কহিনুর,১৪,১৫

0
638

#কহিনুর,১৪,১৫
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৪

কিছু সত্য মেনে নিতে কষ্ট হয় তবুও মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। চোখের পানির সঙ্গে ভাসিয়ে দিতে হয় দুঃখগুলোকে। কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা মানতে পারলেও তাঁকে ক্ষমা করা যায় না। জুবায়ের হঠাৎ থমকে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। এতকাল যাকে বাবা মা বলে এসেছে হঠাৎ বুঝতে পারলো সব মিথ্যা। মানতে পারছে না।অধরা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। নিরবতা কাটিয়ে অধরা মুখ খুঁলল। ভয়ে ভয়ে বলল,
> মাথা ঠান্ডা করুণ। আমিও অনাথ বাবা মা নেই। পৃথিবীতে আপনজন বলতে আপনি আর আমাদের বাচ্চাটা ছাড়া কেউ নেই। আমরা নতুন করে আমাদের পরিবার সাজাবো। পারবেন না আমাদের সঙ্গে চলতে?
জুবায়ের বহুকষ্টে বলল,
> খুব পারবো। সরি অনেক। আর মারবো না।তুমি জানো উনার সঙ্গে আমার ডিএনএ মিলেনি কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে মিলেছে। ভাইয়ের ব্লাডে কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। ও সুস্থ আছে। জানিনা সূর্যের আলোতে ওর কি সমস্যা। ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে।
অধরা জুবায়েরের হাত দুটো নিজের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল,
> আপনাদের পরিবারিক উকিলের সঙ্গে কথা বলুন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার কার নামে চেক করে ফেলুন। যা করবেন গোপনে। আমার বিশ্বাস এগুলো সব আপনার নামে। আর আরমান ফারুকী আপনার ছোট চাচা। আপনি উনার বড় ভাইয়ের ছেলে। দ্রুত ব‍‍্যাবস্থা নিন। আপনার নামে যদি কোনো সম্পদ থাকে তবে নতুন করে দলিল করুন। লিখে ফেলুন আপনার কিছু হলে সব অর্থসম্পদ মসজিদ বা সরকারি খাতে চলে যাবে।
জুবায়েরের উত্তর দিলো না। শুয়ে পড়লো। কিছু একটা ভেবে অধরাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর গালাতে মুখ ঢুবিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> ঘুমাও চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না। যতক্ষণ বেঁচে আছি তোমাদের খেয়াল রাখবো ইনশাআল্লাহ। বাচ্চাটা যেনো আমার মায়ের মতো হয় দোয়া করবে একটু? চোখের সামনে ছিল তাই গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। কেনো এমন হলো বলতে পারো?

অধরা কি বলবে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করলো। বাবা মায়ের কথাগুলো আবারও মনে পড়ছে। বছর খানিক আগেও সব ঠিক ছিল। এতো ত‍্যাগ বিসর্জন সব কহিনুরের জন্য। মেয়েটা শুভ নাকি অশুভ কিছুই ওদের জানা নেই। কহিনুরের রহস্য কিভাবে জানতে পারবে মাথায় আসছে না। দাদুর রুমটা যদি একবার চেক করা যেতো ভালো হতো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। যখন ঘুম ভাঙলো তখন নিজেকে বিছানায় একা পেলো জুবায়ের নেই। অধরা দ্রুত উঠে বসলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিক নেই। জুবায়ের ওকে না বলে বাইরে গেছে ভেবে টেনশন হচ্ছে। অধরা ফ্রেস হয়ে বাইরে যেতে গেলো তখনই জুবায়ের খাবারের ট্রে নিয়ে হাজির হলো। মুখে হাসির ঝিলিক। মন খারাপের কোনো চিহ্ন নেই। অধরা বেশ অবাক হলো ওর ব‍্যবহার দেখে। কৌতূহল চাপিয়ে রেখে বলল,
> কোথায় ছিলেন? টেনশন করছি।
জুবায়ের ওকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর সামনে খাবার নিয়ে বসে পড়লো। প্লেটে খাবার নিয়ে বলল,
> চিন্তা করে ঠিকঠাক খাওয়া হচ্ছে না। বেবীর পুষ্টির দরকার আছে। চুপচাপ খেয়ে আমার উদ্ধার করো। তোমার শশুর মশাইকে জব্দ করার হাতিয়ার পেয়ে গেছি। বিষয়টা যে আমরা জেনে গেছি আরমান ফারুকীকে বুঝতে দিলে চলবে না।
অধরা বিস্মিত হয়ে বলল,

> কি করতে চাইছেন আপনি? শুনুন ভুলভাল কাজের জন্য আপনি আগে থেকেই ফেমাস হয়ে আছেন। নতুন করে নিজের বুদ্ধিতে দুমদাম কিছু করার চেষ্টা করবেন না। আমাকে বলুন সাহায্য করবো।
> তুমি জানো এই সম্পত্তি আমার বাবা সুলতান জাফর ফারুকীর নামে ছিলো। জানিনা কি কারণে উনি সবটা আমার নামে করে দিয়েছিলেন। আমাদের পুরাতন উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে। লোকটা প্রথমে বলতে চাইনি পরে বাধ্য হয়ে বলেছে। আমি লোক দিয়ে উনার ছেলেকে উঠিয়ে এনেছিলাম। সামান্য এইটুকু কাজ, আমি এখানে বসে আধা ঘন্টার মধ্যে শেষ করেছি।
জুবায়ের ভাব নিয়ে কথাগুলো বললো। অধার চোখ কপালে। এই লোকটা যে সরলভাবে কিছুই ভাবতে জানেনা। কি দরকার ছিল কিডন‍্যাপ করার। ঝামেলার শেষ নেই। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> ছেড়ে দিয়েছেন তো? সামান্য কাজের জন্য কিডন‍্যাপ করে ফেললেন? বাচ্চা ছেলেটার যদি কিছু হয়ে যেতো?
> দূর বাচ্চা কোথায় পেলে? দেখো লুকিয়ে চুরিয়ে কয়টা বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে তার ঠিক নেই। ভীষণ দুষ্ট। যাইহোক ছেড়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম তুমি ঘুম থেকে উঠার আগেই কাজটা শেষ করবো। তথ্য জেনেছি এখন আইনি নোটিশ পাঠাবো।আরমান ফারুকী ঝটকা খাবে কেমন বলো?

> আপনার মাথা । একদম ফালতু বুদ্ধি। আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার ভাই এসে সব দখল করবে। এসব বাদ দিয়ে অন‍্য কিছু ভাবুন।

> আচ্ছা আমার নামের সব কিছু আমি যদি আমার স্ত্রী সন্তানের নামে করিয়ে দেয় তাহলে?
অধরা বিরক্ত হলো, ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনার বিপদটা আমার বাচ্চার ঘাড়ে স্থানান্তরিত করতে চাইছেন এসব হবে না।
> আরে বাবা কথা তো শেষ করতে দাও। আমি এখানে উল্লেখ করবো যতদিন আমার বাচ্চার বয়স আঠারো হবে না ততদিন এর দ্বায়ীত্ব আমার স্ত্রীর উপরে থাকবে। তারপর মেয়ের বয়স হলে ও নিজেই নিজের সবটা বুঝে নিবে। তাছাড়া আমার তো আর একটা মেয়ে হবে না। আরও হবে আমি উল্লেখ করবো আমার যতগুলো বেবী হবে সবগুলো সমানুপাতিক সম্পত্তির মালিক হবে।
অধরা চরম বিরক্ত জুবায়েরের উপরে। লোকটা মহা ফাজিল। একটা মেয়ের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে আবার আরও চাইছে। অধরা থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
> সবটা আপনি কহিনুরের নামে করে দিন। ঝামেলা মিটে যাবে। মেয়ে যতদিন পযর্ন্ত বিয়ের উপযুক্ত না হবে ততদিন পযর্ন্ত ওটা আপনি দেখাশোনা করবেন। আর যদি কোনো কারণে কহিনুরের কিছু হয়ে যায় তবে এটা সরকারি ফান্ডে চলে যাবে। একটা শব্দও আর উচ্চারণ করবেন না। বহুত বাজে কথা বলেছেন আর না।
জুবায়ের মুখটা করুন করে পকেট থেকে ফোনটা বের করে উকিলের কাছে ফোন দিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলে দিলো। দ্রুত দলিত তৈরি করতে হবে। অধরার ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। আরমান ফারুকীর বদ বুদ্ধি গুলোকে ছুটিয়ে দিবে। প্রতারণা খু*ন সব কিছুর জন্য কঠিন শাস্তির ব‍্যবস্থা করবে। হঠাৎ বাইরে থেকে শব্দ শুনে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। বাইরে কিছু একটা নিয়ে চেচামেচি হচ্ছে। অধরা খাবার শেষ করতে পারলো না। উঠে আসতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের দিলো না। ওকে বসিয়ে দিয়ে ও নিজের বেরিয়ে আসলো। গতদুদিন ধরে বাড়ির দক্ষিণ সাইডে অবস্থিত এক প্রতিবেশির কাজের মেয়েটা নিখোঁজ আছে। খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জুবায়ের বিষয়টা জেনে রুমে এসে অধরাকে বলে দিলো। অধরার কেনো জানি সন্দেহ হচ্ছে। রাতেই ভেবেছিল কেউ নিখোঁজ থাকবে আর তাঁই হলো। এই বাড়ির কেউ কালো যাদুর সঙ্গে যুক্ত আছে। বাবার ডাইরিতে লেখা ছিল কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তার মানে পরিস্কার এই বাড়ির ঐশ্বর্যের পেছনে মেয়েদের মুখের ভাষাটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমনটা হতেই পারে কিন্তু কে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত? আরমান ফারুকী নাকি উনার বাবা? অধরার মাথাটা দপদপ করে যন্ত্রণা হচ্ছে। জানালা খোঁলা ছিল বেশ ঠান্ডা বাসাত আসছে। জুবায়ের সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাইরের দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো,
> অধরা সেই লোকটা!
অধরা চমকে উঠে বিছানা থেকে নেমে আসলো। গতকাল সন্ধ্যায় কাচা মাং*স খেয়েছিল সেই লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের ওকে ছেড়ে বাইরে যেতে চাইলো কিন্তু অধরা দিলো না। ওর হাতটা খপ করে ধরে বলল,
> উনার সঙ্গে আমি কথা বলবো আপনি চুপচাপ শুনবেন। হাঙ্গামা করে সত্যি জানা মুশকিল হবে। আমি কথা বলবো আপনি শুনবেন। চলুন বারান্দা দিয়ে পেছনের গেট দিয়ে বাইরে যায়। আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
জুবায়ের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ওর হাতটা ধরে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমে ছোটখাট একটা আড্ডা বসেছে। ফুপির মেয়েগুলো কথা বলতে জানেনা কিন্তু আসর জামাতে উস্তাদ। ইশারা করছে সেটা কাজের মেয়েটা অনুবাদ করছে। অধরা এক নজর সেদিকে দেখে নিলো। দাদু আড্ডার মাঝে বসে আছে। আহা এখনই যদি দাদুর ঘরটা চেক করতে পরতো। অধরার ভাবনার চিরচ্ছেদ হলো সেই লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটা ওদেরকে মনে হচ্ছে প্রথমবার দেখেছে। বিস্মিত হচ্ছে আর সরল করে হাসছে। অধরা ভনিতা ছাড়া বলে উঠলো,
> গতকাল সন্ধ্যায় জঙ্গলে কেনো গিয়েছিলেন? কি খেয়েছিলেন উত্তর দিন?
লোকটা ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> কি বলছেন ম‍্যাম আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি গতকাল বিকেলে চলে গিয়েছিলাম এসেছি সকালে। আপনি ভূল দেখেছেন বোধহয়।
জুবায়ের জ্বলে উঠলো। মুঠো শক্ত করে লোকটার মুখ বরাবর আঘাত করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে নিলো। হাত উঠানোর আগেই অধরা ওর পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যে নিজের আঙুল চালান করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আমি কথা বলছি তো। চুপচাপ দেখুন।
> মিথ্যা বলছে কেনো? থাপ্পড় দিলে বাপ বাপ করে সব বলে দিবে। হাত ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ দেখো।
> আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। চুপ থাকতে বলেছিনা?
জুবায়ের নিভে গেলো। যতবার জ্বলে উঠে অধরা ততবার ওকে নিভিয়ে ছাড়ে। এই জন্য উকিলের বিষয়টা নিজের বুদ্ধিতে করেছে তাও অধরার অনুপস্থিতিতে। বেশ করেছে কাজটা। আধর ওকে এক পলক দেখে নিয়ে সামানের লোকটাকে বলল,
> সমস্যা নেই আসলে দূর থেকে ভালো দেখতে পারিনি। মনের ভূল ছিল তাই আপনাকে বিরক্ত করেছি। আপনি এবার আসুন।
লোকটা মনে হলো হাপ ছেড়ে বাঁচলো।দ্রুত চলে গেলো।অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে আছে। জুবায়ের বিস্মিত হয়ে বলল,
> ছেড়ে দিলে? ওরে তো আমি দেখছি। এমন পিটাবো না সারা জীবনের জন্য মিথ্যা ভূলে যাবে। ওর জন্য আমি অজ্ঞান ছিলাম। বউয়ের খোঁটা শুনেছি।

অধরা ওর কথার পাত্তা দিলো না। চাপা কন্ঠে বলল,

> ওই নর খাদকটা স্বাভাবিক মানুষ কিছুতেই ছিল না। আপনি কি জানেন এই বাড়িতে নর বলি হয়? অসংখ্য নরখাদক আপনাদের বাড়িতে বসবাস করছে এটা কি মানেন? জুবায়ের আয়াতকে বাড়ি পাঠানোর ব‍্যবস্থা করুন,সেটা এখুনি। দ্রুত করবেন।

জুবায়েরের কপালে চিন্তার রেখা। বুঝতে পারলো না ওর কথাগুলো। দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। কি সাংঘাতিক কথাবার্তা বলছে মেয়েটা। ও কোনরকম নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> কি বলছো তোমার মাথা ঠিক আছে?
> একদম ঠিক আছে। আপনাদের বাড়ির কেউ একজন কালো যাদু বা শয়তানের উপাসনা করে। গতকাল যে খু*লিটা দেখেছিলাম ওটা পাশের বাড়ির ওই মেয়েটার। খু*লি নিয়ে লা*শটা এই নরখাদকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রমাণ থাকে না।
> এসব করে কিসের লাভ? বুঝিয়ে বলো।
> এখন সময় নেই। পরে আপনাকে বলো। এখন আপনি আয়াতের জন্য গাড়ি নিয়ে আসুন। লোকদিয়ে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। এক মিনিট নষ্ট মানে ওর জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি হবে।
জুবায়ের সব কৌতূহল দমিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলো। আয়াত কিছুতেই এই বাড়ি থেকে যেতে চাইছে না কিন্তু অধরা শুনলো না। এটা ওটা বুঝিয়ে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। ছেলেটার জন্য ওর দম বন্ধ লাগছিল। এই মৃত্যু পুরীতে থাকা মানে বিষাক্ত জীবন পার করা। জুবায়েরের দাদু বেশ কষ্ট পেয়েছেন ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেওয়াতে। উনি অধরাকে নিজের রুমে ডেকে নিলেন। অধরা প্রথমবার দাদুর রুমে প্রবেশ করলো। জুবায়ের আসতে চেয়েছিল কিন্তু অধরা ওকে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে সময় কম। দরজায় পা রাখতেই ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠে আওয়াজ আসলো,
> কোথায় ছিলে দাদুভাই? সারাদিন খোঁজ পাচ্ছি না। এই বুড়ো মানুষটা সারাদিন তোমাকে প্রচণ্ড মিস করেছে এটা কি তুমি জানো?
অধরা ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে চনচল হয়ে উঠলো। ভেতরে গিয়ে একদম দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> দাদু জানেন তো আমার অবস্থা!শরীর হঠাৎ হঠাৎ খারাপ হচ্ছে, ঘুম পাচ্ছে।
> তা বটে এই সময়ে এরকম একটু হয়ে থাকে। তুমি চিন্তা করোনা। তোমার পেটে আমাদের সুলতান পরিবারের বিশেষ একজন অতিথি সে। তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা সবাই দোয়া করছি।
> আপনারা ছাড়া কে আছে আমার? বাবা মা পরিবার পরিজন কেউ নেই।
> দুঃখ করো না বাবা মা কারো চিরকাল থাকে না। যেই ছেলেটা এসেছিল ওকে কিছুদিন কাছে রাখতে পারতে। ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে ঠিক করোনি। শুনেছি এক সঙ্গে বড় হয়েছো। কাছে থাকলে তোমার ভালো লাগতো।
অধরা থমকে গেলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ত্রুটি করলো না। ঢোক গিলে বলল,
> আন্টি অসুস্থ ওকে দরকার ছিল বাড়িতে। কয়েকদিন পরে আবারও আসবে।
ভদ্রলোক বিশ্বাস করলো কি ঠিক বোঝা গেলো না। বিছানা থেকে নেমে আলমারির কাছে গিয়ে একটা লাল পুটলি বের করলো। যেটা খুঁলে ভেতর থেকে একটা পুরাতন ডাইরি নিয়ে অধরার সামনে ধরলেন। আর চাপা কন্ঠে বললেন,
> এই ডাইরীটা তোমার। পড়ে আমাকে ফেরত দিবে। এখানে আমাদের বংশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।

অধরা আগ্রহ নিয়ে ডাইরিটা দ্রুত নিজের হস্তগত করলো। মনে হলো এখুনি না নিলে আর পাবে না। ওর অস্থিরতা দেখে দাদু মৃদু হাসলো। বলল,
> এটা পড়লে তোমার সব কৌতূহল আশাকরি মিটে যাবে।
অধরা ডাইরীর উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। উপরে বেশ গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে “কোহিনুর”। ভেতরে কি লেখা আছে কে জানে। অধরা দাদুর চোখে দৃষ্টি রেখে বলল,
> কক্ষে নিয়ে যেতে চাই, দিবেন?
> নিশ্চয়ই, তবে কাউকে দেখাতে পারবে না। নিয়ে যাও সকাল হলে ফেরত দিতে হবে।
অধরা সম্মতি জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসলো। কি আছে এই ডাইরীতে?
(চলবে)

#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫

পথিব সকল পাপের মূল হচ্ছে লোভ। ভালো থাকার লোভে মানুষ কতকিছু করে। খারাপ কাজ করতেও পিছপা হয়না। আমি সুলতান রশীদ ফারুকীর একমাত্র পুত্র সুলতান ফারাবি ফারুকী। আমি বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান যদিও আমার আরেকটা বোন আছে। আমার বাবা বেশ প্রভাবশালী জমিদার ।।উত্তরাধিকারসূত্রে আমি বাবার সকল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ। বোনের জন্য ছিল কিছু নগদ অর্থ আর বক্স বন্ধি স্বর্ণালঙ্কার। এটা নিয়ে বোন বা আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এটাইযে নিয়ম।।আমার বোন আঞ্জুমান ফারুকী যেনো আসমান থেকে নেমে আসা এক টুকরো চাঁদের কণা। প্রণাধিক প্রিয় ছিল আমার ভগ্নি। জলন্ত আগ্নি পিণ্ডের মতো ঝাঝালো ছিল ওর সৌন্দর্য। কন্ঠ ছিল ততধিক মধুর। আমাদের দু’ভাইবো মানুষ হয়েছিলাম কাজের মহিলা রহিমা খালার কাছে। আম্মা বহুকাল ইহজগৎ ছেড়েছেন। বাবা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আর দ্বিতীয় বিবাহের ঝামেলায় যাননি। ধীরে ধীরে আমরা দু’ভাইবোন বড় হলাম। বোনটা আমার থেকে বেশ ছোট। পরিণত বয়সের আগেই হঠাৎ বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন উনার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। বাবার কথা আগ্রহ করার ক্ষমতা কোনকালেই আমার ছিল না। তাছাড়া বিয়ে করবো না বলার মাতো তেমন কোনো কারণও তখন হয়ে উঠেনি। নতুন বধূকে পেয়ে খুব একটা মন খারাপ হয়নি। লাজুক ভঙ্গিতে নব বধূকে বরণ করে নিয়েছিলাম নিজের বক্ষপিঞ্জরে। বেশ ভালোভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল। সারাক্ষণ বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা সহসা দক্ষিণা দোলা দিতো হৃদয়ে।কিন্তু ভালো মূহুর্তগুলো চোখের নিমিষে পার হয়ে যায়। বাবা অসুস্থ হলেন,তাঁর জমিদারির ভার আমার উপরে এসে পড়লো। বিয়ের বছর খানিক হয়নি তখনও। খাজনা আদায় করতে আমাকে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে যাওয়া আসা লাগতে থাকলো। আমি দক্ষ হাতে সবটা সামলাতে থাকলাম। বাবা ভরসাস্থল পেয়ে সুস্থ হয়েও আর কাজকর্ম করলেন না। ছেড়ে দিলেন আমার হাতে। আমি একজন দক্ষ জমিদার বনে গেছি। কোন এক গ্রীষ্মকালের সকালবেলায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম দূরের এক গঞ্জে। কয়েকদিনের সফর। সঙ্গে নিয়েছি লাঠিয়াল বাহিনী পালকী আর আমার একমাত্র বিশ্বস্ত কর্মচারী জাফরুল্লাহ শেখরকে। লোকটা আমার নায়েবের কাজ করতো। একদম খাস কর্মচারী যাকে বলে। যখন যা বলেছি প্রশ্ন ছাড়া হাজির করেছে। এমন ছেলেকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান ছিলাম। যাইহোক টানা একদিন চলল আমাদের পালকী। রাতে তাবু ভিড়িয়ে নিলাম একটা পদ্ম দিঘি সামনে রেখে। যদিও সামান্য দুরুত্ব ছিল তবুও অসুবিধা কিছু হতো না। গ্রামের প্রথমেই পুকুরটা পড়েছে। ভাবলাম পানির অসুবিধা থেকে বাঁচতে এটাই আমাদের উপযুক্ত স্থান। সেদিন রাতটা বেশ ভালোভাবে পার করলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি লাঠিয়াল বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলাম গঞ্জের হাট থেকে খাবার কিনে আনতে। চাল ডাল এনে ওরা রান্না বসিয়ে দিলো। আমি তাবুতে থেকে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। জানিনা কিসের এত ছটফটানি। কোন সর্বনাশের ঈঙ্গিত। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম পুকুরের কিনারে। হঠাৎ পানির ঝপঝপ তরঙ্গে আমার দৃষ্টি সেদিকে পতিত হলো। ক্ষণিকের জন্য আমি থমকে গেলাম। দৃষ্টি স্থির হলো। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো হুর পদ্ম দীঘির পানিতে নেমে এসেছে। আমি দিসা হারা পথিকের ন‍্যায় এলোমেলো পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে চললাম। হৃদয় পুলকীত হলো মেয়ের রূপের বাহার দেখে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় মেয়েটার সম্মুখীন গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেয়েটা ততক্ষণে কন্ঠ অবধি পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ভেজা কাপড় আর দীর্ঘ কেশ পল্লব গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অবশিষ্ট পোশাক পানিতে ভাসমান। মেয়েটা দু’হাতে শরীর ঢাকায় চেষ্টা করছে কিন্তু ব‍্যার্থ। দীঘির স্বচ্ছ কাচের ন‍্যায় পানিতে আমি ওর ঠিকরে পড়া রূপের যাদুতে ঘায়েল । মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠস্বরে আমার ধ‍্যান ভাঙলো,
> কে আপনি? এখানে কোন সাহসে এসেছেন? জানেন না এই পুকুরের আশেপাশে পুরুষের আসা নিষেধ?
মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আমি ফিচেল হাসলাম। জমিদার ফারাবি ফারুকীকে আটকাবে এমন সাহস এই এলাকায় কার আছে? আমি জমিদার পুত্র নিজের সয়ং জমিদার। যা আমার পছন্দ যা আমি নিতে আগ্রহী সেটা শুধুই আমার। আমি উপলব্দি করলাম দীঘির পানিতে অবস্থান করা ওই জলপরি শুধু আমার সম্পত্তি। শুধুই আমার। ঘরে যে স্ত্রী আছে সেটা বেমালুম ভূলে গিয়ে এই রূপসীর প্রেমে আমি হাবুডুবু খেলাম। মনে হলো আমি মদ্যপান করেছি। এতো নেশা আগে কখনও বুঝিনি। একেই বলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমার সমস্ত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের মেয়েটাকে বলে উঠলাম
> এহেন সময়ে তুমি দীঘিতে গোসল করছো মেয়ে? যদি পুরুষেরা আসে তখন? সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? একঘরে করবে যে লোকে!
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা ভড়কে গেলো। নেত্র পল্লবে নেমে আসলো অশ্রুকণা। দীঘির পানিতে তা মিলেমিশে একাকার। আমি হাসলাম। এটাইতো চেয়েছিলাম আমি। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের বাইরে গোসল করা তো দূর লেখাপড়া করার নিয়ম পযর্ন্ত নেই। উচ্চবিত্তরা খুব সখের বসে বাড়িতে মাস্টার রেখে শেখাতে পারে তবে সেটা খুব সৌখিন। বাংলা উপ‍্যাস বা গল্প আর আরবি জানতে পারলেই সে উচ্চতর শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের বাজারে এহেন মেয়ের দাম নেই বললেই চলে। মেয়েরা হবে পানির মতো স্বচ্ছ আর তরল । যেখানে রাখবে তেমনি চলতে হবে। যথেষ্ট কারণ আর পর্দা নিয়ে বাইরে যাওয়ায় যায়। কিন্তু এই মেয়েটা এত বাধা নিষেধ অবজ্ঞা করে কিভাবে দীঘিতে নেমেছে বুঝলাম না। কৌতূহল দমিয়ে রেখে বললাম,
> আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি চলে যাবো। তোমার বলার উপরে নির্ভর করছে আমার যাওয়াটা। যদি ঝটপট না বলো তাহলে এখুনি আমি লোকজন ডেকে তোমাকে দেখাবো।
মেয়েটা চরম ভয়ে মুখটা কুকড়ে ফেলেছে। মেয়েটার মুখ দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। ওই নেত্রের জ্বল শুধু আমার কারণে ঝরবে আর আমার কারণেই বিলুপ্ত হবে। মেয়েটা আমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য। আমি দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই মেয়েটা উত্তর দিলো,
> জ্বী বলুন?
আমি বাঁকা হেসে জিঞ্জাসা করলাম,
> নাম কি তোমার?
> চন্দ্রিমা প্রিয়জনেরা সবাই চন্দ্র বলেই ডাকে।
> বাবার নাম? এই গায়ের কার মেয়ে তুমি?
> আমার বাবা ফকির নিজাম উদ্দিন শেখ। উনি ফকির সন‍্যাসী মানুষ।
মেয়েটার কথা শুনে আমার হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো। সামান্য নিজাম শেখকে হাতের মুঠোয় নিতে আমার তো বাম হাতের খেল। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। উঠে আসার সময় বললাম,
> চন্দ্র তুমি আর কখনও খোলা দীঘির পানিতে ভিজতে আসবে না। তোমার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।আমার চোখ ঝলসে গেছে তাঁর দায়ভার কে নিবে চন্দ্র? বাড়িতে যাও।
কথাটা বলে আমি পিছনে ফিরলাম না। দ্রুতগতিতে ফিরে এলাম নিজের তাবুতে। নায়েবকে ডেকে নিজের সর্বনাশের কাহিনি বর্ণনা করে বলে দিলাম, পদ্ম দীঘির পানিতে থাকা ওই ভেজা পদ্মটিকে আমার চাই। যেভাবেই হোক ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাও। আমার কথা আগ্রহ করার সাধ‍্য ছিল না। প্রস্তাব নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লো নায়েব। চন্দ্রের বাবা ফকির সন‍্যাসী মানুষ জমিদারের পুত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস ছিল না। গ্রহণ করে নিলেন। আমি পেয়ে গেলাম আমার হৃদয় পটভূমিতে বাসা বাঁধা নতুন পুষ্পকে। সেরাতে আমাদের বিয়ে হলো। ভোরবেলা চন্দ্র কে নিয়ে ফিরলাম কিন্তু ওকে নিজের বাস ভূমিতে তুলতে পারলাম না। জমিদার হওয়ার সুবাদে আমাদের বেশ কিছু মহল ছিল। আমার পছন্দসই এক মহলে ওকে নিয়ে উঠলাম। লাঠিয়াল বাহিনী আর নায়েব কে কঠোর ভাবে নিষেধ করলাম বাড়িতে গিয়ে পাঁচকান না করতে। আমি মেতে উঠলাম চন্দ্রকে নিয়ে। আমার হৃদয় বক্ষের রাণী। যাকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভূলে যায়। প্রথম স্ত্রীর কন্দনরত পত্র বাবার আদেশ অবজ্ঞা করে আমি পড়ে থাকলাম চন্দ্রের কাছে। ওর রূপের যাদুতে ঝলসে তখন আমি দিসাহারা। তবে অনুধাবন করলাম এভাবে আর কতদিন? চন্দ্রের জন্য হলেও জমিদারিটা ধরতে হবে। ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ওকে রেখে ফিরে এলাম প্রথম স্ত্রীর কাছে। মেয়েটার হাসিখুশি মুখটা ততদিনে মলিন হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমাকে একান্তে পেয়েই লজ্জায় নেত্রদ্বয় বন্ধ করে শুনিয়ে দিলো আমাদের জমিদারিতে নতুন বংশধর আসতে চলেছে। কথাটা আমার কাছে কি যে বিষাদের ছিল সেটা যদি লিখে বোঝাতে পারতাম।আমার চোখের আগুনে মনে হলো সে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। পায়ে ঠেলে বেরিয়ে আসলাম অনাগত সন্তানের মাকে। আমার চন্দ্র ছাড়া এমন অধিকার কারো হতে পারে মানতে পারলাম না। চলে এলাম চন্দ্রের কাছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলো। বাবা আর বোনের দীর্ঘ পত্রের ঘনঘটা লেগেই থাকলো। বোনের পত্রের প্রতিটা লাইন জুড়ে ছিল তাঁর ভাবিমায়ের বিষাদঘন চোখের পানির বর্ণনা। সেসব আমার হৃদয় কুঞ্জে কোনো চিহ্ন আঁকতে পারেনি। সুখের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে আমি চন্দ্র বিলাসে মেতে থাকি। চমৎকার মেয়ে ছিল চন্দ্র। সর্বদা সে আমাকে নতুন নতুন রূপে চমকে দিতো। আমি থমকে যেতাম। কিন্তু অচিরেই আমার সমস্ত সুখের অবসান ঘটিয়ে বাবা জেনে গেলেন সবটা। এসব কথা যে ঝড়ো হওয়ায় আগুনের ফুলকির মতো উড়ে বেড়ায়। ধামাচাপা দিতে পারলাম না। বাবা ছিলেন শক্ত ধাচের মানুষ। শক্ত হাতে জমিদারি সামলেছে। উনি পত্র আর লোক পাঠালেন আমার দুয়ারে। হুমকি দিলেন চন্দ্রকে ত‍্যাগ দিয়ে ফিরে যেতে। নয়তো চন্দ্রের ক্ষতি করতে উনি দু’বার ভাববেন না। আমি থমকে গেলাম। বাবা এক কথার মানুষ। যা ইচ্ছা করে বসবে। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি চন্দ্রেকে আমার প্রথম স্ত্রীর কথা বলে দিলাম। চন্দ্র বিচক্ষণ মানুষ দক্ষ হাতে আমাকে সামলে নিলো। আমাকে বোঝালো। আমি চন্দ্রের জয় জয়কার করলাম। আহা এমন স্ত্রী পেয়ে আমি ধন‍্য। কিন্তু বাবাকে কি বলে বোঝাই? সেদিন রাতে চন্দ্রের কোলে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে চন্দ্র বিলাস করছিলাম। মনে শতশত ভয় আর অশান্তি দানা বেঁধেছে। সেই মূহুর্তে চন্দ্র আমাকে বলে বসলো,
> আমি জানতাম আপনি সেদিন সেই দীঘির পাড়ে আপনি আসবেন। আপনার হৃদয় বক্ষের এইখানটাতে হাত রাখার অধিকার দিবেন।
আমি চমকে উঠে জিঞ্জাসা করলাম,
> চন্দ্র হেয়ালি করো না। বুঝিয়ে বলো।
> আপনাকে দেখেছিলাম মোড়লের কাচারীতে কোনো একদিন। আমি থমকে গিয়েছিলাম। এমন সুদর্শন যুবককে পাওয়ার লোভ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাহস করা যে বড্ড অন‍্যায়। কি করবো মাথায় কিছু আসছিল না। বাবা সন‍্যাসী মানুষ নানারকম বই আর মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। কাকতলীয় ভাবে একটা বই আমার হাতে আসলো। আমি বইটা পড়তে শুরু করলাম। খুব আর্কষণ করেছিল বইটা আমাকে। কালো যাদুর বইটা। আমি শুরু করলাম সাধনা করা। বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু যখন শেষের পথে সেই সময়ে একজন লোক আমার নিকট উপস্থিত হলেন। জানিনা সে কে?কোনো মানুষ নাকি জ্বীন বা শয়তান! আমাকে একটা পাথর দিয়ে বললেন এই পাথর কোনো সাধারণ পাথর না। এর থেকে যা ইচ্ছা তাই পাওয়া যাবে। তবে এটার বিনিময়ে কিছু খোয়াতে হবে। এই পাথরের গুণে আমি আপনার উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছিলাম। চাইতে হলো না কিছুই। উনি আরও বলেছিলেন পাথরের অভিশাপ কাটাতে হলে পাথর মানবির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সব কিছুই ধবংস হয় তেমনি এই পাথরও হবে। তখন জন্ম নিবেন সে।।আমি এখন অবধি কিছুই চাইনি। আপনি চাইতে পারেন। সব বিপদ কেটে যাবে।
চন্দ্রের কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদম্য কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে নিয়ে আসতে বললাম পাথরটা। ও নিয়ে আসলো। চেয়ে বসলাম নিজের যত ইচ্ছে চাওয়া পাওয়া ছিল। চন্দ্র আমার হাতে একটা কাগজ তুলে ধরলো। সেখানে লেখা ছিল আমার সকল চাওয়ার বিনিময়ে খোয়াতে হবে আমার বংশের সকল মেয়েদের কন্ঠের ভাষা। বছরের পর বছর জন্ম নিবে অপরূপা সুন্দরী কন‍্যা। তাদের রূপে ঝলসে যাবে যেকোনো যুবকের হৃদয় কিন্তু তাঁরা হবে বোবা বধির। কোনো যুবক ইচ্ছা করলেই তাদেরকে নিজের আয়ত্বে নিতে পারবে না। মানব নিষিদ্ধ মানবী হবে তাঁরা। আমি রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু হবে না।

কিন্তু কাকতলীয়ভাবে পরদিন বাবা আসলেন আমার দুয়ারে। আমাকে আর চন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে। প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় খবরগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে ইহ জগতের মায়া ত‍্যাগ করেছে। জন্ম নিয়েছে এক ছেলে। আমি প্রাণাধিক প্রিয় বোনটা হঠাৎ বাক শক্তি হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। তাঁর মুখের মিষ্টি কন্ঠে ভাইজান ডাকটা শোনার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু চন্দ্র ছিল স্বাভাবিক। কি সর্বনাশীনির মোহ মায়ায় জড়িয়ে আমি নিজের ক্ষতি করেছি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বাড়িতে ফিরে ছুটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরলাম। স্ত্রীর মুখটা দেখার সৌভাগ্য হলো না। বেচারী স্বামীর দেওয়া লাঞ্ছনা গঞ্জনা হৃদয়ে ধারণ করে পথিব মায়া ত‍্যাগ করেছে। কি যে কষ্ট হলো। হারিয়ে যাওয়ার পরেই আমি সেই রত্নের মূল্য বুঝতে পারলাম।। চন্দ্রকে দেখলেই তা হুড়মুড় করে বাড়তে থাকলো। বোনটা চুপসে গেছে।একদিন আত্মহত্যা করে বসলো। আমি চন্দ্রকে তাড়িয়ে দিতে পারিনি কারণ ততদিনে সুলতান বংশের অনাগত বংশধরের মা সে। দিন যেতে লাগলো আমার মধ্যে তিক্ততা বাড়লো। ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। জন্ম নিলো আমার দুই রাজকন্যা। খুশী হওয়ার বদলে আমি হতাশ হলাম। ওদের কন্ঠ যে আমি জন্মের আগেই কেড়ে নিয়েছি। সহ‍্য করতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমার পাপের শাস্তি পাওয়া উচিৎ। ভেঙে পড়া মন আর শরীর নিয়ে আমি এই পথিব জগতে থাকতে চাইনা। পাথরটা গহিন অরণ্যে সমাধিত করলাম। দরকার নেই ওই সর্বনাশিনী পথর আর চন্দ্রের মতো মেয়েকে। ও আমার কাছে বিষাক্ত। কত বছর এভাবে সকলের অভিশাপ কুড়াতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানেন।

অধরা এই পযর্ন্ত এসে থামলো। ডাইরীতে লোকটার লেখা শেষ হয়েছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাতে জুবায়েরের দাদুর লেখা। উনার বাবা সুইসাইড করেছিলেন। ডাইরীটা উনার সেই চন্দ্র মায়ের থেকে প্রাপ্ত ছিল। জুবায়েরের বাবারা দুই ভাই জমজ। দেখতে হুবহু এক। জমিদারদের আমল ছিল না তবে বেশ জমিজমা অর্থসম্পদ ছিল সুলতানদের কাছে। জুবায়েরের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন অন‍্যটা ছিল বেয়াড়া। জুবায়েরের বাবা জার্মানিতে এসেছিলেন যুবক বয়সে। এখানে এসে ব‍্যবসা করতে শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে ভালো উন্নতি করেন। বিয়ে করেন। আরেকজন তখন বুদ্ধি করতে থাকে কিভাবে ভাইকে সরিয়ে নিজে দখল নিবেন। তাছাড়া উনার ঘরে তখন জন্ম নিয়েছে দু জোড়া বোবা বধির কন‍্যা। সুলতান বংশের অভিশাপ আর অর্থের লোভেই উনি কালো যাদুর বইটা নিয়েছিলেন।। ডাইরীতে উল্লেখ নেই উনি কালো যাদু শুরু করেছেন। এটা খুঁজে নিতে হবে। হয়তো উনি এসব করে অধরার সম্পর্কে জেনেছেন। ।অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল ডাইরী পড়ে। মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প পড়লত। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। জুবায়ের এখনো ফিরে আসেনি। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। অধরার ধ‍্যান ভাঙলো জুবায়েরের আগমনে। ছেলেটার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে ধাঁরালো খঞ্জর। লোকটা ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অধরার সারা শরীর বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। মনে হলো এখনো বুঝি জুবায়ের খঞ্জরটা নিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here