চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,বোনাস পর্ব

0
392

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস,বোনাস পর্ব
#মম_সাহা

(৬৫)

তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে বিরক্ত অহি। আর কিছু অপ্রয়োজনীয় মিথ্যে অজুহাতে বাহিরে এসে নওশাদের দেখা পাওয়ার পর হতভম্বও সে। লোকটার ফর্সা ফর্সা মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! অনেকক্ষণ যাবত হয়তো ভিজছে! অহি দ্রুত গিয়ে নওশাদের মাথার উপর ছাতা ধরলো। বৃষ্টির অবাধ্যতায় কতখানি ভিজেও গেলো সে। বিরক্ত এবং অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কী করছেন!”

ঠান্ডায় নওশাদের নাক-মুখ বসে যাওয়ার উপক্রম। তবুও অনেক কষ্টে বললো,
“আপনাকে দেখতে এসেছি!”

“আপনি আমাকে দেখতে বনানী থেকে ধানমন্ডি এসেছেন! বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব জানেন তো?”

“আপনি বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব দেখছেন অথচ আমার ভালোবাসার গুরুত্ব দেখছেন না! এ কেমন অবিচার আপনার? দয়া করে নাহয় একটু দয়া করুন, আমায় নিয়ে ভাবুন, আমায় একটু নাহয় ভালোবাসুন।”

নওশাদের কণ্ঠে তুমুল আকুলতা। অহি বিরক্ত হলো। এমন পা* গলামো কিংবা বাচ্চামো তার কখনোই পছন্দ না। তবুও লোকটা এসব করছে!

অহিকে চুপ থাকতে দেখে কথা বললো নওশাদ। আকুতি করে বললো,
“আমার প্রতি কী আপনার একটুও মায়া হয় না?”

“না, হয়না।”

প্রশ্নের জবাবে অহির কাঠকাঠ উত্তর। নওশাদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভারিক্কী গলায় বললো,
“তাহলে এখনি এখান থেকে যান। আমার ভালোবাসার প্রতি যার দয়া নেই, তার যেন আমার প্রতিও কোনো করুণা নাহয়।”

নওশাদের কথার এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে প্রায় থতমত খেয়ে গেলো অহি। স্তম্ভিত হয়ে বললো,
“কী করছেন? টিনএজারদের মতন আচরণ করবেন না।”

“ভালোবাসার আচরণের আবার পার্থক্য আছে নাকি? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি গম্ভীর কিংবা টিনএজারও হতে রাজি।”

“আমার এসব পছন্দ না কিন্তু।”

“তাহলে চলুন, বিয়ে করি?”

নওশাদের হঠাৎ এমন প্রস্তাবে অহি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কেমন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো! অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“কী!”

“চলুন না, বিয়ে করে ফেলি।”

অহি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে নওশাদ ফাজলামো করছে বলে তো মনে হয় না কিন্তু কথাটা যে সত্যি সত্যি বলছে তাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বনানী থেকে এই রাতে ছুটে এসেছে কি কেবল এই কথাটা বলার জন্য? এত পা* গলাটে চিন্তা! অহি তপ্ত শ্বাস ফেললো, শীতল কণ্ঠে বললো,
“যেখান থেকে আসছেন, সেখানে ফিরে যান। এসব করে আমার মনে বিরক্তের সৃষ্টি করছেন, তাছাড়া আর কিছুই না।”

“কোথায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন! যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে হলেও আমার আপনাকে চাই।”

“আমাকে চান? কেনো চাইবেন? ভালো লাগে বলে?”

“না, ভালোবাসি বলে।”

নওশাদের সহজ স্বাভাবিক উত্তরে অহির তেজের ভাঁটা পড়লো। হাল ছেড়ে দেওয়া ভাবে বললো,
“আচ্ছা মানলাম ভালোবাসেন বলে। তা, ভালোবাসলেই কি পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? ইতিহাসে এমন কতই তো হয়েছে যে তুমুল ভালোবাসার পরও একজন আরেকজনকে পায় নি। তাহলে আপনারই কেন পেতে হবে?”

“ইতিহাসে বিচ্ছেদ ছিলো বলে আমিও অপ্রাপ্তি রাখবো তা ভাবছেন কেনো? বার বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে তারও কোনো মানে নেই। ইতিহাস যারা রটেছে তারাও মানুষ। তারা নাহয় রটেছে অপ্রাপ্তির ইতিহাস, আমরা নাহয় রটবো প্রাপ্তিরটা।”

“আমায় পেয়ে কি আর এমন হবে বলুন? আমাকে এখন হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু একসাথে সংসার করার পর আর নাও ভালো লাগতে পারে।”

“আপনাকে পেলে তেমন কিছুই হবে না। কেবল পাওয়া না পাওয়ার এই পৃথিবীতে, আপনাকে পেয়ে গেলে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।”

এমন একটা অনুভূতি মাখানো কথা শোনার পর আর কথা খুঁজে পেলো না অহি। বিরক্ত দেখাতে গিয়ে দেখলো কি আশ্চর্য! তার বিরক্ত লাগছে না। তবুও সে মিছে বিরক্তের ভাব ধরলো। নাক-মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো নিজের বিল্ডিং এ। নওশাদ পেছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,
“আপনি বিয়ের জন্য রাজি না হলে আজই আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার জান দিয়ে দিবো।”

অহি গোপন হাসলে। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ ম* রে না। ভিজতে থাকুন।”

“বৃষ্টিতে না ম* রলেও আপনার ঐ হাসিতে ঠিকই ম* রেছি।”

অহি আর পিছু ফিরলো না। চলে গেলো নিজের ফ্লাটে। নওশাদের কথাটা সে নেহাৎই হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। ভাবলো নওশাদ হয়তো মজা করেই বলেছে। কিন্তু অপরদিকে নওশাদ নাছোড়বান্দা তা যে জানা নেই রমণীর।

(৬৬)

মন খারাপের আকাশে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো অভিমানেরাও। চিত্রা বাহারের তীক্ষ্ণ কথা হজম করে চুপ করে ছিলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাকে চুপ করিয়েছে বাহারের আনা অন্য কারো জন্য নূপুর আর চিঠি। চিঠিটা পড়তে পারে নি তবে যতটুকুই দেখেছে মুগ্ধতা ভরা ছিলো। কারো জন্য খুব যত্নে লিখেছিলো চিঠিটা। বাহার চিত্রাকে ছাড়াও অন্যকারো কথা চিন্তা করছে ভাবলেই অষ্টাদশীর বক্ষ মাঝে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়। প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে আমি একটু বেশিই স্বার্থপর হই। সব ভাগ করা মানুষটাও প্রিয় মানুষের ভাগ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বাহার ভাইকে তা জানিয়ে লাভ নাই। মানুষটা তো এমনই, অনুভূতি বুঝলেও প্রকাশ্যে তার মূল্য দেই নি কভু। অথচ সেই বাহার ভাইয়ের জন্যই অষ্টাদশীর এত হাহাকার!

ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে ছোটোখাটো একটা আড্ডার আসর বসলো। কিন্তু চিত্রার মন বসলো না সেই আসরে। সে কাজের নাম দিয়ে উঠে চলে গেলো। তখনও প্রকৃতিতে ভরা বর্ষণ। বারান্দার ছোটো ছোটো শিকের জানালা গলিয়ে হাত ভিজাতে পারছে না বলে চিত্রার মন আরও খারাপ হলো। কেবল দেখেই যেতে হলো নিবিড়ে সেই বর্ষণ ধারা।

তন্মধ্যেই চিত্রা নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। মানুষটাকে দেখার আগেই মানুষটার গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ভালোবাসা যখন মানসিক শান্তি নাহয়ে মাথা ব্যাথার কারণ হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় সে ভালোবাসার মানুষটি ভুল।”

চিত্রা কণ্ঠের মালিককে চিনলো কিন্তু এ মানুষ এমন কথা বলতে পারে ভেবেই তার অবাক লাগলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“দুলাভাই, আপনি!”

চিত্রার বিস্মিত মুখ দেখে হাসলো মাহতাব। পকেটে হাত গুঁজে হেলতে দুলতে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“ভালোবাসার মানুষ ভুল হলে ভালোবাসা ফুল নাহয়ে কাঁটা হয়ে রবে কিন্তু শালীকা।”

চিত্রা কথা বললো না। দুলাভাই কিছু বুঝতে পারলো কিনা ভেবেই তার বুক কাঁপলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কী বলছেন এসব?”

“তোমাদের বয়সই এমন যে এটা বলতে হচ্ছে। শোনো, কোনো সম্পর্ক যদি তোমায় ব্যাথা দেয়, তিল তিল করে মা* রে তবে তুমি বরং সে সম্পর্কটাই মে* রে ফেলো। মনে রেখো, ভুল কারণে নিজে মরার চেয়ে, ভুল কারণটার মৃত্যু হওয়া ভালো।”

চিত্রা কি বুঝলো কে জানে, কেবল অনবরত মাথা নাড়ালো। চিত্রাকে খুশি করতে হাস্যোজ্জ্বল মাহাতাব বলে উঠলো,
“চলে আজ রাতের রাস্তা ঘুরবো, বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খাবো। যাবে?”

চিত্রা কতক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলো। এতক্ষণের মন খারাপ টা তার হুট করেই ভালো হয়ে গেলো।

(৬৭)

তখন প্রায় মধ্যরাত। চিত্রাদের ফ্লাটে কেবল অহি আর মুনিয়া বেগম রয়েছে। চিত্রা, চেরি, মাহতাব, তুহিন তো কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে রাতের রাস্তা ঘুরার জন্য। বাহার ভাইও তার পরপর বেরিয়ে গিয়েছে। অহি, মুনিয়া বেগম নিজেদের মতন ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত তিনটে, হুট করে সশব্দে বেজে উঠলো অহির ফোন। কড়া ঘুমটা হঠাৎই হালকা হয়ে এলো ফোনের শব্দে। অহি বিরক্ত হলো, চোখ-মুখ কুঁচকে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বাহার ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমায় ভালোবাসো অহি?”

অহির ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে হুট করে এমন কথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতির সৃষ্টি করলো। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক জেগে উঠলো সেকেন্ডের মাঝেই, অহি চুপ থেকে রয়েসয়ে উত্তর দিলো,
“ভালোবাসতাম, এখন ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছি।”

উত্তর টা শুনে ফোনের অপর পাশের বাহার ভাই কি একটু হাসলো! হ্যাঁ হয়তো হাসলো। ক্ষীণ হেসে বললো,
“এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। আরেকটা উত্তম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলো তো ঝটফট।”

অহি ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বললো,
“কী?”

“তোমাদের বাড়ির নিচে যে ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজেছে এই মাঝ রাত্তি অব্দি, তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফেলো। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি অনবরত ছুটে চলা ঘড়ির কাটা, আমার মতন বেকার বাহারের জন্য থেমে থাকা তোমার মানায় না। আমরা তো বেকার মানুষ। আমরা হলাম অযত্নের কংক্রিট।

মানুষ ভাবে পাথর মন, দিলাম নাহয় একটু ভেঙে,
ক্রেংকিটের আড়ালেও হৃদয় নরম,মানুষ কি আর তা জানে?

একটা মৃত্যুর স্বাদ পেতে, বেকার মরে রোজ,,
তাই তো সমাজ নিয়ম করে আমাদের স্বপ্ন করছে ভোজ।

ফ্যানের সাথে কি যেন ঝু* লে, ডাকে মোরে মুক্তি হেথায়,
বাঁচবার সাধ বেকারেরও আছে, সে কথা কি সমাজে বিকায়?

যোগ্যতার সার্টিফিকেট তাচ্ছিল্যে ভাসে, অযোগ্যদের কাছে,
একটা চাকরি না পেলে, বেকারদের প্রেমও মিছে।

তোমাদের অবশ্য সে পিছুটান নেই, প্রেম মিছে হওয়ার ভয় নেই। মধ্যরাতে তোমার দোরে ভালোবাসা চাওয়া মানুষটাকে আজ নাহয় একটা কিছু বলেই দেও। মুক্তি নাহয় প্রেমের মৃ* ত্যু।”

অহি চুপ করে বাহার ভাইয়ের কথা শুনলো। অপর পাশ থেকে কল টা কাটতেই সে ওরনা টা জড়িয়ে সাবধানে ফ্লাটের দরজা আটকে নিচে নেমে গেলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে।

বিল্ডিং ছেড়ে রাস্তায় নামতেই জুবুথুবু নওশাদকে চোখে পড়লো অহির। বেচারা শীতে কাঁপছে। অহি বেশ শক্তপোক্ত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেলো নওশাদের কাছে। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনি না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন? এসব করে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?”

“আমায় বিয়ে করে নিলেই তো পারেন। বাঁচিয়ে নিন না আমায়।”

অহির মুখে তুমুল কাঠিন্যতা। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য যে ছেলেটা মধ্যরাত অব্দি এমন পা* গলামো করতে পারে তাকে ফেরানোর সাধ্যি আমার নেই। এত রাতে কাজী অফিস খোলা থাকবে তো?”

নওশাদ ভেবেছিল এবারও বরাবরের মতন প্রত্যাখ্যান আসবে কিন্তু অহির কথায় সে হতভম্ব। নওশাদের হতভম্ব ভাব দেখে অহি ঠাট্টা করে বললো,
“বিয়ে কি করবেন না শহীদ হওয়ার ইচ্ছে এখনও আছে?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here