বাঁক ( ১৮ পর্ব )
____________
সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই অথচ ইরফান এখনও আসছে না। মৃদুল অস্থিরতায় বারবার আঁজলা করে নিজের মুখ ঘষছে। মানহা আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘অনেক্ষণ তো হলো, ওর বাসার ঠিকানা আমাদের কাছে আছে, গিয়ে দেখবো না-কি কী হলো?’
– ‘ইরফান না করেছিল বাসায় যেতে।’
– ‘তাহলে এখন কী করবে?’
– ‘চলে যাই আমরা, সে আবার যোগাযোগ করলে আসা যাবে।’
– ‘কিন্তু ফোন অফ কেন?’
– ‘কোনো সমস্যা হতে পারে।’
– ‘তাই হবে, আচ্ছা চলে যাই আমরা, আর ভালো লাগছে না।’
দু’জন পার্ক থেকে বের হয়ে রিকশা ডাকতে যাবে তখনই মানহার ফোন বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার। মানহা তাড়াতাড়ি রিসিভ করে সালাম দিয়ে বললো,
– ‘কে বলছেন?’
– ‘আমি ইরফান, এটা তোমার ভাবির নাম্বার।’
– ‘ভাইয়া কী সমস্যা বলো তো, আমরা অপেক্ষা করতে করতে এখন চলে যাচ্ছিলাম।’
– ‘সবকিছু বলছি, তার আগে তোমরা শান্তিমতো নিরিবিলি কোথাও বসে এই নাম্বারে কল ব্যাক করো, এই ফোনে টাকা নাই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মানহা ফোন রেখে মৃদুলকে বললো,
– ‘ইরফান কল দিয়েছে ওর ওয়াইফের মোবাইল দিয়ে।’
– ‘কি বলছে?’
– ‘কোথাও বসে কল দিতে, ওর ভয়েজও অস্বাভাবিক মনে হলো।’
– ‘চলো আবার পার্কে গিয়ে বসে কল দেই।
দু’জন আগের জায়গায় গিয়ে বসে।
মানহা বিকাশ থেকে টাকা রিচার্জ করে কল দেয়। ওপাশ থেকে রিসিভ করতেই মানহা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
– ‘আগে বলো তোমার ফোন কী হয়েছে?’
– ‘আর বলো না, আমার এখান থেকে ডায়রেক্ট বন্দর সিএনজি নেই। আম্বরখানা থেকে যেতে হয়। তাই সেখানে যাবার জন্য টমটমটে উঠেছি। হুট করে ট্রাক একটার ধাক্কা লেগে টমটম উলটে গেল। আমি পড়লাম গিয়ে রাস্তায়। মোবাইল হাত থেকে ছিটকে গেছে ময়লা ড্রেনে।’
– ‘বলেন কী আপনার কিছু হয়নি তো?’
– ‘কনুই, হাঁটু আর থুতনিতে লেগেছে। বেন্ডেজ করে বাসায় এসেছি। এখন এগুলো থাক, আমার কথা শুনো। আমাদের দেখা করার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইশিকে খুঁজে বের করা।’
– ‘হ্যাঁ এখন কী করতে হবে বলো।’
– ‘আমি চাচ্ছিলাম ইশি আগে যেখানে ছিল সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিতে। কিন্তু এই অবস্থায় যেতে পারবো না।’
– ‘সেখানকার ঠিকানা জানো?’
– ‘হ্যাঁ জানি।’
মৃদুল মোবাইল নিয়ে বললো,
– ‘ইশিকে কীভাবে খুঁজে পেলে বলো তো।’
– ‘তোমার মামাতো বোন লায়লার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। ইশি একদিন কল দিয়ে তাকে জানায় চাচি হসপিটাল দোয়া করতে। তখন লায়লা আমাকে নিজ থেকে নাম্বার দিয়েছিল।’
মানহা তখন মোবাইল নিয়ে বললো,
– ‘ইরফান ভাই তাহলে লায়লাকে কল দাও। কোথাও থেকে ইশি ওকে কল দিতে পারে।’
– ‘আমি সাথে সাথে লায়লাকে কল দিয়েছি ওর মোবাইল বন্ধ। ইশিকে আমি বলেছিলাম লায়লার মাধ্যমে ওর নাম্বার পেয়েছি। সুতরাং আমার নাম্বার না থাকলে লায়লাকে কল দেয়ার কথা।’
– ‘কিন্তু ওর মোবাইল কোনো কারণে বন্ধ তাই কল দিতে পারবে না। এখন বলো আমাদের কী করতে হবে?’
– ‘ইশি সিলেট আসার আগ পর্যন্ত কয়েকদিন নিয়মিত আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। ওর কলোনির মালিকের নাম আমজাদ। সেইই টিকিট কেটে দিচ্ছে বলেছিল ইশি। আমি ওর কলোনি কোথায় জানি। সবকিছু মেসেজে দিতে পারবো। তোমরা যদি গিয়ে ওর কলোনিতে খোঁজখবর নাও কিছু একটা পেতে পারো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে ঠিকানা মেসেজে দাও।’
– ‘দিচ্ছি, তবে তোমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। আজই বাসে চলে যাও, অথবা ভোরের ট্রেনে। আমি সব সময় কলে যোগাযোগ করবো।’
– ‘আজ তো অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।বাসে করে গিয়ে কাল আবার খোঁজাখুজির ব্যাপার আছে।’
– ‘তাহলে ভোরের ট্রেনে যাও, এখন গিয়ে টিকিট কেটে নিতে পারো।’
– ‘কিন্তু রাতে আজ থাকবো কোথায়? অবিবাহিত দু’জন কোথায় বাসা ভাড়া পেতে পারি বলে দাও।’
ইরফান খানিক্ষণ ভেবে বললো,
– ‘আচ্ছা তোমরা টিকিট কেটে খাবার-দাবার খেয়ে চৌহাট্টা এসে আমাকে কল দাও, আমি থাকার ব্যবস্থা করছি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
তারা টিকিট কেটে চৌহাট্টা ফিরে আসতে আসতে এশার আজান শোনা গেল। মানহা কল দিয়ে জানায় ইরফানকে। তাদের কোথাও খানিক্ষণ বসতে বলে ইরফান। মিনিট বিশেক পর অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। মানহা রিসিভ করে বললো,
– ‘হ্যাঁ কে বলছেন?’
– ‘ইরফান স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনারা কোথায়?’
– ‘চৌহাট্টা রাস্তার পাশে বসার জায়গা আছে না আমরা সেখানে।’
– ‘আচ্ছা বসুন আসছি।’
খানিক পর একটা ছেলে এসে তাদের কল দিয়ে বের করলো৷ কমবয়সী অতি বিনয়ী ছাত্র গোছের চেহারার ছেলে। একটা রিকশা ডেকে বাসার ঠিকানা বুঝিয়ে তাদের তুলে দিল। আরেকটা নিয়ে সেও এলো পেছনে। রিকশা এসে থামলো একটা টিলার সামনে। ছেলেটি রিকশা বিদায় করে বললো,
– ‘আসুন আমার সঙ্গে, আসলে আমার আব্বু-আম্মু সবাই গেছেন নানাবাড়িতে, আমি আর দাদি একা বাসায়। স্যার কল দিয়ে বললেন আপনাদের কথা।’
মানহা মিষ্টি হেঁসে বললো,
– ‘ও আচ্ছা, আপনাকে ঝামেলায় ফেললাম মনে হয়।’
– ‘না না কী যে বলেন। স্যার আমাদের পরিবারের মানুষের মতো।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘আসুন আমার সাথে।’
তাদেরকে একটা ছোট টিলার ওপর নিয়ে এলো। ছোট্ট একটি দালান ঘর দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় গ্রিল, ওপরে চাল। বারান্দায় যাবার পর একটা রুম খুলে দিয়ে বললো,
– ‘স্যার বললেন আপনারা খুব ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বেন আবার ভোরে উঠে চলে যাবেন।’
– ‘জ্বি উনি ঠিকই বলেছেন।’
– ‘তাহলে আর বিরক্ত করছি না, এই রুমে থাকতে পারবেন, ওইযে বাথরুমও আছে। কোনো সমস্যা হলে ডাক দেবেন।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘দরজা বন্ধ করে নিন।’
মৃদুল ভেতরে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসলো। ঘরে একটা পালঙ্ক, আলনা, আলমারি সবকিছুই আছে।
মানহা সোফায় ভ্যানিটিব্যাগ রেখে খানিক্ষণ মলিন মুখে বসে রইল।
– ‘কী হলো তোমার?’
– ‘কিছু না বাড়িতে কল দিতে হবে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
মানহা ইতিউতি করে মোবাইল বের করে মামীর নাম্বারে কল দিলো। ওপাশ থেকে মামী কল রিসিভ করলেন,
– ‘হ্যালো।’
– ‘মামী আমি আজ আসতে পারবো না, তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।’
ফোনটা কেটে গেল। মানহা বুঝতে পারে মামীই কেটে দিয়েছেন।
মৃদুল বিছানা থেকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কি হয়েছে?’
– ‘কিছু না মুখ-হাত ধুয়ে আসি।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
মৃদুল বসে রইল বিছানায়। মানহা বের হয়ে আসার পর সে বাথরুমে গেল। বাথরুম থেকে শুনতে পেল মানহার ফোনে কল এসেছে। সে রিসিভ করে কথা বলছে। মৃদুলের গোসল করতে ইচ্ছা করছে। শরীর জুড়ে কেমন ক্লান্তি, গোসল করলে ভালো লাগবে। কিন্তু ভেজাবে কী? দরজা তো বন্ধই আছে, উলঙ্গ হয়ে গোসল করবে? মানহা কী ভাববে? একটু হাসাহাসি করতে পারে আর তো কিছু না। সে পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে শাওয়ার ছেড়ে গোসল করে নিল। তারপর ভেজা শরীরেই প্যান্ট পরে খালি গায়ে বের হয়ে দেখে মানহা সোফায় বসে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে কেঁপে উঠছে। মৃদুল অবাক হয়ে কাছে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
– ‘কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?’
মানহা চোখের জল মুছে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কিছু না।’
তারপর আলনায় চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একটা টাওয়াল পেয়ে সেটা বাথরুমে নিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে চিপে এনে মৃদুলকে দিয়ে বলে,
– ‘মাথা আর শরীর মুছে নাও এটা দিয়ে।’
মৃদুল হাতে নিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বললো,
– ‘কে কল দিয়েছিল?’
– ‘খালা।’
– ‘কী বললেন?’
– ‘এগুলো জানার দরকার নাই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মৃদুল ভেবে পাচ্ছে না মানহা তো টাওয়াল এনে নিজে মুছে দিতে চাওয়ার কথা। তাছাড়া সে কাপড় ছাড়া কীভাবে গোসল করলো সেটা নিয়েও কিছু বলছে না। অন্যদিন হলে এটা নিয়ে কত কথা বলতো। সে শরীর মুছে টাওয়াল সোফায় মিলে দিলো ফ্যানের বাতাসে শুকানোর জন্য৷ গেঞ্জিটা রাখলো আলনায়। তারপর খালি গায়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মানহা উঠে গিয়ে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় চলে এলো। মৃদুল বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘সোফায় যাচ্ছ কেন?’
মানহা মলিন মুখে বললো,
– ‘কোথায় থাকবো বলো।’
– ‘বিছানায় থাকো সমস্যা কী? তবে এক সঙ্গে তুমি থাকতে না চাইলে আমি সোফায় যাব।’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই’ বলে মানহা পুনরায় বিছানায় বালিশ নিয়ে অন্যদিকে পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।
মৃদুল ওর উম্মুক্ত পিঠের দিকে তাকায়। ব্লাউজের লাল সুতোগুলো টানটান।
– ‘আজ হঠাৎ কী হলো মানহা?’
– ‘কী আবার হবে?’
– ‘আমাকে কেমন এভয়েড করছো?’
– ‘তোমাকে এভয়েড করার ক্ষমতা আমার নেই।’
– ‘তাহলে খালা কিছু বলেছেন যার কারণে তোমার মন খারাপ।’
– ‘মন খারাপ হলে আমি আরও বেশি তোমাকে কাছে চাই।’
– ‘তাহলে?’
– ‘এমনিই।’
মৃদুল ওর বাহু ধরে টেনে মুখোমুখি করে গালে হাত রেখে বললো,
– ‘কী হয়েছে? খালা কী বলেছেন?’
– ‘মামা সকালে তোমার সঙ্গে দেখেছেন। এখন বাড়িতে আবার ফিরছি না। এটা নিয়ে খালাকে কল দিয়ে আমাকে আর তাদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছেন।’
– ‘আমার জন্য তুমি খুব ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছ।’
– ‘তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি।’
– ‘সোফায় গিয়ে ঘুমোতে চাইছিলে কেন? বিশ্বাস নেই না-কি আমাকে?’
– ‘আছে।’
– ‘তাহলে?’
– ‘বিকেলে একটুতে তুমি যা রিয়েক্ট করলে তাই ভাবলাম আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।’
মৃদুলের মনটাই আবার খারাপ হয়ে গেল। মানহার সঙ্গে সে বারবার নির্দয় আচরণ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে তার জন্য ওর পারিবারিক ঝামেলাও শুরু হয়ে গেছে। কী করবে সে এখন? বিবাহিত সেটা বলে দেবে? বলে দিলেও মানহা কী মেনে নেবে? তাছাড়া সেও তো মানহাকে পছন্দ করে। কেবল বিবাহিত বলেই নিজেকে সামলে রাখছে।
– ‘ভেবেছি আর কখনও তোমার কাছে নির্লজ্জের মতো চুমু জড়াজড়ি চাইব না। তুমি এতো রেগে যাও আগে বুঝতে পারিনি।’
মৃদুলের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো মানহার কথায়। সে সঙ্গে সঙ্গে বললো,
– ‘এভাবে বলছো কেন মানহা? তুমি নির্লজ্জ হতে যাবে কেন? আমার এমনিতেই বিকেলে মন ভালো ছিল না।’
মানহা ওর চুলে আঙুল ডুবিয়ে বললো,
– ‘এখন ভালো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘খালাও আজ খুব বকাঝকা করেছেন মৃদুল।’
– ‘ইশ আমার জন্য তুমি সব কুল হারাবে দেখছি।’
মানহা জল ছলছল চোখে মৃদুলের নগ্ন লোমশ বুকে আঙুল দিয়ে বললো,
– ‘সব হারিয়ে যাক, শুধু তুমি এইখানে একটু আগলে রাখলেই চলবে আমার।’
মৃদুলের বুকে চিনচিনে এক অচেনা ব্যথা অনুভব হলো। সে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যাচ্ছে। মানহাকে সে কীভাবে এড়িয়ে চলবে?
তার বুকে মুখ লুকিয়ে মানহা পুনরায় বললো,
– ‘চুপ করে আছো কেন?’
মৃদুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার গলায় কথা এসে আঁটকে যাচ্ছে।
____চলবে__