
ইশি মানহাকে বললো,

– ‘তুমি কোথায় থাকো? আর মৃদুল ভাই কোথায় যাবে?’

মানহা ফিক করে হেঁসে চারদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো,

– ‘আমরা একসাথে থাকি, কাল থেকে তোমরাও আমাদের সাথে থাকবে একই বাসায়।’

ইশি বিস্মিত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কিছু একটা বুঝতে পারে সে। পুনরায় মানহার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো সে।

– ‘আরে কাঁদছো কেন? কালই তো দেখা হচ্ছে, সিএনজিতে উঠো।’

ইশি চোখ মুছে উঠে মায়ের পাশে বসে। সিএনজি চলতে শুরু করে। মানহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদুলের হাত ধরে বললো,

– ‘কি এতো ভাবছো বলো তো?’

– ‘কিছু না।’

মানহা তার বাহুতে গাল চেপে ধরে বললো,

– ‘অনেক কাজ বাকি, চলো একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টেশন যাই।’

– ‘কি কাজ বাকি?’

– ‘বাসে বসে বলা যাবে, এখন একটা রিকশা ডাকো।’

মৃদুল খানিক এগিয়ে এসে রিকশা পেল। একবার মাথায় এলো এখন যদি হুট করে মানহাকে রেখে সে চলে যায় সে? মানহা খুঁজে না পেয়ে কী করবে? ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে ভেতরটা দুমড়ে-মোচড়ে উঠলো তার। এভাবে সে পালাতে পারবে না। তবুও নিজেকে শক্ত করে পালাতে হবে। রিকশা ডেকে নিয়ে গেল সে। মানহা এসে পাশে বসল। চলতে চলতে অনেক বকবক করলো সে কিছুই মৃদুলের মাথায় ঢুকলো না। স্টেশনে এসে সঙ্গে সঙ্গেই বাস পেয়ে গেল তারা। মানহা জানালার পাশে বসে চোখবুজে। বড়ো ক্লান্ত লাগছে তার। মৃদুল আনমনা। মানহা হাই তুলে বললো,

– ‘ঘুম পাচ্ছে।’

– ‘ঘুমাও।’

– ‘তুমি আরেকটু আমার দিকে চেপে বসো।’

মৃদুল খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। মানহা কাঁধে মাথা রেখে বললো,

– ‘বাজারে একটা বাসা ভাড়া দিবে। দুইটা বেডরুম, একটা বাথরুম, কিচেন।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘জানো কত টাকা ভাড়া?’

– ‘কত?’

– ‘মাত্র পাঁচ হাজার। টাউনে হলে আরও বেশি হতো।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘দুই রুমে আমাদের হবে না? আমি আর তুমি এক রুমে। ইশি আর আন্টি এক রুমে।’

– ‘হবে।’

– ‘রোবটের মতো কথা বলছো কেন? তোমার কোনো আগ্রহই নাই দেখছি।’

– ‘এমনিই ভালো লাগছে না।’

– ‘কি এতো চিন্তা করছো বলো তো? এখন আর চিন্তার কিছু দেখছি না আমি। ইরফান আমি তোমার সাথে আছি। আন্টিও আছেন। আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।’

– ‘ইশি পুলিশে ধরা দিক আমি চাই না মানহা।’

– ‘পাগল না-কি তুমি? এরকম তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে না। তুমি ওর অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফেরারির জীবন যাপন করার মানে হয় না। যেখানে ইশিও নির্দোষ।’

– ‘সে খুনি মানহা। নির্দোষ কীভাবে হবে?’

– ‘সেটা আদালত দেখবে মৃদুল। যেহেতু সে প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না এবং আত্মরক্ষার জন্য খুন করেছে তাই ভালো লয়ার ধরে আমরা চেষ্টা করবো।’

– ‘যদি চেষ্টা করে ব্যর্থ হই বুঝতে পারছো কী হবে?’

– ‘কিন্তু চেষ্টা না করেও তো সমস্যা। এভাবে আর কত দিন? তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। সুখ-শান্তিতে বাঁচার অধিকার আছে। তাছাড়া ইরফান আর আন্টি এখন তোমাদের পক্ষে আছে। সুতরাং দয়া করে তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমি আর ইরফান আছি সবকিছু ঠিকঠাক হবে।’

মৃদুল আহত নয়নে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল।
মানহা পুনরায় তার হাতটা প্যাঁচিয়ে ধরে চোখবুজে। খানিক পরেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। জলেস্বরী বাজারে যখন বাস এসে থেমেছে তখন আছরের আজান শোনা যাচ্ছে। মানহা ঘুমোচ্ছে। মৃদুল আস্তে আস্তে ডাক দিল মানহাকে। মানহার চোখে রাজ্যের ঘুম। চোখে মেলে তাকাতেই পারছে না।

– ‘উঠো, এসে গেছি৷’

মানহা কোনোভাবে তার সঙ্গে বাস থেকে নেমে এলো। শরীর যেন নিদ্রায় ভারী হয়ে আছে। মৃদুলের পিছু পিছু রাস্তা পেরিয়ে মামণি ফার্মেসির সামনে এলো। মামা তাদের দিকে কঠিন মুখে তাকিয়ে আছেন দেখেও ভ্রুক্ষেপ করল না মানহা। দু’দিন পরেই মৃদুলের সঙ্গে বিয়ে হবে। তাদের আলাদা সংসার হবে। এখন আর কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু দেখছে না সে।
সিঁড়ি বেয়ে এলো উপরে। চাবি দিল মৃদুলের হাতে। দরজা খুলতেই হাই তুলতে তুলতে বেডরুমে গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়লো।

– ‘মৃদুল আমি ঘুমাচ্ছি, এতোদিন পর মানসিক চাপ মুক্ত হয়েছি। এখন যা ভাবছি তাই ভালো লাগছে। শান্তির একটা ঘুম দেই। এতো আরামের ঘুম অনেকদিন হলো আসেনি।’

‘আচ্ছা ঘুমাও’ বলে মৃদুল বাথরুমে গেল। মুখ-হাত ধুয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে ফাতিহার অনেকগুলো কল। একটা মেসেজ ভিউ করে দেখলো পনেরশো টাকা বিকাশ এসেছে। ফাতিহা তাহলে ছেড়েছে। টাকাগুলো দিয়ে কি মানহার জন্যে কিছু কিনবে? পালিয়ে যাওয়ার পর তো টাকার দরকার হতে পারে। বাসে আজ মানহার কথা শুনে তার সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সংশয় দূর হয়ে গেছে। এখান থেকে পালাতেই হবে। মানহা কোনোভাবেই চাইবে না সে খুনের অপরাধ ঘাড়ে নিয়ে অস্থিরতার অনিশ্চয়তার জীবন যাপন করুক।
ইশি আর মা’কে নিয়ে সোজা রূপগঞ্জ যেতে পারবে না। ফাতিহা ছাড়া সবাই জানে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। তবুও এখান থেকে বের হয়ে ফাতিহার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে তাদের ওখানে যাওয়া সম্ভব কি-না। না হলে ফাতিহাকেই চলে আসতে বলতে হবে। সবাই মিলে কোথাও গিয়ে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করবে তারা। মৃদুল আলগোছে বাথরুম থেকে বের হয়। মানহা ঘুমোচ্ছে। এখনই বের হয়ে যেতে হবে তার। ইশিদের কাছে পৌঁছে সে মানহাকে মেসেজ দিয়ে বিস্তারিত বলে সিম চেঞ্জ করে নিবে। খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘুমন্ত মানহার দিকে। বুকটায় চিনচিনে এক ব্যথা হলো। বড়ো মায়া হচ্ছে ওর জন্য। তবুও নিজেকে শক্ত করে নেয়। সে বিবাহিত, তার উপর ইশির নিরাপত্তা প্রশ্ন। সুতরাং এসব মায়াকে পাত্তা দিলে চলবে না৷ নিজের ব্যাগটা বের করে সে কাঁধে নিয়ে চুপিচুপি বের হয়ে গেল রুম থেকে। তারপর আলগোছে দরজা খুলে বের হয়।

____চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here