#কহিনুর,১৭,১৮
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৭
অধরা দাদুর কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলো। এক বুক সাহস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভদ্রলোক তখন কিসের একটা বই নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়তেছিল। অধরার পায়ের শব্দ শুনে লোকটা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যাইহোক ডাইরীটা পড়েছো? একা পড়তে বলেছিলাম।
অধরা ঢোক গিলে বলল,
> পড়েছি কিন্তু কিছু জটিল বিষয় মাথায় ঢুকছে না। উল্লেখিত মানব নিষিদ্ধ মানবিদের বিয়ে হচ্ছে তাঁরা সংসার করছে কিভাবে সম্ভব হলো? কহিনুরের জন্ম নিয়ে খোলামেলা কিছু লেখা নেই। পাথর মানবির জন্ম কবে,কখন হবে বলা হয়নি। বিষয়টা কি আপনি জানেন?
অধরার প্রশ্ন শুনে দাদু মৃদু হাসলেন। মুখটা পূর্বের ন্যায় গম্ভীর করে বললেন,
> পাথরের শক্তি ক্ষয় হয়েছে সেটা তো তুমি নিশ্চয়ই জানো? তুমি নিজে সয়ং কা*লো যাদুর ফসল। তোমার বাবা না চাইতেও তোমাকে চেয়েছিলেন। শেষ চাওয়া ছিল এটা। কা*লো যাদুর শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
> আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি সবটা জানেন তাই না? আমাদের পরিবার সম্পর্কে সবটা কিভাবে জানলেন?
অধরার চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। ওর বাবার সম্পর্কে এই লোকটা সব জানে। ওর এভাবে উত্তেজিত দেখে দাদু বললেন,
> আমি সিউর জানিনা আরমান বলেছিল শুনেছি ওর থেকে। আমার ছেলেটা কিন্তু খারাপ না। পরিবারের ভালো করতে একটু স্বার্থপর হয়েছে। তুমি খামাখা ভয় পাচ্ছো। এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। বাইরের দিকে নজর না দিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবো। বাচ্চার মা হতে চলেছো ওকে আর জুবায়েরকে নিয়ে ভাবো। ভাবার কতকিছু আছে। আমরা আছি বাকীটা ভাবার জন্য।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। লোকটা ঠাণ্ডা মাথায় ওকে হু*ম*কি দিচ্ছে। অধরা চুপচাপ সহ্য করা বা ভয় পাওয়ার মতো মেয়ে না। ম*রতে ওর ভয় নেই। তবে ম*রলে একা ম*রবে না পাপের এই অট্টালিকার ধ্বংস করে দিয়ে যাবে। কহিনুরকে ও এই পৃথিবীর এক কোণে লুকিয়ে রাখবে। কোনো পাপি তাপির সাধ্য হবে না ওর কাছে গিয়ে নতুন পাপের সূচনা করতে। কথাগুলো ভেবে ও নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। ঘনঘন চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে বলল,
> নিজেকে নিয়েই তো চিন্তা করছি দাদু। আমার স্বামী আর সন্তান ছাড়া কি আছে ভাবার মতো বিষয়? আসলে এই বাড়িতে তো খু*ন খারাপি পিশাচের আনাগোনা। ভয় করে যদি কিছু হয়ে যায়। আচ্ছা দাদু গতকাল রাতে আপনিই বারান্দা ধরে হাটছিলেন তাই না? পায়ের শব্দের সঙ্গে ঠাকঠক আওয়াজ পেলাম। আপনার লাঠির শব্দ মনে হলো। সবাই মিলে কার সঙ্গে রুশনারার বিয়ে দিলেন দাদু? ভদ্রলোক সরি অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পশুর সঙ্গে বিয়ে বাহ দারুণ সমাধান পেয়েছেন। ডাইরীর এক পৃষ্ঠা ছেড়া ছিল ওটা আপনার কাছে তাই না?
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। দাদুর মধ্যে যথেষ্ট ঝামেলা আছে। ভদ্রলোক বিনা দরকারে নিজের চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস লিপিবদ্ধ ডাইরীটা ওকে কখনও দিবে না। অধরা অতটা বোকা না। ওর মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। বাবা মা ওকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার কৌশল শিখিয়েছে। জুবায়েরের দাদুর মুখে চিন্তার ছাপ। উনি বুঝতে পারছেন না অধরা এত কথা কিভাবে জেনেছে। উনি মুখটা কুচকে নিয়ে বললেন,
> দাদুভাই তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো? ডাইরীটা তোমাকে দিয়েছি যাতে বুঝতে পারো সুলতানরা কেনো এই বাচ্চাটাকে এতটা চাইছে। তাছাড়া গতকাল রাতে আমি নিজের কক্ষে ছিলাম। বাইরে কি হয়েছে জানিনা। আর রইল তোমার ডাইরীর পরবর্তী পৃষ্ঠা? ওটা আমি জানিনা। বহুকাল আগের ডাইরী কিভাবে কি হয়েছে জানিনা। এই ডাইরীটা দেখো আগেকার দিনের দতের কালিতে লেখা। কাগজপত্র কিন্তু তখন সস্তা ছিল না। ভদ্রলোক জমিদার ছিলেন বিধায় সমস্যা হয়নি।
অধরা দাদুর একটা কথাও বিশ্বাস করলো না।। ও যেভাবে প্রশ্ন করেছে লোকটা সেসব কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। খামাখা সময় নষ্ট হচ্ছে। অধরা কথাগুলো ভেবে নিয়ে বলল,
> আচ্ছা দাদু দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। মনে রাখবো আপনার কথা। এখন যায় পরে আসবো।
অধরা কথা শেষ করে আর অপেক্ষা করলো না। হনহন করে বেরিয়ে আসলো। এই বাড়ির সব মানুষ গুলো এক রকম। রহস্য যে কোথায় গিয়ে জটলা খুঁলবে বোঝা যাচ্ছে না। শুরু যখন হয়েছে তার শেষটা তো হবেই, অধরা নিজের হাতে এই সুলতান বংশের নতুন ইতিহাস রচনা করবে। কহিনুরের জীবনে কোনো পাপের চিহ্ন পড়বে না। মশ্রিন জীবন হবে ওর। সাদা শুভ্র ফুলের মতো সৌরভ ছড়াবে। অধরা ওকে নিজের মনের মতো করে বড় করবে। এতটা ভালোবাসা দিবে মেয়েটা যদি কোনো অশুভ খারাপ কিছু হয়েও থাকে তবে ও ভালো হয়ে যাবে। এলোমেলো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে যখন ও নিজের কক্ষে ফিরছিল হঠাৎ ওর পথ আগলে ধরলো গালিব। অধরা হতবাক হয়ে ছেলেটাকে দেখলো। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই ভ্রু কুচকে ফেলল। এই ছেলেটা সেই অর্ধ*মানব। অধরা দ্রুত নিজের ঘোমটাটা আরও খানিক টেনে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> কি চাই?
গালিব ঠোঁট বাঁকা করে হাসলো। অধরার পছন্দ হলো না। দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে আবারও বলল,
> কি চাই আপনার? পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? বোবা নাকি বোবার ভান নিয়েছেন কোনটা?
> সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর বুদ্ধিতে আমি মুগ্ধ। আপনার মন রপ্ত করা বেশ কঠিন। সহজে পড়া যাবে না।
অধরা বিরক্ত হলো। ভয়ানক দুটো গালি দিলো মনে মনে। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করতে পারলো না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> চেষ্টা করার কথা কল্পণাও করবেন না। ধবংস হয়ে যাবেন। আমার চোখে আগুন আছে আর হৃদয়ে আছে বি*ষা*ক্ত খ*ঞ্জ*র। নতুন বিয়ে করেছেন বউ ছেড়ে এখানে এসে আজেবাজে বকছেন লজ্জা থাকা উচিৎ। অবশ্যই মানুষ হলে লজ্জা শরমের বালাই থাকতো। আপনি তো আবার অন্য কিছু। যাইহোক পথ ছাড়ুন। আপনাকে আমি ভয় পাচ্ছি না।
অধরা এক সঙ্গে একগাদা কটুকথা শুনিয়ে দিলো। এমনিতেই দাদুর বিষয় নিয়ে চিন্তিত তার মধ্যে এই ছেলেটা এসে ঝামেলা করছে। অধরা এতগুলো কথা শুনে লোকটার কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং মিটিমিটি হাসলো আর বলল,
> ভয় না পেলে আরও মজা। খেলা জমবে। নিস্তব্ধ রজনী শনশন বাতাসে যখন কারো উন্মুক্ত হৃদ*পিণ্ডটা খা*ম*চে তুলে নেওয়া হবে সেই দৃশ্যটা দেখে ভয় পাবেন আপনি। নিশ্চয়ই পাবেন,সেদিন আর দেরী নেই। প্রিয়জনের হৃদ*পিণ্ড ছি*নি*য়ে নিতে দেখতে কেমন লাগবে ভাবতে পারছেন?
অধরা ঢোক গিলল। সবাই আজ ওর সঙ্গে ভয়ংকর কথাবার্তা বলছে। দিনটাই খারাপ। জুবায়েরেকে এখন ওর বড্ড দরকার। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। লোকটা মিষ্টি মিষ্টি করে জা*ন নেওয়ার পাইতারা করছে। অধরাকে চুপচাপ ভাবতে দেখে লোকটা আবারও বলল,
> কি হলো কিছু বলুন?
অধরা চমকে উঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। মুখটা কঠিন করে বলল,
> আমি এমন পরিস্থিতি তৈরী হতেই দিব না। প্রিয়জনের প্রাণ নিজের প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবো। আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন বাচাল টাইপ। রাস্তা ছাড়বেন নাকি উন্য কিছু করব?
গালিব ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়েটা কি করতে পারে বুঝলো না। অধরা চেয়েছি জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসবে কিন্তু তেমন কিছুই করতে হলো না। জুবায়ের এসে হাজির। ও সোজা অধরার হাত ধরে বলল,
> কতক্ষণ অপেক্ষা করছি কক্ষে চলো। আর আপনি ওর রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ভদ্রতা শিখুন কাজে আসবে।
জুবায়ের উত্তরের আশা করলো না। দ্রুত অধরাকে নিয়ে নিজের কক্ষে দরজা বন্ধ করলো। গালিব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে কোনো রাগ নেই। তৃপ্তি নিয়ে হেসে দাদুর কাছে ছুটলো।
☆☆☆☆☆☆☆☆
অধরা সোফায় বসে আছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। জুবায়ের ধা*রা*লো একটা খ*ঞ্জ*র হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
> এটা তোমার জন্য কিনেছি। এখনকার মেয়েরা মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে আর তুমি এটা নিয়ে ঘুরবে। যদি কখনও আমিও তোমার ক্ষতি করতে আসি হৃদ*পিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিতে দুবার ভাববে না।
জুবায়ের খ*ঞ্জ*রটা অধরার হাতে দিতেই ও সেটা রেখে দিয়ে বলল,
> আপনার দাদু আমাকে ভয় দেখিয়েছে। আমার কি মনে হয় জানেন ভদ্রলোক এসব করছে। আপনার চাচা উনার হাতের পুতুল। ইস্টোর রুমে যাওয়াটা খুব দরকার। আজ রাতে পারবেন ব্যবস্থা করতে?চাবি আছে?
জুবায়ের কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে চাবি বের করে বলল,
> চাবি তৈরী করে নিয়েছি। দাদুর রুমটা একটু চেক করা দরকার ছিল। আচ্ছা গতকাল তো বললে না ডাইরীর পৃষ্ঠা একটা ছিল না? সবতো ঠিকঠাক মনে হলো।
> আরে আপনি ভাবুন হুট করে ডাইরী শেষ কিভাবে হতে পারে? উনি হঠাৎ লেখা থামিয়ে দেওয়ার মানুষ না। এত লম্বা কাহিনি লিখেছেন। যেখানে নিজের দোষটা অকপটে স্বীকার করতে দু’বার ভাবেননি সেখানে শেষে একটা উপদেশ দিবেন না এমন হয়নাকি। ওখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা ছিল তাইতো দাদু ওটা দিতে চাইনি। তাছাড়া দাদু ডাইরীটা আমাকে দিয়েছেন যাতে আমার মনটা নরম হয়। রহস্য জেনে গেছি ভেবে যদি আমি আর কোনো ঝামেলা না করি এসব কারণে উনি পড়তে দিয়েছিলেন। যাইহোক ওই পৃষ্ঠাটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে। আর হ্যা এই মহা কাহিনীর ভিলেনকে আমরা না চিনলেও ভিলেন কিন্তু আমাদের চিনে নিয়েছে।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> মানে?
> মানে স্বাভাবিক। স্টোর রুমে সেদিন আমাদের দুজনকে সেই লোকটা দেখে নিয়েছিল তারপর দাদু এই ডাইরীটা আমাকে দিয়েছে।লোকটা দাদুর সঙ্গে যুক্ত আছে। আচ্ছা আপনি বাংলাদেশের গিয়েছেন কখনও?
> বহুবার গেছি। ওখানে আমাদের অফিস আছে। তাছাড়া ছোট থাকতে প্রায় যেতাম। মায়ের সঙ্গে গিয়েছি। জোর করে নিয়ে যেতেন। বড় হয়ে তেমন যাওয়া হয়না। তবে দাদু আরমান ফারুকীর যাওয়া আসা লেগেই থাকে। তুমি জানো গতকাল পুলিশ খোঁজ করছিল আমাকে? মায়ের মৃ*ত্যু নাকি স্বাভাবিক না। আবারও তদন্ত করতে চাইছে।
অধরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এতদিন পরে আবারও কেসটা রি অপেন হয়েছে ঠিক হজম হলো না। বলল,
> কিভাবে সম্ভব?
> এখানকার আইনকানুন সস্তা না যে বললেই সব মিটে যাবে। আমি আসল অপরাধীকে ধরার জন্য বাড়িতে কিছু বলিনি। তদন্ত চলছে। আশাকরি দ্রুতই সব সামনে আসবে।
অধরা বেশ খুশি হলো। জুবায়ের এতদিন পরে একটা কাজের কাজ করেছে। সেদিন ছাদে ঠিক কি হয়েছিল জানতে হবে। অপরাধীকে ধরতে না পারলে জানা কঠিন।
☆☆☆☆☆☆
অন্ধকার কক্ষে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। কক্ষের দক্ষিণ দিকে দুজন মানব মানবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে হাজারো কৌতূহল আর বিস্ময় খেলা করছে। আধার ওদের দুজনকে ঢেকে নিয়েছে। তাছাড়া সামনে আসে বিশালাকার এক পুরাতন আলমারি। কক্ষের মাঝখানে ছোট একটা বৃত্তের মধ্যে মোমবাতি নিভু নিভু করে জ্বলছে। একজন মুখোশধারী মোমবাতির সামনে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে কি একটা বিড়বিড় করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কক্ষের দরজা দুমকরে খুঁলে খেলো। দুজন মানবের আগমন ঘটলো। ওরা একা আসেনি। মুখ বেঁধে নিয়ে আসেছে এক মেয়েকে। যদিও মেয়েটার কোনো জ্ঞান নেই। ওরা মেয়েটিকে লোকটার সামনে বসিয়ে দিলো। ক্রমশ মোমবাতির হলুদ আলো লাল আকার ধারণ করলো। অধরা এতক্ষণ জুবায়েরের পাশে দাঁড়িয়ে এসব চুপচাপ দেখছিল। চুপিচুপি স্টোর রুমে আসার দু’মিনিট পরেই এই অদ্ভুত লোকটা এসে হাজির হয়েছে। জুবায়ের ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ওর আরেক হাতে একটা বই আছে।বইটা বহুকাল আগের। যদি পুরোটা পড়া হয়নি। তার আগেই এই লোকগুলো চলে আসলো। অধরার ভয় করছে এই মেয়েটার জন্য। এরা ওর সঙ্গে কি করতে চলেছে কে জানে। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে। মেয়েটাকে বাঁচানো জরুরী। জুবায়ের পকেটে হাত দিয়ে লাইট বের করলো। উদ্দেশ্য বই টা পুড়িয়ে দিয়ে এদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা। জুবায়েরের মতিগতি দেখে অধরা ঝট করে বইটা নিজের হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আপনি লুকিয়ে থাকবেন ওদের সামনে আমি যাবো। ওরা আমার ক্ষতি করতে পারবে না কিন্তু আপনার করবে।
জুবায়ের রজী হলো না। বউকে বিপদে পাঠিয়ে নিজের লুকিয়ে থেকে কাপুরুষের মতো মজা নিবে কখনও না। ও প্রতিবাদ করলো কিন্তু ধোপে টিকলো না। অধরা জুবায়েরের হাত থেকে লাইট নিয়ে বেরিয়ে আসলো। সোজা লোকগুলোর সামনে লাইট জ্বালিয়ে বইটাতে আগুন লাগিয়ে ধ্যান মগ্ন লোকটার সামনে ছুড়ে দিয়ে বলল,
> কে আপনি? কি করতে চাইছেন ওর সঙ্গে?
লোকটা চোখ খুলে আহত হলো পুড়ে বইটা দেখে। বিকট শব্দ করে বলল,
> এটা কি করলে তুমি? এভাবে বইটা পুড়িয়ে দিলে? তোমাকে আমি ছাড়বো না।
লোকটা ছুটে গিয়ে অধরাকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। অধরার হাতে থাকা ধা*রা*লো খঞ্জরটা লোকটার বুকে বি*ধে দিলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে সব চুপচাপ। বই পোড়া ধোয়ায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মোমবাতি নিভে গেছে। জুবায়ের দ্রুত বেরিয়ে এসে অধরার হাত ধরলো।মেয়েটা কাঁপছে। জীবনে প্রথমবার এরকম একটা কাজ করেছে। জুবায়ের ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,
> ভয় নেই আমি আছি। মেয়েটাকে বাইরে নিতে হবে। তুমি একা হাঁটতে পারবে?
অধরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো পারবে। তবুও জুবায়েরের সন্দেহ হচ্ছে। ওকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে আবারও স্টোর রুমে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে বের হলো। অধরা এখনো কাঁপছে। হাতের খ*ঞ্জ*র থেকে ফোটা ফোটা র*ক্ত ঝরছে। জুবায়ের মেয়েটিকে ওর পাশে রেখে খ*ঞ্জ*রটা কেড়ে নিয়ে কিচেনের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে পানি নিয়ে অধরার সামনে ধরলো। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। পানি পেয়ে ও সময় নষ্ট করলো না। ঢকঢক করে গলাই ঢেলে নিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল,
> আমি খু*নি হয়ে গেলাম।
জুবায়ের ওকে সামনে এনে দু’হাতের মুঠোয় মেয়েটার মুখটা নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> এইটুকুতে ওর কিছুই হয়নি। বরং ওকে চেনার সহজ উপায় পেয়ে গেলাম। আগামীকাল সকালে যার গায়ে আঘাতের চিহ্ন পাবো ভেবে নিভো এই মুখোশ পরা লোকটা সেই। ভয় পাবে না একদম। বাঘনীকে ভয় পেলে মানাই না। এখন মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো জরুরী।
অধরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। জুবায়ের ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে মেয়েটার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। জ্ঞান ফিরলো না দেখে কাজের মেয়েদের ডেকে নিয়ে অসলো। ওদেরকে বুঝিয়ে দিলো এই মেয়েটার যত্ন নিতে। আগামীকাল সকালে পরিচয় জেনে ওর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। জুবায়ের অধরাকে নিয়ে কক্ষে ফিরে আসলো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সকাল হলেই জানা যাবে এই কাজের সঙ্গে সরাসরি কে যুক্ত আছে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৮
প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও ঘেমেঘেটে একাকার অধরা। জুবায়ের ওকে বুকে নিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জীবনে প্রথমবার কাউকে এভাবে আ*ঘা*ত করেছে। লোকটা খারাপ ছিল তাই বলে এভাবে আঘাত করাটা ঠিক হয়নি। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। চোখে ঘুম নেই। মেয়েটা এভাবে ভয় পাবে ওর ভাবনার বাইরে ছিল। আগে জানলে কিছুতেই যেতে দিতো না। মেয়েটা ওর একটা কথাও শুনে না রাগ হচ্ছে। এইটুকুতে ভয়ে কুপোকাত। সামনে যে আরও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। মনে জোর থাকাটা এখন অতি জরুরি। কথাগুলো ভেবে জুবায়ের ওর কপালে ওষ্ঠদ্বয় রেখে বলল,
> সারারাত জেগে থাকবে? যা করেছো বেশ করেছো। লোকগুলো ভালো ছিল না। এমনওতো হতে পারে ওরা মানুষ না। তুমি খামাখা ভয় পাচ্ছো আর আমাকে কষ্ট দিচ্ছো। অধরা সামনে কিন্তু তোমার স্বামীর প্রা*ণ নেওয়ার দৃশ্যটাও তোমাকে দেখতে হতে পারে তখন? এখন থেকে শক্ত হও।
জুবায়েরের বলতে দেরী হলো কিন্তু অধরার উঠে বসতে দেরী হলো না। মুখটা ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
> জঘন্য খারাপ আপনি। দেখছেন আমি ভয় পাচ্ছি কোথায় সান্ত্বনা দিবেন, আদর করবেন তানা ওসব বাজে কথা বলছেন? আপনি সত্যিই খারাপ।
জুবায়ের অধরার মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> আমি ভালো হতেও চাইনা। আমি আমার লক্ষ্মী বউয়ের উড়নচন্ডী বর। মাথা গরম করে যা করতে পারবো শান্ত মাথায় সেটা জীবনেও পারবো না। ধুমদাম অদ্ভুত কাজকর্ম করে তোমাকে চমকে দিব নাজেহাল করবো। তুমি বকবে আমি মজা নিবো বেশ হবে। আচ্ছা আমাদের মেয়েটা কার মতো হবে বলতে পারো? তোমার মতো ছিঁদকাদুনে নাকি আমার মতো ভদ্রলোক? আমার মেয়ে যদিও জানি সে আমার মতোই হবে। তবুও যদি না হয়!ওই হবে তো?
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়ে কেমন হবে ও এখুনি কিভাবে জানবে। তাছাড়া বাচ্চাদের যা শেখানো হয় বাচ্চারা তাই শিখে। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> মেয়ে আপনাদের মতোই হবে। সুলতান বংশের মাথার উপরে চড়ে নাচবে এই মেয়ে। আপনি মিলিয়ে নিবেন। হাড়ে হাড়ে চিনি আপনাদের।
> আমিও চাই আমার মেয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে আর কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো গতি নিয়ে ধরণীতে আসুক। ওকে আমি তোমার মতো ভিতুর ডিম তৈরী করবো না। মেয়ের এক চোখে থাকবে আগুন আরেক চোখে থাকবে মমতা। সুলতানদের এতদিনের করা পাপ ধ্বংস করে দিবে। আমিও চেয়েছি ধ্বং*স হোক। আমি মনে প্রাণে ছেয়েছি আমার মেয়ে ধ্বংস হয়ে আসুক।
অধরা মুখ কাচুমাচু করে ফেলল। মেয়েটা না আসতেই কতকিছু। আসলে না জানি কি করবে। বাবা তাঁর মেয়ের জন্য ভাবছে বিষয়টা ভেবেও ওর শান্তি অনুভব হচ্ছে। স্ত্রীর কাছে এর চাইতে বেশিকিছু আর কিবা চাওয়ার থাকে। তবুও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
> বাচ্চাটাকে আপনি একদম আজেবাজে কিছু শেখাবেন না। আমার বাচ্চাটা হবে খুবই শান্ত। মায়ের মতো ভদ্র। আপনার মতো না।
জুবায়ের মানতে পারলো না। মেয়ে মায়ের মতো হতেই পারে তবে ওর মেয়ে কিছুতেই তাঁর মায়ের মতো হতে পারবে না। সামান্য একটু সাহস দেখিয়ে হাড় হাড্ডি ঠকঠক করে কাঁপিয়ে ভুমিকম্প করে দিচ্ছে। জুবায়ের বেটি হবে হিংস্র। কথায় কথায় লোকের হৃদপিণ্ড কাঁপিয়ে দিবে। সুলতান বংশের রত্ন সে। তাঁর চলন বলন কিছুতেই সাধারণ হবে না। কথাগুলো ভেবেও শান্তি লাগছে ওর। অধরাকে ভয় থেকে বের করতে মূলত ও এতক্ষণ ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছিল। একটু চিন্তা যে হচ্ছে না তেমন না। কাকে না কাকে মে*রে দিয়েছে লোকটা কে হতে পারে ভাবলো। নিজের ভাই নাকি চাচা নাকি দাদু? সবাইকে সন্দেহ হচ্ছে। সন্দেহের বাইরে কেউ নেই। জুবায়েরকে চুপচাপ ভাবতে দেখে অধরা মুখ খুলল। আবারও পূর্বের মতো ভয়ে ভয়ে বলল,
> কি হয়েছে আপনার? কি ভাবছেন এতো?
> তেমন কিছু না।। দ্রুত আসো ঘুমাতে হবে। একা একা ভয় পাবে তারচেয়ে আমাকে ঝাপটে ধরে চোখ বন্ধ করো। সকালের জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
জুবায়ের কথাটা শেষ করে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মধ্য রাত ঘুম বেশিক্ষণ হবে না। বাইরে মেয়েটাকে রেখে আসা হয়েছে যদিও সকাল পযর্ন্ত বিষয়টা গোপন থাকবে। এই বাড়িতে বাইরের একজন মেয়েকে আনা হয়েছে ভাবতেই বিরক্তিকর লাগছে।
☆☆☆☆☆☆☆
ভোরবেলা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙলো অধরার। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে শরীর মৃদু কাঁপছে। জুবায়ের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওকে না ডাকলে উঠবে না। অধরা চুপচাপ উঠে এসে দরজা খুঁলে দিলো। দরজার সামনে জুহি দাঁড়িয়ে আছে। অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। দুদিন আগে মা*রা যাওয়া মানুষ হঠাৎ ফিরে এসেছে? অধরা ভয়ে চুপসে গেলো। মেয়েটা ওকে ইগনোর করে হুড়মুড় করে ভেতরে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো। জুবায়ের ঘুমের মধ্যে মেয়েটার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। অধরার রাগ হচ্ছে না যা হচ্ছে সব কৌতূহল। এই পেত্নী যে মা*রা গিয়ে এভাবে ফিরে আসবে ওর ভাবনার বাইরে ছিল । নাকি এরাও জমজ ছিল ? জুহির হাকডাকে জুবায়ের উঠে বসলো। চোখ খুঁলেই হতভম্ব হয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জুহির দিকে তাঁকিয়ে চমকে গিয়েছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অধরা ভাবলো এখুনি বুঝি ছেলেটা ওকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। জুবায়েরের মুখের আকৃতি পরিবর্তন হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। দ্রুতগতিতে বিছানা থেকে নেমে জুহির গলা টিপে ধরে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> তুই মানুষ হোস বা পেত্নী আমার কিছু যায় আসেনা। তোকে যে শিক্ষা দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছি এটাই অনেক। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া। আমার সঙ্গে গেম খেলার মজা তোকে আমি হাড়ে হাড়ে বোঝাবো। ভেবেছিলাম তোর ক*বের উপরে গিয়ে বো*ম ফেলবো কিন্তু পারিনি অন্যদের কথা ভেবে।
জুবায়েরের শক্তিশালী পেশিশক্তির কাছে জুহির নাজেহাল অবস্থা। গলা বেশ ভালো ভাবেই ধরেছে। অধরা হতভম্ব হয়ে গেলো জুবায়ের কৃতকর্ম দেখে। এই ছেলেটার যে মাথায় সমস্যা সেটা আবারও প্রমাণিত। প্রেমিকার শোকে একদিন কাতর ছিল। প্রেমিকা ফিরে এসেছে সেই খুশীতে কোথায় জড়িয়ে ধরবে তানা গলা টিপে ধরছে। মা*রা যাবে ভেবে অধরা জুবায়েরের হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল,
> ছাড়ুন বলছি। ওকে মা*র*ছেন কেনো? পাগলামি অনেক হয়েছে।
জুবায়ের অধরার কোথা ইগনোর করলো। গলা আরও শক্ত করে ধরেছে। মেয়েটা ছটফট করছে।মেয়েটা যদি জানতো এমন হবে তাহলে হয়তো এখানে আসার কথা কল্পণাও করতো না। অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে জুবায়েরের হাতটা ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
> সুযোগ না দিয়ে মে*রে ফেলবেন? আগে শুনি তারপর যা ইচ্ছে করা যাবে। মৃ*ত মানুষ ফিরে এসেছে জুবায়ের ফারুকী কিভাবে সম্ভব এটা নিয়ে ভাবুন।
অধরার ঝাঝালো কন্ঠ শুনে জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিলো তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে লা*থি বসিয়ে দিলো মেয়েটার পেট বরাবর। জুহি ছিটকে গিয়ে পড়লো সোফার উপরে। জুবায়ের হাপাচ্ছে তবুও দমন হলো না। দ্বিতীয়বার মেয়েটার সামনে যেতেই অধরা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ রাঙিয়ে বলল,
>মাথা ঠান্ডা করুন আমি দেখছি। মা*রা গেলে ঝামেলা পাকিয়ে যাবে।
জুবায়ের আক্ষেপ নিয়ে উত্তর দিলো,
> আমি জানি ও জুহি না। জানিনা ও কে তবে যেই হোক সুযোগ যখন পেয়েছি রাগ মিটিয়ে নিবো। ওরে আমি ভর্তা বানিয়ে খাবো। পিচ*পিচ করে কা*টবো। তুমি ফ্রাই করে দিবা। যদিও ওর মাং*স খাওয়ার অযোগ্য। তবুও ফেলবো না। রাগ মেটানোর জন্য খেয়ে ফেলবো।
জুবায়ের রাগের মাথায় হড়বড় করে যা মুখে আসলো বলে দিলো। অধরা কপাল চাপড়ালো। লোকটা এমন কেনো কে জানে। বুদ্ধি জ্ঞানের বড্ড অভাব। অধরা নাক মুখ কুচকে বলল,
> একটা কথাও আর উচ্চারণ করবেন না। কথা বললে কিন্তু আমি আপনাকে খু*ন করবো। চুপচাপ গিয়ে বসুন। আমি দেখছি কি করা যায়। যে ওকে পাঠিয়েছে কি তাঁর ষড়যন্ত্র সেটা তো বুঝতে দিন।
জুবায়ের বিরক্ত হলো অধরার ধমক শুনে। ওর একেবারেই ইচ্ছে নেই এই মেয়েকে ছেড়ে দেওেয়ার। অন্যদিকে মেয়েটা পড়েছে মহা বিপদে। জা*ন বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। একটুর জন্য বেঁ*চে গেছে। অধরা মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে ঝটপট পাশে থাকা একটা গ্লাসের পানি মেয়েটার মুখে ছুড়ে দিলো। মেয়েটা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এই ঘরে যে বাঘ আর বাঘিনীর বসবাস এটা ওর জানা ছিল না। অধরা টাওয়েল নিয়ে এসে মেয়েটার মুখ থেকে মেকাপের আস্তরণ উঠিয়ে দিলো। পুরোপুরি উঠলো না তবে বোঝা গেলো কিছুটা। এটা জুহি না পাক্কা সিউর। অধরা বাঁকা হাসলো। মেয়েটার চোখেমুখে ভয় দাঁনা বেঁধেছে। জুবায়েরের চোখে বিস্ময়। অধরা নীরবতা ভেঙে থমথমে মুখ নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> কে পাঠিয়েছে?
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। জুবায়ের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ছিল । অধরার প্রশ্ন শুনে আবার উঠে আসলো। ওকে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে মেয়েটা দ্রুতগতিতে অধরার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো,
> আমাকে বাঁ*চা*ন। মা*র*বেন না প্লিজ। আমি নিজ ইচ্ছেতে আসিনি। আমাকে আনা হয়েছে। আমি জুহি আপুর ছোট বোন। আপুর সঙ্গে হালকা চেহারার মিল আছে দেখে আপনার শশুর মশাই আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে এনেছে। আমি আগে জানলে আসতাম না।
মেয়েটা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই হুড়হুড় করে সব গোপন তথ্য বলে দিলো। জুবায়কে এবার থামানো গেলো না। মেয়েটাকে তুলে নিয়ে জোরে আরেকটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দিলো। অধরা গিয়ে ওকে ধরে ফেলল। ভ্রু কুচকে মেজাজ দেখিয়ে বলল,
> একদম ওকে মা*র*বেন না। আপনার ড্যাড এসব করছে। উনাকে গিয়ে প্রশ্ন করুন তারপর ওকে মা?র*বেন। ভালো মুনাফা পেলে সবাই লোভী হয়ে উঠে। আগে শুনুন উনার উদ্দেশ্য কি ছিল। এই মেয়ে বলো কি উদ্দেশ্য নিয়ে তোমাকে ভাড়া করা হয়েছে?
মেয়েটা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,
> উনার সঙ্গে প্রমের নাটক করে আপনার থেকে আলাদা করতে আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আপনার সঙ্গে থেকে উনি বেয়াদব হয়ে উঠেছে। আরমান ফারুকী স্যার আমাকে বলেছিলেন আমাকে দেখলে জুনায়েদ স্যার শান্ত হয়ে যাবেন। উনার সব কথা শুনবেন।
জুবায়েরকে বেয়াদব বলা হয়েছে শুনে ও আবারও জ্বলে উঠলো। তেড়ে আসতে চাইলো কিন্তু অধরা চোখ রাঙিয়ে নিষেধ করলো। মেয়েটা আবারও বলল,
> আমি জানতাম না উনি এরকম আ*ক্র*মণ করে বসবেন। আরমান স্যার মিথ্যা বলে আমাকে পাঠিয়েছে। প্লিজ কিছু করবেন না। অনেক ব্যাথা পাচ্ছি। কখনও আর এমন লোভ করবো না।
অধরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
> প্রথমবার ছিল তাই ক্ষমা করেছি। দ্বিতীয়বার এই সুযোগ পাবেনা। এই বাড়ির দিকে পা রেখেও ঘুমাবে না। যাও
মেয়েটা অনুমতি পেয়ে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। যেমন হুড়মুড় করে এসেছিল তেমনি দৌড়ে পালিয়ে গেলো। অধরার এবার ভীষণ হাসি পেলো। মেয়েটা কত আশা নিয়ে এসেছিল। ও তো জানেই না জুবায়ের কেমন টাইপের ছেলে। বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করতে পারেনা। যদি মেয়েটাকে ও সুযোগ দিতো তবে চিত্রটা এখন অন্যরকম হতো। সে যাইহোক আরমান ফারুকী কি করতে চাইছে? উনি যেকোনো উপায়ে আবারও জুবায়েরকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চেয়েছে নাতো? কথাটা ভেবেই ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> রণক্ষেত্রে পৌঁছে গেছি আর অপেক্ষা করলে চলবে না। যা হবে সামনে সামনে। চলো আরমান ফারুকীর সঙ্গে বোঝাপড়াটা শেষ করে আসি। উনি এখন বাইরে আছে জগিং করছে।
অধরা কিছু বলার আগেই জুবায়ের ওর হাত ধরে বেরিয়ে আসলো। বাড়ির পেছনের বাগানে আরমান ফারুকী নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে জগিং করতে এসেছেন। মাঝেমাঝে গল্প করছে আবার দৌড়াদৌড়িও করছে। জুবায়ের সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। আরমান ফারুকী ওকে দেখে থমকে গিয়ে বলল,
> কিছু বলবে?
জুবায়ের হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> বলার মতো অনেক কথায় আছে আপাতত এটা বলুন ওই ফালতু মেয়েটাকে আমাকে কাছে কেনো পাঠিয়েছেন?
আরমান ফারুকী ভ্রু কুচকে চিন্তিত হয়ে বললেন,
> কোন মেয়ে? তুমি কোন মেয়ের কথা বলছো? জুবায়ের মাথা ঠান্ডা করো। তোমার এই হট মেজাজের জন্য বিপদে পড়বে একদিন।
> রাখুন আপনার মেজাজ। ওই মেয়েকে পাঠিয়ে ঠিক করেননি। কি ভেবেছেন আবারও আপনার কথায় উঠবো আর বসবো? কখনও না।
> আরে বাবা আমি সত্যি বলছি আমি এমন করিনি। নিয়ে এসো সেই মেয়েকে আমি কথা বলতে চাই। মেয়েটার কথায় তো হবে না। আমিও কথা বলে দেখি। তুমি দিনদিন বড্ড বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছো। গতকাল আমার নামে নোটিশ পাঠিয়েছো। তোমার সব সম্পত্তি তোমার মেয়ের নামে লিখে দিয়েছো। এসব কি হচ্ছে বলবে? বাচ্চাটার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় ধরো মা*রা যায় তখন সব সরকারি ফান্ডে চলে যাবে। এসব কি পাগলামি বলতো? তোমাকে এসব কে করতে বলেছে? জুবায়ের আমি তোমার ভালো চাই।
আরমান ফারুকীর কথা শুনে অধরা হতবাক হলো। লোকটা ভালো সাজার নাটক করছে নাকি এমনিতেই ভালো কোনটা? জুবায়েরের মাথা গরম ছিল আরও গরম হলো। বাবা হিসেবে এতদিন যাকে সম্মান করেছে হঠাৎ তাঁর গায়ে হাত তোলাটা বেমানান লাগে নয়তো এতক্ষণ অবস্থা খারাপ ছিল। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া তো কথা বলা যাবে না। তাছাড়া সব বলে দিলে লোকটা সতর্ক হয়ে যাবে। অধরা পেছন থেকে জুবায়েরের হাত টেনে ফিসফিস করে বলল,
> যথেষ্ট হয়েছে। আর কোনো ঝামেলা করবেন না। মেয়েটাকে হাজির করুন। তারপর কথা বলবেন।
জুবায়ের কিছু একটা ভেবে ঠান্ডা হলো। আরমান ফারুকী জুবায়েরের হাত ধরে খুব অসহায় কন্ঠ নিয়ে জানালো। উনি এসবের মধ্যে নেই। উনি করুণ মুখে বললেন,
> আমি তোমাদের সকলের ভালো চেয়ে বাবার অনুমতি নিয়ে অধরাকে এই বাড়িতে এনেছিলাম বউ করে। বাবার কাছে শুনেছিলাম কহিনুরের জন্ম হলে আমাদের বাড়ির মেয়েগুলোর জীবন থেকে অভিশাপ কেটে যাবে। বাবা হয়ে এইটুকু চাওয়া কি আমার অপরাধ ছিল? তোমরা অযথা আমাকে ভুল বুঝেছো।
অধরা এখনো ভ্রু কুচকে আছে। এই বাড়িতে যে যাকে পারছে দোষারোপ করে নিজেকে সাধু বানানোর চেষ্টা করছে। দাদু নিজের ছেলেকে দোষ দিলো অন্যদিকে ছেলে দাদুকে দোষ দিচ্ছে। এতকিছুর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো গতকাল যে লোকটাকে ছু*রি*কা*ঘা*ত করা হলো সে কোথায় গেলো?
(চলবে )