নীরবতা #নাইমা_জাহান_রিতু #পর্ব_১_2_3

0
665

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১_2_3

(অন্য কেও কপি করে পোস্ট করার আগে অবশ্যই লেখিকার অনুমতি নিয়ে পোস্ট করবেন)

-“পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছি কী ক্লাস এইটের মেয়ে বিয়ে করার জন্য?”
-“তা আমি কি করে বলবো! তোর মন তুই ভালো জানিস।”
-“আম্মা প্লিজ কথা ঘুরাবে না।”
ছেলের কথায় চোখমুখ কুঁচকে বিছানায় বসলেন মোরশেদা বেগম। চিন্তিত মুখে বললেন,
-“এখন এইমুহূর্তে এসব কথা কেনো উঠছে? তোর আব্বা যা ঠিক করেছে অবশ্যই তা ঠিকভুল বিবেচনা করেই করছে।”
-“এটাই তোমাদের ঠিক? আমি, যে কিনা দেশের বাইরে থেকে পড়ে এসেছি সে শুধুমাত্র তোমাদের উপর সম্মান রেখে তোমাদের পছন্দমতো গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তাই বলে ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা মেয়ে? আম্মা, তোমার বিবেকে বাধছে না?”
-“না, বাধছে না। বড়টার জন্য তো বেশ পড়ুয়া ভালো ঘরের মেয়েই আনা হয়েছিল। আজ কই সে? তোর ভাইয়ের কপালে পাঁচ লাথি বসিয়ে অন্য ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে তার তো বুক কাঁপেনি। তোর ভাইয়ের কথা না হয় নাই ভাবলো.. নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকেও ফেলে যেতে বেহায়া মেয়ে দু’বার ভাবেনি। আসলে এসব মেয়েদের বুক-পিঠ নেই। সব পারে এরা.. সব।”
-“ভাবিকে এর মাঝে কেনো টানছো? তাছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তো আর ভাবির মতো হবে না।”
-“তর্ক করিস না, মেসবাহ। রেডি হয়ে নিচে আয়। অর্পা হলুদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে, এখন আর কিছুই করার নেই তার। তার মা কোনোভাবেই তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে টু শব্দ করবে না। শুধু মা নয়, এবাড়িতে কারোই সেই সাহস নেই। তবে কিছু একটা করা উচিৎ। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকে অজপাড়াগাঁর বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া মেয়েদের অবস্থাও তো একবার দেখা উচিৎ। পড়াশোনার খাতিরে দেশ বিদেশে তার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। বিয়ের খবর পেলেই সকলে ঘাড়ে চেঁপে বসবে তার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতের জন্য। তখন কোন মুখে ওই ছোট্ট দু’ঘরের ছাপড়ায় নিয়ে যাবে তাদের? কপালের ঘাম মুছে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। চিন্তিত মনে আবারও ফিরে এল বিছানায়। মোরশেদা বেগম এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বেশ খানিক্ষন হলো। তবে তার সেই সুগন্ধি পানের ঘ্রাণ এখনো রয়েই গেছে। পানের এই ঘ্রাণ পেলেই মাকে খুব করে মনে পড়ে তার। পেশার খাতিরে তার নানান শ্রেণির লোকের সাথে উঠাবসা হয়। তবে তার মায়ের মত পানের ঘ্রাণ এখনো কোথাও পায়নি সে। এ যেন উপরওয়ালা শুধু তার মায়ের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন! মৃদু হেসে মেসবাহ বিছানায় শরীর মেলে দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই তার সামনে ভেসে উঠলো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম। ছোট বেলা থেকেই যার কাজ নিজের সকল দোষ তার উপরে চাপিয়ে দেয়া। -“বিয়ে তাইলে করেই ফেললি!”
-“করার তো ইচ্ছে নেই। তবে ভাবসাব তো বলছে বিয়ে আমার হয়েই যাচ্ছে।”
-“শালা প্যাচাইস না। ঝেড়ে কাশ।”
ঘরের বাইরের দিকে নজর দিল মেসবাহ। তারপর হালকা কেশে বললো,
-“এসেছি কাল রাত দু’টোর পর। ভাবলাম অনেকদিন পর জব্বব একটা ঘুম দিব। কিন্তু ভোর না হতেই আব্বার চেচামেচিতে ঘুম গেল আমার আকাশে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসতেই আব্বা জানালেন, আমার মেয়েকে একবার দেখে আসতে হবে এবং তা এখনি। আমি দ্বিমত জানিয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আপনি তো দেখেছেনই। তাতেই হবে। তবে কে শোনে কার কথা! যাকগে.. অবশেষে গেলাম মেয়ে দেখতে।”
-“আচ্ছা.. তারপর?”
-“তারপর তো তারপরই। আমি হতবাক! এনি আইডিয়া আমার হবু বউ কীসে পড়ে? ক্লাস এইটেরে… ক্লাস এইটে।”
খানিকক্ষণ থেমে ওপাশ থেকে লিমন বললো,
-“আর ইউ কিডিং মি?”
-“উহু.. আই অ্যাম সিরিয়াস।”
-“তাইলে তো ভালোই.. কচি মেয়ে পাচ্ছিস। একদম কচি। সেইরাম খেলা হবে।”
-“এত কচি মেয়ে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোর শখ হলে না হয় তুইই রাখ সেইরাম খেলার জন্য।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করলো লিমন। যেনো এর চেয়ে হাস্যকর কথা তার জীবনে শোনেনি সে।
-“এই তুই বন্ধু? চিন্তায় চিন্তায় আমি কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। আর তুই নির্দ্বিধায় হেসেই যাচ্ছিস!”
-“কী করবো বল? তোর যে বাপ! তার উপরে কারো সাধ্য আছে কিছু বলার? বাপ তো না যেনো আগুনের গোলা। কেউ কিছু বলতে গেলে তার আগুনের গোলার মাঝে থেকে এক মুঠো আগুন ছুঁড়ে দুনিয়া ছেড়ে তাকে পরকালের রাস্তা ধরিয়ে দেবে।”
বলে আবারও সমানতালে হাসতে শুরু করলো লিমন। তার হাসির জবাবে তাকে কড়া কিছু কথা শোনানোর ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কল কেটে চোখজোড়া বুজলো মেসবাহ। আপাতত তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে। পাঁচ ভাই বোনের মাঝে বড় ভাই মাজহারুল এবং বড় বোন অর্পাসহ তার নিজের তাদের বাবার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস নেই। বাদ থাকলো মুবিন এবং অনা.. মুবিনের কথা বাবা উপেক্ষা করলেও অনার কথা ফেলার মত মন এখনো হয়ে উঠেনি তার। তাহলে কী একবার অনাকে দিয়েই চেষ্টা করিয়ে দেখবে? ভাবামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। এগুলো লম্বা বারান্দা ধরে। দোতালার দক্ষিণের একদম কোণার ঘরেটি অনার। বেশ বড়সড় সেই ঘরটিতে বইপত্রের উপস্থিতি না মিললেও সাঁজগোঁজের জিনিসের অভাব নেই।

-“অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন। সবাই ভালোবাসি বলতে পারে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারে না…”
চৈতালির কথায় পাশ ফিরে তার হাতে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসের বইটি দেখে কপাল কুঁচকে গেল অনার। হাতের কাজল রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে বললো,
-“তুই কবে এসব গল্প উপন্যাস পড়া বন্ধ করবি বল তো? এসব তোকে শুধু মধুর স্বপ্ন দেখাবে কিন্তু তোর বাস্তব জীবন এসবের মতো সুন্দর করে তুলতে পারবে না। তখন আফসোস বিহীন বিকল্প কিছু থাকবে না তোর জীবনে।”
বই থেকে চোখ না উঠিয়েই চৈতালি বললো,
-“আফসোস করতে কিন্তু আমার ভালোই লাগে। এই যেমন ধর, আমি তোর মতো সুন্দরী হতে পারলাম না এই আফসোস আমার আজীবনই রয়ে যাবে।”
-“মজা করছিস?”
-“মোটেও না।”
ঠোঁট বাকিয়ে অনা বললো,
-“সৌন্দর্যের উদাহরণ দিতে গেলে সকলেই সেখানে তোকে টানে। এখন বল.. এনিয়ে কী বলার আছে তোর?”
বই বন্ধ করে অনার দিকে তাকালো চৈতালি। মিটিমিটি হেসে সে বললো,
-“অনেক কিছু বলার আছে আমার। শুনতে চাস? তাহলে কাছে আয়। আমার কপাল ছুঁয়ে দেখা।”
বলেই দৌড়ে ঘরের বাইরের দিকে এগুলো চৈতালি। ইশ! মেয়েটি কী দারুণ রূপবতী! কোমর সমান কোঁকড়াচুল নিয়ে যখন দৌড়ানো শুরু করলো তখন এক পলক দেখে মনে হচ্ছিল রূপকথার রাজ্য ছেড়ে কোনো পরী যেনো নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে। মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্মালে নির্ঘাত এই মেয়ের প্রেমে পড়ে এতদিনে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেত। ভেবে মুচকি হেসে অনাও দৌড়ে এগুলো চৈতালির পিছুপিছু। আজ তাকে চৈতালির কপাল ছুঁতেই হবে। মেয়েটি এভাবে একেকদিন একেক খেলা দিয়ে তাকে হারিয়ে দিতে পারবে না। কখনোই না..

-“এই অনা? এভাবে কোথায় যাচ্ছিস? দৌড়াচ্ছিস কেন? কথা আছে তোর সাথে। দাঁড়া না!”
মেসবাহর ডাকে থেমে গেল চৈতালি। পেছন ফিরে অনাকে দেখামাত্রই সে ঠোঁট টিপে হেসে তার সামনে দাঁড়ানো মেসবাহর উদ্দেশ্যে বললো,
-“বরকে বর বর লাগছে না। কিছু একটা কম কম লাগছে। কী হতে পারে? মুখের হাসি নয় তো?”
-“কচু.. আমার ভাইকে সবসময়ই বর বর লাগে। তার বিয়ে থাকুক বা না থাকুক।”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। তাদের দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“শুধুশুধু হাসবি না। কথা আছে তোর সাথে। ঘরে আয়।”
অনা বললো,
-“বয়েই গেছে আমার! তোমার কথা থাকলে তুমি আসবে আমার ঘরে। আমি কেনো যাবো?”
-“আচ্ছা। তোর যেতে হবে না। চল, তোর ঘরেই চল।”
মেসবাহর কথা শেষ হতেই চৈতালির কপাল ছুঁয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে এগুলো অনা। কেনো যেনো প্রচুর আনন্দ হচ্ছে তার। কেন? চৈতালির খেলায় সে জিততে পেরেছে বলে?

-“তোর ওই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?”
-“কোন মেয়ে?”
-“আমার সঙ্গে যার বিয়ে। কী যেন নাম…”
-“উল্লাসী..”
বোনের কথার পিঠে কিছু বললো না মেসবাহ। অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে তার মন। উল্লাসী আবার কেমন নাম? এমন নামও বুঝি মানুষের হয়?
-“আমার তো খারাপ লাগেনি। তবে অনেক ছোট। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।”
-“এটাই তো সমস্যা। তুই জাস্ট ভাব তাহলে আমাদের মাঝে বয়সের পার্থক্য ঠিক কত হতে পারে! তবে এসব কথা আব্বাকে কে বোঝাবে? সে তো কিছু শুনতেই নারাজ।”
চিন্তিত গলায় অনা বললো,
-“এসব আমাকে কেনো বলছো? নিশ্চিত আমাকে আব্বার কাছে পাঠানোর পায়তারা করছো তুমি!”
-“তুই তো আমার একমাত্র ছোট আদরের বোন। তুই না বুঝলে এসব আর কে বুঝবে বল?”
-“অসম্ভব। আমি এসব নিয়ে আব্বার সাথে কথা বলতে পারবো না।”
বোনের হাত চেপে ধরলো মেসবাহ। অসহায় গলায় বললো,
-“প্লিজ.. তুই আমার শেষ ভরসা।”
ভাইয়ের হাতের মাঝ থেকে হাত ছাড়িয়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে অনা বললো,
-“এতবড় একটি বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি পারবোও না কিছু বলতে। তোমার বিয়েতে অমত থাকলে তুমি আব্বাকে সব খুলে বলো। আব্বা এতটাও পাষাণ না যে তোমার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবে না।”
অনা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হতাশ মনে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। উল্লাসী নামের মেয়েটির চেহারা বারবার ভেসে উঠছে তার সামনে। বাচ্চাসুলভ আচরণ তার মাঝে আছে কিনা তা জানা নেই। তবে মেয়েটির দুধে আলতা গায়ের রঙের মাঝে চিকন স্বাস্থ্যের লম্বা চওড়া গড়নের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়েছে। বড় বড় দুটি চোখ, তড়তড়া নাক, চিকন ঠোঁট যেনো তার বয়সের অপরিপক্কতা বোঝাতে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে জোর করে মেয়েটি চলনে এক অস্বাভাবিক মন্থরতা এনেছে তার অপরিপক্কতা ঢাকার চেষ্টায়। যদিওবা তা আদৌ কোনো কাজে দিয়েছে বলে মনে হয়না। লম্বা কিছু দম ছেড়ে দরজা টেনে নিজের ঘরে ঢুকে টিশার্ট খুলে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে নিল মেসবাহ। তারপর খুব ধীরেসুস্থে এগুলো নিচতলার দিকে।

একটি পাটি বিছিয়ে তার সামনে হলুদ সহ নানান ফলমূল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে অর্পা। তার পাশের চেয়ারে তিনবছরের মেয়ে মৌমিকে কোলে নিয়ে বসে বোনের কার্যক্রম দেখছে মাজহারুল। সাতমাসের বাচ্চাকে রেখে জ্যোতি যেদিন চলে গিয়েছিল মাজহারুলকে ফেলে সেদিন বুকটা ফেঁটে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল তার। শ্বাস নেয়া ভুলে গিয়েছিল, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। জ্যোতি কীভাবে পারলো এতবড় একটি পাপ করতে? বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। মেনে নিতে পারছিল না। দীর্ঘদিন যাবৎ বাস্তবতা ছেড়ে দূরে পালিয়ে বেরিয়েছে। তবে সবশেষে ছোট্ট মৌমির মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতে হয়েছে তাকে। কঠিন কিছু বাস্তবতা মেনে তাকে এগুতে হয়েছে পৃথিবীর বুকে। সব কিছুকে ভাষায় প্রকাশ করা গেলেও কষ্টকে তেমন একটা প্রকাশ করতে পারা যায় না। কারণ, কিছু কষ্ট থাকে যা কখনোই কাউকে বলা যায় না। নিজের মাঝেই চেপে রাখতে হয় দিনের পর দিন। আপন মানুষের দেয়া কষ্টও হয়তো এর মাঝেই একটি।

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২

-“আমার জিনিস কইরে?”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে মুবিন বললো,
-“প্রতিবারই তোর জন্য কিছু না কিছু আনতেই হবে?”
-“তা আনতে হবে না? দুটো নয় তিনটে নয় তোমাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন আমি।”
-“আহারে! তাতে যেন উনি সব উদ্ধার করে ফেলেছে!”
-“এমন করলে কিন্তু হবে না। ভালোই ভালোই কী এনেছো দেখিয়ে দাও।”
ক্লান্ত শরীর বিছানায় মেলে ঠোঁট ভর্তি হাসির ফোয়াড়া ছেড়ে বোনের দিকে তাকালো মুবিন। ভার্সিটি থেকে সকাল সকাল রওনা হলেও গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ে গেছে। ভাইয়ের বিয়ের খবর হঠাৎ করে পাবার ফলে টিকেট কাটার মতো সময় না পাওয়াতে অর্ধেক পথ দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে তাকে। যার ফলে কোমরটা ব্যথায় চিনচিন করছে। তবুও এসবের মাঝে ছোট্ট বোনটির একেকটি কর্মকাণ্ড যেন শান্তির অপর নাম। হাজারো ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর বোনের প্রতিটি মুখের ধ্বনি নতুন উদ্যমে চলার শক্তি বয়ে আনে। এরই নাম বুঝি ভাইবোনের ভালোবাসা!
-“তুমি কী সত্যিই আমার জন্য কিছু আনো নি?”
বোনের অসহায় মাখা মুখের দিকে চেয়ে এপর্যায়ে মুবিন বললো,
-“ব্যাগ খুলে দেখ…”
ভাইয়ের অনুমতি পাওয়া মাত্র ব্যাগ খুলে একেএকে সব বের করতে শুরু করলো অনা। কিছু চকলেটসহ একটি বই হাতে নিয়ে সে এগিয়ে এল মুবিনের দিকে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আমার সাজগোজের জিনিস কই? তাছাড়া বই এনেছো কেনো? আমি কী এসব পড়ি?”
-“পড়িস না?”
-“উহু.. তবে থাক! চৈতালি বই পড়তে ভালোবাসে। ওকেই না হয় বইটি দিয়ে দিব।”
-“চৈতালি টা কে?”
-“আরে.. চৈতালি আমার বান্ধবী। তুমি কেনো যে ওর নাম মনে রাখতে পারো না!”
-“অহ.. হ্যাঁ। মনে পড়েছে।”
-“বেশ হয়েছে। এবার চলো। নিচে হলুদ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। মেজভাইকে এক চিমটি হলুদ লাগিয়ে দিয়ে এসো তো!”
শরীর সায় না দিলেও বোনের কথামতো বিছানা ছেড়ে উঠে একটি টিশার্ট পড়ে নিল মুবিন। তারপর আয়নায় একবার নিজের চেহারা দেখে চোখে চশমা চাপিয়ে এগুলো বোনের পিছুপিছু। আজকাল পড়াশোনার চাপ খুব বেড়ে গেছে। রাত জেগে পড়লেই মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করতে হয় সারাদিন। এমবিএটা কোনোমতে শেষ করলেই এসবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়ে আসলেও আজকাল বুঝেও শরীর টিকছে না। পড়াশোনার সকল অধ্যায় কবে চুকবে কে জানে!
-“মুবিন ভাই না? কেমন আছেন?”
একপলক পাশ ফিরেই চোখ সরিয়ে নিল মুবিন। অস্পষ্ট গলায় জবাব দিল,
-“ভালো..”
-“ভালো থাকলেই ভালো। তা দিনকাল ভালো যাচ্ছে তো? শুনলাম আপনার নাকি ভার্সিটির কোন মেয়েকে মনে ধরেছে!”
চৈতালির কথা শেষ হতেই মুবিনের ফর্সা টসটসে মুখ নিমেষেই কুচকে লাল হয়ে এল। কঠিন কিছু কথা চৈতালির উদ্দেশ্যে শোনাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ের মুখে হলুদের ছোঁয়া লাগিয়ে তার পাশে বসলো মুবিন। উদাস মনে আশেপাশের পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দিতেই মাথা বেয়ে শরীরে পানির উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অনা এবং চৈতালি। কী হলো এটা? তাকে ছাড়া আর কেউ কী নজরে আসেনি তাদের?

রঙ এবং পানি খেলার মাঝ থেকে উঠে মৌমিকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল মাজহারুল। গম্ভীর প্রকৃতির এই মানুষটিকে হাসিঠাট্টার দুনিয়া একদমই টানে না। বরং দুই মেরু এক হওয়ামাত্র তা বিকর্ষণে লেগে যায়। মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে আলমারি খুলে লেহেঙ্গা বের করলো সে। তারপর তা মেয়ের কাছে রেখে পা বাড়ালো তার পিতা আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। হঠাৎ করেই বিষয়টি মাথায় এসেছে তার। মনভুলো স্বভাবের কারণে হয়তো খানিকবাদে তা মাথা থেকে বেরিয়েও যাবে। তার আগেই না হয় একবার এবিষয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে আসা যাক…
-“আব্বা, আসবো?”
আছরের নামাজ সেরে তসবিহ জপছিলেন আলাউদ্দীন শেখ। অবশ্য বছর দুই আগে হজ্ব করে আসার পর থেকে তার নামের পূর্বে একটি হাজী শব্দ যোগ হয়ে পুরো নাম হয়েছে হাজী আলাউদ্দীন শেখ। গ্রামে প্রভাবশালী হবার কারণে তাকে সম্মান থেকেই হোক বা ভীতি, সকলে তাকে হাজীসাব নামেই ডেকে আসছেন। নামাজ কালাম অথবা দান দক্ষিনায় তার কমতি না থাকলেও মুখের ভাষায় কিছুতেই নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না তিনি। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও মাথা ঠান্ডা রাখায় ব্যর্থ হওয়াই বেশকিছু সময় মুখের ভাষা নোংরা করে ফেলছেন। অবশ্য তাতে খুব বেশি একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না তাকে। তার সকল চিন্তা আপাতত এসে আটকে আছে মেজ ছেলের বিয়েতে। বড় ছেলের বিয়ের দুবছরের মাথায় ছেলের বউ তাকে ফেলে চলে যাবার পর থেকেই পাড়ায় একপ্রকার ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল তাদের নিয়ে। তবে তার হজ্ব সেরে আসার পর তা কমলেও সেই একই চিন্তা খেয়ে যাচ্ছে তাকে। আবারও একই অঘটন ঘটবে না তো!
-“আব্বা, আপনি যা করছেন তা কী আরেকটিবার ভাবা যায় না? মেয়েটির বয়স খুবই কম হয়ে যায়।”
বড় ছেলের কথায় জায়নামাজ ছেড়ে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ ছুড়ে আলাউদ্দীন শেখ বললেন,
-“তোমার পত্নীর বয়স কী কম আছিলো?”
-“জ্যোতির কথা থাক আব্বা।”
-“কেন? তা থাকবো কেন? তুমি কী চাইতোছো তোমার ভাইও তোমার মত পত্নীহারা হোক। লোকজন ছিঃ ছিঃ করুক তোমার ভাইরে নিয়া?”
-“না…”
-“তাইলে এইখান থাইকা যাও। নিজে যেইখানে নিজের পত্নীরে ধইরা রাখবার পারো নাই সেইখানে তোমার মুখে এইসব কথা মানায় না।”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মাজহারুল। ধীর গলায় সে বললো,
-“এটা বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আপনার নামে কেসও হয়ে যেতে পারে।”
-“হেহে.. শালার পুত পুলিশগো ভয় দেখাও আমায়? এসব পকেটে নিয়া আমি ঘুরি। যাও এখন। তোমার ব্যর্থ মুখখানা নিয়া এবার তুমি বিদায় হও।”
শান্ত পায়ে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল মাজহারুল। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই মৌমি লেহেঙ্গার নিচের পার্টটি টানাটানি করে পড়ে ফেলেছে। যদিওবা তা ঠিক জায়গা মতো নেই। তবুও দেখতে মন্দ লাগছে না। মেয়েটির চেহারা অবিকল হয়েছে জ্যোতির মত। জ্যোতির মত ছোট ছোট দুটি চোখ, তরতরা নাক, খাড়া দুটি কান। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবন অল্পদিনের হলেও মাঝেমধ্যে প্রায়ই তাকে খরগোশের বাচ্চা বলে ডেকে উঠতো মাজহারুল। ডাক শুনে নাক ফুলিয়ে আহ্লাদে গদগদ করলেও আড়ালে কী হাসতো জ্যোতি?

গরমের ভেতর শেরওয়ানি গায়ে চাপিয়ে বসে থাকা যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে চারপাশে কিছু উটকো ঝামেলা নিয়ে খানিকক্ষণ বসে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেছে মেসবাহর। সাধেই কী গ্রামের মেয়েদের পছন্দ নয় তার? কী আছে তার মাঝে? সে কী চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী? তাকে ঘিরে কেনো এত হৈচৈ? আর কেনই বা সকলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে ঘিরে রয়েছে? হাতের মুঠ চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাটি ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুলো মেসবাহ। চাঁদের আলোয় উঠোনে তার বাবা আলাউদ্দীন শেখকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে কারো হাত ধরে তাকে কোনো ব্যপারে আস্বস্ত করছেন তিনি। ভুল না হলে লোকটিই মেয়ের বাবা। কী কথা হচ্ছে তাদের মাঝে? নিশ্চয়ই তার মেয়েকে আজীবন খুশি রাখার প্রতিজ্ঞা করছেন তার বাবা। তবে তা কী আদৌ সম্ভব তার পক্ষে? তাছাড়া খুশি কী এক পাক্ষিক জিনিস? যা শুধু দিয়েই গেলাম কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না?
-“বাপজান কিছু বলবা?”
আলাউদ্দীন শেখ মেসবাহর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্নটি করতেই আস্থা খুঁজে পেল সে। বাবার দিকে চেয়ে ঢোক চেপে বললো,
-“আব্বা, মেয়ের বয়স খুবই কম। আপনার প্রতি সম্মান রেখে আমি আপনার পছন্দসই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তবে এই বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে আমার মন কোনোভাবেই টানছে না।”
ছেলের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এল আলাউদ্দীন শেখের। রূঢ় গলায় তিনি বললেন,
-“চুপচাপ পিড়িতে যাইয়া বইসা পড়ো। বড়ডা মানসম্মান যা ডুবাই দিছিলো তা কামাইতে আমার বহুদিন লাগছে। তুমিও তার পথে হাইটো না।”
-“বড়ভাই তো ইচ্ছা করে কিছু করেনি। তার ভাগ্যে যা লেখা ছিল তা হয়েছে। তাছাড়া বিয়েতো সে আপনাদের পছন্দমতোই করেছিল। আর আব্বা, আপনি আমাকে এত টাকা খরচ করে বাইরে থেকে লেখা পড়া শিখিয়েছিলেন কী আজ এতবড় একটি অন্যায় করার জন্য?”
-“বেশি নাইচো না বাপজান। ভদ্র পোলার মতো যাইয়া পিড়িতে বসো। নয়তো আমার জুতা তোমার পিঠে। আল্লাহর কসম মাটিতে একখান পড়বো না।”
বাবার এমন কথায় খানিকটা চমকালেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। এরপর আর কিছুই করার বা বলার উপায় না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল সে। আশেপাশের সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে পাটির উপর জবুথবু হয়ে বসতেই কাজীর প্রবেশ ঘটলো সেই ঘরে। নিরব দৃষ্টিতে কাজীর মুখের কথা শুনে একসময় শান্ত গলায় সে বলে উঠলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

(চলবে)

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৩

মাথার উপর ফুল স্পিডে ভনভনিয়ে ফ্যান চললেও কুল কুল করে ঘামছে উল্লাসী। তাকে ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। নতুন বউ দেখতে আসা পাড়ার মহিলাদের ভিড়ে গরমের তোপে একদম হাসফাস অবস্থা তার। অপরদিকে শাড়ি এবং গহনার ভাড়.. সবমিলিয়ে নিজেকে পুরো পাগল পাগল লাগছে। সব ছেড়ে ছুড়ে এক দৌড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে নিজের বাড়িতে। তবে সেখানেও বারণ রয়েছে। ছোটমা খুব ভালো করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এবাড়িতে আসার পর কী কী করণীয় তার। এমন কোনো কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন যে কাজে এবাড়ির লোক অসন্তোষ হয়। তবে আপাতত কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখজোড়া জ্বলছে ফেলা আসা ছোট্ট বোনটির জন্য। বুকের ভেতরটায় হাহাকার করছে। ছোট মা নিশ্চয়ই সুহাকে নানান জিনিস বলে কয়ে যত্নসহকারে খাওয়াবে না। তাহলে কী আজ পুরো রাত না খেয়েই কাটাবে সুহা?
-“বৌমা, এটা খাও।”
খুব কাছ থেকে এক মেয়েলী কণ্ঠস্বর কানে আসায় চোখজোড়া তুলে সামনে তাকাতেই বেশ বয়সী এক মহিলাকে দেখতে পেল উল্লাসী। তার দিকে ড্যাবডেবে চোখে তাকাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“কী ব্যাপার? নাও। জামাইয়ের খাওয়া দুধ একটু হলেও খাইতে হয়।”
অর্ধপূর্ণ দুধের গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে তা এক চুমুক খেয়ে আবারও ফিরিয়ে দিল উল্লাসী। তারপর আঁড়চোখে পাশের মানুষটির দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় টিপটিপ করে উঠলো। বেশ উঁচু স্বাস্থ্যবান পুরুষই বলা চলে লোকটিকে। শ্যাম বর্ণের শরীরের রঙের সাথে মুখ ভর্তি খোঁচাখোঁচা কালো দাঁড়িতে তাকে দেখতে কোনো অংশে দানবের চেয়ে কম লাগছে না। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ লোকটির পাশে বসে থাকলেও চোখ উঁচিয়ে তাকে দেখার সাহস হয়ে উঠেছিল না। কোথাও একটি জড়তা কাজ করছিল।
-“ভাবি.. ও ভাবি। আমার ভাবি.. প্রাণের ভাবি। এটা খাও তো।”
চিন্তা রাজ্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাস্তবে প্রবেশ করতেই মুখের সামনে একটি চামচ দেখতে পেয়ে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। এবাড়িতে আসার পর থেকেই এটাসেটা তাকে খাইয়েই যাচ্ছে সকলে। ছোটোমোটো এক পেটে এত খাবার আটবে কিনা তা একবারও ভেবে দেখছে না এরা। খানিকটা বিরক্ত হয়ে চামুচের খাবার মুখে পুড়তেই পুরো মুখ তেতো হয়ে উঠলো উল্লাসীর। চোখমুখ কুঁচকে চামচ আঁকড়ে ধরে তাকে খাইয়ে দেয়া মেয়েটির দিকে তাকাতেই হোহো করে হেসে উঠলো সে। তার দিকে বুড়ো আঙুল মেলে ধরে বললো,
-“লবণের গল্প পড়োনি? লবণের সেই ঐতিহাসিক গল্পের স্মৃতিচারণ করতেই তোমাকে সামান্য লবণ খাইয়ে দিলাম আরকি!”
পাশ থেকে তার সমবয়সী আরও একজন মেয়ে এসে বললো,
-“তুমিও না! এত বোকা মানুষ হয়? চিনি এবং লবণের মাঝেই পার্থক্য করতে পারো না?”
তাদের করা উপহাস উপেক্ষা করে উল্লাসী খুব কষ্টে মুখ ভর্তি লবণ গিলে ফেলতেই দরজা ঠেলে একগ্লাস পানি হাতে ঘরে প্রবেশ করলো অর্পা। অনা এবং চৈতালির করা কার্যকলাপে তাদের সামান্য ঝেড়ে সে এগিয়ে এল ভাই এবং ভাই বউয়ের দিকে। পানির গ্লাস ভাইয়ের বউয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“ইশ কী একটা অবস্থা! মেয়ে দুটো আচ্ছা পাজি হচ্ছে দিনকেদিন! আর মেসবাহ তুইও! দেখছিসই যে ওরা এসব করছে তখন ওদের নিষেধ করবি না?”
এপর্যায়ে মুখ খুললো মেসবাহ। গম্ভীর গলায় বললো,
-“আমি কী করে জানবো ওরা চিনি না লবণ খাওয়াচ্ছে!”
-“তাও তো কথা! এই উল্লাসী? কতটুকো খাইয়েছে রে? খারাপ লাগছে কী?”
অর্পার করা প্রশ্নে মাথা ঝাকালো উল্লাসী। যার অর্থ ঠিক বোধগম্য হলো না অর্পার। তবুও গলা হালকা প্রসস্থ করে ঘরে থাকা সকলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলতেই একেএকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ভিড় জমানো সকলে। তারপর ভাইয়ের হাত ধরে তাকে উঠিয়ে বাইরে টেনে এনে বললো,
-“তুই আপাতত বাইরে থাক। ঘরে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ হয়ে গেলেই তোকে ডাকবো।”
-“ঠিকাছে।”
লম্বা বারান্দা ধরে সামনে এগুলো মেসবাহ। বুকের ভেতরটায় প্রচুর ছটফট করছে তার। মনে চলা কথাগুলো দ্রুত গতিতে বারবার কানে এসে ঠেকছে। এমনটা তার সঙ্গে শেষ কবে হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করলো মেসবাহ। দেশ ছেড়ে প্রথম যেদিন পা রেখেছিল বিদেশের মাটিতে সেদিন ঠিক এমন অদ্ভুত অনুভূতিই হচ্ছিল তার সঙ্গে। নিজের দেশ ফেলে অচেনা অজানা এক দেশে পাড়ি জমানোয় অদ্ভুত এই অনুভূতি হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তবে আজ? আজ ঠিক কেনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে?

বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। খানিকক্ষণ আগের গরমের সেই ভ্যাপসা ভাবটি এখন আর নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পুরো ঘর শীতল করে তুলেছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা না হলেও বাতাসের তীব্রতার কারণে খানিকক্ষণ পরপর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে উল্লাসীর। সাথে মেঘের গর্জনে ভয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুহা কী করছে এখন? মেঘের ডাকে ভয় পাচ্ছে না তো? ভয় পেলেও কী ছোট মা তাকে নিজের বুকে চেপে ধরছে? যেমনটা সে পরম মমতায় বুকে আঁকড়ে ধরতো সুহাকে? হ্যাঁ.. ছোট মা কথা দিয়েছে তাকে। বিয়েটা করলে খোকনের মত সুহাকেও ভালোবাসবেন তিনি। তাহলে আজ নিশ্চয়ই সুহা এবং খোকন দুজনকে একসাথে বুকে আঁকড়ে নিয়ে বসে রয়েছেন ছোট মা।
-“তোমার নাম যেনো কী?”
পুরুষালী কন্ঠ কানে আসতেই সম্মুখে চাইলো উল্লাসী। কাঁপা গলায় জবাব দিল,
-“উল্লাসী।”
-“কে রেখেছে এই নাম?”
-“মা।”
-“তোমার মাকে তাহলে দেখতে হচ্ছে। অদ্ভুত এক নাম রেখেছেন উনি। উল্লাসী.. গ্রামের এক মহিলার মাথায় এমন নাম এল কী করে তা সত্যিই ভাবাচ্ছে আমায়।”
-“আমার মা গ্রামের ছিলেন না। উনার বাবার বাড়ি ঢাকায়। বাবাকে বিয়ে করার পর উনি গ্রামে এসেছেন।”
মেসবাহ একটি চেয়ার টেনে উল্লাসীর মুখোমুখি বসে বললো,
-“ইন্ট্রেস্টিং। লাভ কেস নাকি?”
-“হু..”
-“গ্রেট। কয় ভাইবোন তোমরা?”
প্রশ্নটি প্রচুর কষ্ট দেয় উল্লাসীকে। তবুও জবাব দিতে হয়। যেখানে সকল প্রশ্নের উত্তর আছে সেখানে তার এই প্রশ্নের উত্তর থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ প্রশ্নটির উত্তর না থাকলেই হয়তোবা ভালো হতো।
-“তিন ভাই বোন।”
-“অহ.. চোখের কাজল লেপ্টে পুরো মুখ ছড়িয়ে গেছে তোমার। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো তুমি। ওপাশটায় ওয়াশরুম।”
মেসবাহ হাতের ইশারা করতেই বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। লোকটি দেখতে দানব দানব হলেও কথা বলার ভঙ্গি অত্যন্ত মনোরম। ম্লান হেসে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেই আঁতকে উঠলো উল্লাসী। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কেঁদেছিল সে। বাবা এবং সুহাকে বুকে চেপে ধরে প্রচুর কেঁদেছিল। তবে তাতে কাজলের এত ভয়ংকর অবস্থা হবে তা মোটেও ধারণায় ছিল না তার। বালতিতে জমানো পানি থেকে একচোল পানি উঠিয়ে খুব দ্রুত চোখেমুখে দিল উল্লাসী। আশপাশে খুঁজে সাবানের সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কাজল মোছার কাজে লেগে পড়লো সে।

-“নীচে শুতে সমস্যা হবে না তো তোমার?”
গামছায় চোখমুখ মুছে মেঝেতে বিছানো চাদরের দিকে তাকিয়ে উল্লাসী ধীর গলায় বললো,
-“না..”
-“গুড। শুয়ে পড়ো এখানে।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় এসে শরীর মেলে দিল মেসবাহ। সারাদিনের চিন্তা এবং ক্লান্তির চোটে ঘুমে চোখজোড়া আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার। তাই বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ গামছা হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকার পর অন্ধকার ঘরে হাতরিয়ে হাতরিয়ে সামনে এগুলো উল্লাসী। ছোটমার কথামতো স্বামীর একটি কথাও অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাতে উপরওয়ালা নারাজ হবে। শুধুশুধু উপরওয়ালাকে নারাজ করে কী লাভ? দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদন্ড ভেবে পরণের শাড়ি খুলে তার ভেতর সকল গহনাদি খুলে তা মাথার কাছে রাখলো উল্লাসী। তারপর নিশ্চিন্তমনে নিদ্রার আয়োজন করলো। ভয় লাগছে তার। অচেনা এক বাড়িতে এই প্রথম একা রয়েছে সে। না সাথে আছে সুহা আর না বাবা…

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here