রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব : ২০
আঁকিবের ফুফু ওদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করেছিলো। আঁকিবের বাবা-মা দুজনে ব্যাংকে গিয়েছিলো একটা কাজে। তাই তারা আসবে না জানিয়েছিল। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে আঁকিব। এদিকে ফুফুকে আগেই বলেছিলো রোদেলার কথা। ওর যাবার আগে ওদের একটা হিল্লে করে দিতে ফুফুকে খুব করে বলেছে।
ফুফু বলেছিলো একদিন নিয়ে আয় বাসায় দেখি আগে, তারপর না হয় কিছু একটা ব্যাবস্থা করলাম। আঁকিব তাই রোদেলাকে নিয়ে এসেছে ওকে কিছু না বলেই।
আঁকিবের মা এসেছেন তার ব্যাগটা ছিনতাই হয়ে গিয়েছে দয়াগন্জ সিগনালে , তার মধ্যে চাবি, মোবাইল সব ছিলো।
ভাগ্যিস ব্যাংক থেকে তোলা টাকাটা আঁকিবের বাবার নিয়ে গিয়েছিলো। তা না হলে আজ আম ছালা দুটোই যেতো। আঁকিবের কাছে চাবি আছে, তিনি কোন উপায় না দেখে সোজা আঁকিবের ফুফুর বাসায় চলে এসেছেন। এদিকে বাসায় ঢুকে রোদেলাকে দেখে তার মাথা খারাপ অবস্থা।
কিছুটা সময় নিলেন তিনি ব্যাপারটা বুঝতে। রিদুন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় আঁকিবের মায়ের হাতে। পানি গ্লাস হাতে নিয়ে আঁকিবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। টিভিতে গান হচ্ছে –
” ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই..…”
তবুও পুরো ঘর স্তব্ধ ঘটনার আকষ্মিকতায়। রিদুন দৌড়ে গিয়ে সাউন্ড মিউট করলো। পানি শেষ করে তিনি আঁকিব কে পাশের ঘরে ডেকে নেন। দড়জা ভিড়িয়ে ছেলের সাথে কথা বলেন। এসব দেখে রোদেলার দমবন্ধ অবস্থা। কি হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে এসব দ্রুত যেন খেলে গেলো ওর ব্রেনে। দ্রুত কিছু হিসাব-নিকাশ চলছে। হঠাৎ রোদেলা ভীষণ ভয় পেতে থাকলো। ওর মা….! ওর মা এসব জানতে পারলে কি হবে…!?
খুন করে ফেলবে সে ওকে। আল্লাহ তুমি আমাকে এই মুহুর্তে উঠিয়ে নাও নাহলে মৃত্যু দাও…. মনে মনে এসব বলতে লাগলো ও। একটা সময় পর আঁকিবের মা চিৎকার করে ঘরের দরজা জোরে খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে কাওকে কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে চলে যান।
আঁকিবের ফুফু তার পিছু পিছু যান। তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি কোন কথা-ই শুনতে রাজি নন। এদিকে সবাই দৌড়ে আঁকিবের কাছে যায়, রোদেলা বসেই থাকে স্তব্ধ হয়ে, যেন কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও।
হঠাৎ ওর মাথাটা কেমন শূন্য হয়ে যায়। ওর গা এলিয়ে পরে যায় সোফা থেকে নিচে। ঐ ঘর থেকে ভারী কিছু পরার শব্দে রিদুন দৌড়ে এসে দেখে রোদেলা ফ্লোরে উপুড় হয়ে পরে আছে। ও চিৎকার করে সবাইকে ডাকে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হাতে পায়ে ঘোষতে থাকে আঁকিব। ওর ফুফু মাথায় তেল দেন। একটা সময় পানি ছিটিয়ে দিতেই চোখ মেলে রোদেলা।
একটু সময় পর যেন সংবিৎ ফিরে ওর। নিজেকে আবিষ্কার করে বিছানায়, সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে। উঠে বসে রোদেলা। ঘটনার আকষ্মিকতায় প্যানিক এটাক হয়েছিল ওর। ওর ফুফু তখনো রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে রোদেলা ।
দ্যা গেইম ইজ ওভার….!
সব শেষ……! শুরুতেই…! বলে কাঁদতে থাকে। আঁকিবও ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ওদেরকে এভাবে দেখে সবাই ঐ ঘর থেকে চলে যায়।
সেটাই আঁকিব আর রোদেলার প্রথম এবং শেষ আলিঙ্গন ছিলো।
এরপর….?
এরপরের ঘটনাগুলো মনে করতে চায় না রোদেলা। ঐ ঘটনার পরের জীবনে যতবার প্রেম এসেছিলো ততবারই আৎকে উঠেছিলো রোদেলা। কিভাবে যে কেটেছে এক-একটা দিন। যতটা না আঁকিবকে হারিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তারচে বেশী কষ্ট ওর মা ওকে দিয়েছিলো। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় রেদেলার ছিলো না। দুনিয়াটা মেয়েদের জন্য নিরাপদ হলে কিংবা ওর চলে যাবার কোন জায়গা থাকলে রোদেলা ঠিক পালিয়ে যেতো।
হঠাৎ ঘরের দড়জা খুলে রোদেলার মা ঘরে ঢুকে বললো –
কিরে ভরা দুপুরে মটকা মেরে পরে আছিস কেন, শরীর ভালো না…? রোদেলা ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলো, কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিলো না তাই, ওর মা গায়ে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা…
রোদেলা ঘুমিয়ে আছে ভেবে তিনি দড়জা ভিড়িয়ে চেলে গেলেন বাইরে। শুয়ে শুয়ে রোদেলা আঁকিবের কথা ভাবতে লাগলো।
কতদিন হয়েছে দেখে না ওকে…?
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ও প্রায়ই খোঁজ করে আঁকিবকে। কত মানুষ দেখে কিন্তু ওকে দেখে না। আচ্ছা আঁকিব কি দেখতে ওমনি আছে….? যেমন দেখতে ছিলো শেষ দেখার সময়….
চোখ ভিজে যায় আবারও….
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, রোদেলা পরে থাকে বিছানায়। পৃথিবীর সব আলস্য ওকে গ্রাস করেছে। চারটায় প্রিসিলা আসে খেতে ডাকতে। উঠে রোদেলা লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে। তারপর যখন খেতে যায় তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। খেতে বসতে দেখে ওর মা আসে টেবিলে। বলে
– ঘরটা দেখে আসবি কাল সকালে…?
– কোন ঘর…?
– একটা বাসা ঠিক করে এসেছি। এডভান্স ও দেয়া হয়েছে।
– তাহলে আর দেখার কি আছে…? এমন তো না যে আমার পছন্দ না হলে ঘরটা বাদ দিয়ে দিবে। এডভান্স তো করেই আসছো…
– তবুও দেখে আসতি…
– না মা, আজ ক্লাসে যেতে পারি নি। কাল আমার প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস আছে…
এ কথাটা বলে হঠাৎ মনে হলো সকালের কথা, শোভনের কথা… আজ বহুদিন পর ডুবে ছিলো আঁকিবে… তাই সব ভুলে গিয়েছিল।
সন্ধ্যায় রোদেলা শোভনের কথা জিজ্ঞেস করলো নাতাশা কে। কি অবস্থা, কেমন আছে…
নাতাশা জানালো ভালোই আছে, অপারেশন এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাত আটটায় অপারেশন করবে।
রোদেলার খুব ইচ্ছে করছিলো হসপিটালে যেতে। কিন্তু ইচ্ছে
থাকলেও যেতে পারবে না। তাছাড়া ওর বোনের কথাটা হঠাৎ মনে হলো। তিনি দেখেছেন ওর হাতে শোভনের হাত। এখন এই রাতে হসপিটালে গেলে উনি কি না কি ভাববেন….
নাতাশাকে টেক্সট করলো ভালোমন্দ জানাবি আমাকে, আমি প্র্যাক্টিক্যাল খাতা লিখছি, সজাগ থাকবো।
নাতাশা বললো আমি তো বাসায় এসে পরেছি। কল্লোল হসপিটালে৷ আচ্ছা তাও জানাবো তোকে…
কিসের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা, কিসের পড়া লেখা। রোদেলার মনটা কেমন যেন অশান্ত। দ্রুত রোদেলা নামাজে বসলো, ওয়াক্তের নামাজ পরে নফল নামাজ পরলো, কুরআন পড়লো কিছুক্ষণ। মুনাজাতে দোয়া করলো শোভনের জন্য।
আর ওর জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড়কে থামিয়ে দিতে বললো। সঠিক রাস্তা দেখাতে বললো আল্লাহ কে।
রাতে খাওয়ার সময় টেবিলে রোদেলার মা সবার উদ্দেশ্যে
বললো আগামী এক তারিখে ওরা নতুন বাসায় উঠছে। কেও কোন কথা বললো না। যেন কিছু শুনলোনা এমন ভাব। রাতে বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললো
– ভাই আমার জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা দিবেন, নতুন বাসায় উঠবো কিছু কেনাকাটা আছে।
বড় মামা কিছুই বললেন না, সকালের বাসি পেপার পড়ায় ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।
রোদেলা মা চলে এলেন তার ঘরে। অনেক রাতে কল্লোল জানালো শোভনের অপারেশন শেষ। ও ভালোই আছে…
এ খবর মামীর কাছ থেকে জানার পর রোদেলার দু চোখ ভেঙে ঘুম এলো।
চলবে…
একটু ছোট হয়ে গেলো। মাথাটা কাজ করছে করছে না, তাই।
রাগ করো না তোমরা।
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1503442150116971/
Next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1505388026589050/