রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২৪
এরিমধ্যে একদিন হঠাৎ নাতাশা আর কল্লোল এসে হাজির রোদেলাদের বাসায়। কল্লোল এসে ওকে দিয়ে চলে গেছে, রাতে ফিরবার সময় আবার নিয়ে যাবে।
নাতাশা যে ফুফুকে জড়িয়ে ধরে যে কাঁদবে সে সম্পর্ক এখনো তৈরী হয়নি নাসিমা বেগমের সাথে। আহ্লাদ করে কথা বলাও না। শুধু বললো ফুফু আপনারা কেন এসে পরলেন ঐ বাড়ি ছেড়ে। নাসিমা বেগমের তেমন উৎসাহ দেখা গেলো না উত্তর দেয়া নিয়ে। ভাইয়ের বা বোনের ছেলেমেয়েদের প্রতি একটা আহ্লাদী পনা যে থাকে তা নাসিমা বেগমের কোন কালেই ছিলো না। নিজের ছেলেমেয়েদের প্রতিই নেই, আর ভাইয়ের বোনের ছেলেমেয়েদের প্রতি…! উল্টো ভাতিজা-ভাতিজিদের প্রতি অভিযোগ রয়েছে নাসিমার কেন তারা অসহায়,এতিম নোভেলকে দেখতে পারে না। ওরা যদি ওর পক্ষ হতো তাহলে তো নোভেলের একটু জোর থাকতো।
সব ভাতিজা-ভাতিজীদের বেলায় এমন ভাব যেন ওদের মায়েরা আগের ঘর থেকে নিয়ে এসে তার ভাইদেরকে বিয়ে করেছে। তিনি এমনই জঘন্য যে ওদের মায়েদের সাথে ঝগড়া লাগলে তাদের ছেলেমেয়েদের টেনে আনতো ঝগড়ায়, বিশ্রী সব কথা বলতো ওদেরকে নিয়ে। রক্তের সম্পর্কের ভাতিজা-ভাতিজিদের যে কেও এমন ভাবে বলতে পারে, তুলনা করতে পারে, অভিশাপ দিতে পারে, নিজ চোখে না দেখলে, কিংবা নিজের কানে না শুনলে কারো বিশ্বাস হবে না। তাই হয়তো একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করা হয়ে গেছে তাদের অজান্তেই। নাতাশা যদি না আসতো তখনই ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হতো, যে কষ্ট ওদের ফুফু কথা দিয়ে দিয়েছে, তাতে ওদের খবর নিতে বাড়ি বয়ে আসা কল্পনাতীত।
কিন্তু নোভেলের হিসাব আলাদা, ওকেও যে খুব আহ্লাদ করে তা না, তবে অনেক আগে থেকেই দেখেছে, ওর একটা আলাদা জায়গা রয়েছে।
একটা ঘটনা, ছোট্ট, অতি ক্ষুদ্র, অনেকেই এটা শুনে হয়তো ভাববে রোদেলা ছোটলোক, হিংসুটে। তবুও বললে বুঝতে সুবিধা হবে সবার। তাই এই তুচ্ছ ঘটনার অবতারনা।
বাড়িতে গরুর দুধ রাখা হতো, বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের মতোই ওরা দুই বোন বড় কাপের দুই-কাপ দুধ পেতো প্রতি দিন রাতে। ওরা দুই বোন নিজেদের কাপ থেকে অল্প করে দুধ আলাদা করে রাখতো ওদের মায়ের জন্য, আর ওর মা সেই এক কাপ দুধ রাখতো নোভেলের জন্য। ডেকে এনে জোর করে খাওয়াতো ওকে। এমন না যে ওকে দুধ দেয়া হতো না, ওকেও সবার মতোই দেয়া হতো, ও হয়তো জানালা দিয়ে ফেলে দিতো, না-হয় সিংকে ঢেলে দিতো, এভাবে চলতে থাকায় মামী আর ওকে দুধ দিতো না। এরপর থেকে সেটাই নিয়ম হল।
ঐ যে এক-কাপ দুধ, মাত্র এক কাপ দুধ….! কত তুচ্ছ জিনিস তাই না…!
ঠিক সেখান থেকেই দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছে ওদের নিজের জন্মদাত্রী মায়ের সাথে। আর অপর দিকে অসহ্য লাগতে থাকে নোভেলকে। আচ্ছা একটু কল্পনা করুন তো এত বড় এই গ্রহটায় আপনার প্রিয় বলতে, আপনজন বলতে, নির্ভরতার জায়গা বলতে কেবল একজনই রয়েছে, যাকে আবর্তন করে ঘুরছেন আপনি উপগ্রহের মতো ।
আর সে…..
আপনার চেয়ে বেশী ভালোবাসে, বেশী গুরুত্ব দেয়, অন্য একজনকে।
আহা…!
মা যদি জানতো..
কত কষ্ট পেতো এসবে রোদেলা…. প্রিসিলা তখন ছোট্ট বাচ্চা, দুনিয়ার কিছুই প্রায় বুঝতো না বললেই চলে। চিনতো শুধু মাকে, সেই মা রাতে ঘুমাতেন নোভেলকে আঁকড়ে ধরে। প্রিসিলা বলতো আমার মা, নোভেল বলতো আমার ফুফু। কি খুনসুটি পূর্ণ মজার দৃশ্য….! তাই না……
কিন্তু দিন যখন গড়াতে থাকে এটাই নিয়ম হয়ে যায়। নোভেলকে ঘুম পাড়িয়ে তিনি ওদের দুই-বোনের কাছে আসতেন। ফুফুকে ছাড়া ওর ঘুমই আসে না। এমনো দিন যেতো কান্না করতে করতে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল চুষতে চুষতে ছোট্ট প্রিসিলা ঘুমিয়ে পরতো। তখন মায়ের উপর ভীষণ রাগ হতো রোদেলার। ইচ্ছে হতো খুন করতে নোভেলকে। দূরত্বটা বেড়েছে খুবই ধীরে, এতটা ধীরে যে কারো চোখেও বাঁধে নি, কেও গুরুত্ব ও দেয় নি।
দিন নিজের মতোই যায় সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ধীরে ধীরে ওদের মা নোভেলের একছত্র অধিপত্যে। ততদিনে প্রিসিলা একলা চলতে শিখে গেছে। এখন আর ওর মাকে লাগে না ঘুমোতে। ও হয়তো ঐ বয়সেই বুঝেছিল
– যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে, তবে একলা চলো রে….
চোখ দুটো একটু বন্ধ করে ভাবুন তো এই দৃশ্যটা….
কেমন লাগবে আপনার….?
কষ্টে দম বন্ধ লাগবে না….?
মনে হবে না বেঁচে থাকার কোন মানে নেই….?
কেও নেই পৃথিবীতে ভালোবাসবার….
প্রিসিলার ডান হাতের ঐ বৃদ্ধাঙ্গুলটা অন্য আঙুলের তুলনায় একটু বেশীই সরু আর চ্যাপ্টা। এত বড় হয়ে গেছে এখনো সেই সরু আঙ্গুলটা সেই সব দিনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে নিরবে। ওর যে এই আঙুলটা চ্যাপ্টা এটা হয়তো নাসিমা ও জানেন না….
কি ভাগ্য ওদের…!
একটা কথা চলতি আছে…
মার বইন খালা, মার চেয়ে ভালা…..
কপালে যাদের দূর্ভোগ দূর্দশা লেখা, তাদের জীবণে ভালো কিছু নেই, সোনা ধরলেও তা ছাই হয়ে যায়। ওদের এক ভীতি ছিলো ওর মা, আরেক ভীতি ওদের খালারা। কথায় যে কত যন্ত্রণা তা ওরা ভালো করে জানে এই মানুষগুলোর মারফতে। সুযোগ পেলেই হলো- সময় নাই অসময় নাই, শোয়া নাই বসা নাই, এমনকি খেতে বসে থাকলেও মাফ নাই। এমন অনেকদিন হয়েছে চোখের পানিতে ভাত ভিজে গিয়েছে রোদেলার। কথার ঘিন্নায়…
অথচ ওদের কোন দোষের কারনে এসব শুনতো না ওরা, ওরা এসব শুনতো বাবা-মায়ের জন্য।
তারা যে সাহায্য (দয়া) করতো তা উসুল করতো এসব শুনিয়ে। এটা যে কত জঘন্য অনুভূতি তা বোঝানো যাবে না কাওকে। একটা মানুষ আপনাকে এক বেলা খাইয়েছে, সে যদি সুযোগ পেলেই তার খোটা দেয় কিংবা কথা শুনায় তাহলে কেমন লাগবে…! ঐ খাবার উগ্রে দিতে ইচ্ছে হবে না…?
আর ওদের দিনের পর দিন শুনতে হয়েছে এসব। দয়াও গ্রহণ করতে হয়েছে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও। মানুষের শৈশব কত আনন্দের হয়, কিন্তু ওদের….!
সব ভুলে শিশুমনে হয়তো ওরা হয়তো খুঁজে নিতো নিজের মতো ভাল থাকার পথ, বিকেলে খেলতে যেতো, কিংবা টিভি দেখতে বসতো….
ওমনিই কোত্থেকে ওর মা এসে টিভি বন্ধ করে বকা দিয়ে রোদেলাকে বলতো – এত সুখ কেন তোর ভিতরে মা*গী তগো সুখ আমি বাইর করতাছি খাড়া…! আমার জীবণ শেষ কইরা দিয়া তরা সুখে থাকবি ভাবছস…!? তগো সুখ আমি…….. আর বলা যাবে না….
আর ভাবতেও পারে না রোদেলা…..
ঠিক এই কারনটায়ই রোদেলা কখনোই ওর ছোটবেলায় ফিরে যেতে চায় না।
ওদের মা নিজে জীবণে সুখ পায় নি, তাই তার কারো সুখ সহ্য হয় না, এ কথাটা অনেক অনেক বছর পর বুঝেছিল রোদেলা। যখন বুঝলো ব্যাপারটা পুরাতন সব হিসেব মিলে গিয়েছিল তখন। ওদের হাসাহাসি, ওদের টিভি দেখা, ওদের হাতে মেহেদী পরা, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, ছোট মামা-মামীর সুন্দর সুখের সংসার, একসাথে ঘুরতে যাওয়া, খেতে যাওয়া, ছবি দেখা এসব না দেখতে পারা… সব হিসাব মিলে যেতে থাকলো।
এসব মানতে পারতেন না নাসিমা । নোভেলের মা ছিলেন গরিব ঘরের মেয়ে। মামারা অবস্থাপন্ন পরিবার। সেই পরিবারে বিয়ে করে মামা তাকে ঘরে তুলেন। মামীকে পছন্দ করে বিয়ে করেছেন মামা। যদিও পারিবারিক ভাবেই হয়েছিল বিয়েটা। নাসিমার সহ্য হতো না গরিব ঘরের একটা মেয়ে বিয়ে করে এসে এমন রাজরানি হালে থাকে, আর ও এমন পরিবারের মেয়ে হয়েও ওর এই দূর্দশা….! এটাই ছিলো নাসিমার যন্ত্রণার মূল কারন। মামীর ভালো থাকাটাই সহ্য হতো না তার।
হায় কপাল…! কে তাকে বোঝাবে যে যার যার ভাগ্য তার তার ঠিকানা তৈরী করে দিয়েছে। ঝগড়া লাগলেই নাসিমা বলতেন ফকিন্নির ঝি…! এটাই ছিলো ঝগড়ার উদ্ভোধনী বাক্য। তিনি এমন সব কথা কোত্থেকে শিখেছেন ভেবে অবাক হয় রোদেলা। ওর নানু বাড়ির কাওকেই এমন কথা কখনো বলতো শুনেনি ও ।
শেষ পর্যন্ত নোভেলের মাকে বাড়ি ছাড়া করে ছাড়লেন। আর এই পাপ তিনি নোভেলকে আঁকড়ে ধরে মোচন করতে চাইতেন।
ছোট মামা তখন বুঝেনি…
যখন বুঝলেন এসব, শক্ত হাতে হাল ধরলেন নিজের সংসারের। নিজেদের কোন ব্যাপারে তাকে নাক গলাতে দিতেন না। পাছে এ সংসারটাও না নষ্ট হয়। সেখানেও দোষ। ছোট মামাকে নাকি মামী তাবিজ করে জবান বন্ধ করে রেখেছেন। তা না হলে এই ভাই এত বদলে গেলো কিভবে…?
নাসিমা এই সংসারও ঘাটতে চেষ্টা করেছেন। পারেন নি..
ছোট মামী দক্ষ, আর ছোট মামা সজাগ থাকায়। এজন্য আড়ালে আবডালে ছোট মামীকে “হুররাম” ডাকেন নাসিমা। সুলতান সুলেমান এর “হুররাম”…
যে সব ভুলিয়ে একছত্র দখলে নিয়েছিলো সুলতান সুলেমানের । বোনদের বৈঠকে সবাই যখন এক হয় তখন নাসিমা বলেন আরেহ্ ঐ মা*গী তো হুররাম… দেখস না আমার ভাইটারে কেমন বোবা বানায়া ফেলছে, দেখস না তরা….
কোন কথা বলতে গিয়ে কত কথা হয়ে গেলো…
কোথায় যেন ছিলাম….!?
ওহ…! নাতাশা এসেছে রোদেলাদের বাসায়।
নাতাশা এসেছে একটা উদ্দেশ্যে। তা না হলে ও এখানে আসার মেয়ে না। ফুফুকে মোটেও পছন্দ করে না নাতাশা, তবুও ফুফাতো বোনদের কষ্টে ও ব্যাথিত হতো। ভালোবাসতো মন থেকে। ও এসেছে সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা বলতে। নাতাশার শ্বশুর বাড়ির লোক কেও জানে না যে এতসব ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। তারা জানে রোদেলারা এখনো ঐ বাড়িতেই আছে। এখন ওরা যদি না যায় তাহলে তারা খারাপ ভাববে…
অনেক বুঝিয়ে রাজি করলো ফুফুকে। তবে তিনি যাবেন না। গেলে ওরা দুই বোন যাক। তার কোন আপত্তি নেই। রোদেলা অবাক হলো তার রাজি হওয়া দেখে।
নাতাশা বললো বৃহস্পতিবার যাবে ওরা , বুধবারই যেন চলে যায়। সারাদিন তিনজন মিলে মজা করে কাটালো, কি করবে, কি পরবে তার প্ল্যান।
রাতে কল্লোল খাবার নিয়ে আসলো সবার জন্য। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হলো সকলের। শেষে বারোটার দিকে চলে গেলো নাতাশা আর কল্লোল। নাসিমার মনে যাই থাক। কল্লোলকে তিনি ভালো ভাবেই আদর আপ্যায়ন করলেন।
রাতে ঘুমানোর আয়োজন করছিলো ওরা দুই বোন। এমন সময় নাসিমা ওদের উদ্দেশ্যে বললেন। তোরা কেও কোথাও যাচ্ছিস না, বুঝলি….!?
ওদের সামনে আমি তোদের অনেক সাধাসিধা করবো। কিন্তু তোরা দুই বোনই বলবি তোরা যেতে চাস না।
প্রিসিলা কেমন যেন চুপসে গেলো কথা শুনে। রোদেলার কোন ভাবান্তর হলো না এ কথা শুনে। ও এসব অনেক দেখেছে জীবণে। এসব এখন আর কষ্টের কারন হয় না ওর জীবণে। মনটা পাথর হয়ে গেছে বহু আগেই। অনুভূতিহীন একটা পাথরের টুকরা….
ঘরের বাতি নিভে গেলো। রোদেলা লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে। মনটাকে শান্ত রাখবার জন্য । একটু পর রোদেলা শুনলো প্রিসিলা ঘন ঘন নাক টানছে… ওর বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে ওর ছোট্ট বোনটা সেন্টমার্টিন না যেতে পারায় কাঁদছে। নাতাশা যখন ওদের প্লান বলছিলো খুশিতে ওর চোখ চকচক করছিলো। তাই তো কষ্টটাও বেশি পাচ্ছে এখন…
রোদেলা দুই বোনের মাঝের কোল-বালিশটা সরিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। কিছু না বলেই অনেক কিছু যেন বললো দু’বোন। যার পাঠোদ্ধার করার ক্ষমতা হয়তো ইশ্বর নাসিমাকে ইহজীবনেও দান করবে না…..
চলবে……
( সবাই লেখা পড়ে অবশ্যই কমেন্ট করবে। আমি ঠিকঠাক লিখতে পারছি কি না, নাকি তালগোল পাকিয়ে ফেলছি তা বুঝছি না। তোমাদের মতামত আমাকে সাহায্য করবে)
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1508285879632598/
Next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1515753548885831/