গল্প- অনুভূতিরা মৃত
পর্ব- প্রথম
.
‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’। গত কয়েক বছর মাঘের শীতে বাঘ তো দূরের কথা, মানুষও কাঁপেনি এই শহরে। শীতের কুয়াশা ভেজা সকাল। ঢাকার আকাশে তখনও সূর্য উঠেনি। ঠান্ডা বাতাসের সাথে গণ কুয়াশায় কনকনে শীতে কাঁপছে শহর। শেষ কবে ঢাকায় এতো শীত পড়েছে সেটাই বিশ্লেষণ করছে আবহাওয়াবিদরা। এদিন সকাল ছয়টায় ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশা বেড়েছে, তাপমাত্রা কমেছে, সকালের রোদ সে যেন অভিমান করেছে তাই তো সুকান্ত ভট্টাচার্য শীতের সকালের রোদকে বলেছিলেন— সোনার চেয়েও দামি। তিনি শীতের সূর্যের কাছে আলো আর উত্তাপ প্রার্থনা করেছিলেন রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটার জন্য। যেন একটু ভালো থাকে, শীত যেন কাবু করতে না পারে।
.
তীব্র এই শীতে থেমে নেই মানুষজন। থেমে নেই তাদের ছুটে চলা। সকালের শীতকে উপেক্ষা করে বাসস্ট্যান্ডে হাজির কয়েকশত মানুষ। সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ডের একটি কর্ণারে তখন শত মানুষে ঢল। তাও আবার একজনকে ঘিরে। যার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য পৌঁছেছে অনন্য এক স্থানে। পাঠক ও ভক্তদের কাছে তিনি স্টোরি কিং নামে পরিচিত। তার গল্পের জাদুতে পাগল হয়েছেন বহুজন। গল্পের মাধ্যমে ছড়াচ্ছেন মুগ্ধতা। বলছিলাম বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় গল্পকার সাকিব হাসান রুয়েলের কথা। আজ সকালের বাসে করে উনি সিলেট যাচ্ছেন। প্রিয় লেখককে কাছে পেয়ে পাঠকরা আত্মহারা। দিচ্ছেন অটোগ্রাফ নিচ্ছেন ফটোগ্রাফ। একজন তো প্রশ্ন করে বসল।
— স্যার আমি আপনার একজন নিয়মিত পাঠক। আপনার লেখা প্রতিটি বই আমার পড়া। সদ্য প্রকাশিত ‘অনুভূতিরা মৃত’ পড়ে কাঁদতে হয়েছে, কেন মিলন হয়নি তাদের?
লেখকের কাছে তখন পাঠকের প্রশ্ন। এটাই তো সাহিত্যচর্চা। বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে লেখক জানান।
— সকল ভালবাসায় মিলন হবে এমনটা নয়। কিছু ভালবাসায় মিলন না হলেও তারা সফল কেননা ভালবাসা দেহকে নয় মনকে খুঁজে।
.
পাঠকের অটোগ্রাফ আবদার মিটিয়ে রুয়েল এবার বাসে চড়ে উঠলেন। নিজের সিট খুঁজে বসে পড়লেন। চাদরটা শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন। বাস ছাড়ার সময় হয়েছে, তার পাশের সিটে একজন মহিলা সাথে ছোট একটি বাচ্চা৷ সেদিকে রুয়েলের মনোযোগ নেই, ব্যাগ থেকে ‘অনুভূতিরা মৃত’ বইটি হাতে নিলেন। স্মৃতি রোমন্থন হচ্ছে, অজস্র গল্পের ভীড়ে ঠাঁই পেয়েছে ‘অনুভূতিরা মৃত’। বাস্তব ঘটনা নিয়ে গল্প। বইয়ের প্রতিটি শব্দ তাকে অতীতে নিয়ে যায়। নিজের লেখা অর্ধশতক বই পাঠকদের উপহার দিয়েছে তার মধ্যে অনুভূতিরা মৃত বিশেষ জায়গা জুড়ে বসে আছে। বাস চলতে শুরু করেছে। মাঘের শীত। সকালে ঘন কুয়াশা আর মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য। তবে থেমে থাকেনি মানুষের পথচলা। ঘন-কুয়াশায় চলাচলকারী গাড়িগুলোকে পথ দেখাচ্ছে হেডলাইট।
.
জানালার পাশের সিটে বসেছে রুয়েল। একসময় জানালার পাশে সিট পেতে কত যুদ্ধ করতো। সেই সময়গুলো ঘুড়ির কাঁটায় হারিয়ে গেছে, চাইলেও ফিরে পাওয়া সম্ভব না। বাইরে মুখ করে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ করেই কানে আসে চেনা একটি গলা।
— আপনার হাতে কী বই?
কিছুটা সংকোচ আর ভয় নিয়ে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। বহুবছর আগের সেই চেনা মুখ। মূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিলো রুয়েল। এই যে ‘মিহি’। এতবছর পর এভাবে দেখা কল্পনা নয়তো? না এতো বাস্তব। সেই পরিচিত কণ্ঠে আবার ভেসে আসল।
— বইটার লেখক কে?
রুয়েল এবার ছোট করে বলেন।
— সাকিব হাসান রুয়েল
লেখকের নাম শুনতেই চমকে উঠলেন মিহি। উত্তেজিত হয়ে বললেন।
— একটা সময় বইটার লেখক আমার কাছের বন্ধু ছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমে আজ অনেক দূরে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের একজন। বইটা কি দেওয়া যাবে?
রুয়েল তখন অস্বস্তি বোধ করছেন। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে বইটি এগিয়ে দিলেন।
.
অনুভূতিরা মৃত বাস্তব গল্প নিয়ে লেখা যেটার চরিত্র লেখক নিজেই, মিহি সেই গল্পের বিশাল একটা পার্ট হয়ে আছে৷ মিহি নিজেও জানে না এই বইটিতে তাকে নিয়ে লেখা অজস্র কথা। সে জানে না তার পাশেই বসে আছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু। রুয়েলের চোখ তখন কালো অন্ধকারে ঢেকে আসছে, মিহি বইটা দেখছে একটি একটি করে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে, রুয়েল আবার মুখ লুকিয়ে তাকিয়ে থাকে।
.
হঠাৎ করেই বাসের মাঝে দেখা। চেনা হয়েও আজ তার অচেনা সাঝার তাড়া। মিহির পরিবর্তন খুঁজতে যায় কিন্তু না! সে আছে আগের মতোই। সেই শান্ত চোখ, হালকা হাসি। মুখের মধ্যে মায়াবী ছাপ। পাশেই ছোট একটি শিশু দেখতে অনেকটা মিহির মতো। রুয়েল ছোট করে প্রশ্ন করে।
— কী নাম তোমার।
মিষ্টি কণ্ঠে সে বলে “উপমা”। আহা ভীষণ সুন্দর নাম। উপমা নামের অর্থ তুলনা। মায়ের মতোই তুলনাহীন। কোন উপমায় মিহিকে বাঁধা যাইনি। ভাবতেই রুয়েলের চোখ আবার অন্ধকার হয়ে আসে। তার ঐ মায়াবী দুচোখ, থমকে দিয়েছে তাকে, বুকের বা পাশে কেমন যেনো এক চিন চিন ব্যাথা হচ্ছে, চোখ যেনো টলমল করছে, মুখে নিরবতার এক আকুতি, সে যেনো এক অন্যরকম অনুভূতি। যে অনুভূতি প্রকাশ করা যায়না। মুখ ফুটে বলা যায়না কেমন আছো? কেননা আজ সবটাই অতীত। সময়ের পরিক্রমায় পার হয়ে গেলো দীর্ঘ বছর। সেই অনুভূতিরা মৃত আজও অনুভূতিরা মৃত। অনুভূতিরা মৃত জানতে হলে আমাদের যেতে হবে অতীতে।
.
প্রতিটি মানুষের জীবন স্বপ্নে ঘেরা। স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। সে স্বপ্ন গুলোকে কেন্দ্র করেই মানুষের বেঁচে থাকা। স্বপ্নহীন মানুষের জীবন মরুভূমির মতো। তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না ফলে তাদের পক্ষে সফলতা অর্জন সম্ভব না। স্বপ্নপূরণের আকাঙ্ক্ষায় মানুষ আজ এত সফল। এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে এসি রুমে বসে আছে তারা। কেউ কাউকে কখনো দেখেনি অথচ ভীষণ অান্তরিক। উপস্থিত প্রতেক্যের চোখের চাহনিতে এক স্বপ্নকে ছোঁয়ার তাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস। থমথমে নিরবতা। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। বুলবুল স্যার ক্লাসে প্রবেশ করতেই পুরাে ক্লাস স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার। চুলগুলো ভীষণ চকচকে মনে হচ্ছে একুশে পা রাখা সদ্য এক তরুণ। অথচ স্যারের শিক্ষকতার বয়স এক যুগ পেরিয়েছে। এমন একজন হ্যান্ডসাম স্যারের সাথে বুলবুল নামটা যায় না। স্যারের নাম হওয়া উচিত ছিল নীরব। হ্যাঁ, নীরব নামটি স্যারের সাথে যায়। স্যার ভীষণ রাগী। রাগী মানুষজন ভীষণ চুপচাপ।
.
নিজের পরিচয় দিয়ে ক্লাস শুরু করবে এমন মূহুর্তে স্যার বলে উঠলেন।
— ঐ ছেঁড়া শার্ট
মূহুর্তেই সবার চোখ স্যারের দিকে কার গায়ে ছেঁড়া শার্ট।
স্যারের এমন রহস্যময় কথায় উপস্থিত সকলে ভীষণ চিন্তিত। একজন প্রশ্ন করে বসলেন।
— স্যার, কাকে বলছেন?
গম্ভীর কণ্ঠে স্যার জানান।
— চশমা পরা ছেলেটি।
উপস্থিত সকলের চোখ তখন রুয়েলের দিকে। ক্লাসে একমাত্র চশমা পরা ছেলে সে। লজ্জায় তার মুখ কালো হয়ে গেছে। বারবার নিজের শার্টে চোখ বুলাচ্ছে কোথাও ছেঁড়া নেই তো? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন কী পরবে, কী করবে, কোন কালার পরবে, এসব ভাবতে ভাবতেই রাত পেরোয় তার। ঘুমহীন চোখ, চাপা রোমাঞ্চ, ড্রয়ার থেকে নামানো নব্য নীল শার্টটি পরে ক্যাম্পাসে পা রাখতেই ছেঁড়া শার্টের অপবাদে লজ্জায় ডুবতে হচ্ছে তাকে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে বুলবুল স্যার মাথা নিচু করে বসে আছে রুয়েল।
.
চলবে……………
— সাকিব হাসান রুয়েল