দেশলাই – ২১ পর্ব

0
149

দেশলাই – ২১ পর্ব

এখান থেকে ঝর্ণার পানির আছড়ে পড়া কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ফ্লাগ মিটিং শেষ হবার অপেক্ষায়। কিন্তু ইলির ভালো লাগছে না। গাইডকে বললো,
– ‘মামা ডাক দিয়েন আমরা এদিকে আছি। চলো রাফসান ভাই।’

দু’জন আবার রাস্তা থেকে উল্টো পথে হেঁটে পাহাড়ে চলে যায়। কিন্তু সেখানে বসার কোনো স্থান নেই, চারপাশে গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়। খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে দেখা গেল কয়েকটি শিমুল গাছের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিলা। ইলি সেদিকে দেখিয়ে বললো,

– ‘চলো টিলায় গিয়ে বসি।’

– ‘গাইড যদি এসে খুঁজে না পায়?’

– ‘আমরা এখান থেকে খেয়াল রাখবো চলো।’

রাফসান আগে টিলায় উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে তুলে। ইলি টিলায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায়। এখান থেকে ঝিরিপথ এবং মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। গাছের ফাঁকফোকর গলে সূর্যের আলো ভেঙে ভেঙে এসে টিলায় আছড়ে পড়ছে। রাফসান সবুজ ঘাসে দুই পা সামনে দিয়ে বসা। ইলি আলগোছে তার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে দুই পায়ের মাঝখানে বসে পড়ে। খোঁপা করা চুলের ধাক্কা লাগে রাফসানের নাকে।
একটু ভান ধরে ‘উফ’ করে আর্তনাদ করে সে।
– ‘অযথা উফ করো না তো। এতটুকুতেই কেউ ব্যাথা পায় না-কি?’

রাফসান কোনো কথা না বলে দুষ্টামি করে খোঁপা খুলে দেয়।
– ‘এটা কি হলো, খোঁপা খুললে কেন?’

– ‘বারবার আমার নাকে-মুখে লাগবে তাই।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। তোমার দুই হাত এদিকে দাও।’

রাফসান হাত বাড়াতেই ইলি দু’দিক থেকে নিজেকে পেঁচিয়ে ওর দুই হাত নিজের পেটের ওপর রেখে প্রশ্ন করে, ‘ইন্তিশার কি পরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?

– ‘হঠাৎ করে ইন্তিশার কথা কেন?’

– ‘তুমি ইন্ডিয়া থেকে এলে মাত্র দুই রাত হলো। আর কখন জিজ্ঞেস করবো?’

– ‘আমি ইন্ডিয়া যাবার আগে করতে পারতি।’

– ‘ইন্তিশার সাথে ব্রেকাপের পর ইন্ডিয়া যাবার আগপর্যন্ত তুমি স্বাভাবিক ছিলে না। মেয়েদের যা-তা গালাগালি করতে। তখন আমি এগুলো জিজ্ঞেস করবো?’

– ‘স্বাভাবিক না হলে কি মুরব্বিরা মিলে আমাকে বিয়ে দিতেন?’

– ‘আরে না, তখন তুমি একটু স্বাভাবিক হয়েছিলে। সবাই ভাবলো বিয়ে-সংসার হলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বলো, ইন্তিশার পরে কি হলো?’

– ‘কি আর হবে। আমার সঙ্গে ব্রেকাপ করার জন্য বিয়ের নাটক করেছিল। তাছাড়া মা-বাবা বুঝতে পেরে মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন এগুলোও ওর নিজের বানানো কথা ছিল।’

– ‘মাইগড৷ তারপর?’

– ‘তারপর খুব বেশি কিছু জানি না। জানার ইচ্ছেও ছিল না। শুধু সুলতানার কাছ থেকে জেনেছি ইন্তিশার বিয়ে হয়নি। অন্য রিলেশনে আছে। এরপর সুলতানাও ঠিকঠাক ফোন রিসিভ করতো না আমার। আমিও ওই গ্রামে আর যাইনি।’

– ‘এখন আর মনে পড়ে না ইন্তিশার কথা?’

– ‘ইন্ডিয়া গিয়ে অনেকটাই ভুলে গেছি। তবে এখনও মনে পড়ে, বাট কষ্ট লাগে না।’

– ‘তোমার মনে আছে আমি বলেছিলাম ইন্তিশা ভালো মেয়ে না?’

– ‘হুম মনে আছে।’

– ‘আমাকেও ইন্তিশার মতো ভাবছো না তো আবার?’

– ‘না।’

– ‘কেন?’

– ‘জানি না।’

– ‘হুম, বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি এবার বাড়িতে গিয়েই মা’কে জানিয়ে দেবো হৃদকে বিয়ে করবো না।’

রাফসান মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে, ‘মাইর দেবো। পাগলামি করিস না।’

ইলি ঘুরে মুখামুখি হয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভান করছো কেন? তুমি আমাকে মনে মনে চাও না বলো?’

রাফসান কি বলবে ভেবে পায় না৷ তার সত্যিই ইলিকে আজকাল ভীষণ ভালো লাগছে। ওর চোখ দু’টো যেন মায়ায় ভরা নদী। তাকালেই বুক শিরশির করে। তাই মনের বিরুদ্ধে ‘না’ শব্দটি বেরুচ্ছে না৷ তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মুচকি হেঁসে বলে, ‘পাকনামি না করে বসতো আগের মতো।’

ইলি কি মনে করে আবার বসে। রাফসানের হাত টেনে এনে পেটে রেখে ওর হাতের ওপর নিজের হাত রাখে৷ তারপর মাথা হেলে দিয়ে বলে,
– ‘জানো? ইন্তিশার সাথে তোমার রিলেশনের কথা শোনার পর কত কেঁদেছি আমি? আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগতো মেয়েটি ভালো না মনে হলে।’

রাফসান তার থুতনি ইলির কাঁধে রেখে হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে ইলিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘এগুলো ভুলে যা ইলি। শুধু শুধু কষ্ট পাবি।’

ইলি খানিকটা ঘুরে মুখের দিকে তাকায়,
– ‘কেন? তুমি বিয়ে করতে চাও না আমায়?’

– ‘সে তো চাই। তোকে পাওয়া আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার৷ কিন্তু আমি তো জানি এ সম্ভব নয়। তাই মনের কথা মনে চাপা রেখেই চলতে হবে।’

– ‘এতো বুঝি না৷ তুমি আমাকে পছন্দ না করলে বইলো। তাহলে আর কিছুই বলবো না। বাট তুমি আর আমি চাইলে বিয়ে ঠিকই হবে। আচ্ছা তুমি ভেবে দেখেছো আমরা দু’জনের বিয়ে হলে কত দারুণ হবে? হৃদের সাথে তো একদমই ইচ্ছা হয় না আমার।’

– ‘ওর সাথে বিয়ে হলেই দেখিস সব ঠিক হয়ে গেছে।’

– ‘কচু ঠিক হবে।’

– ‘এ ছাড়া আর উপায় নেই ইলি। হৃদকে মেনে নে।’

– ‘উপায় আছে জনাব। আমি বাড়িতে গিয়ে হৃদকে বিয়ে না করার কথা জানিয়ে দেবো৷ বাট তোমার কথা কিছুই জানাবো না। এরপর আমি পড়ালেখা শেষ করে জব নেব। তুমিও তোমার চাচাদের বলে মধুশ্বরী বাজারে কোনো ব্যবসা দিয়ে দাও। এরপর আমরা সবাইকে মানিয়ে বিয়ে করে নেবো।’

– ‘বাব্বাহ, এতোকিছু ভেবে বসে আছিস?’

– ‘বিয়ের জন্য পাগল হয়ে আছি দেখে নির্লজ্জ ভাবছো না তো আবার?’

– ‘ভাবছিই তো।’

ইলি মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে মুখটা দেখে বলে,
– ‘নির্লজ্জ ভাবছো না। উল্টো তোমার ভালো লাগছে।’

– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। তুই অন্তর্যামী হয়ে গেছিস না-কি?’

– ‘অন্তর্যামী না অনুমান করতে পারি।’

– ‘বকবক করিস না চল যাই।’

– ‘এখানে আমার এতো ভালো লাগছে। তুমি চলে যেতে চাও কেন?’

– ‘এমনিই।’

– ‘শোনো, এখানে তো পানির জন্য এভাবে ড্রেস পরে এসেছি। কাল লাউয়াছড়া যাবো শাড়ি পরে। ওইদিনের সন্ধ্যার মতো।’

– ‘আচ্ছা, তারপর ছবি তুলে হৃদকে পাঠাবি।’

– ‘ধুরো। তুমি এখন এমন হয়ে গেলে কেন?’

– ‘কেমন?’

– ‘রোবট মানব।’

রাফসান হেঁসে বললো, ‘তাই না-কি? কেন মনে হলো?’

– ‘বলবো না।’

– ‘তোকে শাড়ি পরলে অবশ্যই বেশি সুন্দর লাগবে। তবে সব সময়ই সুন্দর লাগে।’

– ‘তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে সব কষ্টতেও সুখ লাগতো রাফসান ভাই।’

– ‘কিরে শুধু শুধু বিয়ে বিয়ে করছিস কেন?’

– ‘কেন করছি বলবো?’

– ‘কেন?’

ইলি খানিকটা মাথা তুলে চারদিকে তাকায়, তারপর চোখের পলকে রাফসানকে ধাক্কা দিয়ে সবুজ ঘাসে ফেলে ওর ওপরে উঠে বুকে মাথা রেখে চোখবুঁজে৷

– ‘এটা কি হলো ইলি?’

– ‘শুধু বিয়ে বিয়ে করছি কেন প্রাক্টিক্যালি দেখালাম। বিয়ে ছাড়া তো বুকে মাথা রেখে ঘুমানো যাবে না।’

– ‘দেখানো তো শেষ এবার উঠ।’

– ‘আচ্ছা উঠছি। তুমি শুয়ে থাকো৷ কোনো দুষ্টামি করবো না।’

রাফসান আধশোয়া হয়ে বসে বলে, ‘আমি শুয়ে থাকবো কেন?’

ইলি আসন পেতে পাশে বসে বললো,
– ‘আমার কোলে মাথা তুলতে পারো।’

– ‘না লাগবে না।’

– ‘প্লিজ আসো না। গাইড হঠাৎ ডাক দেবে।’

– ‘কি বলিস এগুলো?’

– ‘বলছি না মাথা রাখতে?’

রাফসান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর আমতা-আমতা করে মাথা রেখে বলে,
– ‘তুই হঠাৎ এমন হলি কেন?’

– ‘এতো প্রশ্ন করো না তো।’

ইলি পরম ভালোবাসায় রাফসানের ঘন কালো চুলে আঙুল ডোবায়। এক হাতে দাড়িগুলো খানিক ছুঁয়ে দেয়। রাফসান তাকিয়ে আছে সোজা মুখের দিকে। ইলির বোধহয় একটু অস্বস্তি লাগলো। হাত দিয়ে রাফসানের চোখ দু’টো বন্ধ করে বলে,
– ‘চোখবুঁজে থাকো।’

রাফসান সত্যি সত্যি চোখবুঁজে। ইলি মাথায়, মুখে হাত বুলাচ্ছে। খানিক্ষণ যেতেই রাফসান চোখ মেলে বলে,
– ‘আমার তো ঘুম পাচ্ছে।’

– ‘তাই?’

– ‘হুম।’

– ‘তাহলে ঘুমাও। আমি ডেকে দেবো।’

রাফসান বেখেয়ালি হয়ে পাশ ফিরে ইলির কোমর জড়িয়ে চোখবুঁজে। ইলির পুরো শরীর কেঁপে উঠে। রাফসানের নাক ডুবে গেছে পেটে। কোল জুড়ে উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ছে। ইলির হার্ট বিট বেড়ে গেছে। নিজেই শুনতে পাচ্ছে নিজের ধুকপুকানি। মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
– ‘রাফসান ভাই উঠো তো।’

– ‘কিরে কি হলো?’

– ‘কিছু না। উঠো চলে যাই।’

রাফসান দাঁত কটমট করে তাকিয়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘তোর হঠাৎ কি হয় বুঝি না ইলি।’

ইলি কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুরো শরীর যেন কাঁপছে।

– ‘কিরে চল। তোর আবার কি হলো?’

– ‘কিছু না। চলো যাই।’

দু’জন টিলা থেকে নেমে আবার হাঁটতে শুরু করে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here