চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ পঁচিশ

0
625

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,পর্বঃ পঁচিশ
#মম_সাহা

(৬৮)

তুমুল বর্ষণ মাথায় নিয়ে, অনাকাঙ্খিত ভাবে হয়ে গেলো নওশাদ আর অহির বিয়ে। বেশ সাদামাটা এবং অপ্রত্যাশিত ছিলো মধ্যরাতের সেই বিয়েটা। আর সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হলো, বাহার ভাই ছিল সে বিয়ের প্রধান সাক্ষী। নওশাদ যে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে পারবে তা অহির ধারণার বাহিরে ছিল কিন্তু তবুও সে নড়বড়ে অনুভূতি নিয়ে শক্ত করে সেই মানুষটার হাত ধরেছিল। যা হবে দেখা যাবে তার ভিতরে উপস্থিত। আর সবটা সম্পূর্ণ হওয়ার বড় ভূমিকা বাহার ভাইয়ের।

অহি কাজী অফিসে বাহার ভাইকে সব প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেসও করেছিল “বাহার ভাই, আপনি সিউর কীভাবে ছিলেন যে বিয়েটা আমি করতামই?”

বাহার তখন মুচকি হেসে বলেছিল,”মানুষ বরাবরই ভালোবাসার কাঙালি। যখন কেউ সেই ভালোবাসা উজাড় করে দেয় তখন খুব কম সংখ্যক মানুষই তা ফেরাতে পারে। ঘৃণা দেখেও চুপ থাকা যায় কিন্তু ভালোবাসা দেখলে তার বিপরীতে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। আর আমি তোমাকে প্রথমে কেনো জিজ্ঞেস করেছিলাম আমায় ভালোবাসো কিনা বলো তো? আমি তোমাকে কিঞ্চিৎ ভাঙার চেষ্টা করেছি যেন তুমি খুঁটি শক্ত করে ধরো। আর আমি সক্ষম।”

বাহারের কথায় চুপ রইলো অহি। ভালোবাসবে না করেও আরো একবার ভালোবাসলো বাহারকে। এ-ই শেষ। এরপর আর মানুষটাকে ভালোবাসা হবে না। আর মুগ্ধ হওয়া হবে না মানুষটার উপর। মনে একজন রেখে আরেকজনের সাথে ঘর করা যে পাপ। আর অহি সে পাপ কখনো করবে না। মনের মানুষকে নাহয় মন থেকে চিরতরে বিতারিত করবে।

এরপরেই খুব নীরব ভাবে হয়ে গেলো একপাক্ষিক ভালোবাসার বিচ্ছেদ, এবং আরেকটা একপাক্ষিক ভালোবাসার সন্ধি। প্রকৃতির নিয়মই এটা, কোথাও ভাঙবে সে আবার কোথাও জোড়া লাগবে।

(৬৯)

সওদাগর বাড়িতে মুখ থমথমে ভাব। সেই বাড়ির সকল সদস্য চিত্রা, তুহিনও সহ আজ সে বাড়িতে এসেছে। নওশাদের বাবা-মাও এসেছে। বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা মেয়ে এমন একটা কাজ করতে পারে তা যেন কারো বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাই কেবল বিস্মিত নয়নে তাদের দেখে যাচ্ছে ঘন্টাখানেক যাবত।

প্রথম কথাটা আফজাল সওদাগরই বললেন। গম্ভীর কণ্ঠে সে অহির দিকে তাকিয়ে শুধালেন,
“তোমার যদি নওশাদকে এতই পছন্দ হয়েছে, আমাদের বললেই তো পারতে। আমরা তোমার পছন্দ কখনো অপূর্ণ রাখি নি।”

বড়চাচাকে বাড়ির বাচ্চারা বরাবরই বেশ পছন্দ করে। তাই এ মানুষটার কথার বিপরীতে অহি কোমল হয়েই বললো,
“আমার পছন্দের সব তোমরা পূরণ করেছো তা আমিও মানি। তাই বলে আমার ভালোবাসার সব পূরণ করবে তা তো না। সেই সংশয় থেকেই এমন কাজ করা।”

অহির উত্তরে আফজাল সওদাগর তপ্ত শ্বাস ফেললেন। কিন্তু পরের কথাটা উচ্চারণ করলেন অবনী বেগম। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,
“তোমার ভালোবাসাও আমরা অপূর্ণ রাখতাম না।”

“ও তাই নাকি? সাইকোলজি পড়তে চেয়েছিলাম যেটা আমার ভালোবাসা ছিলো, তোমরা ভর্তি করিয়ে ছিলে বাংলায়। ছয়-সাত বছরের আমি আবদার করে ছিলাম তোমাদের সাথে থাকার, ঠাঁই হয়েছিল আমার হোস্টেলে। এভাবেই পূরণ করতে তাই না?”

মেয়ের তাচ্ছিল্য মাখা কণ্ঠে মাথা নত হয়ে আসে অবনী বেগমের। মেয়েকে সে যখন হোস্টেলে দেয় তখনও তার কাছে জীবনের মানে ভিন্ন ছিল। আজকের অবনীর আর তখনের অবনীর পার্থক্য অনেক। কিন্তু মানুষ তা আর জানলো কই?

“অহি, তোমার মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?”

নুরুল সওদাগরের গম্ভীর কণ্ঠে অহির তাচ্ছিল্য ভাব আর বিস্তৃতি লাভ করলো। খুব করে মানুষটাকেও দুটো কথা শুনাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সে শুনালো না। যতই হোক, নওশাদ এবং তার বাবা-মা সওদাগর বাড়ির মেহমান। তাদের সামনে এমন আচরণ শোভনীয় না।

নওশাদের বাবা-মা এতক্ষণ চুপই ছিলো। সওদাগর বাড়ির কথা কাটাকাটি থামার অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো তারা। তাই তো সওদাগর বাড়ির মানুষদের কথা থামতেই মুখ খুললেন নওশাদের মা নওরিন। তুমুল আশ্চর্যের সাথে সে প্রশ্ন করলেন,
“নওশাদ, তুমি হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলে?”

“হুট করে তো নেই নি, মা। তোমাদের তো জানিয়ে ছিলাম কিন্তু তোমরাই আমাকে কোনো পজিটিভ উত্তর দিতে পারো নি। তাই বাধ্য হলাম।”

“কেবল একবার জানিয়ে ছিলে। মানুষ দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বাবা-মাকে মানায়। অধচ ইতিহাসে তুমিই একমাত্র ছেলে যে একবার মাত্র কথা কাটাকাটি করে বিয়ে করে ফেলছো। কী অদ্ভুত!”

“বিয়েই তো করবো মা, কোনো অপরাধ তো না। তো এত মানামানির কথা আসছে কোথা থেকে? আমি কিংবা অহি, দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই তোমাদের এমন অদ্ভুত আচরণ শোভা পাচ্ছে না।”

“দেখলে দেখলে, তোমার ছেলের কথা শুনলে? মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”

নওরিন খাতুনের স্বামীর প্রতি অভিযোগ। ইলিয়াস খান মিনমিনে কণ্ঠে বললো,
“যা হয়েছে তা কি বদলাতে পারবে? এরচেয়ে মেনেই নেও।”

স্বামীর জবাবে হতাশ নওরিন। তিনি ভেবেছেন তার স্বামী হয়তো তার পক্ষ থেকে একটু হলেও কিছু বলবে। তা আর হলো কই! হতাশার শ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
“এমন হুটহাট বিয়ে আমি মেনে নিতে পারছি না।”

“এখন করণীয়! আলাদা থাকবো?”

ছেলের ঝটপট উত্তরে ব্যাথিত দৃষ্টি নিয়ে তাকান নওরিন খাতুন। দশমাস দশদিন যে ছেলেকে গর্ভে ধারণ করলো, ছেলে ভূমিষ্ট হওয়ার পর এত গুলো বছর যে মা বুকে আগলে রাখলো, একটা মেয়ের জন্য সে মায়ের মুখের উপর এমন প্রশ্ন হয়তো একটা সন্তানই করতে পারে। কি আর করার? যুগ বদলের খেলায় এসব হয়তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কিছুটা রাগ এই মেয়েটার উপরও বর্তাচ্ছে। কিছুটা সময় মৌণ থেকে নওরিন খাতুন তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,
“আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না অহি। কিন্তু আমার ছেলের আবার ওকেই পছন্দ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার পছন্দ অপছন্দে কিছু আটকাবে না। আমি না চাইলেও আমার ছেলে ওর সাথে সংসার করবে আমি জানি। আমার ছেলের হয়তো মায়ের প্রয়োজন নেই অথচ আমার কিন্তু ছেলের প্রয়োজন আছে। একান্তই আমার সেই স্বার্থে আমি বিয়েটা মেনে নিচ্ছি। তবে আমাদের বা আপনাদের পরিবারের একটা মান সম্মান আছে। সেই মান সম্মানের ভিত্তিতে আমি চাচ্ছি বিয়েটা আবার বড় করে দিতে।”

মায়ের কথায় নওশাদের মুখটা ছোটো হয়ে এলো। মা যে তার কষ্ট পেয়েছে তাও বুঝতে পারলো সে কিন্তু এমন জেদ না দেখালে হয়তো পরিস্থিতি ঘুরে যেতো। তাই এমন কঠিন হওয়া।

নওরিন খাতুনের স্পষ্ট কথার ধাঁচ অহির বেশ ভালো লাগলো। মানুষটা হয়তো উপর উপর শক্ত কিন্তু ভেতর ভেতর খুব কোমল। নওরিন খাতুনের প্রস্তাবে রাজি হলেন আফজাল সওদাগর। মহিলজ যে বেশ বুদ্ধিমতী তা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো।

বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো পঁচিশ দিন পরে। অহির মায়ের মতামতও নেওয়া হলো। বাড়িতে পরে গেলো আনন্দের ঢেউ। সব কিছুতে নিরেপক্ষ ভূমিকা পালন করলো রোজা সওদাগর এবং চাঁদনী। না আনন্দ হলেন না অন্য কিছু। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত থাকার কড়া নির্দেশ দেওয়ায় তারা কেবল তা পালন করলো। এছাড়া কিছুই না। চিত্রা আর চেরি তো আনন্দে আত্মহারা কিন্তু চিত্রা চাইলেও সে আনন্দ দেখাতে পারছে না। এ বাড়িটা যে তাকে পর করেছে। পরের বাড়িতে শোক মানায় আনন্দ না।

(৭০)

অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে পা রেখে সংশয়ে কাঁপছে চিত্রা। যে বাড়িতে একসময় বিনা বাঁধায় ছুটে বেড়িয়েছে, সে বাড়ির দেয়াল ছুঁতেও যেন আজ করছে ভয়। কেমন পর পর লাগছে সবটা!

বাড়ির সকলে যখন মিষ্টি ভাগাভাগি করতে ব্যস্ত চিত্রা এক ফাঁকে চলে গেলো চাঁদনী আপার কাছে। ছোটো থেকে এ অব্দি আপা তাকে কম আদর করে নি। আজ যদি আপা মুখ ফিরিয়ে থাকে তবে চিত্রার দায়িত্ব আপার কাছে ক্ষমা চাওয়া। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।

চাঁদনী নিজের ঘরের কিছু জামাকাপড় গুছচ্ছিল। তন্মধ্যেই ঘরে দরজায় টোকার শব্দ, ক্ষীণ শব্দে চিত্রা বললো,
“আসবো?”

চাঁদনী একবার পলক ঝাপটিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বললো,
“আয়।”

চিত্রা আসলো। ছোটো ছোটো পা ফেলে ঘরে থাকা চেয়ারটাতে বসলো। বুকে তখন তার তুমুল ঝড়। এত কাছের বড় আপার সাথে কথা বলতেই হাত-পা তার কাঁপছে। তবুও সে বললো,
“কেমন আছে, আপা?”

“যেমন চেয়েছিলি।”

বড় আপার কাঠ কাঠ উত্তরে মনে মনে হোঁচট খেলো চিত্রা। কণ্ঠধ্বনি বার বার জড়িয়ে এলো তবুও সে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম আপা।”

“তাহলে আর কি, ভালোই আছি।”

চিত্রা আর কথা আগানোর শক্তি পেলো না। কত কথা সাজিয়ে এসেছিলো কিন্তু এখন সব অগোছালো হয়ে গেছে। ঘরে দু’জন মানবী চুপ হয়ে রইলো। কত কথা বলতে চেয়েও বলা হলো না। শেষমেশ চিত্রা মনের লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটা করেই বসলো,
“আপা, দুলাভাইয়ের সাথে তোমার সব ঠিক আছে তো?”

চাঁদনীর হাত থেমে গেলো সাথে সাথে। কিন্তু উত্তরটা সাথে সাথে এলো না। এলো দুই তিন মিনিট পর। হৃদয় ছাড় খার করা উত্তর সেটা। চাঁদনী আপা অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আমার মায়ের রাগ আমার উপর না মিটালেও পারতি।”

“আমি তোমায় ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাই নি বড়আপা।”

চিত্রার মাথা নত হয়ে এলো। বড় আপা তাচ্ছিল্য করে বললো,
“এত জোরে ধাক্কা কী মানুষ অনিচ্ছাকৃত দেয়? আমার তো জানা ছিলো না।”

বড় আপার কথায় চিত্রার চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমি তো ধাক্কা দেই নি তোমায়, কেবল হাত ঝারা দিয়ে ছিলাম।”

“থাক সেসব কথা। আমি তবুও দোয়া করি, তুই যেন তোর স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকিস।”

বড় আপার দোয়ার আড়ালে কী গোপন অভিশাপের ছোঁয়া ছিলো! চিত্রার মনে কেমন খচখচ করলো বড় আপার কথা। সে তো আপাকে ধাক্কা দেয় নি, তাহলে!

তন্মধ্যেই নিচ থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। নুরুল সওদাগরের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে তুমুল ভাবে। চিত্রা এবং চাঁদনী অপেক্ষা না করেই ছুট লাগালো।

(৭১)

বাহার ভাইয়ের ঘর ফাঁকা। তার অবহেলার বিছানা শূণ্য। পড়ার টেবিলে যত্নের বই গুলোও নেই। বাহার ভাইয়ের অস্তিত্ব চিলেকোঠার ঘরের কোথাও নেই। মূলত নুরুল সওদাগরের চেঁচামেচির কারণ এটা।

চিত্রা কেবল ফ্যালফ্যাল করে শূণ্য ঘরটায় তাকিয়ে রইলো। শূণ্য ঘরটার রঙ মেটে হওয়া দেয়ালে বড় বড় করে লিখা,
“স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার যার প্রতি অনীহা, মানুষ কীভাবে তাকে করবে দয়া!”

অবশেষে, অবশেষে বাহার ভাই নামক মানুষটা মায়া লাগিয়ে চলে গেলো! অবশেষে বাহার ভাই মানুষটা সত্যিই কঠিন হলো। অষ্টাদশী মানতে পারবে এই অনাকাঙ্খিত বিচ্ছেদ?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here