গল্প- অনুভূতিরা মৃত
চব্বিশ পর্ব
.
সত্যি আমি সারপ্রাইজড। এত বড় সারপ্রাইজ জীবনেও পাইনি। তোমাদের আগামী দিন সুখের হোক। ভালো থেকো, দেখা হবে। কথাগুলো বলতেই বিদায় নেয় রুয়েল। কষ্টে জর্জরিত তার হৃদয়। যত্ন করে কাঁদানোর জন্য খুব আপন মানুষগুলোই যথেষ্ট! কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হূমায়ূন আহমদের বলে যাওয়া কথাটি আজ পরতে পরতে প্রমাণ দিচ্ছে। কিংবা কবি হেলাল হাফিজের বলে যাওয়া কষ্ট কবিতা জোরে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে– কষ্ট নেবে, লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট, পাথর চাপা, সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট, আলোর মাঝে কালোর কষ্ট ‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে, কষ্ট নেবে কষ্ট? নিষ্টুর এই পৃথিবীতে সবকিছুর ভাগ দেওয়া নেওয়া হয় কিন্তু কষ্টের ভাগ নেওয়ার মতো মানুষের বড্ড অভাব। আমরা যাদের কে মনে করি কষ্টের ভাগ দিব তারাই আমাদের কষ্ট দিয়ে থাকে।
.
গভীর রাত। দরজা বন্ধ করে কান্না করছে রুয়েল। আহা সেই কী কান্না। গভীর রাতের কান্না মনকে শীতল করে। কষ্ট কমে আসে। ধীরেধীরে কান্না কমে আসে। মনকে শীতল করে শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এই মূহুর্তে রুয়েলের সিদ্ধান্ত থাকবে না দেশে। বিদায় জানাবে বাংলার এই আলো বাতাসকে, পাড়ি জমাবে বিদেশের কোন মাটিতে। মামার রয়েছে নিজস্ব মেইন পাওয়ারের বিজনেস। বিসা জটিলতায় বেগ পেতে হবে না। সকাল হতেই মা কে জানিয়ে দেয় নিজের সিদ্ধান্ত। স্বাদরে গ্রহণ করে মা। ফেইসবুক লগিন করতেই ভেসে উঠে কলকাতার লেখক সুমনা ভার্মার স্ট্যাটাস যা মিলে যায় তার জীবনের সহিত। সেদিন আর আশার আলাে জ্বালব না। যেদিন অনুভূতির মৃত হয়ে যাবে, সেদিন আর চোখ বেয়ে নােনা জল ‘ ক্ষরণ হবে না। যেদিন অনুভূতিরা মৃত হয়ে যাবে, সেদিন আর বুক জমাট বাঁধবে না, অপ্রকাশিত অন্তঃক্ষরণে, যেদিন অনুভূতিরা মৃত হয়ে যাবে। সেদিন কোনাে প্রশ্ন থাকবে না, থাকবে না কোন অভিযোগ, না কোন অভিমান। যেদিন অনুভূতিরা মৃত হয়ে যাবে।
.
ঘরে বাইর পা ফেলা বন্ধ করে দিয়েছে, ক্যাম্পাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, মিহির সাথে কথা নেই ছয়দিন হলো। একাকী রুয়েল সময় দিচ্ছে নিজেকে, গড়ে তুলছে নিজেকে। এরমধ্যে মিহি কয়েকবার ফোন করেও পাইনি তাকে, ইচ্ছে করে ফোন তুলেনি রুয়েল। নতুন করে কোন কষ্টের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না সে। নিজেকে যত বেশি গড়া যায় সেদিকে মনস্থির তার। ফেইসবুক লগিন করতেই হোমপেইজে ভেসে আসল মিহির সাথে তপুর ছবি। ক্যাপশনে লিখা- যদি পৃথিবীর সব গোলাপ প্রতিদিন একটা করে তোমাকে দিয়ে বলি আমি তোমাকে ভালোবাসি। সব গোলাপ শেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমার ভালোবাসা শেষ হবে না। এক বুক কষ্ট নিয়ে এড়িয়ে যায় ছবিটি। মেসেজ চ্যাক করতেই তার চোখ চড়কগাছ। আহম্মেদ সোহাগ নামের ছেলেট একশত সতেরোটি মেসেজ করেছে, যেখানে লেখা– ভাইয়া আপনি আমার প্রিয় একজন লেখক। আমি এখন সিলেট শহরতলিতে অবস্থান করছি। জীবনে অনেকগুলো ইচ্ছের মধ্যে একটি ইচ্ছে, আপনার সাথে দেখা করা। আপনার মেসেজর রিপ্লাই না পেয়ে চলে যেতে হচ্ছে, ভালোবাসি ভাই। মূহুর্তেই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, দেখা করা উচিত প্রিয় পাঠকের সহিত। সােহাগ নামের ছেলেটির বাড়ি হবিগঞ্জ। সিলেটের পাশবর্তী জেলা। নিয়মিত পাঠক। গল্প পড়তে পড়তে তৈরি হয় ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকে সম্মান সেই থেকে বড় ভাইয়ের দেখা। রুয়েল দেখে ছোট ভাইয়ের স্নেহের চোখে।
.
অপরাধবোদ হচ্ছে, দেখা করা উচিত ছিল ছোট এই ছেলেটির সাথে। অপরাধবোদ থেকেই তৈরি হয় দায়িত্বের। এইতো আর কয়েকদিন এরপরই দেশ ত্যাগ করবে। আর কখনো দেখ হবে না। দেখা না হওয়ার আজন্ম এক আফসোস থাকবে ছেলেটির। গাড়ি নিয়ে বের হয় রুয়েল। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছ, একে একে পিছনে চলে যাচ্ছে সব। গাছপালা, বাড়ি ঘর, সবুজ ক্ষেত আরাে আছে নদী। সব যেন গতিশীল। অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটছে, উপরে নীল সাদার বর্ণিল আকাশ। সময় বাড়ছে, দুরত্ব কমছে, কাছে আসছে গন্তব্য। কয়েক ঘণ্টা পর গাড়ি এসে থামল থামল হবিগঞ্জ। নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাহনি সোহাগের দিকে। কিন্তু ছেলেটা কোথায়? এখানেই তো থাকার কথা। চারপাশ চোখ লাগিয়ে খুঁজছে তাকে, মূহুর্তেই ঝাপটে ধরে তাকে। কালো শার্ট পরিহিত সোহাগ। প্রিয় লেখক কে পেয়ে আবেগ আপ্লুত। নীল সাদার ভার্চুয়াল জগৎ বড় অদ্ভুত। যাদের সাথে কখনো দেখা হবে না, একসাথে বসে চা-কফি খাওয়া হবে না। লোক পাবলিকের আড়ালে ইনবক্সের ভিতর! সেই মানুষগুলোর সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্বেও তাদের জন্য কেমন একটা মায়ার টান। তাদেরই একজন সোহাগ।
.
বিদায় জানানোর পূর্ব মূহুর্তে চায়ের কাপে আড্ডা হয়েছে, গল্প হয়েছে অসংখ্য বিষয়ে। এবার যে বিদায়ের পালা। গাড়িতে উঠে বসেছে, গাড়ি চলছে। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, অভিনব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহাগ। প্রিয় মানুষকে বিদায় জানাতে ছলছল করছে তার চোখ। এইতো আর কয়েকদিন বাংলাদেশ ত্যাগ করবে মানুষটি। ভাবতেই চোখে জল আবিষ্কার করে। অজানা, অচেনা মানুষের জন্য চোখে জল। একেই বুঝি বলে রক্তের সম্পর্ক না হয়েও আত্মার সম্পর্ক।
.
কুঁড়ি দিন পর মুখোমুখি মিহি ও রুয়েল। ঠিক কুড়ি দিন আগে কথা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল। সারপ্রাইজ দিয়েছিল। এত বড় সারপ্রাইজড হজম করতে পারেনি। বুঝতে পারেনি মিহি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অথচ দুরত্ব যেন আকাশ পাতাল। দেহের দুরত্বের চেয়ে মনের দুরত্ব বেশি আজকে যেন তা প্রকাশ পাচ্ছে।
.
চলবে……………….
— সাকিব হাসান রুয়েল