আমার_হৃদয়ে_সে #রোকসানা_আক্তার পর্ব-৩৭

0
704

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৭

ইদানীং ভারী শরীরটা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ!তারপরও ডানহাতে সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে অতি সংযতে উঠে দাঁড়াই।আলতো রুমের দরজা খুলে চারপাশে তাকাই।ডাইনিং,হলরুমে কেউ নেই।থাকলে আমাকে এতক্ষণে এখানে আসতে দেখলে বকাবকি শুরু করে দিত।বিশেষ করে মা সবথেকে বেশি।সন্তান পেটে আসার পর থেকে তিনিতো কোনো কাজেই আমাকে হাত দিতে দেননি।হাত দিতে গেলেই বলতেন,”আমার নাত/নাতনীর যদি কিছু হয় তাহলে তোমার খবর আছে!অনেক শখ বেঁধে রেখেছি মনে তাতো তুমি জানোই!”উনার শখ হলো উনি উনার নাত/নাতনীর সাথে খেলা করবেন।দুষ্টুমি করবেন।তাকে গোসল করিয়ে দেবেন।খাইয়ে দেবেন।আবার ঘুম পাড়িয়েও দেবেন।এমনকি জানেন?উনি আমাদের চক্ষু আড়ালে একটা দামী গাড়িও কিনে রেখেছেন!সেদিন হৃদয় তার কলেজের কি দরকারী কাগজ নিতে আলমারী খুলতে যেয়ে দেখে একটি খেলনা গাড়ি।অবশ্যি প্রথমে বুঝতে পারে নি খেলনা গাড়িটি মা কেনো কিনেছিলেন।সে খেলনা গাড়িটি হাতে নিয়ে ডাইনিং এ এসে মাকে বলে,

“মা,এটা কারজন্যে?”

উনি হঠাৎ ছেলের এহেন কথায় কিছুটা বিব্রতকর হয়ে যান।বাচ্চা এখনো হয়নি অথচ তারজন্যে গাড়ি!ছেলে বিষয়টি শুনলে কেমন দেখাবে না?আমি সেখানেই ছিলাম দাঁড়িয়ে তখন।হৃদয় জবাব পাওয়ার অপেক্ষায়!মা উপায়ন্তর না পেয়ে বলে উঠেন,

“আসলে বাবা,আমার নাত/নাতি হলে তাকে গাড়িটা দেব তাই আর কি কিনে…!”

বাকিটুকু বলতে পারেননি।হৃদয় ভারী অবাক হয়।আমিও।আমার চোখেতে পানি চলে এসেছিলো প্রায়।নিজেকে সংযত করে মাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরি।তাই এই মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোকিছুই করতে পারি না।ইচ্ছা হলেও পারি না।হয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।নাহয় পাশ কেঁটে চলে আসি।এই আটটা মাস এভাবেই গেছে আমার!আমি ধীর গতিতে পা ফেলে টেবিলের কাছে আসি।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে নিলে তার থেকে কিছু পানি গদগদ করে নিচে পড়ে যায়।তাতে আর পাত্তা না দিয়ে গ্লাসের পানিটা শেষ করে পেছন ঘুরে এক কদম পা ফেলতে পা পিচলে যায়।পড়ে যেতে আর সময় দিই নি আমি।ওমনি টেবিলের পায়া ধরে ফেলি!পেটে টান পড়ে। কিছুটা কুঁকড়িয়ে উঠি আমি।আমার কুঁকড়ানোর শব্দ হয়তো আমার শ্বশুরের রুম থেকে শোনা যায়।কেননা তিনি অমনি দরজা খুলেন আমার দিকে এগিয়ে আসেন।আমাকে উঠাতে আমার বাম হাত ধরতে ধরতে বললেন,
“তোমাকে কে বলেছে একা একা পানি খেতে আসতে?রুনু ছিলো!তোমার শাশুড়ী ছিলো!বা আমাকেও তো ডাকতে পারতে!”

তারপর উনার সাহায্যে উঠে দাঁড়াই।উনি এবার আমার বাম হাতটা ছেড়ে বলেন,
“যাও রুমে যাও।এরকম আর করবে না!”

বলে চোখমুখ ভারী শক্ত করলেন!আমি কিছু আর বলতে পারলাম না।উনার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে থেকে ঘোর স্তব্ধতা মুখে রুমে ফিরে এলাম!দরজা বন্ধ করলাম।বিছানার এককোণে গিয়ে বসলাম।পঞ্চাশ সেকেন্ডের মতন চুপচাপ বসে থাকলাম।চোখজোড়া এরমাঝে ভিঁজে উঠলো।সাথে ফুঁটে উঠলো ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
হৃদয়ের সাথে আমার বিয়ের আজ দশমাস হতে চললো। এই দশমাসে বাবা আমার সাথে আজ এই প্রথম ভালো মতন কথা বললেন তাও নিজ থেকে!!
এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না উনি যে আমার সাথে কথা বলবে ।আমাকে এসে ধরবেন!হয়তো আমার পেটে বেড়ে উঠেছে উনারই একমাত্র ছেলের একমাত্র সন্তান যার ব্যথা পাওয়ার সংবাদটা উনার মস্তিষ্কে আপনাআপনিই পৌঁছে গেছে।তাই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি।ছুটে আসেন নাত/নাতীকে বাঁচাতে।হ্যাঁ,এইসবকিছুই শেকড়ের টান।ভালোবাসার টান।মায়া-মমতার টান।এই টানে রাগ থাকে না।অভিমান থাকে না।পেটে হাত বুলালাম।

“বাবু?তুমি খুব লাকী।তোমার কারণে তোমার দাদু আজ আমার সাথে কথা বলেছে।তুমি তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে আসো।খুব তাড়াতাড়ি ।এসে তোমার দাদুর রাগ ভাঙ্গিয়ে দাও!”

৬০.
লাবণ্য আসাতে এই বাড়ির সবাই খুব খুশি!সবার সবার মতে লাবণ্যের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন আদর!লাবণ্যের আজ ছয়মাস।বসতে শিখেছে সবে মেয়েটা।এই এইটুকুন বাচ্চার জন্যে ওর দাদু,বাবা এমনকি দাদাও খেলনাপুতুল এনে ভরিয়ে ফেলেছে।দাদা খেলনাগুলো আমার রুমে এসে লাবণ্যকে সরাসরি দেয়না।কীভাবে দেয় জানেন?হাসনাকে ডেকে নিয়ে ওর মাধ্যমে লাবণ্যকে আমার রুম থেকে নিয়ে তারপর লাবণ্যের হাতে খেলনাগুলো দেন।সাথে খুব আদরও করে দেন!হাসনা বললো।হাসনার মুখ থেকে আমি এবং শাশুড়ী মা কথাগুলো শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি।খুশির মাঝে শাশুড়ী মা আবার অভিমানও করে বসেন।বলেন,

“এই আমি দেখবো,এই জোহারা বেগম দেখবে তোমার শ্বশুর ক’দিন আমাদের সাথে রাগ করে থাকতে পারে!যেচে যেয়ে কোনোদিনও কথা বলবো না!এই জোহারাকে সে চিনে না এখনো!”

আমি হেসে উঠলাম।বললাম,
“মা?বাবা হয়তো লজ্জায় কথা বলতে পারছেন আমাদের সাথে।আগে আমরা কথা বলে উনার রাগের লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিই?”
“চুপ করো বউ মা!পুরুষ মানুষের আবার লজ্জা কীসের?!”

৬১.
লাবণ্যের এগারোমাসে পা পড়েছে।হাঁটি হাঁটি পা ফেলে দিনে দশ বারোবার ওর দাদার রুম,দাদীর রুম,হাসনার রুম এবং আমাদের রুমে হাঁটাহাঁটি করে।হাঁটতে যেয়ে পড়ে যায়।তারপরও হাঁটে।আমরা পেছন থেকে ওকে ধরতে গেলে আরো দৌঁড় মারার চেষ্টা করে।এরকম দুষ্টু মেয়েটা!ওদিন সদর দরজা খোলা ছিল। ও কি করলো? দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।আমি আতঙ্ক মনে ওর পেছনে ছুট লাগাই।কারণ নিচতলায় যাওয়ার আবার সিড়ি আমাদের দরজার একদম বাম কর্ণারে।মেয়েটা যদি ঘুরে সেদিকে একবার যায় তাহলে আর রক্ষা নেই!বেরিয়ে দেখি ও সত্যিই সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নিচে পা ফেললে সিঁড়ির প্রথম ধাপ!জোর গলায় “লাবণ্য” বলে ওকে ধরতে গেলে ও পাশ থেকে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ায় ।আর আমি পা পিচলে কেনজানি সিঁড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ে যাই।অস্ফুট একটা চিৎকার করে দেয়ালের সাথে মাথা ফাঁটাবার আগে কেউ যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।আর সে দেয়ালের সাথে পিষে যায়।আমি পিটপিট চোখের পাতা মেলে সামনে তাকিয়ে আমার জামাইটা!কলেজ থেকে ফিরেছে।কপাল,মুখ,গলা,বুক,শার্টের উপরের অংশে ঘাম লেপে আছে।ঘাম থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে।মানুষ বলে ঘামের গন্ধ দুর্গন্ধ।কিন্তু হৃদয়ের গাঁয়ের এই গন্ধটা আমার ভীষণ প্রিয়!কেমন যেন বকুল ফুলের মতন লাগে নাকে গন্ধটা।নাক ফুলিয়ে গন্ধটা নিই কিছুক্ষণ।তারপর কোনো কিছু না ভেবে হৃদয়কে জড়িয়ে ধরি খুব জোরে!হৃদয় কুঁকড়ে যাওয়ার মতন আর্তনাদ করে উঠে একটু।আমি অসংযত হয়ে ওকে ছাড়িয়ে বলে উঠি,

“কি হয়েছে?আপনি একরকম করতেছেন কেন?”

হৃদয় বলে,
“তোমাকে বাঁচাতে যেয়ে আমি নিজেই শেষ!দেয়াল আমার পিঠটা আর রাখলো?এভাবে বেপরোয়া ভাবে চলো কেনো?দেখেশুনে চলতে পারো না?এখন যদি আমি না থাকলে তোমার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত!কি করতে তখন?”
“আমার কি দোষ?আপনি যেমন ছোট্টবেলায় শাশুড়ী মার নাকে দঁড়ি বেঁধে মাকে পুরো বাসায় ঘুরিয়েছেন!তেমনি আপনার মেয়েটা আপনার সেই বদভ্যাসটা পেয়ে এখন আমার সাথে তাই করতেছে।আগে গিয়ে থামান আপনার মেয়েকে!!”

হৃদয় হেসে উঠলো।তারপর জোরে জোরে দুইটা বড় শ্বাস ছেড়ে আমার দুইকাঁধে আলতো হাত রেখে বললো,
“মেয়েটা কোথায় আমার?”

হৃদয়ের কথায় আমি পেছন ঘুরে উপরে তাকাই।লাবণ্য নেই।হয়তো আবার ঘরে ভেতর চলে গেছে।হৃদয়ের দিকে ফের আবার ফিরলাম। বললাম,
“গিয়ে দেখুন?এখন আবার কার নাকে জানি দড়ি বেঁধে দিয়ে তাকে ঘুরচ্ছে?”
“এই চুপ!আমার মেয়ের নামে একদম বাজে বকবে না!লক্ষী মেয়ে আমার!”
“লক্ষী?অলক্ষী আপনার মেয়ে একদম আপনার মতন।”

হৃদয় আমার কথা শুনে আবারো মৃদু হাসলো।তারপর আমার কাঁধ থেকে হাতজোড়া নামিয়ে বাসায় ঢুকার শশব্যস্ত হতে হতে বললো,
“আমার মেয়ে তোমার মতন লক্ষী হয়েছে ব!অলক্ষী বলবে না একদম!”

বলে দাঁড়ালো না আর।পাশ কেঁটে উঠে চলে গেলো।ও চলে যাবার পর আমার মুখেও আপনাআপনি হাসি ফুঁটে উঠলো।
“পাগল একটা!”

চলবে…

(গল্পটা কি শেষ হয়ে যাচ্ছে তাহলে🤔?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here