রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩৫

0
804

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৫

এসব ভাবতেই রোদেলার হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠে, ওর মায়ের ফোন…! দেখেই বুক কেঁপে ওঠে ওর। ভয়ে ফোনটা দ্রুত রিসিভ করে ও। ওপাশ থেকে ওর মায়ের ভীষণ রাগী কন্ঠ শোনা যায়- কিরে প্রেম করতে গেছস ঐখানে… এজন্যই তো বলি নাতাশার জামাই কেন আসে সুপারিশ করতে, তলে তলে এত জল। মা*গী, পোলা দেখলে আর হুশ থাকে না… তর এত কামড়ানি উঠছে আমারে কইতি আমি কামড়ানি কমানের ব্যাবস্থা করতাম। আমার ভাতিজির সংসারে হাত দিছস তুই… তর বাপ এক কারো ভালো দেখতে পারে না, তুই তার জন্মের তুই কি ভালো হবি।

উত্তরে রোদেলা কাঁদছে শুধু,

এসব পিরিত করার আগে একবার ভাবলি না, আমার ভাতিজির সংসারে অশান্তি হইবো কি না। তুই আগে বাড়ি আয় মা*গী দেখ তরে কি করি… তরে যদি সিরিয়ালে না দাড় করাইছি আমি…..

কথা গুলো বলেই কিছু না শুনোই ফোনটা কোটে দিলো। তিনি যেন কথাগুলো বলতেই ফোন দিয়েছিলেন। তাই তার যা বলার বলে ফোন কেটে দিলেন। অপরপক্ষের কিছু শোনার তার দরকার নেই।

রোদেলার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পরে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হতবাক। কি হলো ওর, ঐ মুহূর্তে রোদেলা সেখান থেকে দৌড়ে রিসোর্টের দিকে চলে যায়।

সবাই হতবাক এই কান্ডে। ব্যাপারটা আসলো কি হলো বুঝতে পারলো না। কে কল দিলো, কি বললো,
মেয়েটা এভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেন…?

শোভন দাঁড়িয়ে যায়। কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে ওর মুখ।
কল্লোল আর ওর দুলাভাই ওর কাছে গিয়ে ওকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে। নাতাশা যেন বরফের মূর্তি হয়ে গেলো। কি হলো আপার, কে কল করলো ফোনে….?

বড় মামীকে দেখা গেলো সারা চৌধুরী মানে শোভনের মা কে স্বান্তনা দিতে। এত উৎসব উৎসব আমেজ যেন হঠাৎ আসা কোন ঝড়ে বিদ্ধস্ত হয়ে গেলো।

সবার এত আনন্দের অনুভূতি কেমন শোকের মতো অনুভূত হতে লাগলো। সারা চৌধুরীকে দেখা গেলো রিসোর্টের দিকে রোদেলার পিছু হাঁটা দিতে। নাতাশা তার পিছনে ছুঁটলো।
বাকীরা তখনো সোখানে দাঁড়িয়ে।

রোদেলা রুমে ঢুকে দড়জা আটকে দিলো। কান্নায় ওর বুক ভেসে যাচ্ছে। ও জানতো এমন কিছু হবে, ওদের কপালে সুখ কেন সইবে, সুখের জন্য তো ওদের জন্মই হয় নি।

এমন সময় সারা চৌধুরী, রোদেলার বড় মামী, প্রিসিলা,
নাতাশা, সবাই জড় হয় রোদেলাদের রুমের সামনে। দড়জায় কড়া নাড়তে থাকেন তারা। রোদেলা দড়জা খুলবে কি ও কেঁদেই যাচ্ছে। এমন সময় নাতাশার মায়ের ফোনে কল আসে নাসিমার। তিনি জানতে চান কবে ফিরছে তারা। একটা পর্যায়ে নাসিমার সাথে বাকবিতণ্ডা বাঁধে নাতাশার মায়ের সাথে। তিনি নাকি রোদেলাকে উস্কে দিচ্ছে এসব ব্যাপারে।
নাতাশার মা জানতে চায় কে তাকে এসব বলেছে। নাসিমা কিছু না বললেও তার আর বুঝতে বাকী থাকে না কে এসব কথা নাসিমাকে বলেছেন। তিনি ফোন কেটে বলেন, আপা তখন রোদেলার মা কল করেছিলো রোদেলাকে। নোভেল ওকে কল দিয়ে কি না কি বলেছে তা শুনে মেয়েকে বকেছে। আপনি রুমে যান আমি ব্যাপারটা দেখছি…..

সারা চৌধুরী তবুও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি বাকরুদ্ধ এমন কান্ডে। নাতাশা তাকে বললেন –
বৌমা চলেন আমি আপনাকে রুমে পৌঁছে দিই….
তিনি ফিরে গেলেন তার রুমে। বড় মামী দড়জায় নক দিয়ে বললেন –
: রোদেলা দড়জা খোল মা, এসবের জন্য আমি আপরাধী আমাকে তুই শাস্তি দে মা। ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই, কান্নার শব্দ ভেসে আসছে শুধু। নাতাশা ওর চাচী শ্বাশুড়িকে রুমে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে রোদেলার রুমের দড়জার কাছে, এসে বলে-
: মা দেখো তো ঐ হারামী নোভেলটা কোথায়, বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বলো ও কি বলেছে ফুফুকে। তিনি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ঢাকায় ফিরি আগে, ঐ হতচ্ছাড়া নোভেলের খবর যদি আমি না করি আমিও….

নাতাশা রোদেলার দড়জায় নক করে বলে-
আপা আমি একাই এখানে, প্লিজ দড়জাটা খোল। ওপাশ থেকে রোদেলা বলে-
নাতাশা এখন তুই যা প্লিজ, আমাকে একটু একা থাকতে দে….

নাতাশা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যায় সেখান থেকে। সন্ধ্যায় প্রিসিলা এসে দড়জায় নক করে। দড়জা খুলে রোদেলা। কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কোনরকম কথাবার্তা বলে ওকে বিরক্ত করে না রোদেলাকে। ফোনে ওর মা কি বলতে পারে তা ওর চেয়ে ভালো আর কে অনুমান করতে পারবে এই এত মানুষের ভীড়ে….? ওরা এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে যা ওদের অনেক কিছুই বোঝার ক্ষমতা বয়স হওয়ার আগেই হয়ে গেছে।

রাতের খাবার রুমেই আনে নাতাশা, কেও কোন কথা বলে না, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। বড় মামী রাতে এসে বলেন কাল আমরা ফিরছি ঢাকায়। তুই আমাদের বাড়িতে উঠবি। তোর মাকে একট শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েরা বড় হয়েছে তাও তার শাসন করার ধরন বদলায় নি। বড় মামী রোদেলার হাত ধরে বলে-
তুই আমাকে ক্ষমা করে দে মা।
রোদেলার চোখের পানি সেই মুষ্টি বদ্ধ হাতে পরে ওর হয়ে উত্তর দেয় যেন…

মামী বুকে টেনে নেয় ওকে। বলেন-
: বিশ্বাস কর মা, আমার যদি উপযুক্ত ছেলে থাকতো তাহলে তোকে আমি আমার ছেলের বৌ করে ঘরে তুলতাম। আর কেও না জানুক আমি তো জানি…
তোরা দু-বোন আগুনে জ্বলেপুড়ে খাঁটি সোনা…

রোদেলা মামীর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে বলে-
: মামী আমি নাকী নাতাশার সংসারে অশান্তি করতে এসব করেছি… আরো কি কি বলছে আমি আপনাকে মুখে বলতে পারবো না..

: আমি জানি মা, নাসিমা কি বলতে পারে আমি তা জানি…
তুই আর কাঁদিস না মা, মাথা ব্যাথা করবে।

খাবারটা খেয়ে শুয়ে পর মা। কাল আমরা রওনা দিবো…
ঢাকায় ফিরি আগে দেখ তোর মা আর নোভেলের কি অবস্থা আমি করি।

পরদিন সকালেও ডাইনিং হলে আসে না রোদেলা, প্রিসিলা ওর খাবার রুমে নিয়ে যায়। এতক্ষণে সবার জানা হয়ে গেছে কি হয়েছে রোদেলার সাথে…

সবাই খুবই দুঃখি এ ব্যাপারে। এত আয়েজন করে, এত কথা শুনেও যদি ওদের হাতবদল টা অন্ততঃ হতো তবুও কষ্টটা কম হতো সবার। কোন কিছু তো হলোই না মাঝখানে এই অশান্তি। এ্যামীকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। তার কারন কারো অজানা নয়। ও চায় না এ-সম্পর্কটা হোক। তাই গতকালের ঘটনায় ও বিচলিত তো নয়ই উল্টো খুশিই বলা চলে।

দুপুরের খাবারের পর তিনটার দিকে ওরা সেন্টমার্টিন ছাড়ে। সন্ধ্যা ছটা নাগাদ টেকনাফে পৌঁছে। সেখানে হালকা নাশতা করে সবাই । কিন্তু রোদেলা সেই যে গাড়িতে গিয়ে বসলো সারা রাস্তায় একটা বারের জন্য নামলো না গাড়ি থেকে ঢাকা পৌঁছানো অব্দি।

ঢাকায় পৌঁছে বড় মামা রোদেলাকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে। নাসিমাকে ডাকালেন বাসায়, আর নোভেলকে বললেন বিকেলে বাড়িতে থাকতে।

রোদেলা নাতাশার ঘরে উঠলো। নাতাশাও এসেছে ওদের সাথে। কল্লোল চলে গেছে নিজ বাড়িতে। নাতাশাকে নিজেই বলেছে রোদেলার সাথে সাথে থাকতে। বিকেলে সবাই কথা বললে, রাতে ও আসবে। আর পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে শোভনের বাবা-মা’কেও সাথে আনবেন। এমনটাই বললো নাতাশাকে। নাতাশা বললো আমি তোমাকে আপডেট জানাবো। তারাহুরোর কিছু নাই। আমাদের তারাহুরোর করনেই আজ এ অবস্থা।

বিকেলে নাসিমার আসার কথা থাকলেও নাসিমা আসে না। বড় মামা ফোন করেন তাকে, ফোনও ধরেন না। শেষে তারা রোদেলা আর প্রিসিলাকে ছাড়াই ওদের বাড়িতে যায়, নাতাশাও যায় সাথে সেখানে গিয়ে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে। অবশেষে তারা তাঁকে বুঝাতে সামর্থ্য হন যে এখানে রোদেলার কোন দোষ নেই। উল্টো সম্বন্ধটা হলে নাতাশারই ভালো। কিছু দিন পর কল্লোল যখন চলে যাবে, নাতাশা একা হয়ে যাবে, দুই বোন এক বাড়িতে থাকলে দুজনের জন্যই ভালো। সেদিন তাকে ভালোভাবে বোঝায় সবাই। তিনি এত বড় বাড়িতে সম্বন্ধ করতে চান না, কারন তাদের সাথে ওদের যায় না। বড় ভাইয়ের সাথে কি কথা বললো নাসিমা তা জানা না গেলেও নাসিমা আগামীকাল তাদের সবাইকে আসতে বলে “কৃষ্ণচূড়ায়”। বাড়ি ফিরে নোভেলকেও আচ্ছা ধোলাই দিলো বড়-মামা। না জেনে-বুঝে এমন কাজ ভবিষ্যতে যেন আর না করে তাও কঠোর ভাবে বলে দিলো। নাতাশা কল্লোলকে বললো আগামীকাল সবাইকে নিয়ে আসতে। তাদের সকলকে জানানো হলো আগামীকাল আসার কথা।

পরদিন বিকেলে নাসিমা এলো। বাড়িতে এতদিন পর সবাই একসাথে হলো। যদিও রোদেলা কেমন থুম মেরে আছে ঐ দিনকার পর থেকে। কি যেন ভাবে সারাদিন। নাসিমা বিকাল চারটায় বাড়িতে এলেও একটিবারের জন্যও রোদেলার কাছে যায় না, ভুল স্বীকার করে না, অনুতাপ দেখানো তো অনেক দূরের কথা।

আচ্ছা আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে-
বাবা-মা যদি ভুল করে তারা কি সন্তানের কাছে ভুল স্বীকার করতে পারে না….? পারে না ক্ষমা চাইতে….?

রোদেলা চায় না তার মা তার কাছে ক্ষমা চাক, ও চায় ওর মা একটু বুঝুক। একজন জন্মধাত্রী মায়ের চেয়ে তার সন্তানকে ভালো কে চিনবে।

দুনিয়ার সবাই যদি বলে সে খারাপ তিনি তো অন্তত জানবেন তার মেয়েটা কেমন…? অথচ তিনিই এমন সব কুৎসিত কথা বলেন যা মানুষ কল্পনা ও করতে পারেন না। বাইরের মানুষ যখন এসব শুনে তখন তারা কি একটা বারও ভাববে না যে মা কি মিথ্যে বলবে নিজোর মেয়ের সম্পর্কে। মেয়েটা মনে হয় আসলেই খারাপ।

এই ওর দুঃখ, সারা দুনিয়া যদি ওকে খারাপ বলতো ও পরোয়া করতো না কিন্তু ওর নিজের মায়ের এসব কথা কিভাবে মেনে নিবে ও….

বিকেল নাগাদ নাতাশার শ্বশুরবাড়ির সবাইর আসার কথা এ বাড়িতে। সন্ধ্যা হতে চললো এখনো এসে পৌঁছায় নি। খাবার দাবার বাড়িতেই তৈরী করা হয়েছে সব ।

রোদেলা দড়জা আটকে বসে আছে নাতাশার ঘরে। বড় মামী নাসিমাকে নিয়ে রোদেলার কাছে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে ও। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলে মামী আপনি একটু বাইরে যান।

বড়মামী কোন কথা না বলে বাইরে চলে যায়। ঘরের মধ্যে কেবল নাসিমা আর রোদোলা। দুজন দুই দিকে মুখ করে বসে আছে, তাই কারো অভিব্যাক্তিই বোঝা যাচ্ছে না। ঘরে পিনপতন নিরবতা। কিছু সময় পর রোদেলা বললো-
এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না। সবাই জানবে তুমি রাজি না তাই এ বিয়ে হচ্ছে না… আমি তোমাকে অনেক বলবো, কিন্তু তুমি বলবে তোমার মত নেই এ বিয়েতে।

এমনটা যদি না হয় তাহলে তুমি যে এতদিন মানুষকে বলে বেরিয়েছ তুমি শক্ত হাতে না হাল না ধরলে “আমি কবে কারো হাত ধরে বেড়িয়ে যেতাম” তা আমি সত্যি করে ছেড়ে দিবো।

বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় ও…
বেরুতেই দেখে ডাইনিং রুমে বাসে আছে নাতাশার শ্বশুরবাড়ির লোক। তাদেরকে দেখে ও পেছনের দড়জা দিয়ে দ্রুত তিনতলায় ওর নানীর ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে…

(পড়ে কিন্তু তোমরা অবশ্যই কমেন্ট করবা)
Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1522929151501604&id=659404701187391
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=457127023118498&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here