#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-০৮
চারদিকে রাত নামলে আমি একটা কাজ করি তা হলো অভিকে রিয়াজ ভাইয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অনেকগুলো টেক্সট করে দিই।টেক্সটগুলো লেখার শেষে তাকে কিছু আমার অপিনিয়ন জানাই।তা হলো-
“সবকথা বললাম।পড়ছেন নিশ্চয়ই?এবার এসব বিশ্বাস করা না করা তা আপনার ব্যাপার!ওকে?তবে হ্যাঁ,কেউ যখন অন্যায় না করার পরও হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে সে সত্যিই অন্যায় করেছে তখন সত্যি খুব খারাপ লাগে।আগে ভালো মতন কেনোকিছু জাস্টিফাই না করে কাউকে অপবাদ দেওয়া কতবড় জঘন্যতম কাজ আশা করি তা জানেন।যাইহোক আর প্যাঁচাল পাড়ছি না।ভালো থাকবেন!”
মেসেজগুলো করে ফোনটা রেখে দিলাম।জাস্ট জানিয়ে দিলাম।কারো কাছে মিথ্যে অপবাদ পাওয়ার ইচ্ছে আমার একদমই নেই!আমি ওই রাফিকেও খুঁজে বের করবো।বের করেই ওর সামনে নিয়ে যাবো।তবে তা এখন না।সময় আসুক।ভাবনার মাঝেই,
“পারিসা?খেতে আয়?”
ওপাশ থেকে খালামণির ডাক আসে। আমি ওড়নাটা ঠিকঠাক মতন গাঁয়ে জড়িয়ে ডাইনিং এ যাই।ডাইনিং আঙ্কেল মিস্টার মেহরাব শেখ বসে আছেন।আঙ্কেলের পাশের চেয়ারে ফাহিম।আর খালামণি খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।আমি চেয়ারে বসতেই আঙ্কেল আমাকে দেখলেন।বলে উঠেন,
“হাই,পারিসা?হোয়াট’স আপ?কখন এসেছো?”
এই বাসায় আসার পর এখন মাত্র আঙ্কেলের সাথে আমার দেখা হলো।আজ সারাদিন অফিসেই ছিলেন।আমি আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলি,
“আলহামদুলিল্লাহ। সকালে এসেছি আঙ্কেল।”
“তুমি সকালে এসেছো অথচ তোমার খালামণি আমাকে কিছুক্ষণ আগে বললো।একটা কল করেও জানালো না!”
বলে খালামণির দিকে নিরস দৃষ্টিতে তাকান।তা দেখে খালামণি বলেন,
“বলি নি।তোমার জন্যে এটা জাস্ট সারপ্রাইজ ছিল!”
“আচ্ছা?তা সারপ্রাইজটা একটু অন্যরকম হলে ভালো হত না?”
আঙ্কেলের দিকে এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।আঙ্কেল হেসে উঠে বলেন,
“আই মিন আমার জামাই বাবার কথা বলেছি।তোমাকে এবং অভিকে একসাথে দেখতে পেলে সারপ্রাইজটা আরো ভালো হতো।অভিকে সঙ্গে আনলে না কেন?”
আঙ্কেলের কথায় মুখটা মলীন হয়ে যায়।চোখের পাতা দ্রুত উঠানামা করে। আঙ্কেলকে প্রত্যুত্তর করতে যেয়েও ঠোঁটজোড়া বারবার কেঁপে উঠে।আমার অবস্থা খালামণির সচেতন মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে যায়।তিনি কথার ফোঁড়ন কেঁটে আঙ্কেলকে বলেন,
“অভি আসবে না।”
“কেন?”
তারপর খালামণি আঙ্কেলকে বিস্তারিত সব বলেন।আঙ্কেল খালামণির থেকে আমার এবং অভির ব্যাপারটা শুনে খুব আপসেট হয়ে যান!প্রথমতো দুই তিন মিনিটস চুপ থাকেন।তার খানিক্ষন পর নিজেকে ধাতস্থতা করে বলেন,
“অভিকে আমিতো খুব ভালো জেনেছি।আর সে এরকম কিছু করে ফেলবে অবিশ্বাস্য!আসলে রাহেলা,এখনকার মানুষদের চেনা খুবই মুশকিল।তোমার সাথে একজন মানুষ সার্বক্ষণিক থাকবে।তোমার ব্যাপারে সে সব জানবে।তুমিও তার ব্যাপারে সব জানবে।মানে দুজনে খুব ক্লোজ থাকবে।।আর পরে দেখবে কি না সেই মানুষটাই পেছনে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লোকদের কাছে তোমার বদনাম রটাচ্ছে।সো।স্যাড!”
বলে আঙ্কেল একটা আক্ষেপ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।পাশ থেকে ফাহিম বলে উঠে,
“বাবা?তোমার এসিস্ট্যান্ট টা না এরকম?”
“কে বললো তোমাকে?”
“তুমিই তো একবার মাকে বলেছিলে।তখন আমি শুনেছি।”
আঙ্কেল ফাহিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
“বাবা তুমি এখনো ছোট্ট।এসব মনে রাখতে নেই।তোমার মনে রাখতে হবে শুধুই পড়াশুনা।ওকে?”
“আচ্ছা,বাবা।”
বলে ফাহিম আবার খাবারে মনোযোগ দিলো।ফাহিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার আঙ্কেল আমার দিকে তাকান।বলেন,
“পারিসা যা হবার হয়েছে।সব ভুলে যাও।আমি বুঝতেছি তোমার অবস্থাটা। অভি তোমাকে ভুল বুঝেছে ওটা ওর ফল্ট ছিল।ওর ওই ফল্ট ভাঙ্গাতে এখন শুধুই ওই রিয়াজ নামের ছেলেটাকে লাগবে।তুমি কি ওকে।খুঁজে অভির কাছে নিয়ে যেতে চাও?”
“নিয়ে গেলে ত ও তখন বুঝবে আমার কোনোই দোষ ছিল না।”
“রাইট।”
“আর পরে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে।তবে আঙ্কেল আমি চাই না আমি ওর কাছে নিজে যেয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার এবং ও পরে আমাকে সরি বলার।ওর তখন ওই সরিটা খুবই অর্থহীন মনে হবে!”
“এখন তোমার তাহলে কি ডিসিশন?”
“যে কোনো বিষয় ভালোভাবে না জাস্টিফাই করে আমাকে ভুল ভাবলো এবং শেষে আমার চরিত্র নিয়েও কথা তুললো তার কাছে ফিরে যাওয়াহবে কি না আমি নিজেও জানি না।আমি জব করবো আঙ্কেল। এটাই এখন এটাই আমার ডিসিশন।আপনি আমার জন্যে ভালো একটা জব দেখুন।”
“বুঝলাম।আমি যেহেতু আছি জব তোমার পাক্কা।ওটা নিয়ে টেনশন করতে হবে না।টেনশন টা শুধু অভি এবং তোমাকে নিয়েই।ডিভোর্সের কথা যেহেতু তোলা হয়েছে তবে এখানে ভুল বোঝাবুঝি টাই কি প্রাধান্যতা পেল না?”
“আমি অভিকে ভুলবোঝাবুঝির বিষয়টা টেক্সটে করেছি ক্লিয়ারলি!তারপরও যদি ওর আমাকে বিশ্বাস না হয় বাট নাথিং টু ডু আঙ্কেল।আর এটা ভেবে এখন চিন্তা করারও সময় নাই।এখন আমার চিন্তা শুধু মুভ অন মাই ফিউচার।”
“ইয়েস!রাইট স্যা,মাই ডটার।জব করতে পারলেই তোমার মা-বাবার এবং তোমার ওই অযোগ্য স্বামীকে উচিত জবাব দিতে পারবে।আমি চাই ওরা নিজেরাই তোমার কাছে এসে নত হোক!”
আঙ্কেলের এ’কথার আর জবাব দিলাম না।নির্লিপ্ত খেয়ে উঠলাম।রুমে এসে ফোন হাতে নিলাম।ফোনে অভির আর কোনো রেসপন্স মেসেজ এলো না।একঘন্টা হয়ে গেছে মেসেজ পাঠানোর। এতক্ষণে হয়তো দেখেও ফেলেছে মেসেজগুলো।দেখার পরও….!এবার কেনজানি মুখে খুব তাচ্ছিল্যকর একটা হাসি ফুঁটে উঠলো।তবে “তাচ্ছিল্য হাসি দেওয়ার” কারণটা মাথায় নিলাম না।তা এড়িয়ে যেয়ে সোঁজা ফেসবুকে ঢুকলাম।নিউজফিড স্ক্রল করতে চোখ পড়লো একটা ডিপিতে।ডিপিটি অভির।নিউ ছবি।কিছুক্ষণ আগে সে ছবিটা আপলোড দিয়েছে।ছবিতে সে অন্যদিক তাকিয়ে হেসে আছে।গাঁয়ে ব্লু কালারের গেঞ্জি।পড়নে জিন্স।হেয়ার জেড এঙ্গেলে কাঁটা।এই লুকে তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।সাথে হাজারো লাইকস,কমেন্টস।কমেন্টসের রিপ্লাইগুলোর বাক্য খুবই নির্লিপ্ত আর প্রাণবন্ত।দেখেই বুঝা যাচ্ছে বড্ড সুখে আছ সে।মেসেজগুলোও একটিবারের জন্যে তার হৃদয়ে নাড়া দিলনা।বড়ই পাষাণ আর নিষ্ঠুর!ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো।তারপর নিজেকে আবার সামলালাম।এখন আর নিজেকে আবেগে রাখবো না।আবেগে রাখলে আবার আগের মতন সেই কষ্ট পেতে হবে।এখন আর কষ্ট পেতে চাই না।এখন নিজেকে শক্ত করতে চাই!শক্তটাই আমার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শেষ ভরসা!ভাবনার মাঝেই ফাহিম ভেতরে ঢুকলো।এসেই বললো,
“আপু?একটা কাজ করো ত?”
“বলো।”
সে আমার দিকে একটা কাগজ এবং কলম এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সুন্দর দেখে একটা আর্ট করে দাও আমাকে।মা বললেন তুমি নাকি খুব ভালো ড্রয়িং জানো?”
আমি কিছুটা অসংযত হয়ে যাই।মন ভালো নেই।তারউপর আবার ড্রয়িং!খানিকটা বিরক্তিও লেগে যায়।বলি,
“রাত তো অনেক হয়েছে।ঘুমাবে না?”
“আমি এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না।”
“কেন?”
“মাত্র ন’টা বাঁজে এটা কোনো রাত হলো নাকি?জ্ঞানীরা জানো কখন ঘুমায়?”
“কখন?”
“পড়াশুনা শেষ করে!”
“তোমার পড়াশুনা শেষ হয়নি?”
“য়ুহু।”
“কি পড়া বাকি আছে? ”
“ড্রয়িং।শুধুই ড্রয়িং।”
বলে ফাহিম দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে।ভেতরে আমার আরেক রাশ বিরক্তি ছুঁয়ে যায়।ফাহিম বলে,
“ঘুমানোর আগে আমি যদি রংতুলি নিয়ে না বসি তাহলে রাতে আমার ভালো ঘুম হয় না।আমি রংতুলি করলে রাতে খুব ভালে ড্রয়িং এর স্বপ্ন দেখি।স্বপ্নে দেখি অনেক বড় একজন আর্টিস্ট হয়েছি।”
“তোমার ড্রিম কি আর্টিস্ট হবার?”
“জ্বী।কিন্তু বাবা চাইছেন না।”
“তুমি যদি ভালো আর্ট জানো।বড় বড় প্রতিযোগিতা জয়েন করো তাহলে অবশ্যই তিনি একদিন রাজি হবেন।”
“দোয়া করো আপু।আমি বাবাকে রাজি করাবই।”
“সিউর।যাইহোক অনেক কথা বললাম।এবার তাড়াতাড়ি ড্রয়িং করে দিয়ে আমাকে বিদেয় করো।”
“আজ না করলে হবে না?”
“য়ু হু।আমার এখনই চাই।”
এই একটা ঝামেলা!ছোট্টদের যদি কোনো আবদার এই একবার রাখি তাহলে ত হলোই..!সারাক্ষণ কানের কাছে খালি ঘ্যানঘ্যান করবে আর বলবে,”আপু ড্রয়িং,আপু ড্রয়িং।”এদের এই ছোট্ট বাচ্চাগুলোর এই এক হলো বদভ্যাস!তারপরও খালামণি যেহেতু কথাটা বলেই দিলো তাহলে ত আবার ড্রয়িং না করে দিলে খালামণির কাছে ছোট্ট হয়ে যাবো।নাহ ড্রয়িং করেই দিই।ছোট্ট মানুষ।ড্রয়িং করে দিলে খুশি হয়ে যাবে।ভাবতলই বিরক্তি ভাবটা মসৃণ হয়ে যায়। মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলি,
“দাও”
খসখস পেন্সিলের আওয়াজে একটা স্কেচ করে দিলাম।স্কেচ করা শেষ হলে ফাহিম সে কি খুশি!খুশির লগন যেন তাকে ধরছেই না।সে টপ করে কাগজাট হাতে নিয়ে বলে,
“সে কি,তুমিতো খুব ভালো স্কেচ পারো।কি সুন্দর একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।আচ্ছা রং টা আমি করবো?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা করা শেষ হলে তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসবো।হ্যাঁ?”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
ফাহিম আমার উত্তর পেয়ে স্কেচ নিয়ে ওর রুমের দিকে ছুট দিল।ফাহিম বড্ড পাকনা ছেলে।বয়স তেমন না।এই এগারো। ক্লাস মাত্র সিক্স!
চলবে….