রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ১৮

0
1186

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৮

এদিকে আঁকিবের চিঠি পাওয়ার একমাস পূর্ণ হলো।
এরি মধ্যে একদিন দুপুরে রোদেলা বাসা থেকে বের হয়ে ওর মেঝো খালামনির বাসায় যেতে। তিনি ওদের বাসার কাছেই থাকে৷ ওদের বারান্দা হতে ডাকলে শুনতে পাবেন এমন দূরত্ব। অথচ মেইন রোড দিয়ে গেলে অনেকটা পথ ঘুরে যাওয়া লাগে। প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগে। আর বাড়ির পেছনের সর্ট কার্ট একটা রাস্তা আছে সেটা দিয়ে গেলে দু-তিন মিনিটে পৌঁছানো যায়। যদিও জায়গাটা সরু আর নির্জন। লোকজন তেমন যাতায়াত করে না সেখান দিয়ে।

সেদিন ওর মা ওর খালামনির পছন্দের তরকারি রান্না করায় রোদেলাকে বলে তাকে দিয়ে এসে খাবার খেতে। রোদেলা তাই সর্ট কার্ট রাস্তাটাই বেছে নেয়। একটু হাঁটতেই রোদেলা বুঝতে পারে কেও ওর পিছনে রয়েছে। পিছন ফিরে তাকায় ও। দেখে আঁকিব। ওকে দেখে ওর পালানোর মতো অবস্থা।

রোদেলা আবার হাঁটা শুরু করে পেছনে আঁকিব। রোদেলা দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে বলে-
: কি ব্যাপার…? কিছু বলবেন…
থতমত খেয়ে আঁকিব বলে
: না, মানে….
চিঠির উত্তরটা…?
: কোন চিঠি…?
মাথা চুলকায় আঁকিব… ভাবতে থাকে ওটা বেহাত হলো কি না…
: আচ্ছা থাক…
: কি থাকবে…
: না, কিছু না…
বলেই ও চলে যায় ও।
রোদেলা হাসতে থাকে ওর এমন কান্ড দেখে।

এর দু-তিন দিন পর স্কুলে যাবার সময় রাস্তার সামনের মুদি দোকান থেকে কলম কিনতে দাঁড়ায় রোদেলা। ও না তাকিয়েও বুঝতে পারে আঁকিব ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। দোকানি মামা যখন কলম আনতে দাঁড়ায় আঁকিব ও ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। খুব সম্ভবত চিন্তা করতে সময় নেয় কি করবে… তা নিয়ে। দোকানি কলম দেয়। রোদেলা কলমটা ব্যাগে ঢুকাতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। এরপর তিনি ভাংতি টাকাটা ফেরত দেয়। আঁকিব দোকানিকে এক প্যাকেট নুডলস দিতে বলে, সেটা নিতে পেছন ঘুরতেই সে রোদেলার ঐ টাকার নিচে একটা কাগজ ঢুকিয়ে দেয়। রোদেলা এ কান্ড দেখে অবাক।

আঁকিব দ্রুত টাকা দিয়ে নুডলস হাতে দ্রুত হাঁটা শুরু করে। রোদেলা আশেপাশে কেও দেখেলো কিনা তা খেয়াল করে মুচকি হেসে টাকাটা দ্রুত ওর পার্সে ঢুকায়।

স্কুলে গিয়ে দেখে কাগজটা আরো একটা চিঠি। আগেরটা ছিলো সাহিত্যিক টাইপ। ভালো যে বাসে তা ঘুরিয়ে পেচিয়ে লেখা। আর এই চিঠিটা সংক্ষিপ্ত, অকপটে বর্নিত হয়েছে ওর ভালোবাসার কথা, আরো ছিলো ওকে ছাড়া ওর পৃথিবীর করুণ বর্ণনা।

রোদেলা আঁকিবের ব্যাপারটা পেন্ডিং রেখেছে। একটু যাচাই করে নিতে চায় ও। সত্যিই কি ভালোবাসে নাকি এসব টাইমপাস।

রোদেলা সিমিকে বললো – তুই তো জানিস আমার মা কি কড়া, এসব জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। তুই ওকে বলে দিস ও যদি বন্ধু হিসেবে থাকতে চায় তাহলে কথা বলবো, তা না হলে এসব দাঁড়িয়ে থাকা, ফলো করা এসব বাদ দিতে। ওর পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব না।

এরপর শুরু হয় আঁকিবের পাগলামি। দিন নাই রাত নাই দাঁড়িয়ে থাকে ওদের বাসার সামনে। রাতের তিনটা বাজেও বারান্দার জানালায় দাঁড়ালে ওকে দেখা যায়৷
পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। দিনদিন নাদুস-নুদুস আঁকিব কেমন শুকিয়ে যায়। অল্প বয়সের প্রেম গুলোতে যা হয় আর কি…! কি পাগলামি এসব…! এমন করলে কেও না কেও অবশ্যই জানবে এ ছেলে কেন দিনরাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। পাড়া প্রতিবেশী না বলতেই অনেক কিছু বুঝে। আর এ তো প্রেমের দাবিতে নিরব অনশন।

একদিন বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে ও। ওর বাবা ওকে বকা দিয়ে নিয়ে যায় বাড়িতে। এরপর তিনদিন আঁকিবের কোন দেখা নাই। খবর নিয়ে জানলো আঁকিব হসপিটালে ভর্তি। জ্বর, ঠান্ডা লেগে মাথা ঘুরে পরে যায় জ্ঞান হারায় ও। তাই তারা ওকে হসপিটালে নিয়ে যান উনারা।

কি যে করবে রোদেলা ভেবেই পায় না। এসবের জন্য নিজেকে দোষী ভাবে ও। জীবণের এই ভাগটায় বিশেষ করে মেয়েরা প্রেম করে প্রেমিককে জীবণ সঙ্গী রূপে পাওয়ার জন্য। যদিও তখন বয়স,পরিস্থিতি, পড়াশোনা এ ব্যাপারে কোন ধারনা থাকে না। কত বছর অপেক্ষা করতে হবে দুজনের এক হতে, আদৌ এক হওয়া হবে কি না… এ ব্যাপারে বাস্তবিক কোন ধারনাই থাকে না। এজন্য তারা অনেক ভেবে চিন্তে, যোগ-বিয়োগের অনেক হিসেব কষে জীবণের প্রথম প্রেমটা করে। এত হিসেবের প্রেমটা হয়তো ভেঙেও যায় ঢুনকো কারনে, তবুও ভালোবাসে দুজন দুজনকে আপন করে পেতে। কামুকতা যতটা না থাকে এই প্রেম গুলোতে তার চেয়ে বেশী থাকে দুজনকে দুজনে কেবলি আপন করে পাবার আকুতি। এক পলক দেখা, একটু হাসির বিনিময়, চিঠি কিংবা প্রিয় কোন গিফটের আদানপ্রদান, খুব বেশী হলে হাতটা ধরা। এজন্য এই প্রেম গুলো অনেক বেশী পবিত্র হয়ে থাকে।

আজকাল কেও কেও হয়তো এর ব্যাতিক্রমও হয়ে থাকে। অনেকের আবার দুম করে প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু রোদেলা একটু বেশীই বাস্তববাদী। জীবণের এই ঘাত-প্রতিঘাত ওকে বয়সের চেয়ে বেশী ম্যাচিউর করে তুলেছে।

সিমির বন্ধুকে দিয়ে আঁকিবকে একটা চিঠি দেয় রোদেলা।

“রবিবার,
কলোনীর লাইব্রেরি,
বিকাল ৫ টা…..”

জাস্ট এটুকুই।

রেদেলা একটু সময় পেলো ভাবার। ওকে কি বলবে তা গুছিয়ে নেয়া দরকার। সিমি বললো এমন ভাবে ভাবছিস যেন ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। জাস্ট দেখা করবি, প্রেম করার হলে হ্যা বলবি আর না করার হলে কিছু একটা বলে দিবি ব্যাস। এত ভাবাভাবির কি আছে…

রোদেলা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
ইশ…! তোর মতে যদি ভাবতে পারতাম….!
সিমি উত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে…. আর বলে- আজব পাবলিক…

রবিবার…
বিকেল চারটা পয়তাল্লিশ
সেদিন ছিলো শবেবরাতের আগের দিন। যথা সময়ে লাইব্রেরিতে এলো দুজনে। বারান্দার টেবিলে মুখোমুখি দুজনে বসলো। মুখে কোন কথা হলো না।

প্রথমে বললো রোদেলা.
: তারপর…?
: তারপর আর কি… তারপর যা তা তো তোমার কাছে…
: ওহ্ তাই নাকি…!
: হুম…
: যা করলেন আপনি তা কি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না…
: কি করেছি আমি…? তোমার পথ আগলে রেখেছি, নাকি বিরক্ত করেছি তোমাকে…? নাকি ” প্রেম চাই “প্ল্যাকর্ড হাতে বসে ছিলাম ..?
: বাসার সামনে খাম্বার মতে দাড়িয়ে থাকাটা কি স্বাভাবিক…?
: ভালো লাগতো তাই দাড়িয়ে থাকতাম।
: মানুষ কি ভাবাবে তা ভেবে দেখেছেন…?
: যার যা ভাবার ভাববে, আমার তাতে কিছু যায় আসে না,
: আমার যায় আসে, হুট করে একটা ছেলে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, আপনার বাবা-মা’ই বা কি ভাববেন…
: বাবার কাছে বাইক চেয়েছিলাম, তিনি ভেবেছেন কিনে না দেওয়ায় রাগ করেছি…
: আরেব্বাহ্ এক ঢিলে দুই পাখি…!
: এসব বলতে ডেকেছো…?
: নাতো…
: তো…
: আমার জীবনটা অন্য সবার চেয়ে আলাদা, আমি ভয় পাই ভালোবাসতে… কারণ আমার অনেক দায়িত্ব…
: তোমার দায়িত্ব আমরা দু’জন একসাথে পালন করবো,
মলিন হাসি হাসলো রোদেলা।
: কেন আপনার পরিবার তা মেনে নিবে..? আমি বিত্তশালী পিতার কন্যা নই, উল্টো আমার পরিবারের দায়িত্ব আমার উপর, তাছাড়া রূপবতী ও নই, তেমন কোন গুনও নেই আমার। আপনি হয়তো ভালোবেসে এসব মেনে নিবেন আপনার পরিবার কেন মানবে….?
: আমি আমার পরিবারের একমাত্র সন্তান তাই…
: আমার ভয়টা এখনেই…
অনেকগুলো সন্তান থাকলে হয়তো তারা কষ্ট কম পেতো, একজনকে মন মতো বিয়ে দিতে না পারলে, অন্য একজনকে দিয়ে শখ পূরণ করলো। কিন্তু আপনি একমাত্র সন্তান… আর তাদের জায়গায় যদি আমি থাকতাম আমিও এ সম্পর্ক মেনে নিতাম না।
: তোমার এত কিছু ভাবা লাগবে না, তুমি ছোট মেয়ে ছোটর মতো থাকো। এসব আমি দেখবো। তুমি শুধু আমার হও, বাকী সব আমি দেখে নিবো।
রোদেলা উত্তর কিছুই বলে নি, অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলো চোখের পানি আড়াল করতে।
: আমি তোমাদের ব্যাপারে সব জানি রোদেলা। আমি তোমার পরিবারকে বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো তোমাকে। তাছাড়া আমি তোমাকে দেখে তোমাকে বিচার করেছি, তোমার পরিবারকে দেখে না। আমি খুব সম্ভবত বছর খানিক রয়েছি দেশে। স্কলারশিপের ব্যাবস্থাটা গেলে কোথাও একটা সেটেল হয়ে যাবো।
: আমার ভয় হয় কাওকে ভালোবাসতে…
: আমাকে ভয় করার কোন কারন নেই, আমার মাথায় কোন শিং নেই, কিংবা আমার চারটা পা ও নেই। আমি খুবই নিরিহ একটা জীব। তিনবেলা খাবার আর সারা বেলা ভালোবাসা দিলেই আমি সহজেই পোষ মেনে যাই…
একথা শুনে হেসে দেয় রোদেলা…

এরপর একটা প্যাকেট দেয় আঁকিব। বলে আজ থেকে আমি তাহলে তোমার হলাম….

কথাটা বলেই লাইব্রেরির বারান্দা থেকে চলে যায় আঁকিব।
প্যাকেটা বুকে জড়িয়ে রেখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রোদেলা। এসব স্বপ্ন নয় তো… সত্যিই কি ওর ভাগ্যে এমন ভালোবাসা রয়েছে…

বাসায় ফিরে রোদেলা প্যাকেটা খুললো। আঁকিব সেখানে আড়ং থেকে আনা একটা সাদা কুর্তি আর একজোড়া রূপার নুপুর উপহার দিয়েছিলো রোদেলাকে। নুপুর জোড়া হাতে নিয়ে গালের সাথে অনেকক্ষণ আগলে রেখেছিলো রোদেলা।

নুপুর…!
রূপার একজোড়া নুপুর…!
রোদেলার অনেকদিনের শখ…!

এই নুপুর জোড়া দেখে রোদেলা ভেবেছিলো না বলতেই যে শখ পূরণ করে সে হয়তো কখনো ওর হাত ছেড়ে যাবে না….

চলবে….

previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1501382216989631/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1503442150116971/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here