রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ১০

0
999

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১০

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বালিশের নিচে থাকা ফোনের কম্পনে। রোদেলা চোখ বন্ধ করেই হাতড়াতে থাকে বালিশের নিচে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে ম্যাসেজ এসেছে। অসভ্য শেভনের….
শুভ সকাল…

ফোন পাশে রেখে আড়মোড়া ভাঙে রোদেলা। ম্যাসেজের জন্য বিরক্ত হতে চায় না ও… বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে বড় বড় দুটো নিশ্বাস নেয়। এরপর ঝটপট বিছানা গুছিয়ে বারান্দায় যায়, সূর্য উঠেছে কিছুক্ষণ আগে। বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেয়, শুকনো পাতা গুলো পরিষ্কার করে।
নামাজ পরে একটু পড়তে বসে ও। ওর মা উঠেন আজানের আগে। এদিকটায় গ্যাসের অনেক সমস্যা। সকাল সকাল না উঠলে রান্না করা যায় না। তাই রেদেলার মা সকাল সকাল উঠে পরেন। আটটার মধ্যে তার রান্না-নাশতা সব তৈরী হয়ে যায়। রেদেলা নাশতা খেয়ে প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে পরে।

বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক। কেও বলবে না যে গতকাল কি একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা এখানেই মাটি চাপা পরে যাবে। মা যা বলার বলেছেন , আর কাওকে এ বিষয়ে কোন কথা বলতে শোনা যাবে না, ওর বিচার করবে তো দূরের কথা।

ঠিক এই শাসনহীন পরিবেশটাই দিনে দিনে ওকে অমানুষ তৈরীর জন্য দায়ী। কোন জবাবদিহিতা নাই, শাসন যা করার একমাত্র তিনিই করেন। ছোট মামী যে ঠিকই বলেছেন তা সকলেই জানেন। তবুও কপট রাগ দোখান বড় মামা মামী। মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ান। দুজনকে মিলমিশ করিয়ে দেন। সব ঠিকঠাক হয়ে যায় সময়ের ব্যাবধানে।

রোদেলার হঠাৎ ছোট মামীর কথাগুলো মনে পরলো । তারপর আর খাওয়া গলা দিয়ে নামলো না। এ কথাগুলো ভবালেই ওর মরে যেতে ইচ্ছে হয়। সারা দুনিয়ায় সন্তানের জন্য বাবা মায়েররা মানুষের কথা শুনে। আর ওদের বেলায় তা উল্টো। বাবা মায়ের জন্য ওদের মানুষের কথা শুনা লাগে। মা-বাবা দুজনই দোষী ওদের এই জীবণের জন্য। রোদেলা পুরোনো কথা গুলো সব ভাবে। বাবা-মায়ের করা প্রতিটি ভুল ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকে। চোখদুটো ভিজে যায় ওর এসব ভেবে। এসব ঘটনা মনে করলে বুকে চাপা ব্যাথা অনুভব করে ও, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে…
এসব তাই ও মনে করতে চায় না। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলো সুযোগ পেলেই এসব কথা শুনাতে ভুল করে না। আজ পর্যন্ত মানুষের কাছে কখনো দয়া আর তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পায় নি ওরা । ওদের মেধা, ভালো রেজাল্ট, পরিশ্রম, রোজগার, অল্পে তুষ্টি, এডজাস্টমেন্ট, এমন অনেক গুন এসবের ভিড়ে হারিয়ে যায়৷ পরিচিত কেও দেখলে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছো, কিংবা পড়াশোনা কেমন চলছে….
জিজ্ঞেস করে তোমার বাবা কি ফিরেছে…?
তারপর শুরু হয় আফসোসের আড়ালে ওদের ঐসব ঘটনার বিবরণ। বাবা মায়ের করা ভুল সম্পর্কীয় তাদের নিজস্ব মতামত। তারা এমন ভাব দেখায় যেন ওদের নিয়ে খুবই চিন্তিত। ওদের জন্য সহমর্মি, আসলে এসবের আড়ালে থাকে ওদের হেয় করার নিঁখাত চেষ্টা। এদের একমাত্র দায়িত্ব ওদের এই পারিবারিক নোংরা ক্ষতকে শুকাতে না দেয়া। কেটেকুটে তা তাজা রাখা। ওদের জীবণ কিভাবে কাটছে, ভবিষ্যতে কি হবে তা না ভেবে, এসব নোংরা ঘাটার এ কাজ তারা দায়িত্বের সাথে পালন করছে….

এসবের জন্য বাবা মায়ের প্রতি ঘৃণা হয় রোদেলার।
মা-বাবা কাওকেই ও জীবণেও ক্ষমা করতে পারবে না।

কত কত দিন ও মাকে বলেছে মা আমরা আলাদা বাসা নিয়ে দূরে কোথাও থাকি। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না, জিজ্ঞেস করবে না তোমার বাবা ফিরিছে কি না…..
তোমাদের এখন চলে কিভাবে বলে বাজে ইঙ্গিত করবে না…..
তিনি ওর কথা আমলে তো নেনই নি, উল্টো কথা শুনিয়ে দিয়েছেন।

আজ একবার বলবে মনে মনে ঠিক করে। এসব আর নিতে পারে না, ওর ছোটবোনটা অনেক অন্তর্মুখী স্বভাবের। রোদেলা চায় কেও ওর জীবণটাকে এসব প্রশ্নবান জর্জরিত না করুক।

এমন সময় ছোটমামী প্রতিদিনের মতো রেদেলার টিফিন রেডি করে দেন। তিনি তার মেয়ে কণার জন্য টিফিন তৈরী করে সাথে রোদেলার জন্য ও করে প্রতিদিন। কণার স্কুল শুরু হওয়া থেকে এ নিয়ম শুরু। রেদেলা আজ টিফিন না নিয়েই চলে যায়। কিছুটা অভিমান করে মামীর সাথে। এক সিঁড়ি নেমে যেতেই ছোটমামী দৌড়ে আসে টিফিন বক্স হাতে,
ডাক দেয় -রোদেলা……
তোমার টিফিন ভুলে গেছো…..!
রোদেলা শুনতে পেয়েও হাঁটা থামায় না। মামী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে রোদেলার কাছে। পেছন থেকে হাত ধরে বলে- রাগ করেছো আমার সাথে….?
আমি আসলে লজ্জিত তোমাদের সামনে এসব বলার জন্য।
কথাগুলো বলতে আমি বাধ্য হয়েছি, আসলে আমরা সবাই ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় আছি। তুমিও এর বাইরে নও।
তুমিই বলো একটা কথা আমি ভুল বলেছি। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী…….?
রোদেলা কোন জবাব দেয় না, বক্সটা হাতে নিয়ে নেমে যায়… মামী তখনো দাঁড়ানো সিঁড়ির রেলিং ধরে…

মামীদের সাথে রোদেলার খুব ভালো সম্পর্ক। বন্ধুদের মতো..
তাই মামী অনুতপ্ত গতকালের ঘটনায়। রোদেলা ভাবে তিনি ভুল নন… ভুল যা হয়েছে, হচ্ছে, এবং হবে সবকিছুর জন্য দায়ী একমাত্র ওর মা। ও আসলে এসবের শেষ চায়, তাই আলাদা বাসা নিতে চায়, যাতে মামীরা অন্ততঃ শান্তিতে থাকতে পারেন। মনে মনে ভাবে আজ রাতে আবার কথাটা তুলবে ও….

কলেজে যায় ঠিকই রোদেলা, কিন্তু ক্লাসে মন বসে না।
ক্লাসের অফ পিরিয়ডে বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো রোদেলা, নতুন কোচিং শুরু করবে এ বিষয়ে। এমন সময় কল এলো শোভনের। রোদেলা কমনরুমে সরে গিয়ে কল রিসিভ করলো।

: শুভ অপরাহ্ন মিস রোদেলা….
: আচ্ছা শোভন নামের অর্থি কি আপনি জানেন…?
: হঠাৎ নামের অর্থ নিয়ে পরলেন কেন….? ছেলেমেয়েদের নাম ঠিকঠাক তো অনেক দূরের কথা আগে….
: আশ্চর্য…. আপনি তো ভীষণ অসভ্য….!
: আহ্ রোদেলা, আপনি আমাকে যাই বলেন আমি আমাকে তাই মেনে নিতে রাজি, আপনি ভুত বললে আমি ভুত, ডাকাত বললে ডাকাত….!
: আপনার নামের সাথে আপনি পুরো উল্টো… আপনার জন্য এ নামটা রাখা উচিত হয় নি…
: তাহলে একটা নাম রেখে দিন আমাকে, দুটো খাসি জবাই করে নামটা বদলে ফেলি….
: আরেব্বাহ্, আপনার সাথে কথায় পারবে এমন লোক পৃথিবীতে একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না….
: আমর সাথে যাকে মানবে তাকে মনে হয় আমি খুঁজে পেয়েছি।
: শোনেন শোভন, আপনি আমাদের আত্নীয় মানুষ তাই আপনার এসব ফালতু কথা সহ্য করেছি, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
: আরেহ্ বেআইন সাহেব, আপনার সাথে আমার সম্পর্কটাই সীমা-আইনের বাইরে।
: শুনুন আপনি, এসব ফালতু কথা বললে আমাকে কল কিংবা ম্যাসেজ কোনটাই করবেন না আপনি….
: আরেহ্ রাগিয়ে ফেললাম আপনাকে, রাগলে কেমন দেখায় আপনাকে, খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, আচ্ছা অনুগ্রহ করে একটা সেলফি তুলে রাখবেন কি, যখন দেখা হবে তখন দেখে নিব নি….
: আচ্ছা আমি রাখছি, শুভ সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত এসব ম্যাসেজ দিবেন না, ভালো থাকবেন।
: ওকে, আপনিও ভালো থাকবেন। ছবিটা তুলে রাখবেন কিন্তু, আমি রাতে দেখতে আসবো….

রোদেলা ওর মুখের উপর ফোনটা কেটে দিয়ে একটু হাসলো, পাগল ছাগল পোলাপান…

ক্লাসের বেল পরায় কমন রুমটা পুরো ফাঁকা। রাগি ভঙ্গিতে রোদেলা সত্যিই দুটো সেলফি তুললো… জুম করে ছবি দুটোকে দেখলো। ওর অবাক লাগলো একটা ফালতু ছেলের কথামতো ও সেলফি তুললো…!
ঠিক এ সময়ই একটা রিকুয়েষ্ট নোটিফিকেশন এলো ফেসবুকে, জুনায়েদ আফনান শোভন সেন্ড ইউ ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট…..

ফেসবুক খুলে শোভনের প্রোফাইলের পোস্টমর্টেম করলো রোদেলা। ছেলে ৯৯% ঠিক, তবে ফালতু কথা বেশী বলে…
পাশে বসা মিশু জিজ্ঞেস করলো কিরে কোন ছেলে ৯৯% ভালো….? রোদেলা বা পাশে তাকিয়ে বললো আরেহ্ নাতাশার দেবর হয়… ফোন দিয়ে লাইন মারার চেষ্টা করছে। ফালতু পোলাপান….
ছোট বোনের দেবড়….! দেখিস আবার…..
দূর…

ক্লাস কোচিং টিউশনি সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা। পাঁচটায় আবার বাসায় স্টুডেন্ট আসে এক ব্যাচ পড়ার জন্য। ওদেরকে পড়ানো শেষে একটু ফ্রি হয় রোদেলা।

বাসায় ফিরলে ও যেন ওর অভিশপ্ত জীবণে ফিরে আসে। অনেকটা বাধ্য হয়েই ফিরে আসা প্রতিদিনের জীবণে। দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। আজ ও মাকে সুন্দর করে বোঝাবে, মা যত যাই বলুক না কেন কোন অবস্থাতেই রাগবে না।

রাতে খাবার পর রেদেলা ওর মায়ের ঘরে যায়, ওর মা ভাঁজ করা কাপড় ওয়ারড্রবে তুলে রাখছে। রোদেলা ওর মায়ের খাটে বসে বললো –
: মা একটা দরকারী কথা বলতে আসছি আমি….
: কি কথা…. বল
: তোমার কি এখনো মনে হয় না, এ বাড়ি ছেড়ে আমাদের চলে যাওয়া উচিত….?
মা অগ্নি মুর্তি রূপে ওর দিকে তাকায়, যেন সব সম্পদ রোদেলা লিখে নিতে চাইছে….
: এই তোর দরকারী কথা….?
: মা কথাটা যে কতটুকু দরকারী তা আমার চেয়ে তুমি ভালো বুঝ, বুঝেও না বোঝার ভান কেন করে আছো তা আমি বুঝি না….
: আমিতো শখে মানুষের বাড়ি বাদী হয়ে থাকি, দুটো যুবতী মেয়ে নিয়ে আমি একা কোথায় থাকবো, তাছাড় তোদের বিয়েও তো দিতে হবে। আমার বুঝ আমার কাছে।
তোদেরকে জন্ম দিয়েই তো আমার যত পাপ…. যার জন্য করি চুরি তারাই বলে চোর। তোরা না থাকলে আমার এক পেটের কোন চিন্তা ছিলো, যে কেও আমাকে খুশি মনে রাখতো, কাজ করতাম ভাত খেতাম। কারো কথা শুনতে হতো না।

রোদেলার চোখে পানি এসে পরে। মনে মনে বলে তোমাদের ঘরে জন্মানোও আমাদের পাপ….
একমাত্র পাপ…

: তোদের একটা ব্যাবস্থা করে আমি চলে যাবো এ বাড়ি থেকে।। যে সুনাম তোর বাপ কামাই করেছে, একা থেকে তোদের বিয়ে জোগাড় করতে হবে না…..

: করতে হবে না জোগাড়, কেও যদি সব জেনে বিয়ে করে করবে না করলে না করবে, এসব ভেবে তোমার মাথা নষ্ট করা লাগবে না। আগামীকাল আমরা বাসা খুঁজতে বের হবো।

: তোর যদি ভালো না লাগে তুই চলে যেতে পারিস। আমার কথা ভাবতে হবে না তোকে….

: মা ব্যাপারটা আমার একার সমস্যা না…. মানুষ যখন কথা শোনায় নাম ধরে ধরে বলে না। আমাদের তিনজনের উপরেই পরে কথা গুলো….

: আমি এক কথার মানুষ, এসব শুনতে যদি রুচিতে বাঁধে তাহলে চলে যাস না কেন কারো হাত ধরে, তুইও বাচস, আমিও বাঁচি।

রোদেলা ওর মায়ের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে, ওর দুচোখ বেয়ে পানি পরছে… ও মনে মনে বলে যদি কেও থাকতো সত্যিই চলে যেতাম এ নরক থেকে……

ওর মা একথা বলেই বাথরুমে ঢুকে যায়, রোদেলা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে, ওর মা কেন ওদের কষ্ট বুঝে না, তিনি কি জানেন না তার মেয়ে কেমন, কিভাবে পারে মা হয়ে একথা বলতে….! আল্লাহর কাছে দোয়া করে আল্লাহ তুমি আমাদের এ কষ্টের অবসান ঘটাও।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে, রোদেলা অন্যমনস্ক হয়ে বসে বসে শুনতে থাকে… একবার, দুইবার, তিনবার, কেও কেন দড়জাটা খুলছে না…? বাড়ির সব কি মুর্তি হয়ে গেছে…

রোদেলা চোখে মুখে পানি দিয়ে দড়জা খুলতে যায়। দড়জা খুলে দেখে শোভন দাড়িয়ে…..!
রোদেলা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে, পেছনে ঘুরে
দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে, ঘড়িতে সময় সাড়ে দশটা…!
শোভন বললো…
: কি ব্যাপার বেআইন সাহেবা, ঢুকতে দিবেন না ঘরে…?
: আপনি এত রাতে…!
: বলেছিলাম না রাতে আসবো ছবি দেখতে….?
রোদেলার মনে পরে দুপুরের কথা। এরপর বলে
: আর ইউ গোন ম্যাড…?
: ইয়েস আই এ্যাম…!

চলবে….

[লেখা পড়ে আপনারা কমেন্ট কেন করেন না…? এত কষ্ট কমেন্ট করতে…? তাহলে ভাবেন তো আমার কত কষ্ট হয়….!
আপনারা ধরানাও করতে পারবেন না কিভাবে লিখি, আমার দেড় বছর বয়সী মেয়ে ফোন অথবা ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই হামলে পড়ে। ওর থেকে লুকিয়ে লিখতে হয়, নাহলে ওর ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কি যে এক যন্ত্রণায় লিখি, তবুও লিখি আপনাদের জন্য। প্লিজ কমেন্ট করে আপনাদের অনুভূতি জানান…
আপনাদের মতামত আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা জানবেন সকলে…..❣️]
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1489827754811744/
Next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1491806677947185/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here