রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১১
দড়জা বন্ধ করে ওকে বসতে বলে ভিতরে খবর দিতে গেলো রোদেলা, এমন সময় আবার বেল বেজে উঠলো। বড় মামা এসেছেন ভেবে রোদেলা গেট খুলে দেখে কল্লোল ভাই…!
: আরে ভাইয়া….!
: দড়জা কেন বন্ধ করলেন, ও কি বলে নি আমি আসছি…
রোদেলা পিছন ফিরে তাকায় শোভনের দিকে। শোভন দ্রুত চোখ ফিরিয়ে টি-টেবিলে রাখা ম্যাগাজিন দেখতে থাকে।
কল্লোল ভাইয়া ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো…
: নিচে গাড়ি সাইড করে আসতে দেড়ি হয়ে গেলো,
: আমাকে কিছু বলেন নি উনি…
: কিরে শোভন….!
শোভন একটা মুচকি হাসি হাসলো, রেদেলা রাগী মুখ করে রান্নাঘরে চলে গেলো। মামীরা এমন সময় ছাদ থেকে নামলেন। ওদের দেখে বললেন –
আরে বাবারা কেমন আছো তোমরা…?
: আসসালামু আলাইকুম মা… কেমন আছেন আপনারা…???
: ওয়ালাইকুম আসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি বাবা, তোমরা বস বস…
আমাদের এখানেই এসেছো নাকি কোন কাজ ছিলো এদিকে
: না মা আপনাদের এখানেই এসেছি…. আগামী ১২ তারিখ ডেট ঠিক হয়েছে সেন্টমার্টিন যাবার, মা আর বৌমারা ড্রেস ঠিক করেছে, সবাই একরকম ড্রেস আর পাঞ্জাবি পরবে। আপনাদের ড্রেস গুলোর কাপড় দিয়ে পাঠালো, এগুলো তৈরী করতেও তো সময় লাগবে….
: নাতাশাকে নিয়ে আসতে….
: মা, আমি অফিস থেকেই এসে পরেছি, শোভন এগুলো নিয়ে আমার অফিসে এসেছে, নাতাশা জানে যদি আমি এখানে এসেছি, তাহলে বাড়ি গিয়ে আমার খবর আছে….
এ কথা শুনে সবাই হাসলো, রোদেলা কফি করে এনেছে, ওদের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন চলছে।
ড্রেসের ব্যাগ ছোট মামী পাশে সরিয়ে রাখলেন। একটু পর বড় মামা আসাতে সবাই একসাথে অনেক কথা হলো। ওরা চলে যেতে চাইলো, কিন্তু সবাই ওদেরকে জোড় করে রেখে দিলো, রাতে না খেয়ে যেতে দিবে না।
এমন সময় নাতাশা ফোন করে কল্লোলের ফোনে। কল্লোল ফোনটা দেখায় শোভনকে, উঠে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করে। রোদেলা খাবার দিচ্ছে টেবিলে। কল্লোলকে না দেখে জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া কোথায়,
শোভন বললো
: বৌকে কনভেন্স করতে গিয়েছে, ভাবী তো দৌড়ের উপর রাখে ভাইয়া কে, কি মধুর যন্ত্রণা……
আপনিও কি আমার সাথে এমন করবেন…???
এমন সময় বড় মামী ভাজা মাছ নিয়ে রুমে ঢুকে, রোদেলা যে একটু কথা শুনাবে তাও পারে না। দাঁতে ঠোট চেপে হাতে থাকা চামচ উচিয়ে মার দেবার ভঙ্গিতে শাসায় শোভনকে। শোভন ফিক করে হেসে দেয়। রোদেলা দ্রুত চলে যায় রান্নাঘরে। কথা শেষ করে কল্লোল হাত ধুয়ে টেবিলে বসে। শ্বশুরের জন্য অপেক্ষা করে। সবাই একসাথে খেতে বসে, বড় মামা, ছোট মামা, শোভন, কল্লোল, রোদেলার নানু, ছোটমামী, প্রিসিলা, রোদেলা জোর করে বড় মামীকেও বসিয়ে দেয়। কল্লোল থাকায় উনি ইতস্তত বোধ করেন। কল্লোল বলে মা বসুন না, আমাকে আপনি জামাই কেন ভাবছেন, ছেলে ভেবে বসুন, একসাথে খাওয়ায় একটা শান্তি। যত কাজ হোক বাড়িতে রাতের খাবারটা আমরা সবাই একসাথে খাই।
ছোটমামা বললো বসেন ভাবী, শেষে রোদেলা পাশে থেকে সবাইকে খাবার বেড়ে দেয়।
কল্লোল অবশ্য ওকে ও বসতে বলে একসাথে, ও রাজি হয় না। ঘুরে ঘুরে কার কি লাগবে দিতে থাকে। শোভনকে মাছ সাধায় শোভন বলে আমি মাছ খেতে পারি না, কাটার ভয়ে। বড় মামা বললে ইলিশ মাছ আবার কেও না খায়। এমন সময় বেল বেজে উঠে। রোদেলা দড়জা খুলে দেখে নোভেল এসেছে। ও ঘরে ঢুকে টেবিলে একবার চোখ বুলিয়ে দ্রুত ওর ঘরে গিয়েই দড়জা আটকে দিলো। কোন কথাই বললোনা, এমনকি মেহমানদের সাথেও না, কল্লোল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বড় মামার উদ্দেশ্যে বলেন তা বাবা আপনার ব্যাবসার কি খবর…?
আর ব্যাবসা…
দেশের যা পরিস্থিতি, মাল কিনা লাগে বেশী দামে, অথচ পাইকাররা বেশী দাম দিয়ে কিনতে চায় না, কি যে মুশকিল। তার উপর মালের ট্রাক জায়গায় জায়গায় আটকে চাঁদা আদায় করে নেতা-ফেতার লোকেরা, আছি যন্ত্রনায়। এ বয়সে এত পেরেশানি কুলায় না। ভাবছি ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলবো।
তাদের কথার ফাঁকে শোভন রোদেলাকে বললো,
: বললেন না কিন্তু,
গোশত পাতে দিতে দিতে বললো…
: কি …?
: আপনিও এমন মধুর যন্ত্রণা দিবেন কিনা…?
: আপনার পাবনা যাবার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।
এমন সময় ছোটমামা বলে কিরে রোদেলা কিসের কাউন্টডাউনের কথা হচ্ছে….?
রোদেলা থতমত খেয়ে যায়, পরিস্থিতি সামলে শোভন বলে- ১২ তারিখ সেন্টমার্টিন….. তার কাউন্টডাউ…
রোদেলা মনে মনে বকে শোভনকে, ছাগল একটা…
নিজেও বিপদে পরবে ওকেও সাথে নিয়ে নিবে। মা যদি এসব শুনে কোন কিছু না বুঝেই ওকে খুন করে ফেলবে।
কল্লোল, শোভন হাত ধুতে বেসিনের কাছে যেতেই ছোটমামা বললে, দেখলেন বড়দা… হারামজাদা ঘরে ঢুকলো সলাম, কালাম কিচ্ছু নাই… মুখের উপর দড়জা আটকে দিলো…
বড় মামা বললো, বাদ দে ছোট….
ওদের যেতে যেতে সাড়ে এগারোটা বাজলো। যাবার আগে দাদীর সাথে দেখা করে আসতে তাদেরকে উপরে নিয়ে গেলো প্রিসিলা। দেখা করে ওরা চলে গলো।
খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রেখে ঘুমুতে গেলো রোদেলা। বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করেছে এমন সময় ফোনটা কেঁপে উঠে ম্যাসেজ টিউনে। এত রাতে ঐ অশোভন লোক ছাড়া আর কে দিবে ম্যাসেজ। দূর দেখা লাগবে না। কি আর লিখবে গুড নাইট ছাড়া….!
তবুও মন এ কথা শুনবে কেন, তার এটা না দেখা পর্যন্ত শান্তি কই….! অবাধ্য মনকে সায় না দিয়ে ও ঘুমাতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর আবার বলিশ কেঁপে উঠল ম্যাসেজের টোনে। অন্ধকার ঘরে ফোনটা বের করে মুখের সামনে ধরলো। ২ টা ম্যাসেজই অশোভন লোকটা পাঠিয়েছে। প্রথমে দ্বিতীয় টা খুলে পড়লো রোদেলা। কি ব্যাপার আমার এন্সার কই….!?
দ্রুত প্রথমটা খুললো….
আমিতো আপনার ঘরে গিয়ে এলাম। আপনার বিছানায় বসলাম, আপনার ডেস্কের কিবোর্ডের নিচে কিছু একটা রেখে এলাম। দেখে আমাকে জানান…..!
রোদেলা ফোনটা বিছানায় ছুড়ে দাড়িয়ে পরলো। এমন সময় লোডশেডিং হলো। পুরো বাড়িটা যেন অন্ধকারে ডুব দিলো হঠাৎ। কোন দিকে ও দাঁড়িয়ে, কোন দিকে ডেস্ক কিছুই ঠাওর করতে পারলো না। উল্টো ঘুরে বিছানায় ফোনটা খুঁজলো। ও এমন অস্থির স্বভাবের না। কিন্তু ওর মন কেমন অস্থির হয়ে গেলো কি আছে কিবোর্ডের নিচে তা জানতে।
অন্ধকার চোখে সয়ে এলে ঘরের আসবাব কোথায় কি তা দেখলো। কিবোর্ডের নিচে হাত দিয়ে দেখলো একটা ছোট্ট খাম। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে খুলতে চেষ্টা করলো। খুলে দেখলো একটা কার্ড। কার্ডটা খুলতেই নানান রঙের আলো
জ্বেলে মিউজিক বেজে উঠলো, অন্ধকারে এমন আলো রোদেলার মুখ আলোকিত হলো। কার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা…
উইল ইউ বি মাইন….!?
রোদেলা খুশি হবে নাকি চিন্তিত বুঝতে পারলো না। এসব ভালোবাসার অনুভূতিকে ও কখনো প্রশ্রয় দেয় নি। ওর জীবণটা অন্য আট-দশ জনের মতো না। অন্যেরা ভুল করলে কিংবা কোন ক্ষত থাকলে তাদের বাবা মা সেটা শুধরে দিতে সাহায্য করে। আগলে রাখে অন্যদের কাছ থেকে।
আর ওদের মা…….
বাইরের কেও কিছু বলার আগে তিনিই যা না তাই বলা শুরু করবে… উঠতে বসতে কথা শুনাবে। যা হবে তা তো বললবেই, যা না হবে তাও…. তাছাড়া বড় সন্তান হওয়ার কারনে ওর কিছু দায়িত্বও রয়েছে। যেগুলো ও কখনো এড়িয়ে যায় না। এ বয়সে অন্য মেয়েরা যখন নেইল পলিশের রঙ, জামার ডিজাইন, স্টাইলিশ ব্যাগ নিয়ে ব্যাস্ত ও তখন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে ওর পরিবারের মানুষগুলোর জন্য। একথা শুনলে অনেকে ভাববে যারা পরিশ্রম করে তারা কি জীবন উপভোগ করে না…..? রোদেলার কপালটাই মন্দ। কোন একদিন যদি একটু পরিপাটি হয়ে বের হয় ওর মা আড় চোখে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তো আকারে ইঙ্গিতে বাজে কথাও বলে ফেলে। রোদেলা তাই সাধারণ ভাবে চলাফেরা করা। হঠাৎ রেদেলার একটা ঘটনা মনে পরলো। বাড়ির সবাই ইদে হাতে মেহেদী পরে, বড় মামী বারো মাস হাতে পাতা মেহেদী পরেন। তার হাত থেকে মেহেদীর রঙই ফুরায় না। একদিন মেহেদী বেশী হওয়ায় রোদেলা তা এনে নখ কালো করবার জন্য চুন সাবান দিয়ে মেহেদী পরে। রঙটা যাতে গাড় হয় তাই বার বার তুলে বার বার পরে। ওর মা এসে দেখে খুব বিরক্ত হন। বলেন – হঠাৎ এমন মেহেদীর উপর পরলি কেন। কথাটা এমন বিশ্রী ভঙ্গিতে বললেন যে রোদেলার চোখে পানি এসে পরলো। সামান্য মেহেদী পরা নিয়েও তার কথা শুনাতে হয়। অথচ অন্য কেও হলে ভাবতো এ বয়সে মেয়েরা কত কি করে, নিজেকে পরিপাটি রাখে। এ বিষয়ে অনেককে দেখেছি মেয়েদের উৎসাহ দেয়, সবসময় গুছগাছ থাকতে বলেন। আর উনি সব কিছুতেই উল্টো পথে হাঁটা মানুষ……
সংবিৎ ফিরে আসে আরো একটা ম্যসেজে….
অশোভন লোকটা পাঠিয়েছে-
রোদেলা তোমার ঘর ঘুরে এলাম আজ….
তুমি কবে আসছো আমার ঘরে……!?
এই যা তুমি বলে ফেললাম…..
চলবে…..
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1490455208082332/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1493116191149567/