কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২

0
963

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন

চৌধুরী বাড়িতে মিটিং বসেছে জমির মাহমুদের পাঠানো প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। অধরা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত প্রায় অর্ধেকেই বিয়ের পক্ষে কথা বলছে। বোবা বধির মেয়ের জন্য নাকি এর চাইতে ভালো প্রস্তাব পাওয়া যাবে না। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> এই বিয়ে হবে না। নূরের বাবার অনুপস্থিতিতে আমি পারবো না ওর বিয়ের কথা ভাবতে। তাছাড়া আমার মেয়ে এতটা ফেলনা না। ওর পরিচয় জানলে তোমাদের মুখের ভাষা হারিয়ে যাবে। কিভাবে বললে এই ছেলে আমার মেয়ের জন্য উপযুক্ত? তাছাড়া মেয়েটা এখনো বাচ্চা। ওর বিয়ের কথা ভাবতে আমি রাজি না। ওর ফুপিদের বিয়ে পঁচিশ পেরিয়ে গিয়েও হয়নি সেখানে ওরতো পনেরো পেরিয়েছে মাত্র।

অধরার কথা শুনে ডালিয়া হক বিরক্ত হলেন। শশুর বাড়ির কোনো কথা মেয়েটা আজ অবধি খোলোসা করে কিছু বলেনি। এখন এসব বলে মেয়ের বিয়েতে বাঁধা দিচ্ছে। উনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না ফোস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন,
> বিয়ের কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। ছেলেকে একবার সামনে থেকে দেখো যদি অপছন্দ হয় তখন ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। আমি চাইছি ওরা এই বাড়িতে আসুক। মেয়ের বিয়ের পরে আমি তোর জন্যও ছেলে দেখবো। এভাবে আর কতদিন।
ডালিয়া হকের কথা শুনে অধরা চরম বিরক্ত হলো। ইচ্ছা হলো চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলতে কিন্তু পারলো না। এই লোকগুলো বিপদের সময় ওকে আশ্রয় দিয়েছিল। অধরা প্রতিবাদ করতে পারলো না তবুও চোখ বন্ধ করে বলল,
> মনিমা বিয়ে ছাড়া কি মানুষ বাঁচে না? আমি বা আমার মেয়ে যদি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে উঠি তবে আমি ওকে নিয়ে কোথাও চলে যাবো। কৃতজ্ঞ আমি তোমাদের উপরে তাই বলে এমন কিছু করার জন্য আমি আপোষ করতে পারবো না। তোমরা জানো না আমি কতটা যন্ত্রণা নিয়ে পাহাড় সমান ভালোবাসাকে পদলিত করে মেয়ের জীবন বাঁচাতে আমি এই দেশে পা রেখেছিলাম। তাছাড়া ওর বিয়ে আমার হাতে নেই। সবটা ওর নিয়তির উপরে নির্ভর করছে। আশাকরি সকলে বুঝবে আমার কথা।
অধরার চোখ থেকে পানি ঝরছে। তিক্ততাই ভরে উঠছে মন। জুবায়েরকে ভূলে যাওয়া আদো কি সম্ভব? কখনও না। জুবায়ের ফারুকীকে ভূলে যাওয়ার মতো ক্ষমতা অধরার নেই। লোকটার রাগ,ভালোবাসা আর রেগে গিয়ে বোকা বোকা কাজকর্মগুলোকে অধরা প্রচণ্ড ভালোবাসে। ভীষণ রকম মিস করে। মনে হলো পি*শা*চরা ওকে মানুষের রূপ নিয়ে কষ্ট দিতে এসব করছে। অধরা কথা শেষ করে কারো জন্য অপেক্ষা করলো না দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো।
ও চলে যেতেই সকলে থমথমে মুখ নিয়ে বসে থাকলো। অধরা কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছাড়তে চাইছে কারো হজম হচ্ছে না। চৌধুরী সাহেব গম্ভীর মুখ নিয়ে ছোট ছেলে লুতফর চৌধুরীকে বললেন,
> জমির মাহমুদ লোকটা সুবিধার না। স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবেনা। বিয়েটা হলে ওরা সুলতান রিসোর্ট দখল নিবে আমি সিউর। তুমি সোজাসুজি না বলে দিবে।
> কিন্তু বাবা ছেলেটাকে আমি দেখেছি বেশ সুদর্শন। এমন ছেলে হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে?
লুতফুর চৌধুরীর দুমেয়েই রেগে আগুন বাবার কথা শুনে। কহিনুর এইটুকু একটা মেয়ে তার আবার বিয়ে,কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া মেয়েটা একদম নরমাল না। বাইরের কোরো সামনে আজ অবধি গিয়েছে বলে মনে হয়না। এই বাড়ির নিদ্দিষ্ট একটা কক্ষে সে গৃহ বন্ধী। মা ছাড়া যার দিন চলে না। মিষ্টি ঠোঁট উল্টে বলল,
> বাবা শুধু চেহারার সৌন্দর্য তোমার চোখে পড়লো এটা দেখলে না ওরা কতটা অহংকারী? ছেলেকে আমি চিনি ওর কাজিন দুদিন আগে রহস্যজনকভাবে মা*র্ডা*র হয়েছে। ওর মৃ*ত মা ছেলের অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে নিজের হাতে ছেলেকে শাস্তি দিয়ে গেছে। বুঝতে পারছো কেমন খারাপ ওরা?
মিষ্টির কন্ঠ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে। আশেপাশের সকলেই বিষয়টা জানে তবে মিষ্টি যেভাবে বলেছে এভাবে না। অনুমান করা হচ্ছে খু*নী নিজেকে আড়াল করতে এসব করেছে নয়তো ছেলেটা স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। লা*সের হৃৎপিণ্ড ভয়ানকভাবে পচে গিয়ে ভেতরে ছড়িয়ে ছিল। এটা ওর মৃত্যুর আগেই নষ্ট ছিল। ছেলেটা হয়তো জানতো তাই মৃত্যুর আগে নিজেই এসব করেছে। দ্বিতীয় যুক্তিটা পুলিশ বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে। সন্দেহের বসে তো আর ভালো মানুষকে তুলে আনতে পারবে না। কিন্তু মিষ্টি নিজের রাগ থেকে উল্টোপাল্টা বকছে। ওর বড়বোন মৌসুমী আর ফুপির ছেলে রিয়াদ পাশে বসে ছিল। বোনের কথা শুনে দুজন শব্দ করে হেসে ফেলল। রিয়াদ বলল,
> দারুণ বুদ্ধি কিন্তু আমাদের মিষ্টির। কি সুন্দর খু*নীকে ধরে ফেলল। যাইহোক আমি আসছি। কহিনুরের বিয়ে নিয়ে কাউকে আর ভাবতে হবে না। এতবড় একটা বাড়িতে আমরা এতগুলো ভাইবোনেরা আছি সারাজীবন ওকে দেখাশোনা করবো। এতো সুন্দর একটা পুতুলের ভাই হতে পেরে আমি গর্ভবোধ করি।
রিয়াদ কথা শেষ করে উঠে গেলো। মৌসুমী আর মিষ্টিরও একই মতামত। তবে ডালিয়া হকের পছন্দ হলো না। উনি অধরাকে নিয়ে ভাবেন। কহিনুরের জন্য মেয়েটার জীবন নষ্ট হচ্ছে। কিবা বয়স অধরার। এই বয়সে সে সাদা পোশাক করে চোখের সামনে ঘুরছে। আজ অবধি রঙিন পোশাকের ছিটেফোঁটাও পরতে দেখেনি। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায়না। উনি বিষয়টা ভেবে থমথমে মুখ নিয়ে উঠে গেলেন। সেদিনের জন্য মিটিং শেষ হলো। লুতফুর চৌধুরী ঘরে গিয়ে জমির মাহমুদকে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। বলে দিলেন মেয়ের বয়স কম বিয়ে নিয়ে ভাবছেন না। উনি খুব বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু লুতফুর চৌধুরী শুনলেন না। ফোন কেটে দিলেন মুখের সামনে।
******
থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে জমির মাহমুদ। মেজাজ খারাপ সেই সঙ্গে আক্রোশে ভেতরে ভেতরে ফেঁটে পড়ছেন। ছেলের বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে উনি সিউর ছিলেন ওরা না বলবে না। বোবা মেয়ের জন্য এমন ছেলে পেয়ে ওরা লুফে নিবে ভেবেছিলেন কিন্তু উনার সব ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে। কিসের এতো অহংকার অধরা ম্যাডামের জানা নেই। সুযোগ পেলে উনি এই মহিলাকে চরম শিক্ষা দিবেন। সামনে আহির মাহমুদ বাবার মুখের দিয়ে তাকিয়ে বসে আছে। বাবার ভাব ভঙ্গি ওর কেমন জানি লাগছে তাই প্রশ্ন করলো,
> সমস্যা কি বলবে?
> ওরা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করছে রিসোর্ট গুড়িয়ে দিয়ে আসি কিন্তু তা সম্ভব না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
আহির বাবার কথা শুনে অবাক হলো সেই সঙ্গে মনের মধ্যে অপমানবোধ জাগ্রত হলো। বোবা বধির মেয়ের জন্য কি ওরা রাজপুত্র ধরে আনবে? খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। আহির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> বাবা আমাদের রিসোর্টের পার্টির জন্য কি ওদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছো? না জানালে আমি যেতাম আজ। বিয়ে টিয়ে এসব ছাড়ো। আমি দেখতে চাই ওদের মেয়ে কোন সে বিশ্ব সুন্দরী।

জমির মাহমুদ নড়েচড়ে বসলেন। উনি ছেলের দিকে মনযোগ সহকারে তাকিয়ে বললেন,
> যেতে পারো কিন্তু দেখতে পারবে বলে মনে হয় না। নেহাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো। মিষ্টির সঙ্গে ওর ভালো ভাব আছে। ও যদি পারে সুযোগ করে দিতে।
নেহা আহিরের ছোট বোন। মিষ্টির সহপাঠি। তেমন বন্ধুত্ব না থাকলেও খারাপ না। মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। আহির সিদ্ধান্ত নিলো নেহাকে নিয়েই যাবে চৌধুরী বাড়িতে।
*****
কহিনুরের হালকা বাদামি রঙের চুলগুলোতে চিরুনি বুলিয়ে দিয়ে থামলো অধরা। মেয়েটা চেহারা ঠিক ফুপিদের মতো হয়েছে। ফর্সা গায়ের রঙের সঙ্গে হালকা বাদামি চুল। চোখের রঙ পযর্ন্ত বাদামি। মেয়েটাকে দেখতে কেমন বিদেশি বিদেশি লাগে এটা অধরার পছন্দ হচ্ছে না। মেয়ের চুলগুলোতে ও কালো রঙ ধরিয়ে দিবে বলে ভেবে নিয়েছে। মিষ্টি কঠোরভাবে নিষেধ করেছে কহিনুরের চুলে হাত না লাগাতে। এভাবেই ওকে ভালো লাগে। কিন্তু অধরার মন মানছে না। মেয়ে হবে মায়ের মতো তানা সে বাবা ফুপিদের মতো চেহারা আর মায়ের মতো আচরণ পেয়েছে। শান্ত আর ধীর। বাবা ছিল এটোম বো*ম। যখন তখন চিৎকার চেচামেচি আর ভয়াবহ কান্ড কারখানা করে বসতো। জুবায়েরের কথা ভেবেই অধরার চোখে পানি চলে আসলো। লোকটা কেমন আছে জানতে ইচ্ছা করে। এতগুলি দিন পার হলো অথচ ওদের খোঁজ করতে কেউ আসলো না বিষয়টা ঠিক হজম হচ্ছে না। ওর খোঁজ না করলেও কহিনুরের খোঁজ করা উচিৎ ছিল। নাকি ওদের অগোচরে খোঁজ চলছে? অধরা এতদিন ভয়ে জুবায়েরের খোঁজ করেনি তবে এবার সিদ্ধান্ত নিলো সুলতানদের কোম্পানিতে খোঁজ নিবে। সোস্যাল সাইটে ওদের তথ্য থাকতে পারে। কথাটা মাথায় আসতেই ও মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে উঠে আসলো। বাইরে সোরগোল হচ্ছে। মিহির আর নেহা এসেছে নিমন্ত্রণ করতে। মিষ্টির সঙ্গে নেহা বায়না ধরেছে কহিনুরকে দেখবে। মিষ্টি ওকে নিয়ে আসার সময় নেহা ভাইকেও সঙ্গে নিয়েছে। কেউ মুখের উপরে না করতে পারেনি। ওরাই হৈচৈ করে কহিনুরের ঘরে ঢুকে পড়লো। কহিনুর তখন মাথা নিচু করে ড্রয়িং করছিল। মিহির কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে ছিল হঠাৎ কহিনুর মাথা তুলতেই ও ভড়কে গেলো। চমকে উঠলো। মেয়েটার সম্পর্কে যা শুনেছিল তার চাইতে বেশি ছাড়া কম না। এই রূপে যেনো খু*ন হলেও শান্তি। মানুষ এতটা সুন্দর কিভাবে হতে পারে? মিষ্টি ইশারা করে পরিচয় করিয়ে দিল। কহিনুর বিনিময়ে হাসলো। এই হাসির মধ্যে কি যে ছিল মিহির বুঝতে পারলো না। রহস্যে ঘেরা সেই হাসি নিমিষেই কোনো পুরুষের গলাই ফাঁসি হয়ে উঠতে পারে।কথাটা ভেবেই ওর হৃৎপৃণ্ড হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ধুপ করে উঠলো। সারা শরীর বেয়ে কেমন একটা অনুভব হচ্ছে। অস্বস্তি নাকি ভালো লাগা আহির বুঝতে পারলো না। তবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ওর সম্ভব হচ্ছে না। এই রূপের মাদকতা ওর সহ্য হচ্ছে না। যাবার পথে কঠিন শপথ নিলো এই মায়াবিনীকে ওর যেকোনো উপায়ে চাই। ছিনিয়ে নিবে নয়তো কৌশল অবলম্বন করবে। প্রশ্ন – আহিরের এই আশা কি আদো পূরণ হবে? নাকি কহিনুরের রূপের মাদকতায় ওর মৃ*ত্যু লেখা হবে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here