অনুভূতিরা মৃত বাইশ পর্ব .

0
185

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
বাইশ পর্ব
.
বনলতার সাথে দেখা হয় পঁচিশ দিন আগে। এরপর থেকে সে নিখোঁজ। পঁচিশতম দিনে দৌঁড়ে চলে যাই তার পিসির কাছে। হসপিটালের বারান্দায় পায়চারি করছি, পিসি এখনো আসেনি৷ পিসি আসতেই বলে উঠলাম, বনলতা কোথায়? নিশ্চুপ পিসি৷ কোন উত্তর নেই তার। নিরবতা সহ্য হচ্ছে না আর৷ পিসিকে আবার প্রশ্ন করি৷ পিসি একটা চিঠি দিয়ে বলে, এই চিঠিতেই লেখা আছে বনলতার ঠিকানা। চোখে-মুখে হতাশা। ভয় হচ্ছে, এই প্রথম কোন চিঠি খুলতে এত ভয় হচ্ছে৷ কোনভাবেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছি না।
.
থমথমে নিরবতা। একটি চিঠি এই একটি চিঠি আমার মন খারাপ হতে পারে কিংবা হতে পারে মন ভালোর মেডিসিন। বুক কাঁপছে, থরথর করে হাত কেঁপে উঠছে, এত ভয় কেন করছে আমার৷ অবশেষে ভয়কে জয় করতে পেরেছি, চিঠি খুলতেই লেখা– প্রিয় রুয়েল, জানি না এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবে কি না? আর যখন পৌঁছাবে তুমি নিশ্চয় ভালো থাকবে না তাই আর জিঙেস করতে সাহস হয়নি কেমন আছো? জানো, যেদিন তোমাকে নামিয়ে আসি সেদিন বৃষ্টি ছিল। সেদিন আকাশ কেন কান্না করছিল, আকাশের কেন মন খারাপ ছিল? এই উত্তর আমি জানি না। তবে মনে হয়েছিল আকাশ কেঁদেছিল আমাদের জন্য। আমরা জানতাম না কিন্তু আকাশ হয়তো জেনেছিল আমাদের আর দেখা হবে না। বৃষ্টি ভেজা রাতে তোমায় যখন নামিয়ে আসি। কী এক অজানা ভয় তাড়া করেছিল। অবচেতন মন আমার। হঠাৎ কী হয় জানি না। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হসপিটালের ব্রেডে আবিষ্কার করি। প্রতিবার শুধু তোমাকে খুঁজি, যখন বুঝতে পারলাম, না বাঁচব না! আমি তখনই এলোমেলো হাতে চিঠি লিখি। কষ্ট পেয়ো না। তোমার বনলতার মতো একজনকে খুঁজে নিয়ো৷ ভালো থেকো প্রিয়৷ আজ আর নয় আমাদের দেখা হবে পরপারে।
.
চিঠির এতটুকু পড়ে খুব জোড়ে কান্না করেছিলাম। কান্নার শব্দ সীমানা ছাড়ালেও পৌঁছেনি তার কাছে, বনলতা কি আমায় দেখতে চেয়েছিল? জানিনা আমি! আকাশপানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেছিলাম, তােমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। তুমি সিগারেট পছন্দ করতে না। বলেছিলে, যদি কখনো সিগারেটের স্বাদ নেই তাহলে তুমি হারিয়ে যাবে। শুধু আমার জীবন থেকে নয়, এই পৃথিবী থেকে। তুমি ঠিক কথা রাখলে কিন্তু আমি তোমার অগোচরে প্রতিনিয়ত সিগারেটের স্বাদ নিয়েছি। ক্ষমা করো আমায়।
.
আবার তো দেখা হচ্ছে……. বনলতাকে বলা শেষ কথাটি আজও কানে বাজছে, আবার তো দেখা হচ্ছে, অথচ কখনো দেখা হবে না। নিষ্ঠুর পৃথিবী দেখেয়েছে নিষ্ঠুরতা। অসহায়ত্ব এমন এক জিনিস যা কখনো বড়ত্ব প্রকাশ করে না শুধুই প্রকাশ করে অসহায়ত্ব। জানুয়ারি দুই তারিখ পৃথিবীতে বনলতার আগমন ঠিক একই দিনে তার পরলোকগমন। আহা নিয়তির কী নিষ্টুর দান।
.
কখনও ভাবিনি এইভাবে তার চলে যাওয়া। কোন এক রাতে হু হু করে কেঁদে উঠতাম। চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে রাতের আকাশে তাকে খুঁজতাম। মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়। কোটি তাঁরার ভিড়ে তাকে খুঁজতাম। রিভার ভিউ বেঞ্চে তাকে খুঁজতাম। ভেবে উঠতাম– আমার পড়া চিঠিটা মিথ্যে। এইতো বনলতা। বিশাল আকারে সহমহিমায় দাঁড়ানো বটবৃক্ষের ছায়াতলে তাকে খুঁজতাম। সুখের সময়গুলাে এখানেই কাটাতাম। বনলতা আমার আস্থা, বিশ্বাস আর নির্ভরতা। মানুষটি আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতায় জড়িয়ে রেখেছিল আমার ভালােবাসা। যার মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম সত্যিকারের ভালােবাসা। ভালবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কত তীব্র। তা শুধু যে হারায় সে বুঝে। এখন আর কেউ বলে না! চলো বৃষ্টিতে ভিজি, মাঝ-রাতে কেউ বলে না রাতের শহর ঘুরতে, আমি জানি সে ফিরবে না। ধরবে না এ হাত। তবু অপেক্ষায় থাকি। কিছু পাবাে না জেনেও অপেক্ষা করার মাঝে অনেক আনন্দ আছে, সেখানে অনন্ত হারানোর ভয় নেই।
.
এতটুকু বলেই, কেঁদে উঠে রুয়েল। কেঁদে উঠে মিহি। অনুভূতিরা মৃত আজ প্রমাণিত। সেদিন হারিয়েছিল বনলতা। রুয়েল জানে হারিয়ে গেছে বনলতা। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সত্যি হলো, মারা যায়নি বনলতা। সেদিন বিদায় বেলায়, মানুষটা চলে যায়। বুষ্টি ভেজা পিচ ঢালা পথে ছুটে চলে টয়োটা গাড়ি। দূর্ঘটনা ঘটার পর স্মৃতিভাণ্ডারের একটা অংশ পুরোপুরি হারিয়ে যায়। পূর্বের সকল স্মৃতি ভুলে যায়। মনে পড়েনি একসাথে হেঁটে চলা। মনে পড়েনি রিকশায় করে ঘুরা বেড়ানো৷ মনে পড়েনি নৌকায় করে নদীতে ভেসে চলা। কেউ মনে করানোর চেষ্টা করেনি। চেষ্টা করলেও হতো না। বৃথাই চলে যেতো কিছু সময়। মাঝে-মধ্যে পাগলামি করতো, এভাবেই কেটে যায় দুই সপ্তাহ। তখনি পিসির গুটির চাল। এলোমেলো হাতে চিঠি লিখে ধরিয়ে দেয় বনলতার নামে। উড়িয়ে নিয়ে আসে লন্ডনের পাত্র। সদ্য বিবাহিত বধূকে পুনরায় বধূ সাজায়। সেদিন কবুল বলা মেয়েটি সাত পাকে বাঁধা পরে। কালেমা পড়ে বিয়ে করা বধূ অগ্নি সাক্ষী রেখে চলে যায় স্বামীর ঘরে। দেরি করেনি, আকাশপথে পাড়ি জমায় লন্ডনের মাটিতে। আহা ভালোবাসা, নির্মম ভালোবাসা। রূপকথার গল্পকে হার মানানো প্রেমের ইতি কী ভয়ানক, কী ভয়াবহ, কত নির্মম।
.
রাত তখন তিনটা অতিক্রম করছে, অনুভূতিরা মৃত গল্পের পাঠক রুয়েল। মিহি তার একমাত্র শ্রোতা। ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস নেয়। যেই দীর্ঘশ্বাসে হারানোর বেদনা জ্বলজ্বল করছে, চোখে মুখে ছলছল করছে বেদনার ছাপ। হতাশায় নিমজ্জিত রুয়েল বলে উঠে, এমন ভাবে তুমি কেমন করে ছেড়ে গেলে আমায়। এতদিন তবে কেন তুমি ভালোবাসলে আমায়। নিশ্চুপ মিহি। এই মূহুর্তে তার মনে পড়ছে, লিওনার্দোর একটি কথা। পৃথিবীতে সবাইকে ভালোবাসা যায় না, আবার যাকে ভালোবাসা যায় তার দুরত্ব সহ্য করা কঠিন।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here