গল্প- অনুভূতিরা মৃত
পর্ব- পনেরো
.
সেদিনই প্রথম জানতে পারি হিন্দু ধর্মের মেয়েটি সেন বাড়ির ছোট মেয়ে বনলতা সেন। মূহুর্তেই আমার পৃথিবী থমকে গেলো। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী একটা মেয়েকে নিয়ে স্বপ্নগুলো মূহুর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম। নিকোটিনে শান্তি খুঁজে বেড়ায়। বিশ্বাস হারাতে লাগলাম কেননা এটা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এই দেশে। আমাদের সংবিধানে যতোই লেখা থাকুক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর। যে কোনো ছেলে বা মেয়ে, যে কোনো ধর্মের, জাতের, গোত্রের কাউকে বিয়ে করতে পারে। প্রত্যেকটি মানুষের নিজের পছন্দের মানুষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বদা পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং এতে ধর্মের, রাষ্ট্রের এবং সমাজের মাথা গলানোর কোনো অধিকার নেই। যতোই স্পেশাল ম্যারেজ এক্টের ব্যবস্থা থাকুক, যতোই সুপ্রীম কোর্ট রায় দিক, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করলে। মুসলিম হয়ে হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসলে, হিন্দু হয়ে মুসলমান ছেলের সাথে প্রেম করলে, এই সমাজ কখনো মেনে নিবে না। এই ক্ষেত্রে এদেশের সমাজ খুব কঠিন। কঠোর থেকেও কঠোরতম।
.
ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাতে লাগলাম। আগের মতাে আর বনলতাকে ফলাে করা হয়না। তবে হঠাৎ যখন দেখা হয়ে যেতো চোখ সড়াতে পারতাম না। অদ্ভুত রকম এক অনুভূতি তৈরি হতো যা আগে কখনো হয়নি। চেষ্টা করতাম দূরে থাকতে, অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার এই চেষ্টাতে জল ঢেলে দিলো পিন্সিপাল স্যার। কলেজের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমার গ্রুপে বনলতা। টিম লিডার হিসেবে সর্বদা যোগাযোগ রাখতে হতো। একসাথে গ্রুপিং করে প্যাক্টিস চলতো। আমি পারতাম না বনলতার চোখের দিকে তাকাতে। তার জাদুময় মায়াবী চোখের প্রভাবে হারিয়ে যেতাম এক ভিন্ন জগতে। যেখানে শুধু আমার ও বনলতার বসবাস।
.
গভীর রাত। আমি তখন বিভোর ঘুমে। ফোন বেজেই চলছে, একটার পর একটা কল হচ্ছে৷ ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ চড়কগাছ। বনলতার নাম্বার দেখে; পাহাড় পরিমাণ আফসোস জমা হচ্ছে। কল ব্যাক করতেই বনলতা জানায়, আপনি তো দেখছি মহা ঘুমকাতুরে। আপনার গার্লফ্রেন্ড টিকবে না। আমি হাসি৷ বারবার বনলতার কথাগুলো কল্পনা ভাসে। এক অদ্ভুত রকম আনন্দ ভালো লাগা কাজ করে। প্রেমে পড়লে বুঝি এমন আনন্দ হয়। দিনের পর দিন বনলতার প্রতি দুর্বলতা বেড়ে চলছে। আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। জানাতে হবে ভালোবাসার কথা। আমার যে সাহস হচ্ছে না। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ধর্মের ভেদাভেদ। প্রেম এমন এক ধরনের আগুন যা ইচ্ছে করলেই নেভানো যায় না। একবার যদি তা জ্বলে উঠে তখন তা জ্বলতেই থাকে। ঠিক যেমন সূর্যের আলোর মতো। ঝড় কিংবা বৃষ্টি দিনের বেলায় সে আলো দিতে বাধ্য। নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে কেউ ভালোবাসে না। সবকিছু পিছনে ফেলে মানুষ এখন ভালোবাসার পিছনে ছুটতে ব্যস্ত।
.
কীভাবে প্রপোজ করতে হবে? কীভাবে জানাতে হয় ভালোবাসার কথা। সহজে ভালোবাসা জানানোর কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করতে থাকি। হঠাৎ মনে হলো ভালোবাসা কোন গবেষণার বিষয় নয়৷ মনের কথা জানানোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত সাহস। সাহস করে একদিন জানিয়ে দিলাম ভালোবাসার কথা। পড়ন্ত বিকেলে শুভ্র নির্মল বাতাসে গোলাপ হাতে বলে উঠলাম। ভালোবাসা জমাচ্ছি, আমিও একদিন ভালোবাসব। পৃথিবী তন্ন তন্ন করে একশো আটটি নীলপদ্ম এনে দিতে না পারলেও রমনার কদমগাছ থেকে আটটা কদম অনায়াসে পেরে দেবো। সাত সাগর, তের নদী পাড়ি দিতে না পারলেও এ শহরের জ্যাম পাড়ি দেবো। ধর্মের দোহাই দিয়ে ফিরিয়ে দেয় বনলতা। আমি পিছু ছাড়েনি৷ অসংখ্যবার বনলতার পথ আটকে দাঁড়িয়েছি, বারবার ফিরিয়ে দিতো। হঠাৎ একদিন বলে উঠল, ভালবাসার জন্য কী করতে পারবে? ছোট করে বলেছিলাম, সবকিছু। ভালোবাসার প্রমাণ দিতে ছেড়ে যেতে হবে তাকে। প্রমাণ হিসেবে বলেছিল, আজ থেকে ঠিক দুই বছর তার সামনে আসতে পারব না৷ কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারব না৷ কোন কল, মেসেজ করতে পারব না। মোটকথা বনলতা থেকে দুই বছর নির্বাসনে যেতে হবে। জোর গলায় জানিয়ে দিলাম পারব আমি। ঠিক দুই বছর পর দেখা হবে একই জায়গায়।
.
বনলতাকে ভালােবাসার প্রমাণ দিতে বেরিয়ে পড়লাম। কলেজ ত্যাগ করলাম। ত্যাগ করলাম নিজ শহর। মনে বিশ্বাস আর ভালােবাসার শক্তি নিয়ে আশ্রয় নিলাম চট্টগ্রাম। খুব কষ্ট হচ্ছে মানিয়ে নিতে। পরিবার প্রিয়জন ছেড়ে অচেনা শহরে। মাঝেমধ্যে গভীর ঘুমে চিৎকার করে উঠতাম। বনলতাকে নিয়ে কতাে যে গল্প লিখেছি, প্রতিটা গল্পের কল্পনায় ছিল বনলতা। সেইসময় প্রায় আবৃত্তি করতাম মহাদেব সাহার কবিতা। এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না। একবার তোমাকে দেখতে পাবো, এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে- বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো ভরা দামোদর। কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল; তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর। ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে কিংবা বোমারু বিমান ওড়া শঙ্কিত শহরে। তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।
.
সেদিন বৃহস্পতিবার বনলতাকে ছেড়ে আসার পর অফুরন্ত ভালোবাসা জমাচ্ছি তার জন্য। বুকে একটাই চাওয়া। মনে একটাই ভাবনা দুই বছর পর বনলতার সামনে দাঁড়াবো। অপেক্ষার সময় ফুরিয়ে দুই বছর পর হাজির হবাে বনলতার সামনে কিন্তু বনলতা কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? নাকি আমাকে দূরে পাঠাতেই তার এই কৌশল?
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল