কহিনুর_দ্বিতীয়_খন্ড #পর্ব:১

0
1346

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব:১
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন

“অধু তুই আবার বিয়ে কর। প্রতিবন্ধী মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্য আমরা তো আছি। এতদিনে আমি নিশ্চিত তোর বর আবার বিয়ে করে সংসার পেতেছে।স্বামীরা যদি স্ত্রীকে ভূলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে তাহলে স্ত্রীরা কেনো পারবে না?তাই ভেবেছি তোর আবার বিয়ে দিব”।
বাড়ির বড় কত্রী ডালিয়া হকের কথায় অধরা মলিন হাসলো। জুবায়ের ওকে ঠকিয়েছে বিষয়টা হাস্যকর। লোকটাকে ও দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়ে এসেছে। বেঁচে থাকার জন্য পযাপ্ত রসদ জুবায়ের ওকে দুহাত ভরে দিয়েছে সেই ঋণে বরং ও জর্জরিত। নিশ্চিত মৃ*ত্যু জেনেও একজন মানুষ কতটা ভালোবাসলে নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে অধরার জানা নেই। শেষ বিদাইয়ের কালে লোকটার বলা কথাগুলো এখনো কানে বাঁজে। অধরা অপেক্ষা করবে জুবায়েরের জন্য। উনি একদিন ঠিক আসবেন। কিন্তু কহিনুর? সে যে অভিশপ্ত হয়ে জন্ম নিয়েছে। বোবা বধির বিষয়টা নিয়ে ও চিন্তিত। বিবাহ উপযুক্ত হতে আর কতদিন?। সামনে আবারও কোন ঝড় অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে। ডালিয়া হকে কথা শুনে অধরার ধ্যান ভাঙলো।
>কি বললাম শুনতে পেলি না? ছেলে দেখতে শুরু করব কিন্তু।
>আমার জন্য না তুমি বরং আমার মেয়ের জন্য ছেলে দেখো। আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে মনিমা। তুমি বরং ওকে নিয়ে ভাবো। আমার স্বামী আমানতের খেয়ানত করতে আমি পারবো না। আগেই বলেছি।

ডালিয়া হক বিরক্ত হলেন অধরার কথা শুনে। মেয়েটাকে উনি খুব ভালোবাসেন। এক ঝড়ের রাতে চৌধুরী সাহেব জার্মান থেকে ফেরার পথে মেয়েটাকে সঙ্গে করে এনেছিলেন। তারপর থেকে ও এই বাড়িতে আছে। অধরা সঙ্গে আনা অর্থ দিয়ে কক্সবাজারে জমি কিনে একটা রিসোর্ট তৈরী করেছিল। চৌধুরী সাহেব ওকে সাহায্য করেছেন।যদিও উনি উনি সব দেখাশোনা করেন অধরার কিছু করতে হয়না। ম্যানেজার রাখা আছে উনি মাঝেমাঝে হিসাব গুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এই বাড়িতে আঠারো জন মানুষের বসবাস। যৌথ পরিবার যাকে বলে। চৌধুরী সাহেবের চার ছেলে মেয়ের মধ্যে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে জার্মানি আছে।বাকি দুজন এই বাড়িতে থাকে। তাদের ছেলেমেয়ে সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের বোন ভানুমতি আর তার এক ছেলেও এখানে থাকে। অধরাকে মোটামুটি সবাই পছন্দ করে। তাছাড়া ওর পেছনে কারো সামান্য পরিমাণ অর্থও খরচ করতে হয়না। সমস্যা হলে বরং ওর থেকে অনেকে নিয়ে থাকে। অধরা বুঝতে পারলো ডালিয়া হকের সামনে থাকলে এখন এসব বলতেই থাকবে। উনি তো জানেন না কহিনুরকে বা ওর পরিচয় কি? জুবায়ের ফারুকীর কোটি কোটি সম্পত্তির মালিক এই একরোতি মেয়েটা। যাকে অবহেলা করার মতো সাহস কারো নেই। কথাটা ভেবে ও উঠে আসলো। মেয়েটাকে খাওয়ানোর সময় হয়েছে। মেয়েকে অধরা লোকজনের আড়ালে রাখে। কারো নজরে পড়তে দেয়না। সুলতান পরিবারের অভিশাপ নিয়ে জন্মানো মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ওকে ভাবতে হয়।
******
কলেজ থেকে ফিরে
কহিনুরের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে মিষ্টি। মিষ্টি চৌধুরী সাহেবের ছোট ছেলের মেয়ে। কহিনুর ফ্যাল ফ্যাল করে মিষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কাঁদছে। কহিনুর মিষ্টির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ইশারা করলো কি হয়েছে। মিষ্টি ফুপিয়ে উঠে বলল,
> ইউনিভার্সিটির এক ছেলেকে আমি ভালোবাসি নূর। ছেলেটা একদম ভালো না। ও আমাকে ঠকিয়েছে। আমি ঠকে গেছি নূর খুব বাজেভাবে আমাকে ঠকানো হয়েছে। ও ভালোবাসার অভিনয় করে আমার কিছু ছবি নিয়েছিল। সেগুলো এডিট করে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। আগামীকাল যদি ওর সঙ্গে আমি ওর বন্ধুর বাড়িতে না যায় তবে ও আমার ছবিগুলো ছড়িয়ে দিবে। আমার সম্মান থাকবে না নূর। আমি মরেই যাবো। তুমি জানো ও আমাকে খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছে?

মিষ্টি একদমে কথাগুলো বলে থামলো। নূর কিছু বুঝলো কি বোঝা গেলো না। ও মিষ্টির কপালে চুমু দিয়ে আবারও হাসলো। ইশারা করলো না কাঁদতে। মিষ্টি নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
> তুমি শুনতে পাবেনা জেনেও কথাগুলো বলে কি যে শান্তি পেয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না। কত কিউট তুমি।
মিষ্টি দুহাতে নূরকে জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টির এক বছরের ছোট কহিনুর তবুও দুজনের বেশ ভাব। আজ রাতে মিষ্টি এই রুমে ঘুমাবে বলে ঠিক করেছে। কহিনুর সারাদিন ড্রয়িং আর বই পড়ে সময় পার করে। অধরা ওকে পড়তে শিখিয়েছে। মেয়েটার মেধা শক্তি তুখোড়। ভালো বাংলা ইংলিশ লিখতে পারে। কহিনুর মিষ্টিকে ওর ড্রয়িং করা ছবিগুলো দেখাতে লাগলো। মেয়েটার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। ভয় হচ্ছে গতকালের কথা ভেবে। অভি নামের ছেলেটার মনে কি ঘুরছে ওর অজানা নেই। নিশ্চিত খারাপ কিছু করতে চলেছে কিভাবে আটকাবে ভেবে মাথা খারাপ অবস্থা। রাতে ও কহিনুরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালো। অধরা দুজনকে এভাবে ঘুমাতে দেখে ডাকেনি। বরং আদর করে চলে এসেছে। ভোরবেলা আজানের শব্দে মিষ্টির ঘুম ভাঙলো। তখনও কহিনুর গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। মিষ্টি ওকে না বলে নিজের রুমে চলে আসলো। ফ্রেস হয়ে নামাজ পড়ে আল্লাহ কাছে ক্ষমা চাইলো কান ধরলো আজকের বিপদটা কেটে গেলে জীবনে আর প্রেম ট্রেম করবে না। কাউকে বিশ্বাস করবে না। ভোরের অন্ধকার কেটে আলো ফুটেছে। হঠাৎ ফোনের শব্দে ওর ধ্যান ভাঙলো। দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই ওর বন্ধু মিহির বলে উঠলো,
> দোস্ত অভি ভাইয়া খু*ন হয়েছে। বাথটাবে লা*শ ভাসছিল। ভাইয়ার হাতে একগুচ্ছো মেয়েদের চুল পাওয়া গেছে তবে শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই সবটা কেমন রহস্যজনক। বেডরুম আর ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ ছিল।
মিহিরের কন্ঠে উত্তেজনা বিরাজ করছে। মিষ্টি কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> এটা মা*র্ডার কিভাবে বুঝলি? সামান্য চুল দেখে কি প্রমাণ হয় এটা খু*ন ছিল?
> আরে ওয়াশরুমের জানালায় দ*ড়ি ঝুলছে। মনে হচ্ছে খু*নি এই পথে এসে এসেছিল। যাইহোক মন খারাপ করিস না। ভাইয়ার জন্য দোয়া কর। এখন রাখছি। আমাদের পাড়াতে এমন ঘটনা এই প্রথম। আমি পরে ফোন করবো।

মিহির ফোন কেটে দিয়েছে কিন্তু মিষ্টি ফোন কান থেকে নামাতে ভূলে গেলো। কি যে শান্তি লাগছে মনে হলো এখুনি নামাজে বসে শুকরিয়া আদায় করতে।শ*য়*তান ছেলে খুব ভালো হয়েছে। মিষ্টি ভাবনা অনুযায়ী বসে পড়লো নামাজে।
**********
রিসোর্টের বিজনেস লসের মুখে, কিভাবে আটকানো যায় ভাবতেই জমির মাহমুদের কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটে উঠলো। পাশে উনার একমাত্র ছেলে আহির মাহমুদ কফি খাচ্ছে। ভাইয়ের ছেলে খু*ন হয়েছে তাঁতে উনার দুঃখ অনুভব হচ্ছে না। আনমনে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে উনি ছেলেকে বললেন,
> অধরা ম্যাডামের একটা মেয়ে আছে জানো? মেয়েটাকে দেখিনি তবে তোমার মা আর বোন দেখেছে। ওদের ভীষণ পছন্দ। মেয়ে নাকি মানুষ না কোনো পরীর বাচ্চা। যদিও বোবা বধির এটাই সমস্যা। অধরা ম্যাডামের রিসোর্টটা দখল করার ওই একটা রাস্তায় খোলা আছে। আমি তোমার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ভাবছি।
বাবার কথা শুনে আহির হেসে ফেলল। এই লোকটা স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝে না। কিন্তু তাই বলে এরকম একটা মেয়েকে বিয়ে কখনও না। রাগ হলো তবুও নিয়ন্ত্রণ হারা হলো না। শান্ত হয়ে বলল,
> তার চেয়ে তুমি অধরা ম্যাডামকে বিয়ে করে ফেলো এতে বরং আরও ভালো হবে। ম্যাডাম কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। এতবড় একটা মেয়ে আছে না বললে কেউ বুঝবে না। ম্যাম আবার বিদেশিনী।
ছেলের কথা শুনে জমির মাহমুদ লাজুক হেঁসে বললেন,
> উনি রাজি হলে নিশ্চয়ই প্রস্তাব রাখতাম কিন্তু উনি মানবেন না। তোমার মা জানলে অশান্তি হবে এসব বাদ দিয়ে প্রস্তাবটা ভেবে দেখো। বোবা বধির বউকে রেখে বাইরে তুমি যা ইচ্ছা করতে পারবে কেউ বাধা দিবে না। আরেকটা বিয়ে পযর্ন্ত করতে পারবে। তাছাড়া কাজ শেষ হলে তোমার যা ইচ্ছা করতেই পারো। সুন্দরী বউ পাবে সঙ্গে অর্থ আর কী চাই?
আহির কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,
> মেয়েটাকে দেখতে চাই। ব্যবস্থা করতে পারবে?
> চেষ্টা করবো জানিনা রাজি হবেন কিনা। বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিব আজ। তুমি বরং তোমার চাচুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখো কি অবস্থা সেখানে।
আহির কফির মগটা রেখে ছুটলো চাচার বাড়িতে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সবাই ভেঙে পড়েছে। লা*সের হাতের মুঠোয় পাওয়া চুলের ডিএনএ টেস্ট করানো হয়েছে। রিপোর্ট দেখে পুলিশের চক্ষু চড়ক গাছ। অভির মা মারা গেছে বছর দশেক আগে। মৃত ব্যক্তির চুলের সঙ্গে অভির হাতে পাওয়া চুলের ডিএনএ কিভাবে মিলে গেলো সবটা ধোয়াসা। তাছাড়া ওয়াশরুমের আয়নার গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,

“জন্ম দোষ কর্মে ঘুচে, না ঘুচলে ললাট পোড়ে। বোধির বোবার বাক্য দোষে ঝরছে এখন লাল র*ক্ত।

মৃ*ত্যুটা যে স্বাভাবিক না এটা বুঝতে কারো বাকি নেই। মৃ*ত মায়ের চুল দেখে অনেকেই ভেবেছে হয়তো অভির মায়ের আত্না এসব করেছে কিন্তু সেটা যুক্তিগত হচ্ছে না। আত্না বলে দড়ি দিয়ে নামবে কেনো? আয়নাতে লেখা শব্দের মানে কি কেউ বুঝতে পারলো না। এভাবে দুদিন পার হলো। ময়নাতদন্তের রির্পোট দেখে সকলে আরও একবার চমকে উঠেছে। অভির শরীরে কোনো ক্ষত হয়নি সেটা আগে সকলে জানে কিন্তু ওর হৃৎপিণ্ড বা*জেভাবে ন*ষ্ট হয়ে গেছে এটা জানেনা। শরীরে কোনো প্রকার মেডিসিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একদম স্বাভাবিক। পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তদন্ত করতে। কিভাবে ছেলেটার মৃ*ত্যু হলো কি এর রহস্য?
*****
গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছে অধরা। মেজাজ হঠাৎ খারাপ হচ্ছে। কহিনুরকে ও এতদিন আড়ালে রেখেছিল কিন্তু শেষ পযর্ন্ত আড়াল করতে পারেনি।মেয়েটার জন্য আজ চৌধুরী সাহেবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অধরার মনে হলো এইটুকু একটা মেয়ের বিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। তাছাড়া ও নিজে ইচ্ছা করলেও মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবতে পারবে না। এই মূহুর্ত্তে ওর মনে হলো জুবায়েরকে ওর পাশে খুব বেশি দরকার। প্রশ্ন জাগলো মনে লোকটা কোথায় আর কেমন আছে?আদো বেঁচে আছে তো?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here