বাঁক ( ৭ম পর্ব )

0
135

বাঁক ( ৭ম পর্ব )
_____________

মানহা চোখের জল আড়াল করে বললো,

– ‘বোনকে কতদিন দেখোনি মানে কী? সে কোথায়?’

মৃদুল মাথা তুলে তাকায়। আপন মনে ভাবে তাহলে কী মানহা আমাকে চিনে না? না চিনলে এভাবে মেলা-মেশার কারণ কী? শুরু থেকে এতো উদ্ভট আচরণই বা কেন করছে? মৃদুলও আর নিজের সম্পর্কে জানাতে গেল না। মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আরে না, এটা একটা মুভির ডায়লগ। পূর্ণিমার রাতে এই কথাগুলো নায়ক এভাবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল। এখন মনে পড়ায় আমিও অভিনয় করেছি, এই আরকি।’

মানহা অদ্ভুত চাহনিতে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘পাক্কা অভিনেতা তুমি।’

মানহার বলার ভঙ্গিতে মৃদুল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে,

– ‘আমি কী অভিনয় করলাম?’

– ‘তুমি তো অভিনয়ই করে যাচ্ছ।’

– ‘মানে।’

– ‘তুমি অভিনয় করোনি? তাহলে কি ওইটা মুভির সিন ছিল না? বাস্তবেই কী তোমার বোনকে কতদিন দেখো না?’

– ‘ও আচ্ছা, না ওইটা মুভির সিনই ছিল। কিন্তু তুমি এমনভাবে কথা বলো, দ্বিধায় পড়ে যাই।’

মানহা রহস্য করে আবার হেঁসে উঠে বললো,

– ‘বাবা কী নিখুঁত অভিনয়।’

মৃদুল ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

– ‘এভাবে বলছো কেন?’

– ‘অভিনয় করলে বলা যাবে না কেন?’

– ‘কী অভিনয় করলাম?’

– ‘ওইযে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নায়কের মতো অভিনয় করে বললে সেটা।’

– ‘কিন্তু তোমার বলার ভঙ্গি ভিন্ন।’

– ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।’

মৃদুল বিরক্ত হয়ে মানহার দিকে ঘুরে বসে বললো,

– ‘কী সমস্যা বলো তো। তুমি শুরু থেকে আমার সাথে এরকম রহস্য করছো কেন?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘কী রহস্য করেছি?’

মৃদুল সতর্ক হয়ে যায়। তারপর ব্যস্ত হয়ে বললো,

– ‘আরে আমরা বসে আছি কেন? চলো হাঁটি, এইতো গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি।’

– ‘আবার কাঁধে নাও।’

মৃদুল বসে পিঠ পেতে আবার তাকে কাঁধে নেয়। হাঁটতে থাকে তারা। খানিক পর মানহা ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

– ‘আমার রহস্য কি তোমার কোনো ক্ষতির কারণ হচ্ছে? না হলে ইনজয় করো। ক্ষতি হলে বলবে৷ এইযে জব পেলে, আমি পরিচয়ের জন্য জেরা করিনি৷ বায়োডাটা, যোগ্যতা কিছুই লাগেনি। এতে তোমার তো ভালোই হচ্ছে তাই না?’

মৃদুল হাঁটতে হাঁটতে বললো,

– ‘তা ঠিক, তবুও মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে কিছু লোকাচ্ছ, সবকিছু খুলে বললেই পারো।’

মানহা ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে সুর দিয়ে গাইল ‘সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।’

মৃদুলের কাছে সবকিছু রহস্য লাগছে৷ তবুও সে আগ্রহ দেখাতে গেল না। সময়ের উপর রহস্য ছেড়ে দিল। আজ না হয় কাল সময়ই সকল রহস্যের সমাধান করবে। তবুও অতি উৎসাহী হয়ে নিজ থেকে প্রশ্ন করতে গিয়ে ধরা দিতে চায় না। এর চাইতে মানহার মতোই চলা হোক। তার সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেলে সাহায্য চাইবে। কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হবে। না হয় জীবন জটিল হয়ে যাবে। সে মানহাকে বিশ্বাস করতে চায়। কিছুদিন পর তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলে একদিন সবকিছু খুলে বলে সাহায্য চাইবে। খুঁজে বের করবে তার মা বোনকে। তারপর পুলিশ ধরলে ধরুক। এখন সে যে জীবনকে যাপন করছে এর চাইতে অন্তত খানিক্ষণ মায়ের কোলে মাথা পেতে ঘুমিয়ে হাজতে যাওয়াই ভালো। বোনের মিষ্টি মুখ দেখে ফাসির মঞ্চে উঠা ভালো। এই ফেরারি জীবনে কী আছে? এতো লুকোচুরি ভালো লাগে না। তার জীবনের বাঁকগুলো বড়ো বেদনার। একেকটা বাঁকে কত স্মৃতি, কত আপনজন ফেলে নিরুদ্দেশ হতে হয়। তাকিয়ে দেখে একটা বাড়ির পেছনে চলে এসেছে তারা।

– ‘মানহা নামো এবার। এদিকটা হেঁটে হেঁটে যেতে পারবে না?’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আমি তো পুরাই সুস্থ, দৌড়াতে পারবো।’

– ‘এটা ঠিক না।’

– ‘কী?’

– ‘সুস্থ হয়েও আরেকজনের কাঁধে চলা।’

– ‘ভালো লাগছিল অনেক তাই।’

আচ্ছা ঠিকাছে চলো আমার পিছু পিছু। মৃদুল কুঁড়েঘরের পাশ দিয়ে উঠানে আসে। তারপর মাথায় একটা দূষ্ট বুদ্ধি উদয় হলো তার।

– ‘তুমি ওই রাস্তা দিয়ে পুকুর পাড়ের মাথায় গিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়াও।’

– ‘কেন?’

– ‘আরে যাও না দেখো কী করি।’

মানহা ইতিউতি করে গেল।
মৃদুল কুঁড়েঘরের দরজায় গিয়ে কয়েকটা নক দিতেই ভেতর থেকে পুরুষালী গলায় বললো,

– ‘এই কেটা এতো রাইতে?’

– ‘দাদা ঘুমাইয়া পড়লেন না-কি, দরজাটা খুইলা দেন আমি আইছি।’

– ‘আমি কেটা?’

– ‘দরজাটা খুইলা তো দেখেন দাদা।’

– ‘খাঁড়াও আইতেছি।’

মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিয়ে উঠোন পেরিয়ে পুকুর পাড়ের মাথায় চলে এলো। মানহা অবাক হয়ে বললো,

– ‘এটা কী হলো?’

চলো এখান থেকে তাড়াতাড়ি। দাদা লাঠি নিয়ে খুঁজবে। মানহা হাসতে হাসতে দৌড়ায় ওর সঙ্গে। খানিক পর পিছু ফিরে দেখে দরজা খুলে লোকটি বলছে,

– ‘এই কেটা, কই গেলা ডাইকা?’

তারপর বকাঝকা করে পুনরায় দরজা বন্ধ করে দিলো।

– ‘তুমি তো অনেক দুষ্ট।’

– ‘আর তুমি?’

– ‘আমি কী করলাম?’

– ‘সুস্থ হয়েও কাঁধে চড়া কী দুষ্টামি না?’

মানহা ওর হাত ধরতে ধরতে হাসলো। তারা উঠে এলো মেইন রাস্তায়। খানিক হাঁটার পর বাঁ দিকে গেল। এ রাস্তায় কাজ চলছে৷ ইট বের হয়ে আছে। একটু পথ যেতেই প্রচুর বালিও পেল। হাঁটতে গিয়ে যেন পা ডুবে যাচ্ছে। বালি পেরিয়েই দেখে পাকা রাস্তার মুখে কয়েকটা কুকুর বসে লেজ নাড়াচ্ছে। তাদের দেখেই ‘ভেউ ভেউ’ করে ধেয়ে আসলো। মানহা ‘আল্লাগো’ বলেই মৃদুলের বুকে মুখে লুকোয়।

– ‘আরে আমাকে ছাড়ো।’

– ‘পারবো না ছাড়তে ভয় লাগে।’

– ‘তুমি পেছনে যাও দেখো কুকুরকে কীভাবে বিদায় করি।’

– ‘আচ্ছা।’

কুকুরগুলো তাদের পাশে এসে ‘ভেউ ভেউ’ করে চক্রাকারে ঘুরছে। মানহা পেছনে যেতেই মৃদুল মাটিতে হাত দিয়ে বললো,

– ‘কুত্তার লাঠি কই রে।’

কুকুরগুলো সঙ্গে সঙ্গে যেদিকে পারে ছুটে পালিয়ে গেল। মানহা মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে রাস্তায় বসে গেছে।

– ‘আরে কী হলো এভাবে হাসছো কেন?’

– ‘আমাকে ধরে তুলো আমার পেট ব্যথা করছে।’

মৃূদুল তাকে টেনে তুলতে তুলতে বললো,

– ‘এতো হাসির কী হলো এখানে? তোমরা মেয়ে মানুষ না হুদাই হাসতে পারো।’

– ‘হাসবো না? তুমি মাটিতে হাত দিয়ে কুত্তার লাঠি কই রে এমনভাবে বললে না হেঁসে পারা যায়?’

– ‘ওমা এটা তো সবাইই বলে। মাটিতে হাত দিয়ে এ কথা বললে কুকুর উল্টো দৌড়ে পালায়।’

– ‘তাই বুঝি? কুকুর কী বুঝে কুত্তার লাঠি কী? এ কথা বললে পালাবে কেন?’

– ‘আরে না মাটিতে হাত দিলেই দৌড় দেয়। সঙ্গে একটা কিছু বলা নিয়ম, এই আরকি।’

– ‘কার নিয়ম।’

– ‘মুরব্বিদের।’

‘ও আচ্ছা’ বলেই মানহা আবার হাসতে শুরু করে।
মৃদুল বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘এখন আবার কী হলো? তুমি আবার হাসছো কেন?’

মানহা হাসি থামাতে না পেরে আবার বসে গেল রাস্তায়। কান্না আর হাসি ছোঁয়াচে রোগ কি-না। মৃদুলেরও এখন নিজের অজান্তে হাসি পাচ্ছে। সে হাসতে হাসতে মানহাকে টেনে তুলে বললো ‘তোমরা মেয়েরা না আজব। এই সামান্য ব্যাপারে এতো হাসির কী আছে বুঝি না।’

– ‘হাসবো না? তুমি কিরকম হুট করে মাটিতে হাত দিয়ে বললে ‘কুত্তার লাঠি কই রে’ সেটা আজব না মানুষ হাসলেই আজব হয়ে যায়।’

– ‘খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।’

– ‘জ্বি না স্বাভাবিক না। আপনি এমনভাবে বলছেন গলাই বদলে গেছিল।’

দু’জন অনর্থক তর্ক-বিতর্ক করতে করতে উঠলো এসে পাকা রাস্তায়। আচমকা দেখা গেল রাস্তার মাঝখানে দু’জন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে করতে গান গাইছে ‘হাওয়ার উপর চলে গাড়ি
লাগেনা পেট্রোল ডিজেল
মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল।’

মানহা বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘আল্লাহ এরা রাস্তার মাঝখানে এসব কী করছে?’

‘মাতাল মনে হয়, আচ্ছা তুমি দাঁড়াও আমি আসছি’ বলে মৃদুল লোক দু’টার কাছে গিয়ে বললো, ‘কার দমকলের পানি বেশি দূরে যাচ্ছে দাদা?’
একজন বললো ‘আমারটা দূরে যাইতেছে।’

আরেকজন বললো, ‘চুপ কর শালা আমারটা দূরে যাইতেছে।’

– ‘চুপ শালা মাতাল আমার দমকলের পানি দিয়ে দেয়াল লিক করে ফেলান যাইব।’ বলে লোকটি রাস্তার ওপাশের দেয়ালের দিকে মুততে মুততে হাঁটতে লাগলো।

দ্বিতীয়জন বললো ‘শালা তোকে আমি গুলি করতেছি দেখ’ বলে পেছন থেকে ওর উপরে মুতে মুতে হাঁটছে।

একটু পরেই সামনের মাতাল বললো,

– ‘কিরে শালা দমকলের পানি কই গেল?’

– ‘হ তাইতো, আমারও তো আর আইতেছে না।’

মানহা এসব কাণ্ডকারখানা দেখে দূর থেকে মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বারবার নুইয়ে পড়ছে। মৃদুল তাকে নিয়ে আলগোছে মাতালদের পাশ কাটিয়ে স্টেশনে ঢুকে গেল। সামনেই একটা চা’র দোকান। মানুষ বসে গল্প করতে করতে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। একটু এগুতেই দেখা গেল ছিন্নমূল মানুষেরা যেখানে-সেখানে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। অন্যদিকে কয়েকজন ঘুমানোর জায়গা নিয়েও তুমুল ঝগড়াঝাটি করে যাচ্ছে।

– ‘মামা দু’টা চা দেন।’

মানহা দুষ্টামি করে বললো,

– ‘লিকার চা লাগান মামা লিকার চা।’

মৃদুল ফিসফিস করে বললো,

– ‘তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?’

– ‘ছেলেদের মতো বলার চেষ্টা করেছি আরকি।’

– ‘কেন?’

– ‘এতো কেন কেন করো না তো।’

মামা চা এনে দিলো। মানহা ইচ্ছা করে শব্দ তুলে চা টান দেয়। বসেছেও ছেলেদের মতো। মৃদুল কেবল মুচকি মুচকি হাসছে। চা শেষে মানহা ফিসফিস করে বললো,

– ‘সুপারি আর সিগারেট আনো।’

– ‘কী বলো। আমি এসব খাই না।’

– ‘ব্যাটা মানুষ এগুলো খাও না কেন?’

– ‘ব্যাটা হলেই খাওয়া লাগবে না-কি?’

– ‘নিয়মিত না খেলেও বিশেষ বিশেষ দিনে খাওয়া নিয়ম।’

– ‘কার নিয়ম?’

– ‘এতো কথা না বলে যাও তো, সিগারেট আর সুপারি নিয়ে আসো।’

মৃদুল ইতিউতি করে সিগারেট আর সুপারি নিয়ে এলো। তারা আবার বের হয়ে গেল রাস্তায়। মানহা জর্দা চুন সহ পান মুখে পুরে বললো,

– ‘সিগারেট আর লাইটার দাও।’

– ‘তুমি কী নিয়মিত খাও?’

– ‘আরে না, তবে ছেলেদের মতো সবকিছু করতে ভালো লাগে। আজকেই প্রথম সুযোগ পেলাম।’

– ‘তাই?’

– ‘হ্যাঁ।’

মানহা পান চিবোতে চিবোতে রাস্তায় ‘ফুরুত’ করে রস ফেলে সিগারেটে কায়দা করে আগুন ধরায়। মৃদুল মুচকি মুচকি হাসছে। সে লুকিয়ে জর্দা আর চুন ফেলে পান মুখে দেয়৷ মানহা তার দিকে লাইটার বাড়িয়ে দিলো। সেও একটা সিগারেট ধরায়। দু’জন টানতে টানতে ইটের রাস্তায় এলো৷ চাঁদের আলো এসে তাদের মুখে সরাসরি আছড়ে পড়ছে। মানহা ঠোঁট দেখিয়ে বললো,

– ‘জর্দা আর চুন দিয়ে খেয়েছি ঠোঁট কি লাল হইছে?’

– ‘হ্যাঁ, হইছে তো।’

– ‘তোমার ঠোঁট তো হয়নি।’

– ‘কী জানি কেন হয়নি।’

– ‘আচ্ছা আমার গরম লাগছে কেন? ঘেমে যাচ্ছি।’

– ‘আর?’

– ‘কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে।’

মৃদুল আলগোছে ধরলো মানহাকে।

– ‘তোমার মাথা ঘুরছে। জর্দা দিয়ে পান খেলে এরকম হয়। তাও আবার সিগারেটের টেনেছো৷ তাড়াতাড়ি মুখ থেকে পান ফেলে দাও।’

মানহা বাধ্য মেয়ের মতো মুখ থেকে পান ফেলতে গিয়ে বমি করতে শুরু করলো মাঝ রাস্তায়।

—চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here