কহিনুর,১০,১১

0
547

#কহিনুর,১০,১১
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০

সকল প্রকার খারাপ পরিস্থিতি বা অশুভ কোনো সময়ের মধ্যেও ভালো কিছু সময় থাকে যেটা স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাছাড়া আধার পেরিয়ে আসে রাঙা প্রভাত। কালো রঙ মিলিয়ে গিয়ে সোনালী সূর্য নিয়ে আসে আলো ঝলমলে সকাল। প্রভাতফেরির গানে মুখোমুখি হয়ে যায় পৃথিবী। অধরা ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেছে। গতকাল অনেক রাতে ঘুমানোর ফলে উঠতে লেট হয়েছে। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। অধরা দ্রুত জানালা দিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া। জুবায়ের লোকজন লাগিয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে। বাড়ির সামনে কয়েকজন গান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মতলোব কি কে জানে। জুবায়ের সত্যি সত্যি এসব করবে ওর ধারণা ছিল না। ভেবেছিল ঘুমের মধ্যে সব ভূলে যাবে। ও আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখা হলো আয়াতের সঙ্গে। ছেলেটা মুখ ভাব করে আছে ওকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল,
> আপু তোমার বরের মাথা পুরোপুরি গেছে। কতবার বললাম আমাদের সঙ্গে থাকার কথা কিন্তু শুনলো না। সেই তোমাদের বাড়িটা পরিস্কার করতে উঠেপড়ে লেগে গেলো। হয়েছে টা কি বলবে? হঠাৎ পরিবর্তনটা কেমন জানি মানতে কষ্ট হচ্ছে।
অধরা মলিন হেসে আয়াতের কাধে হাত রেখে বলল,
> চিন্তা করিস না আমি সামলে নিবো। মারিয়া কোথায়?
আয়াত মাথা চুলকে বলল,
> তোমার ননদ আমাকে দেখলে পালিয়ে যায়। তোমাদের বাড়িতে আছেন।
> ওর থেকে দূরে থাক ভাই। আমি চাইনা কোনো ঝামেলা হোক। ওরা আমাদের মতো নরমাল না। জানিনা কি রহস্যের ওদের আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে। দূরে থাক তোর ভালো হবে। আমার মতো তোকে কষ্ট পেতে দিতে চাইছি না।
> কিন্তু…
> কোনো কিন্তু না। আমি যাচ্ছি।
অধরা কথাটা বলে অপেক্ষা করলো না। দ্রুত নিজেদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। বাড়িতে পৌঁছাতে ওর কয়েক মিনিট সময় লাগলো। সোফা থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পযর্ন্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। একদম ঝকঝকে করে ফেলেছে। অধরা ঘুরে ঘুরে সবটা দেখলো। মনে হচ্ছে সব কালো ছায়া জীবন থেকে দূর হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে। মারিয়া ওকে সাহায্য করছে। অধরাকে দেখে মারিয়া চমৎকার করে হাসলো। ইশারা করলো সবটা কেমন লাগছে। অধরা বিনিময়ে মিষ্টি করে হেঁসে বলল,
> দারুন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জুবায়ের এসে হাজির। সঙ্গে একগাদা শপিং ব‍্যাগ। পেছনে পেছনে দুজন লোক এসে আরও কিছু প‍্যাকেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। জুবায়ের সেসব নিয়ে কক্ষে রেখে এসে ধপ করে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সামনে রাখা আপেলের টুকরোতে কামড় বসিয়ে বললো,
> মোটামুটি সব ঠিকঠাক। দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা হয়ে গেছে। আরও লাগলে বলবে।
অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন এখানে থাকবেন? ফিরে না গেলে আপনার ড‍্যাড মানবেন তো? দেখুন ঝামেলা করে কি লাভ তারচেয়ে চলুন ফিরে যায়।
জুবায়ের বিরক্ত হলো অধরার কথা শুনে। মেয়টা এতোদিন এখানে আসার জন্য ঝামেলা করছিল এখন এখানে থাকতে চাইছে না। এর মতলব কি কে জানে। কৌতূহল দমিয়ে রেখে উত্তর দিলো,
> ওখানে থাকলে তোমার মাথায় আজেবাজে চিন্তা ঘুরঘুর করে। বাচ্চার জন্য এসব ভালো না। অতিরিক্ত টেনশনে যদি আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় তখন? যে আসছে সে একটা মানুষের বাচ্চা কোনো ভূতের বাচ্চা না যে সমস্যা হবে না।। ও বাড়ির নাম নিবে না। চুপচাপ খাও আর সকলের সঙ্গে আড্ডা দাও। বাকীটা আমি দেখবো।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা আর ঝামেলা করলো না। এই লোকটার যে তার ছেড়া মাথায় ছিট আছে এটা ওর অজানা নেই। জীবনে তাঁর ভুলের শেষ নেই। মাথা গরম করে আজ পযর্ন্ত যা যা সিদ্ধান্তটা নিয়েছে আজ অবধি সেটা সাকসেস হয়নি। ক্ষেপাটে টাইপের মানুষ। অধরা চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে বসলো। বাবা মায়ের রুমটা তালা লাগানো আছে। অধরা কিছু একটা ভেবে চাবিটা তুলে নিয়ে বাবা মায়ের রুমের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আগের মতোই সাজানো গোছানো আছে। তবে প্রচুর ধুলাবালি। অধরা আলমারির ভেতর থেকে বাবা মায়ের ছবিটা বের করে দেখে নিলো। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। অধরার চোখে পানিতে ছলছল করছে। কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়েও পড়লো। খুনীকে ধরতে পারলে ও তাঁর থেকে জিঞ্জাসা করবে ওকে এতিম করে লোকটার কি এমন লাভ হয়েছে। অধরা ছবিটা রেখে বেশ কিছু জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করলো। ওর বাবা মায়ের ফোন দুটো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এক বছর অন করা হয়নি। চার্জও নেই নাকি নষ্ট হয়ে বন্ধ অধরা বুঝতে পারলো না। দ্রুত সেগুলো চার্জ দেওয়ার ব‍্যবস্থা করতে হবে। ওর বাবার ফোনের গ্লাস ঠিক নেই। অধরা মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। পরে আবারও আসবে ভাবলো। রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে মায়ের লাল রঙের শাড়িটা সুন্দর করে পরে নিলো। ভাবলো আজ সারাদিন বাবা মায়ের ছবিটা সামনে নিয়ে বন্ধ রুমে বসে থাকবে। মায়ের শাড়ি থেকে মা মা গন্ধ আসছে। অধরা ভাবনা অনুযায়ী মায়ের শাড়ি পরে ছবির ফ্রেম বুকে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পরে বাবা আয়ের ছবিটা বুকে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
☆☆☆☆☆☆
ঘন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক পাহাড়ের টিলা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। অধরা নিচে দাঁড়িয়ে ওই টিলার দিকে তাঁকিয়ে আছে। গায়ে শক্তি পাচ্ছে না। টিলা থেকে বাচ্চার আওয়াজ ভেসে আসছে। অধরার মন আনচান করছে বাচ্চাটাকে দেখার জন্য। কিন্তু উপরে কিভাবে উঠবে বুঝতে পারছে। বহুকষ্টে থেমে থেমে ও উপরে উঠে গেলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আশপাশে তাকিয়ে দেখলো। দূরে একটা বাচ্চা খেলছে। ওর হাসির শব্দে সারা বনজুড়ে ঝঙ্কার তুলেছে। অধরা আর অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে বাচটাকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। তাঁর আগেই একটা মুখোশধারি লোক ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। মূহুর্ত্তের মধ্যে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেলো। কোথা থেকে জুবায়ের এসে হাজির হলো। ও বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাঁকা হাসলো। অধরা খেয়াল করলো ওর হাতে ধারালো খঞ্জর। অধরা মনে হলো ওর মতিগতি বুঝতে পেরেছে তাই চিৎকার করে বলল,
> ওকে মারবেন না প্লিজ। জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে যা ইচ্ছা করুন প্লিজ।
জুবায়ের শুনলো না। বাচ্চাটার গলাতে টান দিতে গেলো তখনই জুবায়েরের রূপি আরেকজনের আগমন ঘটলো। ও দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে চাইলো। অধরা ততক্ষণে ছুটে গেলো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পেছনে থেকে অধরাকে চুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। যেটা ওর কোমরে গিয়ে বিধেছে। অধরা চিনতে পারছে না কোনটা জুবায়ের আর কোনটা ওর ভাই। হঠাৎ ওদের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বুঝলো। এতক্ষণ জুবায়ের ভেবে ভূল করছিল ওটা জুবায়ের না। ওর ভাই। লোকটা জুবায়েরের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে লাথি দিয়ে ছুটিতে দিলো। জুবায়ের ছিটকে পড়েছে তবে হাতে এনেছে বাচ্চাটাকে। একদম পাহাড়ের ধারে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ঝাপসা চোখে চিৎকার করে বলল,
> আপনি পড়ে যাবেন পিছিয়ে যাবেন না। পড়লে ওকে বাঁচানো যাবে না।
জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না শুধু মলিন হাসলো। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চারণ করলো
> আমি না থাকলেও ও থাকবে। ও আমার অংশ, আমার আত্না। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষমা পাওয়ার অবলম্বন। ও বাঁচবে তুমি চিন্তা করোনা।
জুবায়ের ধুপ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়লো। অধরা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। সেদিনের সেই স্বপ্নটা ঘুরেফিরে এক দৃশ্য। একটু পরিবর্তন তবে শেষ পরিণতি তো এক। কি ইঙ্গিত দিচ্ছে এই স্বপ্নটাতে? অধরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। সামনে খারাপ দিন আসতে চলেছে বুঝতে পারছে। ভাবলো এটাইকি আমার নিয়তি? এই মূহুর্তে ওর জুবায়েরের কথা খুব মনে পড়ছে । দ্রুত উঠে বসলো। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাযথ চেষ্টা করলো কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারলো না। ঘর থেকে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে গেলো। কাজের মেয়েটা খাবার রেডি করছে। মারিয়া বই পড়ছে। অধরা সোজাসুজি মারিয়াকে জিঞ্জাসা করলো,
> তোমার ভাইয়া কোথায়?
মারিয়া বাইরে ঈঙ্গিত করতেই অধরা ছুটলো বাইরে। জুবায়ের বাইরে টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজিয়েছে। শীতের সকল বা বিকেলে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য। ও সেসব সাজিয়ে গার্ডের সঙ্গে আলাপ করছিল। অধরা ছুটে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মনে হলো এটাই হয়তো শেষবার জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরা। এর পরে আর সুযোগ আসবে না। অন‍্যদিকে জুবায়ের হতভম্ব মেয়েটার এমন আচরণ দেখে। এক বছর বিবাহিত সংসার জীবনে আগে কখনও জড়িয়ে ধরা বা বউকে বুকে নিয়ে ঘুমানো এসব হয়নি। জুবায়ের ইচ্ছে করে ওকে ইগনোর করতো। কিন্তু আজ কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাশের লোকদেরকে ইশারা করলো সরে যেতে। ওরা আদেশ মাত্র চলে গেলো। অধরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জুবায়ের কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> আরে কাঁদছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে বলো? ডাক্তার ডাকবো?
অধরা কথা বললো না। নির্বিকারভাবে কাঁদছে। জুবায়ের ওকে জোর করে সামনে টেনে আনলো। মুখটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> কি হয়েছে না বললে বঝবো কিভাবে? বাঘীনির চোখে পানি আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ সবটা বলো।
অধরা ফুপিয়ে উঠে বলল,
> আমাদের ফিউচার আমি দেখে নিয়েছি বোধহয়। সময় খুব কম। ক্ষমা করবেন আমার ব‍্যবহারে কষ্ট পেলে। খুব সরি।
অধরা দ্রুত জুবায়েরকে ছেড়ে দিয়ে যেভাবে দৌড়ে এসেছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু সময় তাঁকিয়ে ওর পিছু ছুটলো। অধরা সোজা গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জুবায়ের বহুবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কাজ হলো না। মেয়েটা দরজা খুললো না। জুবায়ের বাধ্য হয়ে নিচে গিয়ে সোফায় বসলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। অধরা সন্ধ্যায় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে নেমে আসলো। মনে হলো কিছুই হয়নি। জুবায়ের জিঞ্জাসা করলো কিন্তু ও বলল না। হাসিখুশি মুখে পাশের বাড়িতে আন্টির কাছে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু বুঝতে পারলো না তবে উতলা হলো। মেয়েটার জন্য হঠাৎ করেই আজ কেমন টেনশন হচ্ছে। ভালোলাগা কাজ করছে।
☆☆☆☆☆
অধরা আজ নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। আয়াতদের বাড়িতে আছে। আন্টির সঙ্গে ঘুমাবে বলে রাতে থেকে গেছে। জুবায়ের কয়েকবার এসেছে শেষমেষ নিজেও থেকে গেছে। ও উশখুশ করছে কি হয়েছিল শোনার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। জুবায়ের হতাশ হলো। মেয়েটার মাথায় কি ঘুরছে কে জানে। অধরা চুপচাপ খেয়ে রুমে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। আন্টির সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লো। ভোররাতের আগে হঠাৎ খুটখাট আওয়াজে ওর ঘুম ভাঙলো। দ্রুত উঠে বসলো। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সেদিনের ঝামেলার পর থেকে রুমের বাইরে আলো জ্বালানো থাকে। অধরা দরজা দিতে বেরিয়ে আসলো। চুপচাপ মেইন দরজা খুলতেই দেখলো খোলা গেটের সামনে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। নীল রঙের হুড়ি চাপিয়ে গেটে হেলান দিয়ে হাতদুটো ভাজ করে আছে। অধরা একপা দুপা করে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> শীতের মধ্যে এখানে কি করছেন?
অধরা দ্বিতীয়বার জিঞ্জাসা করতে গিয়ে থমকে গেলো।ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে পিছিয়ে আসলো। এটা কিছুতেই জুবায়ের না। স্বপ্নের কথা ভেবে ও ঢোক গিলল। লোকটা ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

চলবে

#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১

পশ্চিম আকাশে চাঁদ বাঁকা হয়ে কিরণ দিচ্ছে। বাড়ির ডান সাইডে থাকা আলোর ছিটা গেট পযর্ন্ত ছড়িয়ে আছে। অধরা ক্রমাগত পিছিয়ে আসছে। সামনের মানবটার দৃষ্টি ওর মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করছে। অধরা পেছনে ফিরে দৌঁড় দিবে সেই সময় লোকটা ওকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠলো
> থামো মেয়ে, আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি। কিছু বলতে এসেছি।
অধরা থমকে গিয়ে ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
> শুনতে চাই না আপনার কথা। ধবংস করতে চাইছেন তো আমাকে? আমি এমনিতেই ধবংস হয়ে গেছি।

অধরার কথা শুনে লোকটা হাসলো। ঠোঁট কামড়ে বলল,
> সন্দেহ করে দোষারোপ করা কি উচিৎ হচ্ছে? আমি খারাপ কিছু করেছি দেখেছো আজ অবধি? ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে তুমি খামাখা আমাকে ভয় পাচ্ছো। আমি ছোট থেকেই আলোতে যেতে পারিনা কারণ সূর্যের আলোতে আমার সমস্যা হয়। শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এটা এক ধরনের রোগ। তুমি এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ করছো? আর কহিনুরের বিষয়টা ওটা ড‍্যাড দাদুর থেকে পেয়েছে। দাদু কি সব আজেবাজে কথাবার্তা বলে উনার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছো। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমার ক্ষতি কেনো চাইবো আমি, বলো?
অধরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। শাশুড়ির শেষ কথাটা বারবার কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। কাউকে বিশ্বাস করা উচিৎ হবে না। তবুও কিছু বলা দরকার তাই বলল,
> আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার স্বামী চেয়েছেন তাই এখানে আছি। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। আপনি কি এগুলো বলতেই এসেছেন?
লোকটা এক’পা দু’পা করে একদম অধরার সামনে এসে থামলো। দৃষ্টি ওর মুখের দিকে। অধরার অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা হেসে বলল,
> বিশ্বাস করছো না জানি। তবুও আমি চাই তোমরা ফিরে আসো। ভূল ধারনা নিয়ে বসে থেকে কি হবে বলো? নিজের চোখে না দেখলে সেটা নিয়ে চিন্তা করে কি হবে?
অধরা লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। মনে হলো চিৎকার করে সবটা বলতে কিন্তু পারলো না। কিছু বলতে চাইলো তাঁর আগেই অধরার পেছন থেকে জুবায়ের বলে উঠলো,
> ও এখানেই থাকবে আমার সঙ্গে। বাড়িতে নিতে পারলে আমাকে খুন করে আমার স্ত্রী সন্তানকে নিজের কব্জায় নিতে খুব সুবিধা হবে জানি। কিন্তু কি বলতো আমি আপাতত সেটা চাইছি না। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজের কথা ভাবে আমিও তাঁই ভেবেছি। কহিনুরকে না পেলে তোদের সমস্যা, আমার তো না? তাহলে আমি কেনো তোদের জন্য নিজের স্ত্রী ক‍ন‍্যাকে ত‍্যাগ করবো? কোন সুখ পাবো মিস্টার জামসেদ ফারুকী? ভালো করে শুনে নিন আপনার আর আপনার ড‍্যাডের কোনো পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সামনে ওর ভাই জামসেদ ফারুকী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। হয়তো জুবায়েরের থেকে এসব আশা করেনি। জুবায়ের অধার হাতের কব্জি ধরে ফিসফিস করে বলল,

> ভেতরে যাও শীত পড়ছে। আমি কথা বলে আসছি।

অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। থাকা উচিত নাকি চলে যাওয়া উচিৎ? দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে ওর থাকা শোভা পাচ্ছে না কিন্তু না থাকলে যদি এরা দু’ভাই ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তখন? জুবায়ের ওর সঙ্গে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয়বার করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। করতেই পারে। তাছাড়া ও ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামী বলে তাঁকে কারণ ছাড়া বিশ্বাস করে ঠকার মনে হয়না। জুবায়েরকে ও আপাতত সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে। অধরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের আবারও বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বিশ্বাস করতে পারো শেষবারের মতো।
অধরা কিছু বললো না। চুপচাপ ভেতরে চলে গেলো। জুবায়ের একবার পেছনে তাঁকিয়ে সামনে দৃষ্টি ফিরালো। জামসেদ তখনো চুপচাপ ছিল। অধরাকে যেতে দেখে চাপা কন্ঠে বলল,
> ভাই তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? শোন আমি কিন্তু ইনোসেন্ট। যা হচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র আমার হাত নেই। জানিস তো ড‍্যাড কেমন? দাদু উনার মাথায় আজেবাজে সব ঢুকিয়েছে। তাছাড়া তোর যদি অধরাকে নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে ওকে নিয়ে তুই দাদুর কাছে চল। ওখানে থাকবি। ওখানে দাদু দাদিমা সবাই আছে।
> এখানে থাকলে কি অসুবিধা? তাছাড়া তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? আমার স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা না হয় আমি ভাববো। ড‍্যাডকে বলিস এসব কু কর্ম ছেড়ে ভালো হয়ে যেতে। আধুনিক যুগে বসবাস করে সেই আদিকালের মতো ফালতু জিনিস নিয়ে উনি পড়ে আছেন। তাছাড়া আমি তো এখন তোদের পথের কাঁটা। উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হলো কিন্তু হলো না। ভাই অযথা সময় নষ্ট করিস না। এবার যা আমি আসছি।
জুবায়ের কথা শেষ করে এক মূহুর্ত আর অপেক্ষা করলো না। হাটতে শুরু করলো। ওকে পেছন থেকে বহুবার ডাকা হলো। জুবায়ের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অধরার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর আগের চেয়ে হালকা ফোলা ফোলা লাগছে। পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরীরের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে এতোদিন কেনো যে এভাবে দেখা হলো না এখন বেশ আফসোস হচ্ছে। তখন তো জুহি আর আরমান ফারুকীর জন্য চোখে পট্টি বাঁধা ছিল। জুবায়ের একমনে এসব ভেবে চলেছে। হঠাৎ অধরার কথা শুনে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। অধরা চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো,
> দেখা শেষ হয়ে থাকলে বলুন উনি সত্যি সত্যি কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা?
জুবায়ের থতমত খেয়ে বলল,
> আমি জানিনা। মাম্মা বলেন ও ছোট থেকেই এমন। ওর সুবিধার জন্য লুকিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।
> লুকিয়ে কেনো? লোকজন উনার অস্তিত্ব জানলে অসুবিধা কি হতো? নাকি অন‍্যকিছু। ধরুন ওর কাছে এমন কোনো পাওয়ার আছে যেটা আপনার কাছে নেই। আপনাকে খু*ন করে ওকে আপনার জায়গাই প্রতিষ্ঠা করবেন আপনার বাবা। আপনাকে হত্যার পেছনে আরও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে সেটার খোঁজ করুন। এখানে বসে থেকে কিছু হবে না। চলুন এমন কোথাও যায় সেখানে গিয়ে পুরোপুরি রহস্যের সমাধান জেনে নিতে পারবো। আমাকে নিয়ে টেনশন নেই। বাচ্চা হতে এখনো অনেকটা সময় আছে। ততদিন আমাকে কিছু করবে না। বিপদ আপনাকে নিয়ে। জুবায়ের বসে থাকলে সমস্যা বৃদ্ধি হবে। বুদ্ধি নেই কেনো আপনার?
জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। এই মেয়েটার বুদ্ধি সত্যিই চমৎকার। ওর ভালো লাগছে অধরা ওকে নিয়ে চিন্তা করছে কিন্তু ওকি আদো মেয়েটার ভরসার যোগ্য? জুবায়ের কিছু একটা ভেবে বলল,
> ওই বাড়িতে পা রাখলেই আমি নিজের মধ্যে থাকি না। জানিনা কি হয় তোমাকে দেখতে পারিনা। রাগ হয় অশান্তি লাগে। আমি না চাইতে তোমার উপরে টর্চার করি। কিছু একটা আছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। বোঝাতে পারবো না তোমাকে।
অধরা আগ্রহ নিয়ে বলল,
> আপনি তখন নিজের মধ্যে সত্যি থাকেন না। সম্মোহন করা হয়। কারো হাতের পুতুলের মতো আচরণ করেন। যাইহোক এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমি বুদ্ধি বের করছি। আপনি আমাদের যাওয়ার কথা ভাবুন। এখানে ফিরবো একেবারে সব রহস্য জেনে তারপর।
> আমাদের আরেকটি বাড়ি আছে তুমি জানো? সেখানে দাদু আছেন। ভাই বলছিলো ড‍্যাড এসব দাদুর কথায় করছেন। তুমি যাবে সেখানে?
অধরা একটুও চমকালো না। বাড়ি থাকতেই পারে। কারণ আরমান ফারুকী স্ত্রীকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় সেখানে থাকেন। কিন্তু সেই বাড়িতে কে কে আছে এটা ওর জানা নেই। কখনও বলতে শোনেনি। অধরা সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
> যাওয়ার ব‍্যবস্থা করুন। আর আপনার ভাইকে একটু বলবেন ভাতৃবধুকে বোনের নজরে দেখলে ভালো হয়। হারাম জিনিসের প্রতি উনার একটু বেশিই আগ্রহ। আমি যতই নিজেকে আড়ালে রাখি উনি সামনে চলে আসছেন।
জুবায়েরের খারাপ লাগছে,রাগ হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> সরি। তোমার সন্ধান কিন্তু ওই দিয়েছিল। আমাকে বলেছিল শুধু বিয়ের পরে একটা বাচ্চা হলে তোমাকে ছেড়ে জুহিকে বিয়ে করে নেওয়ার কথা। তাছাড়া তখন আমি ড‍্যাডের বাধ‍্য ছিলাম। ভাইবোনদের কথা ভেবেছিলাম।
অধরা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> বউরা সব সময় খারাপ হয়না। আপনাদের মতো পুরুষের বিয়ে করা সাজে না। ভাইবোনদের ভালো করতে নিষেধ করছি না তাইবলে নিজের সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দিবেন এটা কেমন কথা? আপনি জানেন ঘরের শান্তি হচ্ছে স্ত্রী সন্তান। যাইহোক বুঝতে হবে না। রহস্যের সমাধান করে আমাকে ছেড়ে দিয়েন। জুহি তো নেই আত্না ফাত্তা থাকলে ডেকে নিয়ে বিয়ে করে নিয়েন। আমি মেয়েকে নিয়ে থাকবো। তারপর যদি ভালো কাউকে পাই তখন বিয়ে নিয়ে ভাববো। আমি যথেষ্ট সুন্দরী । ছেলের অভাব হবে না। তাছাড়া আপনার ভাই আছেন তো। উনি বারবার আমাকে কু ইঙ্গিত….
অধরা বাকীটা বলতে পারলো না। জুবায়ের ওকে মুখ চপে ধরে রাগে ফুলছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> বিশ্বাস ভেঙেছি শাস্তি হিসেবে সারাজীবন এক কক্ষে দুটো বিছানা তৈরী করে ঘুমাবো তবুও চোখের সামনে থাকা চাই। আমি খারাপ মানুষ সারাজীবন খারাপ থাকবো। মারামারি জোরজবরদস্তি সব আমার কাজ। ভালো হতেও চাইছি না। তুমি যদি এসব ফালতু চিন্তা করে থাকো আমিও খারাপ হবো। ভালোবাসা বাসির দিন শেষ। আমাকে দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করে আমার সামনে ঘুরবে সমস্যা নাই।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। অধরা জানতো এমন কিছুই হবে। জুবায়েরকে চিনতে ওর বাকি নিই। একটু চেতিয়ে দিলেই কাজ হয়েছে। যে ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সেখানে এই মাথা মোটা লোকটাকে নিয়ে গিয়ে বিপদ হবে কি কে জানে।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গাড়ি চলছে জুবায়েরের দাদুর বাড়িতে। সকাল সকাল আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েছে অধরা। সঙ্গে আয়াত এসেছে। অধরা ওকে নিতে চাইনি কিন্তু ছেলেটা শুনছে না। যদি কোনো ঝামেলা হয় তাই জোর করে এসেছে। কাজের মেয়েটা আর মারিয়াও আছে। জুবায়ের মারিয়াকে রেখে কোথাও যায়না। বোনকে সঙ্গে রাখে। মেয়েটার মধ্যে কিছু ঝামেলা আছে। আরমান ফারুকী জানলে ঠিকই মেয়েকে নিজের কাজে লাগিয়ে দিবে। সকলের ছোট বোনটাকে ওর বাকী বোনদের থেকে আলাদা রাখে। ওরা বোবা বধির হতে পারে কিন্তু কিভাবে জানি মানুষের সব কথা বুঝে যায়। রাতের আধরে সব পার্টিতেও যায়। কোনো রাত মিস করে না। দীর্ঘ চার ঘন্টা পর গাড়ি থামলো বিশাল এক অট্টালিকার সামনে। বাড়িটার ধুসর রঙের। অধরা গাড়ি থেকে পা নামাতেই মনে হলো পুরো শরীর কেঁপে উঠে পড়ে যাবে। জুবায়ের ওকে ধরে ফেলল। দীর্ঘসময় গাড়িতে থাকার ফলে এমন হচ্ছে। মারিয়া এসে ওর হাত ধরে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। গেটের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে বরণ করে নিতে। বাড়ির ভেতরটাতে ছোটখাট একটা বাগান দেখা গেলো। আচার্যের বিষয় এখানে কোনো ফুল নেই। অধরাকে রাণীর মতো বরণ করা হচ্ছে এটাই ওকে ভাবাচ্ছে। কয়েকজন মিলে ওকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলো। অধরা বসতেই সিঁড়ি দিয়ে একজন সাদা চুলের বৃদ্ধ লোক নেমে আসলো। অধরা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here