রোদেলা লেখা : মাহাবুবা মিতু পর্ব: ১৯

0
879

রোদেলা
লেখা : মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৯

সেই দিনগুলো স্বপ্নের মতো ছিলো, ওকে এক পলক দেখায় যে শান্তি রোদেলা পেতো তা ওর কাছে ছিলো অপার্থিব কোন সুখ। জীবণে এরকম সুখানুভূতি সেবারই প্রথম। এর আগে ওর জীবণের রোজনামচায় সুখ বলে কিছুই ছিলো না, ছিলো অপমান, ঘৃণা, লাঞ্ছনা, আর সীমাহীন কষ্ট।

আঁকিব স্বপ্ন দেখতে ভয় পাওয়া রোদেলাকে স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছে। জীবণের নতুন একটা মানে খুঁজতে পথ দেখিয়েছে। দিন যত যায় ওদের ভালোবাসার গভীরতা তত বাড়ে। রোদোলা প্রথমবারের মতে ভাবে জীবণ এত সুন্দর….!

স্কুল পালিয়ে দেখা করা, দুজন মিলে বাইকে দূর বহু দূরে রাইড করা, ঢাকার বিখ্যাত সব খাবার খুঁজে খুঁজে খাওয়া। দুইটা মাস যেন ঘোরের মধ্যে ছিলো। সময় সামনে খুব কম। কারন ওর ভিসা প্রসেসিং শেষের দিকে। যে কোন সময় ওকে টিকেট কেটে চলে যেতে হবে। রোদেলা এসব শুনে ভয় পায়। একমাত্র আঁকিবই ওর দুঃখগুলোকে ছুঁয়ে দেখেছে, জীবণের ঝড়ের ঝাপটায় ভাঙাচোরা মনটাকে সারিয়ে তুলেছে। সেই আঁকিব যদি চলে যায় ওর কি হবে…?

তারমানে এই না যে ও আঁকিবের ভালো চায় না। ও চায় আঁকিব যাক। গিয়ে নিজে সেটেল হয়ে ওকেও নিয়ে যাক এই বিষাক্ত মানুষগুলোর থেকে।

যেখানে ওকে কেও চিনবে না…
কেও জানবেনা ওর বাবা মায়ের কুৎসিত অতীত…
কেও জিজ্ঞেস করবে না তোমার বাবা কি আসছেন…..

সেখানে নতুন এক পৃথিবী গড়ে তুলবে ওরা। এই সুখের জন্য কষ্ট তো করতেই হবে। রোদেলাকে এসব অনেক বুঝায় আঁকিব। ও চায় রেদেলার অতীত মুছে দিতে। কিন্তু এটা তো কোন ম্যাজিক না…. যে হুস করে সব ঠিক করে দিবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবের এই দুনিয়ায় ম্যাজিক তখনই ঘটে যখন মানুষ চেষ্টা আর পরিশ্রম করে। আঁকিব বলে তুমি আমার পাশে থাকলে আমি সব পারবো করতে।

রাতে যখন ঘুমাতে যায় এসব কিছু নিয়ে ভাবনায় ডুব দিতো।
মাঝে মাঝে রোদেলার কান্না পেতো, “এত সুখও ছিলো ওর কপালে…… ” এই ভেবে। ভয়ও পেতো মাঝে মাঝে, কারন বাস্তবিক রোদেলা জানে যত সুন্দর, সহজ দেখাচ্ছে এসব, পথটা তত সোজা না। সুখের সাথে রোদেলার সম্পর্কটা যে বৈরী । জীবনে যে কোন কাজে ও এক পা এগিয়েছে তো জীবণ ওকে ধরে তিন পা পিছিয়ে দিয়েছে। এজন্যই ভয় হয় ওর।

আঁকিবে চলে যাওয়া সময় এগিয়ে আসছিলো খুব দ্রুত। শপিং, আত্নীয়দের বাসায় দাওয়াত খাওয়া এসবে ব্যাস্ত সময় কাটছিলো। এমন দিনও গিয়েছে একবারও দেখা হয় নি দুজনের। ছোট্ট রোদেলা কষ্ট পেতো, অভিমাণ করতো। আঁকিব তখন ওকেও দাওয়াতে নিয়ে যেতে চাইতো। যাতে একসাথে কিছুটা সময় অন্ততঃ থাকা যায়। রোদেলা বলতো
: পাগল তুমি…! যাদের বাসায় যাবে তারা কি ভাববে….?
আঁকিব জানায় ওর বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াতে ওকে নিয়ে যাবে। পরের রবিবার ও যেন তৈরী থাকে।

রোদেলার এই কম কি। পুরো একটা দিন আঁকিবকে কাছে পাবে। রোদেলা কিছু কেনাকাটা করে আঁকিবের জন্য। টিশার্ট, একটা ঘড়ি, আর পারফিউম। ইদে স্টুডেন্টেদের মায়েরা সালামী দিতো, আগে রোদেলা ওর মা ওর কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিতো। টানাপোড়েনের সংসার যেন তলাবিহীন ভাঙা ঝুড়ি। যত দাও ততই লাগে। ওর একার টাকায় কিন্তু চলতো না ভালোভাবে সংসার। ঢাকা শহরে যে সংসারে বাবারা দায়িত্ব ঠিক ভাবে নেয় না, গা বাঁচিয়ে চলে তারা জানে জীবণ কত কঠিন। ওদের জীবণের
প্রথম দিকে ও দেখেছে যে ওর খালামনিরা সবসময়ই চাল, ডাল মাছ বাজার করে দিতো ওদের। ধরতে গেলে তখন তারা না থাকলে ওদের অস্তিত্বই থাকতো না। ইদের জামা জুতাটাও পর্যন্ত তারা কিনে দিতো। ইদে কোন ড্রেস নতুন বের হলেই শত কষ্টেও তারা ওকে তা কিনে দিতো। এত বড় বংশে রোদেলাই ছিলো একমাত্র আদরের ভাগনি।

একটা সময় এমন হয়েছে যে ওদের টানতে টানতে তাদের নিজেদের কোন ব্যাক্তিগত সেভিংসই থাকতো না। হাতখরচের টাকা দিয়ে আর কত তালি দেয়া যায়। তাছাড়া তদেরও তো সংসার আছে আরো অন্যান্য খরচ আছে। কিন্তু তারা আজও ওদের সকল সুখ দুঃখে পাশে আছে ছায়ার মতো। আর যাদের রক্তের পরিচয় বহন করছে ওরা তারা খোঁজ ও নিতো না, ওরা কি বেঁচে আছে নাকি না খেতে পেয়ে মারা গেছে। তাদের ও দোষ নেই, তারাও তাদের ছেলে, তাদের ভাইকে নিয়ে অতিষ্ঠ। তিনি এমন তো নতুন না। জায়গায় জায়গায় অপমান, হতে হতে, জরিমানা দিতে দিতে তারা আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

রোদেলার মনে আছে ওর এসএসসি পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশন এর জন্য টাকা লাগবে। টাকাটা জোগাড় করা হচ্ছিল না। ওর ফুফু-ফুফা তখন ওদের বাড়িতে এসেছিলেন দেখা করতে। তার বর বিদেশে থাকেন, ছুটি শেষ চলে যাবেন তাই। তিনি এসে দেখেছিলেন বাড়ির পরিস্থিতি। তার নিজের মেয়েও(পালিত) রোদেলার ক্লাসেরই ছিলো, পরীক্ষার জন্য দোয়া দিয়ে চলে গিয়ে ছিলেন। ওরা তাকে বলেন নি টাকার সমস্যার কথা, তিনিও জিজ্ঞেস করেন নি। রোদেলার মা কখনোই তাদের কাছে কোন দুঃখের কথা বলতেন না। তিনি নিজে যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছেন। তিনি ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না এমন মানুষ। যারা মনের খবর রাখে না, দায় এড়িয়ে যায় তারা আবার কেমন আপন…? তাই যেচে তাদের আপন হওয়ার কোন চেষ্টাই তিনি করতেন না।

দাওয়াতে যাবার আগের দিন রোদেলাকে বেশ কয়েকবার কল করে আঁকিব। চার্জ না থাকায় ফোন বন্ধ ছিলো। লুকিয়ে ফোন ব্যাবহার করতো তাই সবসময় চার্জ দেয়া সম্ভব হতো না। তো পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে যায় রোদেলা। আঁকিবের দেয়া সাদা কুর্তি পরে সাদা ওড়ানা, সেলোয়ার দিয়ে। চুলগুলোকে সামনে টুইস্ট করে একপাশে বেণির মতো করে বেঁধে নেয়। গেমন কোন প্রসাধনী নয়, একটু কাজল আর আঁকিবের দেয়া পারফিউম। বেশী সাজুগুজু করলে আবার ধরা পরার ভয় থাকবে। বাসায় বলেছে একাডেমিতে অনুষ্ঠান। তাই আজ ফিরতে দেরি হবে।

সাংস্কৃতিক একাডেমিতে গানে রোদেলাখুব ভালো করছিলো। বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে ও ওর খালামনিকে নিয়ে গিয়েছিল। পুরষ্কার ও পেয়েছিলো গান আর আবৃত্তিতে। এজন্য এসব বাঁকা চোখে দেখে না ওর মা। সেদিন বের হয়ে স্টুডেন্টের বাসায় ফোন চার্জ দেয়। ফোন ওপেন করতেই ম্যাসেজ আসে আঁকিবের। সাদা কুর্তিটা পরতে বলেছে ও রোদেলা হাসে এই ম্যাসেজ দেখে। স্টুডেন্ট পড়িয়ে ও চলে যায় আঁকিব ওকে যেখান থেকে নিয়ে যাবে সেখানে। দুপুর বারোটার মধ্যে ওরা ওর বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে যায়।

ওর বন্ধুর ভাইবোনদের সাথে বসে আড্ডা হয়, কথা হয়, একটা সময় রোদেলা জানতে পারে এটা আঁকিবের ফুফুর বাসা। রিদুন আঁকিবের ফুফাতো ভাই। শুনে রোদেলার জানে পানি নাই অবস্থা। ও আঁকিবকে ডেকে বকা দেয় এমন কেন করলো। আঁকিব বললো
: ফুফু আমার বন্ধুর মতো, তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন, তাছাড়া আমি তোমাকে এমনি করে রেখে যাবো নাকি। আমাদের দু’জন একটা ব্যাবস্থা করেই তবে আমি যাবো।
: যত যাই হোক তোমার উচিত ছিলো আমার সাথে এসব আলোচনা করা,
: আমি যাই করেছি, আমাদের ভালোর জন্যই করেছি, এক হতে করেছি। তুমি আমার উপর ভরসা রাখো।

রাগ করে রোদেলা বারান্দা থেকে মিথির ঘরে এসে বসে থাকে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ওরা একসাথে মুভি দেখতে বসে। মনপুরা মুভিটা তখন নতুন রিলিজ হয়েছিল। ক্যাসেটের দোকান থেকে ক্যাসেট এনে ছবি দেখছে সবাই।
সবাই মনপুরায় বুদ, আর রোদেলার মন পুড়ছে… কি ভাববে তারা ওর সম্পর্কে। বিকেলে হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠে। গেইট খুলতে যায় মিথি। গেইট খুলে দেখে আঁকিবের মা এসেছেন। তাকে দেখে রোদেলার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা….

আল্লাহ কি হবে এখন…..!

চলবে
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1502112916916561/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1504774853317034/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here