#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৪
ওদের একসাথে আসতে দেখে সবাই তাকিয়ে রইলো সেদিক। কি বুঝে যেন শোভন হঠাৎ হাত ধরলো রোদেলার। শক্ত করে… রোদেলা শোভনের দিকে তাকিয়ে… কি করছে ও কি হবে এর পরিনাম তা জানাতে ও জানাতে…
সবাই যেন ওদের দেখতেই ব্যাস্ত কি হচ্ছে কি করছে তা কেউই হয়তো খেয়ালই করে নি। কল্লোলের হাতে ছিলো ক্যামেরা। খুটখাট ছবি তুললো কয়েকটা। সেই ছবিতে রোদেলা তাকিয়ে ছিলো শোভনের দিকে…
হাঁটার পথ শেষ করে শোভন রোদেলা সবার সামনে এসে হাতটা ছেড়ো দাঁড়ায়, চারদিকে তাকায় রোদেলা। কি ভাববে সকলে….! নিশ্চয়ই তারা ভাবছে ওর সাথে গভীর কোন সম্পর্ক রয়েছে। না হলে হাত কেন ধরবে….
এসব ভেবে শোভনকে খু*ন করতে ইচ্ছে করে রোদেলার। এত করে বোঝালো, ওয়ার্নিং দিলো তাও আজ আবার যেই সেই। কয়লা ধুলে ময়লা যায় না, কথাটা শতভাগ সত্যি….
এসব কথা যদি ওর মা জানে তাহলে ওকে মে*রেই ফেলবে কথা শুনিয়ে…।
নাতাশাকে দেখতে আসার সময় নাশতা নিয়ে গিয়ে কত বাজে বাজে কথা শুনতে হয়েছে ওকে। ওর মা, খালামনি, আলাদা আলাদা করে কথা শুনিয়েছিলো। সেসব ভেবে ভয়ে ওর আত্না শুকিয়ে যায় । এসব কথা জানলে সারা জীবন ওর কথা শুনতে হবে, কোন দোষ না করেই। বাইরের কেও না,
না কোন মামী, না কোন প্রতিবেশী। নিজের মাই গলার জোড় বাড়িয়ে উঠতে বসতে এ কারনে নোংরা সব কথা শুনাবে ওকে। ওর ভাগ্যটা এমন কেন…?
ওদের কত বান্ধবীরা ট্যিসুর মতো বয়ফ্রেন্ড বদলায়। এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। ওদের ক্লাসমেট বিদিশা গত বছর কলেজ ট্যুরের নাম করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কক্সবাজার ঘুরে এসেছে দুইদিন। সেই ছেলের সাথে ব্রেকআপ করলো এই তো কিছুদিন। এসব ভাবলে ওর আত্মা কেঁপে ওঠে ওর। এক আঁকিবের সাথে সম্পর্ক করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে কত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে ওকে ওর মায়ের কাছ থেকে । অথচ মনের দিক দিয়ে ভঙ্গুর ছিলো ও, ওর মা ওকে এসব যন্ত্রণা দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিলো সে সময়।
একটা বারও ভাবে নি আমার মেয়ে ভুল করেছে…
আসলেই কি ভুল করেছিলো ও….?
কি হতভগা ও…..
কিছু না করেই সারাটা জীবণই কথা শুনে গেলো।
ভাগ্যের এই টানাপোড়েন কি জীবণেও পিঁছু ছাড়বে না ওর….? এমনি করে কোন দোষ না করে কথাই কি শুনে যাবে….
হঠাৎই রোদেলার হাত ছেড়ে শোভন হাঁটু গেড়ে বসে বালুতে, কোত্থেকে যেন একটা রিং বক্স বের করে রোদেলার দিকে এগিয়ে বলে, “উইল ইউ ম্যারি মি”……..!
রোদেলার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হয়। কি বললো এই হতচ্ছাড়া শোভন….! ও ভুল শুনলো না তো…?!
নাহ…
হাঁটু গেড়ে বসার ভঙ্গি আর হাতে রিং বক্স সাক্ষী যা শুনেছে রোদেলা তা সত্যি। একটুও ভুল শুনেনি ও…
শোভনের দিকে তাকায় রোদেলা। ওর মুখটা হাসিহাসি…
অথচ এত বিরক্ত লাগছে ওকে, যে বলার মতো না….
মনে হচ্ছে ওকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে পরবে কল্পনাতেও ভাবে নি রোদেলা। আশেপাশে সবার দিকে তাকায় ও। দৃষ্টিতে ওর অসহায়ত্ব। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সকলের মুখই হাসি হাসি….
বিশেষ করে শোভনের মা সারা চৌধুরীর। তার দিকে তাকাতেই তিনি হেসে মাথা ঝুঁকিকে যেন আদেশ করলো
– নাও আমার ছেলেকে গ্রহণ করে….
চারপাশে উৎসব উৎসব আমেজ, যেন সকলেই প্রবল আগ্রহে তাকিয়ে কি হতে যাচ্ছে…. এসবই যেন পূর্ব পরিকল্পিত… সবাই যেন জানতো এমন কিছু একটা হতে চলছে।
বড় মামী রোদেলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ওকে সাহস দেয় যেন
– ভয় পাস না রোদেলা আমরা তোর সাথে আছি…
বড় মামাকেও খুবই উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তার কাঁধের বোঝা কত সহজে নেমে যাচ্ছে হয়তো তা দেখে। নাতাশার দিকে তাকাতেই ও চোখ মারলো রোদেলাকে। আর কল্লোল থামস আপ করলো। তারমানে ওরা সব জানে এসব ব্যাপারে…
কিভাবে জানলো এসব…! নাতাশার কথায় তো একটা বারের মতোও বোঝা যায় নি যে ও এসব জানে। ওকে কখনো ইঙ্গিতেও জিজ্ঞেস করে নি এসব কথা। তারমানে………!
কি বলতে কি বলেছে শোভন কে জানে….
ইশ্ আগে ভাগেই নাতাশাকে অন্তত সব জানানো উচিত ছিলো। কি ভাববে ও যে আমার বোনটা কেমন… আমার কাছে এত বড় একটা কথা দিব্যি লুকিয়ে ফেললো।
আমাকে কিচ্ছুটি জানালো না…
লজ্জায় আর দুঃখে রোদেলার ইচ্ছে হচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে পরতে।
এদিকে নাতাশা আর কল্লোল ওদের এসব ব্যাপারে প্রথম
জেনেছে যেদিন রোদেলার হাত কেটে গেলো সেদিন। রোদেলাকে রুমে পৌছে দিয়ে ফিরবার সময় কল্লোল শোভনকে শক্ত করে ধরে….
: রোদেলার হাত কাটছে… তুই সেখানে কি করছিলি…?
আমতা আমতা করে শোভন, কিছু একটার আভাস পায় কল্লোল। বলে-
: শোন শোভন আমি কিন্তু কিছু একটা আঁচ করতে পারছি,
তুই যদি কিছু না বলতে চাস, আমি তোকে জোর করবো না, কিন্তু বললে মনে হয় তোরই উপকার হবে….
বলে একটু সময় দেয় শোভনকে….
শোভন মাথাটা নিচু করে ভাবে, বলবে কি না….
অবশেষে একদম শুরু থেকে সব বলে শোভন,
রোদেলাকে কল করা, ওর রুমে গিয়ে কার্ড দেয়া, কল রিসিভ না করায় অনেক রাত অব্দি ওর বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, ফিরবার পথে বাইক এক্সিডেন্টে, ওর রুমে রোদেলাকে আটকে রাখা, সবশেষ ওর হাতটা কেটে ফেলা…
সব সব বলে শোভন কল্লোলকে…
কিচ্ছু বাদ দেয় না… কল্লোল বলে
: রোদেলা কিন্তু একটি বারের জন্য ও বলে নি ও তোকে ভালোবাসে… তাহলে এটা কোন ধরনের পাগলামী….
এটা তো একতরফা ভালোবাসা…
চুপ করে থাকে শোভন…. একটু সময় নিয়ে বলে
– ও আসলে পরিবারের চাপে পরে এমন করছে…
– তুই জানলি কিভাবে…?
– হসপিটালে ছিলাম যখন তখন ও আমার হাত ধরে কেঁদে বলেছিলো ওর অপারগতা… ও ইচ্ছে করলেই এমন একটা সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে পারে না তা ও আমাকে বলেছিলো…
তারমানেটা তো সোজাই…
কোন পিছুটান আছে ওর, তার জন্য ও আমাকে গ্রহন করতে পারছে না…. তাছাড়া ভাবী বললো ওর কাঁধে ওর পরিবারের দায়িত্ব, তাই ও এসবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। ভাই বিশ্বাস কর আমি ওকে সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, ওকে আমি একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে চাই…
এসব শুনে কল্লোলের মন কিছুটা নরম হয়, তবুও কন্ঠে গাম্ভীর্য রেখে ওকে বলে-
: তুই এমন কিছু ভেবে থাকলে খুবই ভালো কথা, আমি কি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো…
মাথা নিচু করে শোভন বলে-
: দেখ তোর যা ভালো মনে হয়…
এরপর একে একে কল্লোল নাতাশা, ওর বাবা-মা, চাচা-চাচী সবাইকে জানায় বিষয়টা। নাতাশার বাবা-মা তো শুনে বিশাল খুশি। একই পরিবারে দুই মেয়ে… তারা জানালো তাদের কোন আপত্তি নেই। তারা যদি বলে তো রোদেলার মায়ের সাথে কথা বলবে এ ব্যাপারে। তারও কোন আপত্তি থাকবার কথা না। তারা রোদেলার মায়ের সাথে কথা বলবে জানালো।
কল্লোল বললো আপাততঃ দরকার নেই, ঢাকায় ফিরেই আমরা সবাই মিলে ওদের বাড়িতে যাবে প্রস্তাব নিয়ে। এরপর নাতাশা আর কল্লোল মিলে এই প্রপোজাল ব্যাপারটার এ্যরেন্জ করে। সারপ্রাইজ দিতে চায় রোদেলাকে। তাই তো নাতাশা এত মানুষ থাকতে শোভনকে পাঠিয়েছে রোদেলাকে ডাকতে। এটা ওদের প্ল্যানেরই একটা অংশ ছিলো।
আর এদিকে সেন্টমার্টিনের নীল রঙা সমুদ্রকে একপাশে রেখে সবার এই স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজনে অসহায় দাঁড়িয়ে রোদেলা, এত সুন্দর লাগছে সবাইকে একরকমের পোশাকে আর হাসিহাসি মুখে রোদেলার ভীষণ কষ্ট হয় এদের সাথে নিজেও যোগ না দিতে পারায়।
হঠাৎই রোদেলার চোখ পরলো এ্যামীর দিকে। তিনি তার বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যাস্ত। চোখমুখ কালো করে রেখেছে। এই পুরো ফ্রেমবন্দী মানুষ গুলোর মাঝে একমাত্র এ্যামীর মুখটাতেই ঘোর অমানিশা। ওর যেন এসবকিছু অসহ্য লাগছে…. এমন লাগাটা অস্বাভাবিক না, এমন কিছু হলে বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
রোদোলা ভাবে ও কি দৌড়ে পালিয়ে যাবে…!
মাথাটা ফাঁকা লাগে ওর। এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও তৈরী ছিলো না ও। সবাই যেন অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন রোদেলা সায় দিবে, কখন আংটি পরাবে শোভন…..
রোদেলা দ্রুত ভাবতে থাকে কি হবে এরপর…
ওর মা আর বোনের দায়িত্ব ওর কাঁধে। এমন একটা পরিবারের অংশ হয়ে ও ওর মাকে বিয়ের পর দেখতে পারবে না। তারা চাইবে না তাদের বাড়ির বৌ চাকরী করুক। আর চাকরী না করলে, রোদেলা সাপোর্ট না করলে ওদের মা আর বোনের সংসার চলবে কিভবে….?
তাছাড়া ওর মায়ের যেই ইগো সমস্যা। মেয়ের জামাই যদি সাহায্য ও করতে চায়, তিনি তা কেন নিবেন..?
তার কিছু না থাক দম্ভের ঘাটতি একটুও নেই। তাই হয়তো কল্লোলের জন্য যখন প্রপোজাল টা এসেছিল তিনি একবাক্যে না বলেছিলেন….
এদিকে তিনি কি মেনে নিবে শোভনকে…?
একই পরিবারের ছেলে ওরা। মা না মেনে নিলে ও একা এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না…
তাহলে কি করবে ও…
চলবে…
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1521576244970228/
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=454823410015526&id=100064636124543