গল্প- অনুভূতিরা মৃত
তেরো পর্ব
.
রসগোল্লা খেতে খেতে রুয়েল প্রশ্ন করে, নিশি আপু কেমন আছে? নিশ্চুপ আরজু ভাইয়া। সে আবার প্রশ্ন করে, বিষণ্ণ মনে উত্তর দেয়। শুনেছি ভালোই আছে, তুই চলে আসার সাত মাস পর নিশির বাবা এক ডাক্তার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। আমি প্রস্তাব পাঠানোর পর বেকারত্বের ট্যাগ লাগিয়ে আমায় রিজেক্ট করে। কথাগুলো বলতেই আরজু ভাইয়ার চোখ অশ্রুতে ছলছল করছে। কি বলবে জানা নেই তার। চুপচাপ নিরব চাহনি। দ্বীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, তবে কি জানিস? অধ্যবসায় ও শ্রম দিয়ে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত সবকিছু আছে শুধু নেই ভালোবাসার মানুষটি। জানস, আমার এই গাড়ির মূল্য নিশির হাজবেন্ডের গাড়ির চেয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা বেশি। নিশির হাজবেন্ডের বাড়ির চেয়ে আমার বাড়িতে কাজ করা হয়েছে বিশেষভাবে। ভালোবাসা এমনি যখন একজন বুঝে, তখন অপরজন বুঝে না। যখন দুজন বুঝে তখন পৃথিবী বুঝে না।
.
আরজু ভাইয়ার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। কী যেন এক অসহ্য যন্ত্রণা চোখে লেগে আছে। সীমাহীন এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে আজও সে বেচে আছে, যে যন্ত্রণার ভাষা জানা নেই কারো। ভালোবাসা না পাওয়ার যে তীব্র যন্ত্রণা, আর্ত চিতকার তা হয়তো না হারালে বুঝা দায়। এক আকাশ যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় জানায় আরজু ভাইয়া। কালো রঙের গাড়িতে ছুটছে তার যন্ত্রণাময় ছুটে চলা। অদ্ভুত ভাবে কান্না করে মিহি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুয়েল। এই মেয়ের কী হলো? হঠাৎ করে চোখে সাগরে লোনা জল কেন? প্রশ্ন করে রুয়েল উত্তর দেয় মিহি। আরজু ভাইয়ার ভালোবাসা হারানোর কষ্টে ব্যথিত সে।
.
নতুন বছর চারদিকে নতুনত্বের ছোঁয়া। নতুন স্বপ্ন নতুন দিন নিয়ে আসে নতুন আশা, হৃদয়ে পুলক জাগে বাঁধে প্রীতির বাসা। চারদিকে নতুনত্বের আমেজ পুরাতন বছর শেষ হয়ে নতুন বছরকে সবাই স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। মিহি ব্যস্ত রুয়েলকে কক্সবাজার নিয়ে যেতে। একটি ব্যান্ড কোম্পানির লটারির মাধ্যমে এই সুযোগ আসে মিহির। সাথে নিতে পারবে যে কোন একজন সঙ্গী। রুয়েলকে ছাড়া যাবে না মিহি। দুইদিন চেষ্টার পর রাজি হয় রুয়েল।
.
এনা ট্রান্সপোর্টে তারা যখন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। রাতের ঘড়িতে তখন দশটা অতিক্রম করছে। এনা ট্রান্সপোর্ট দেশের প্রথম সারির পরিবহন। মহাসড়কে চালু করেছে বিশ্বমানের হুন্দাই বাস। যা যাত্রীদের ঝাঁকি ও বাইরের শব্দ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে নির্ঝঞ্জাট যাত্রা উপভোগ দিয়ে থাকে। এনার নতুন হুন্দাই বাসেই রুয়েল মিহির ভ্রমণ। বাইরের ঠান্ডা আবহাওয়া বাসের ভিতর বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। যতোই বিলাসবহুল বাস হোক, পৌষের শীতকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। জানালার পাশে বসে মিহি যখন কল্পনায় বিভোর রুয়েল তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম পাগল ছেলে। ঘুমের রাজ্যে প্রায় হারায়। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে চিল্লিয়ে উঠে। সে যে এক দুঃস্বপ্ন আবেগের টান। তুমি ঘুমাচ্ছাে? মিহির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে তার। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই জানালার বাইরে আবিষ্কার করে জোনাকি পােকা। মিটিমিটি জ্বলছে, কখনো আবার নিভছে, অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে। মিহি তা ভিডিও করার চেষ্টা করে। চলন্ত বাসে বৃথা চেষ্টা। কয়েক সেকেন্ড যেতেই মন খারাপ করে ক্যামেরা বন্ধ করে। সামনে তাকাতেই ঘুমন্ত বালক ঘুমে বিভোর।
.
ইয়ারফোনের একটি লাইন তার কানে গুচে দেয়। মোবাইলের বক্সে তখন বেজে উঠে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতাে তুমি বলাে তো?যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতাে তুমি বলাে তাে? কোন রাখালের ওই ঘর ছাড়া বাঁশীতে, সবুজের ওই দোল দোল হাসিতে, মন আমার মিশে গেলে বেশ হয়। যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়। তবে কেমন হতাে তুমি বলাে তো? মিহির কাছে তো বেশ ভালো হতো। স্বপ্নের পৃথিবীতে সে স্বপ্ন সাজাত নাম দিতো স্বপ্নপরী। যেই স্বপ্নপরীতে সে হতো রাজকন্যা রুয়েল হতো রাজপুত্র। তখন স্বপ্নের পৃথিবীতে বিরাজ করতো তার ভালোবাসা। কল্পনায় বিভোর মিহি। কল্পনায় তার পথ দীর্ঘ হয়। বাস চলছে তার গতিতে, রাত বাড়ছে, দুরত্ব কমছে, অবচেতন ঘুমন্ত রুয়েল মিহির কাধে মাথা রেখে ঘুমােচ্ছে, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মিহি। সে তাে এটাই চেয়েছিল। মিটমিট করে হাসছে, চোখে তার আনন্দ অশ্রু।
.
সকালে সূর্যের আলােতে ঘুম ভাঙল। পূবের আকাশে জেগে উঠল নতুন বছরের রক্তিম সূর্য। ততাে সময়ে বাস এসে থামল বিশ্বের অন্যতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। বাস থেকে নেমে হােটেলে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সমুদ্র দর্শনে। পশ্চিমা আকাশে লাল সূর্যের আভাস। সমুদ্রের বাতাসে মিহির চুলগুলাে বারবার এলােমেলাে করে দিচ্ছে। মিহির কপালে কালাে টিপ, পায়ে পায়েল, এ যেনাে স্বর্গ থেকে নামা এক অপ্সরী। একের পর এক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। সামনে বিশাল সমুদ্র। নীল আকাশ জুড়ে গােধূলির লুটোপুটি খেলা। চোখ বন্ধ করতেই কানে সমুদ্রের গর্জন। মানুষ আর সমুদ্রের মধ্যে এ যেন এক গভীর প্রণয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রাকৃতিক বালুময় সৈকত হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার সমুদ্রের পানিতে পা রাখতেই শরীর শিহরিয়ে উঠল৷ সর্বদা নদী দেখতে অভ্যস্ত ছেলেটা বিশাল সমুদ্রের সামনে যখন দাঁড়িয়ে নদীকে মনে হচ্ছে তুচ্ছ। সমুদ্রের তুলনায় নদী কিছুই না।
.
আকাশের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করে রুয়েল।
— আচ্ছা, সমুদ্র আমায় এমন ভাবে আকর্ষন করে কেনো? মনে হয় আমি আমি সমুদ্রকে অনুভব করি। মিহি উত্তর দেয় ”লেখক বলেছিল, প্রাণের প্রথম সৃষ্টিই হয় সমুদ্রে। কাজেই বলা যেতে পারে আমরা উঠে এসেছি সমুদ্র থেকে, সমুদ্র হচ্ছে আমাদের আদি মাতা। আমাদের চোখের জল নােনতা, আমাদের রক্তে যে ঘনত্ত্ব সমুদ্রের পানিরও সেই একই ঘনত্ব। সমুদ্রের প্রতি আমরা এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই আকর্ষণ তীব্র ভাবে অনুভব করে। হয়তাে তুমিও তাদের একজন। মিহির উত্তরে মুগ্ধ হয় রুয়েল। মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় তাকে তা বুঝতে পারে মিহি। ছোট করে মিহি বলে।
— একটা প্রশ্ন করতে পারি?
উত্তর দেয় রুয়েল।
— একটা কেন, অসংখ্য প্রশ্ন করো।
— একটাই প্রশ্ন করব এবং আশা করি উত্তর দিবে।
— সমুদ্রের বিশালতায় দাঁড়িয়ে তোমার হাজারও প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুথ।
সুযোগটা কাজে লাগায় মিহি। প্রশ্ন করে সে, আচ্ছা তোমার অনুভূতিরা মৃত কেন? মূহুর্তেই চুপসে যায় রুয়েল।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল