আমার_হৃদয়ে_সে #রোকসানা_আক্তার পর্ব-১৫

0
713

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১৫

২১.
আমি সামনের সিলিং করা দেয়ালের সবুজ রঙ্গের পেইন্টার দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছি।পাশে আমার শাশুড়ী মা,রিমা এবং টিপি বসে আছে।তারা খালামণির সাথে কথা বলতেছে।তারা এসেছেন মিনিট ত্রিশেক হবে।অভি কাল বিধ্বস্ত মুখে বাসায় ফিরে যাবার পর অভির চেহারাটা নাকি শাশুড়ী মার নজরে আসে।তিনি দৌড়ে অভির কাছে যান।গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে?তাকে এরকম কেন লাগছে?অভি বলতে চায় নি।মাও হাল ছাড়েন নি।অনেক বলাবলির পর,অনেক আকুতি মিনতি করার পর অভি অতঃপর আমার এবং তার মাঝের ঝামেলাটার কথা বলে!তা শুনেই আজকে আমার শাশুড়ী মা,রিমি আপু এবং টিপির খালামণিদের বাসায় আগমণ।শাশুড়ী মা খালামণির সাথে থমথমা মুখে বলেন,

“আমি ভাবতেও পারি নি অভি এরকম কিছু করবে!ও এতটা হিতাহিতজ্ঞানশূন্যতা কবে থেকে হলো সত্যি আপা আমার মাথায় ই আসছে না!আমার কষ্টতো সেখানে নয় আমার কষ্ট তো সবচে এখানে! এই মেয়েটার উপর!এই মেয়েটা ত আমাকে একটিবার বলতে পারতো অভি তার সাথে এরকম রূঢ় বিহেভ করতেছে।ইভেন শেষমুহুর্তে, ওর গাঁয়ে হাতও পর্যন্ত তুলেছে!বলেনি এই মেয়ে।এসবের কিছুই বলে নি আমাকে।আর বলবেই বা কী করতে?আমি কি ওর আপন মা যে বলবে?”

শাশুড়ী মাও পুরো কিংকর্তব্য বিমূঢ়!অভির এবং আমার সাথে যে এতবড় একটা ঝামেলা ছিল তা শাশুড়ী মার বিশ্বাসই হচ্ছে না।এখানে ঢোকামাত্র ত আমাকে দেখে প্রথমেই কেঁদে ফেললেন!তারপর রাগী রাগী কয়েকটা কথাও শুনালেন!!আসলে এসব শাশুড়ী মার পক্ষে যায়।আমি সে বাড়িতে উনাদের সামনে এতটা হাসিখুশি থেকেছি।মনের চেপে রাখা কষ্টগুলোর এক ছিটেফোঁটাও বুঝতে দিই নি তাতে তো তিনি ভেবেছেন আমি অভির সাথে খুব হ্যাপী!খুব!কিন্তু আজ এসব শুনার পর কতটাই না কাহিল এবং অস্থির!খালামণি বলেন,

“ছিঃ আপা,এভাবে বলবেন না।ও আপনাকে নিজের মার মতনই ভাবে।এখানে আসার পর থেকে আপনার,ওর শ্বশুর,রিমি মার এবং টিপির কত যে প্রশংসা করেছে।আপনারা নাকি ভীষণ ভালো!”
“হ্যাঁ,আপা আমরা ভীষণ ভালো।এতটা ভালো তাইতো ওর মনের ভেতরে চেপে রাখা কষ্টগুলো একটিবারের জন্যেও অনুধাবন করতে পারি নি!”

বলে শাশুড়ী মার ব্যথাতুর চোখজোড়া আবারো টলমল করে উঠে!গলায় প্রায় কান্নাও বেঁধে যায়।লম্বা করে বার কয়েক শ্বাস ছাড়েন। তারপর নিজেক সংযত করে বলেন,

“বউমা,এখানে আসার পর তাইতো আমি ভাবি বউমার আসতে এতো দেরী হচ্ছে কেন?সে না আমাকে চারদিনের কথা বলে গিয়েছে?আর আমিও কেমন অচেতন!একবারও ওকে কল করে জিজ্ঞেস করিনি ও কেন বাসায় ফিরছে না!”
“প্লিজ আপা,মন খারাপ করবেন না।যা হবার হয়ে গেছে।আগের কথা বলে লাভ নেই।এখন সামনের কথা ভাবতে হবে।”
“হ্যাঁ,সামনের কথাই ভাবতে হবে।”
বলে শাশুড়ী মা এবার আমার দিকে তাঁকান।কাঁধের উপর আলতো হাত ছুয়ে বলেন,

“পারিসা?”

আমি দেয়াল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শাশুড়ী মার দিকে তাকাই।বলি,

“জ্বী মা,বলুন?”
“তুমি অভির ঘরে আর যাবে না মা?”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম।শাশুড়ী মাও নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকলেন।তাকানোর সময়টা একটু বেশিই গড়াতে শাশুড়ী মা আবার বলেন,
“আমি তোমাকে অভির ঘরে ফিরে যেতে জোর করবো না।তবে এটুকুই বলবো তুমি না থাকলে আমি সত্যিই ওখানে ভালো থাকবো না!”

কথাটা বলতে শাশুড়ী মার গলাটা কেমন ধরে আসলো।এই মহিলাকে বিয়ের পর থেকে দেখে এসেছি। কতটা অকৃত্রিম মায়া ই না এই মহিলার মাঝে। বিয়ের প্রথম দিনই আমার মনটা খুব জয় করে নিয়েছেন ইনি ইনার স্নেহ,মমতা,ভালোবাসায়।শুধু ইনি না।আমার শ্বশুর। আমার ননদ-ননদী সবাই।শুধু একজন আমাকে বুঝলো না।সে অভি।হ্যাঁ,এই অভিটাই আমার জীবনের সব সুখময় মুহূর্তকে বিভীষিকা বানিয়ে দিলি!আমার স্বপ্নে গড়া জীবনটাকে তছনছ করে কতগুলো মায়াকে আজ বিচ্ছিন্ন করতে চললো!বুকটা আবারো ভার হয়ে গেলো।আমি শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরলাম।চোখের কোলে পানি চিকচিক করে উঠেছে।কোনোমতে বাম হাত দিয়ে চোখের কোণের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থতা করলাম।বললাম,
“মা,যদি ভাগ্য হয় অভির সাথে থাকবো আর না হলে তো আর কিছুই করার নেই।সব ওই উপরওয়ালাই জানেন।”

শাশুড়ী মা চুপ থাকেন চল্লিশ/পঞ্চাশ সেকেন্ডসের মতন।তারপর বলেন,
“অভি ক্ষমা চেয়েছে তোমার স্কাছে আমাকে তাও বলেছে।সে আসলে না বুঝে ভুল করে ফেলেছে।তবে ওর প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ!জানো কেন?ও তোমাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস না করে কীভাবে পারলো ওই কথা বিশ্বাস করতে?ওর এই ব্যাপারটা আমিও মেনে নিতে পারছি না রে মা!তারপরও দেখ কি করবে!তবে তোকে ছাড়া আমি…

বলে শাশুড়ী মা আবার ভেঙ্গে পড়েন।রিমি আপু এগিয়ে আসেন।শাশুড়ী মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“মায়া জিনিসটা ভীষণ অদ্ভুত! মায়ার চাপাতলে পড়ে
অনেকে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে।মন কেঁদে লাভ নেই মা।কান্নাটা কিছুই দিবে না।ভাবী তোমার যে ওয়েটা ঠিক মনে হয় তুমি তাই করো।আমরা তোমাকে বাঁধা দিব না।কারণ লাইফ তোমার। আমাদের নয়।তুমি যার সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাঁটাবে তার তোমাকে কতটা ঠিক মনে হয় সেটার ডিসিশন অনলি তোমার।কারণ জীবন কোনো ছেলেখেলা নয়।ছেলেখেলা জীবনই দুঃখের হাতছানি দেয়।”

আবার দুইচোখ বেয়ে টলটল করে পানি গড়িয়ে যায়।রিমি আপু মাকে ছেড়ে আমার কাছে আসেন।এপাশে বসেন।বলেন,

“কুল,ডিয়ার।কুল।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তারপর এরকম খানিকক্ষণ চলার পর পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হয়।শাশুড়ী মা আর বসেন নি।উঠে দাঁড়ান।বলেন,

“পারিসা?তুমি আরো সময় নাও মা।তুমি আরো ভাবো কি করবে।আমার কথা মনে রেখে আরেকটু ভাবো মা।এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইলো। ”

বুঝলাম শাশুড়ী মা নিজের মনকে মানাতে পারছেন না। ।খালামণি বলেন,

“আপা দেখা যাক কি করা যায়।ওর বাবা,মা, আপনারা সবাই ই আছেন কী করা যায় সেটা দেখবে সবাই।আগে প্লিজ খাবারটা খান।খাবারটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আপা।সেই কখন রাখলাম।”
“নাহ,আপা।আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না।অন্য আরেকদিন খাবো।কষ্ট দিলাম আজকে।এখন বোধহয় যেতে হবে।”

বলে উঠলাম,
“সে কি,মা!না খেয়ে চলে যাবেন?এটা মানতে পারছি না।”
“নাহ বউমা,জোর করো না।আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”

আমি আবার নিজেকে ধাতস্থতা করলাম।তারপর বললাম,
“আজ থেকে যান না, মা?”
“নারে মা।কপালে থাকলে আরেকদিন।”

চুপ করে রইলাম।রিমু আপু এবং টিপি এরফাঁকে মুখে কিছু একটা ফুঁরলেন।গিলা শেষ হলে রিমি আপু বসা থেকে উঠতে উঠতে বলেন,

“আমি এবং টিপি কিন্তু খেয়ে নিয়েছি।”

রিমু আপুর কথা শুনে বেদনাতীত মুখে হাসি চলে এলো।মাও হালকা হাসলেন।বললেন,

“ভালো করেছিস।”

২২.
রাতে বসে আছি বারান্দায়।নিরিবিলি দূরের তারাগুলো দেখছি।আমি এখন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি অভির সাথে থাকবো না।তাই এটা নিয়ে তাই আর কি একটু মন খারাপ।মন খারাপ ত হবার কথা, তাই না?এখানে যদি আমার ডিভোর্স হয়ে যা তাহলে পরবর্তীতে কীরকম হবে জানি না!কারণ মা,বাবা এবং আমার রিলেটিভসরা কেমন রিয়েক্ট করেন কে জানে!এমনো হবে অভির সাথে আমার সেফারেশন হবার কথা শুনলে বাবা আমাকে আর ঘরেই ঢুকতে দিবেন না!কী করার বলুন?অভিকে আমি যে মন থেকে কেনজানি মানতে পারছি না।ওর সাথে সংসার করলে ও আমাকে কতটা ভালো রাখবে তার গেরান্টিও দিতে পারছি না!মোটকথা, আজ-অব্দি ওকে আমি ভালো করে বুঝতেই পারি নি।এতটা মাস একই ছাদনাতলে, একই রুমে তারপরও না!তাহলে কীভাবে এতটা নিশ্চিত। সবথেকে বড় কথা ও এতটা মাস আমাকে দেখার পরও কেন একটিবার ওর মনে হলো না আমি চরিত্রহীনা না?কেন নিজে নিজে অনুধাবন করলো না ওই ভার্সিটির ছেলেটার বলা সবগুলো কথা মিথ্যে?ওর নিজের কি বুঝার ক্ষমতা নেই?অবিশ্বাস্য!খুব অবিশ্বাস্য!

ফোনের স্কিনে আলো জ্বলে উঠে।পাশে তাকাই।মেসেজ এসেছে।হাতে ফোনটা তুলে নিই।মেসেজ নোটিফিশনে ঢুকে পাঠানো নাম্বারের উপর টাচ করি,

“মানুষ মাত্রই ভুল!মানুষ ভুল করতেই পারে।আর সেই ভুল থেকে সে শিক্ষাও পায়।সেই শিক্ষাটাকে কি একটু সুযোগে জাগায় দেওয়া যায় না?এতটা পাষাণ তুমি পারিসা!”

এরকম মেসেজ গত রাত থেকেই আসতেছে অভির!কলও করেছে বহুবার।রিসিভ করি নি।মেসেজের রিপ্লাই দিই নি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here