গল্প- অনুভূতিরা মৃত
বারো পর্ব
.
আর এক মূহুর্তও না। যত জলদি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। সে যতো জোরে প্যাডেল ঘুরাচ্ছে, মনে হচ্ছে সাইকেল আরো ধীরগতি হচ্ছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে, এখান থেকে পালাতে হবে। রুয়েলের ভাবনা, কারো সাথে কথা বলতে চাই না। যোগাযোগ রাখতে চাই না। কারো করুণা পেতে চাই না। আমার অনুভূতি তো মৃত তাহলে কেন এত আবেগ প্রকাশ করব? নতুন করে কিছু জাগিয়ে তুলতে চাই না৷ সাইকেলের প্যাডেলের সাথে ঘুরছে তার চিন্তা ভাবনা। নির্জন অরণ্য বটবৃক্ষ ছাড়িয়ে সাইকেল প্রবেশ করল শহরে। দিনের আলো নিভে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। রাতের অন্ধকারের সাথে ঘুম সাগর পাড়ি দিলো। অনেকদিন পর রাতের ঘুমটা ভালো হলো। রাতের আঁধার নিভে সকালের সূর্য জেগে উঠল৷ ফুটে উঠল, সকালের সিক্ত রোদ। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই তার চোখ চড়কগাছ। চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে মিহি। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখা এটা স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর স্বপ্ন দেখা বিজ্ঞানিক কোন তথ্য আছে কি? বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে তখনি মিহির ডাক চা খাবে না? চমকে উঠে রুয়েল। স্বপ্নের ভিতর এই মেয়ে কথাও বলছে, দরজার ঠিক সামনে চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে মিহি। না! এটা স্বপ্ন না। ঠিক বাস্তব। এক রাতে এতো পরিবর্তন। কিন্তু কীভাবে সম্ভব?
.
রুয়েল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। মিহি চা এগিয়ে দেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে। ছোট করে বলে, বাহঃ সুন্দর চা। চায়ের রঙটা শুধু আর স্বাদ সেটা বিদঘুটে। লজ্জা পায় মিহি। কিছু বলতে চাচ্ছে সে। নিরবতা ভেঙ্গে বলতে শুরু করে। ক্ষমা করো রুয়েল। আমি জানতাম না সবটা। ভুল বুঝেছি তোমায়। সেদিন তুমি যখন চলে আসো বাবার কাছ থেকে জানতে পারি সবটা। তোমার ব্লাড না পেলে এখানে দাঁড়াতে পারতাম না। কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি, সবকিছুর জন্য স্যরি আমি। অনুভূতিহীন ছেলেটা এগিয়ে আসে। মুখের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে টেনে বলে, বন্ধুত্বে নো স্যরি, নো থ্যাংকস। এভাবেই বন্ধুত্বের শুরু, গল্প মোড় নেয় নতুন গল্পে।
.
গভীর রাত। প্রচণ্ড ঘুমে বিভোর রুয়েল। ফোনের রিংটোন বেজে চলছে, সাধারণত এত রাতে ফোন বাজার কথা না। ঘুম ভেজা চোখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসল।
— আমি আরজু
— আরজু?
— ভুলে গেছিস নিশ্চয়। আরজুকে ভুলে গেলেও চট্টগ্রামের স্মৃতি ভুলিসনি নিশ্চিত?
শুয়া থেকে উঠে বসে সে। আচমকা হয়ে বলে।
— আরজু ভাইয়া তুমি? কতদিন পর।
— হ্যাঁ, আমি সিলেট আছি কাল দেখা করতে পারবি?
.
কিছুক্ষণের মধ্যে মোবাইলের ইনবক্সে ঠিকানা চলে আসে। অনকদিন পর আরজু ভাইয়ার সাথে দেখা হবে। সেই কবে ছেড়ে এসেছিল। যখন সে ছিল একা। ভীষণ একা। সেদিনের পর জীবন থেকে চলে গেছে অনেকগুলো বসন্ত, শরৎ আর হেমন্ত। সেই একাকীত্ব সময়ে পাশে ছিল আরজু ভাইয়া আর নিশি আপু। জীবনের কঠিন একটি শপথ নিয়ে রুয়েল যখন পা রাখে চট্টগ্রামের মাটিতে, তখন নিশি আপুর বাসায় ভাড়ায় উঠে রুয়েল। বন্ধুহীন শহরে জানালার পাশ থেকে ক্রিকেট খেলা দেখেই কেটে যেতো সময়। ইচ্ছে হতো তার ব্যাট বল নিয়ে নেমে পড়তে কিন্তু এখানে সবাই ছিল অপরিচিত। একদিন সাহস করে এগিয়ে যায় সে। টিম লিডারকে বলে তাকে খেলায় নিতে, ফিরিয়ে দেয় তাকে। বিষণ্ণ মনে বাসায় ঢুকতেই নিশি আপুর ডাক। সবটা শুনে নিশি আপু বলে, এই মাঠে খেলা হবে আর আমার ভাইকে নিবে না। চল আমার সাথে। রুয়েলের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে নিশি আপু। নিশি আপুকে দেখে পুচকে যায় টিম লিডার।
— রুয়েল আমার ছোট ভাই, আজকে থেকে ও এই টিমে খেলবে। ওর যেন কোন সমস্যা না হয় এদিকটায় যেন নজর থাকে। নিশি আপুর কথায় উপস্থিত সকলে মাথা নাড়ে।
.
সেদিন জানা যায় টিম লিডার আরজু ভাইয়া নিশি আপুকে পছন্দ করতো। পছন্দ আবার সাধারণ পছন্দ না। সেই লেভেলের পছন্দ। নিশি আপুও পছন্দ করতো তবে সেটা অগোচরে ছিল। রুয়েলের মাধ্যমেই তা সামনে আসে, তার হাত ধরেই চিঠি আদান-প্রদান হতো। আদান-প্রদান হতো ভালোবাসার চিঠি। রুয়েল ছিল তাদের বক্সের পিয়ন। প্রেমিক আরজু চিঠি লিখে– ওগো প্রিয়তমা, আমি এখন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী অষ্টাদশ রমণীর কাছে লিখতে বসছি। হ্যাঁ তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। প্রতিটি প্রেমিক হৃদয়ে গেঁথে আছে তার প্রেমিকা ঠিক তেমনি তুমি। আমি পৃথিবীর বিখ্যাত একটা চরিত্র হতে চাই, বিশ্ব প্রেমিক হয়ে টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে আমার ভেজা চোখ দিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই, মনে হবে তুমি আমার হাজার বছরের চেনা। এক বুক ভালোবাসা নিয়ে রচনা করব একটা ভালোবাসার পৃথিবী। সেই চিঠি পৌঁছে যায় প্রেমিকা নিশির কাছে, রিপ্লাই করে সে। তাদের এই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে রুয়েল।
.
এক সময় চলে আসে রুয়েল। ইন্টার পাস করে ফিরে আসে সিলেট। যোগাযোগ তখন কমতে থাকে, দুরত্ব বাড়তে থাকে এভাবেই হারিয়ে যায়। রাত পোহালেই দেখা হবে আরজু ভাইয়ার সাথে। চট্টগ্রামের দুই বছরের স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠে। আবার ঘুমে হারিয়ে যায়। সকাল হতেই মিহিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আম্বরখানা মাজারগেইটের সামনে অপেক্ষারত আরজু ভাইয়া। মাথায় এলোমেলো চুল বেশ এলোমেলো। তবে শরীরে একটা ভাব আছে, ফর্মাল ড্রেসের সাথে এলোমেলো চুল দেখতে কেমন বিদঘুটে লাগছে, আরজু ভাইয়া মানুষটা এমন এলোমেলো। দেখা হতেই আরজু ভাইয়া হাত চেপে ধরে বলল– চল, রসগোল্লার দোকানে যায়। রুয়েল রসগোল্লা পছন্দ করে। নিশি আপুর সাথে প্রেম হওয়ার পর প্রচুর রসগোল্লা খাওয়াতো। রসগোল্লা খেতে খেতে রুয়েল প্রশ্ন করে, নিশি আপু কেমন আছে? নিশ্চুপ আরজু ভাইয়া। সে আবার প্রশ্ন করে, বিষণ্ণ মনে উত্তর দেয়। শুনেছি ভালোই আছে, তুই চলে আসার সাত মাস পর নিশির বাবা এক ডাক্তার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। আমি প্রস্তাব পাঠানোর পর বেকারত্বের ট্যাগ লাগিয়ে আমায় রিজেক্ট করে। কথাগুলো বলতেই আরজু ভাইয়ার চোখ অশ্রুতে ছলছল করছে।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল