শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর লেখক- এ রহমান পর্ব ১৭

0
522

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৭

নিরিবিলি সকাল। মস্তিষ্কে অগোছালো ভাবনার বিচরণ। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দিনের শুরু। কোন কাজ না পেয়ে শেষে টিভির সামনে বসে পড়ল। এলোমেলো ভাবে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে ঈশা। কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না তার। আজ একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। তাই এখন আর সময় কাটছে না। আজ কাল টিভিতেও তেমন ভালো কিছুই হয় না। খুব বিখ্যাত একটা চ্যানেলে এসে থেমে গেলো সে। কোন এক সিরিয়ালে চরম রকমের ঝগড়া চলছে। বউ শাশুড়ির ঝগড়া। বউ নিজের যোগ্যতা প্রমান করতেই ব্যস্ত। আর শাশুড়ি বউকে একের পর এক টাস্ক দিয়েই যাচ্ছে। যাতে সে কোন ভাবেই যোগ্যতা প্রমান করে উঠতে না পারে। আর বেচারা নায়ক দু চোখ দিয়ে সব কিছু শুধু দেখেই যাচ্ছে অসহায়ের মতো। ঈশা ভলিউম টা একটু বাড়িয়ে দিলো। রিমোট হাতে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চমর সাসপেন্সের ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ এসে তার নাম ধরে প্রচণ্ড গতিতে কানের কাছে চিৎকার করে উঠল। ঈশা চমকে উঠল। হাত থেকে রিমোট পড়ে গেলো। অতি বিরক্ত নিয়ে পাশে ঘুরে তাকাল। ইভানের মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রচণ্ড রেগে আছে সেটা দেখেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু সকাল সকাল এরকম অগ্নি মূর্তি ধারন করার কারণটা বোধগম্য হল না তার। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে বড় মা?

বলেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে আবার বলল
–এরকম সেজে গুজে কোথাও যাচ্ছ? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ?

ইভানের মা পাশে বসে পড়ল। ঝাঝাল গলায় বলল
–কখন থেকে ডাকছি। এমন ভাবে ঢুকে গিয়েছিস যে আশে পাশের কোন খেয়াল নেই।

ঈশা মিনমিনে গলায় বলল
–সিরিয়াল দেখছিলাম তো। তাই খেয়াল করিনি।

ইভানের মা ধমক দিয়ে বললেন
–এসব কি সিরিয়াল দেখিস? বউ শাশুড়ির ঝগড়া শিখছিস? আর আমার বাসায় গিয়ে এসব করার পরিকল্পনা করছিস? সংসারে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা তাই না?

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার মা হেসে ফেলল এসব কথা শুনে। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভানের মা আবার বলল
–ভালো জিনিস দেখবি। কিভাবে শশুর শাশুড়ির খেয়াল রাখতে হয় সেসব শিখবি আর সেবা করবি। আদর্শ বউ হবি বুঝলি?

ইভানের মা থামতেই ঈশা তাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বলল
–তুমি তো শাশুড়ি না। তুমি তো বড় মা। কেন শুধু শুধু শাশুড়ি সাজতে চাইছ। তোমাকে মোটেই মানাচ্ছে না।

ইভানের মা গম্ভির গলায় বলল
–এসব বলে কোন লাভ হবেনা। এখন ছাড় পাচ্ছ বলে যে পরেও ছাড় পাবে তা কিন্তু না। যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমরা একটু বাইরে যাব।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কই যাব?

–মার্কেটে। তোকে নিয়ে যাব। চল। রেডি হয়ে নে।

ঈশা আর কথা বাড়াল না। কারন আজ একটু বেশী গরম মনে হচ্ছে। সকাল সকাল না গেলে গরম আরও বেড়ে যাবে। উঠে নিজের ঘরে গেলো। বেছে বেছে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা কামিজ বের করলো। রেডি হয়ে বের হয়ে এলো। বাইরে এসে দেখে ইভানের মা আর ঈশার মা বসে গল্প করছে। ঈশা বের হয়েই বলল
–আমাকে কেমন লাগছে বড় মা?

মাথায় ওড়নাটা লম্বা করে টেনে দেয়া। আহামরি কোন সাজ নেই। ইভানের মা উঠে দাড়িয়ে বলল
–খুব সুন্দর লাগছে। একদম আমার বাড়ির বড় বউয়ের মতো।

ঈশা একটু লজ্জা পেল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনি বের হয়ে গেলো।

—————
আবহাওয়াটা বেশ গরম। মার্কেটে মানুষের ভিড়ে আরও গরম লাগছে। ক্লান্ত শরীরে দুই হাত ভর্তি ব্যগ ধরে ঈশা আর ইভানের মা দাড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। একটা রিকশা সামনে দেখতেই ঈশা হাত উচিয়ে ডাকল। পাশে ঘুরে দেখে ইভানের মা নেই। এদিক সেদিক তাকাতেই খেয়াল করলো তিনি পাশের দোকানে কি যেন কিনছেন। দোকানদার কে টাকা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে বললেন
–রিকশা পেয়েছিস?

ঈশা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল
–কই গিয়েছিলে তুমি? উঠে পড়।

ইভানের মা উঠে বসলো রিকশায়। ড্রিংকসের বোতলটা ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–এটা আনতে গিয়েছিলাম।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কিন্তু এগুলা তো তোমার পছন্দ না। তাহলে কিনলে কেন?

ইভানের মা মৃদু হেসে বললেন
–তোর তো পছন্দ। তোর জন্য কিনেছি।

ঈশা গভির দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলের মতো মাও তার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে। মেয়ে নেই বলে ঈশাকে সে একদম নিজের মতো ভালবাসে। ঈশার মা ছোট বেলায় তাকে মারার জন্য ইভানের মায়ের কাছে কত যে বকা খেয়েছে তার হিসাব নেই। খুশি হয়ে একটু জড়িয়ে ধরে বলল
–থ্যাঙ্ক ইউ বড় মা।

দুজনে নিজেদের মতো গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলো বাসায়। ঈশা রিকশা থেকে নেমে কিছু একটা ভেবে বলল
–বড় মা। আমি বাসায় যাই। গিয়ে গোসল করব।

ইভানের মা আপত্তি জানাল। বলল
–এখনি না। আগে আমার সাথে উপরে যাবি তারপর বাসায়।

কিন্তু এতে কোন লাভ হল না। ঈশা জোর করে বলল
–আমি একদম ঘেমে গেছি। এখনি গোসল করে ফ্রেশ না হলে ঠাণ্ডা লাগবে। পরে আবার আসব তো।

আর কিছু বলতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো। তিনি ‘আচ্ছা’ বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অর্ধেক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই ইভানের সাথে দেখা হল। ইভান বাইরে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। মা তাকে দেখে বলল
–কোথাও যাচ্ছিস?

ইভান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–হুম। একটু কাজ আছে।

ইভানের মা আর কথা না বলে উপরে চলে গেলেন। ঈশা তাদের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসল। আসলে সে নিচ থেকে ইভানের বারান্দায় দেখেছিলো তাকে রেডি হয়ে দরজা লাগাতে। বুঝে গিয়েছিলো ইভান এখন বাইরে যাবে। তাই বাসায় যাওয়ার বাহানা করে ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে সিঁড়ির নিচে। ইভান শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। হঠাৎ করেই সামনে চোখ পড়ল। ঈশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো। সাদা মাটা চেহারায় ঈশাকে অদ্ভুত লাগছে। শুভ্র রঙটা যেন তার চেহারার সৌন্দর্য হাজার গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইভানের মনেও ঠিক একি রকম অনুভুতি হচ্ছিল। এই মুহূর্তে ঈশাকে খুব মিস করছিল সে। মনে হচ্ছিল কোনভাবে এক পলক দেখা পেলে তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মন সতেজ হয়ে উঠবে। ইভান ধির পায়ে শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই ঈশা সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোট্ট একটা বক্স তার দিকে এগিয়ে দিলো। ইভান ভ্রু কুচকে বক্সটার দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষন পর হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো। কোন কথা বলার আগেই ইরিনা এসে মাঝখানে দাড়িয়ে বলল
–ওহো! এখানে দেখছি আদান প্রদান হচ্ছে। তো কি আদান প্রদান হচ্ছে শুনি?

ঈশা একটু বিরক্ত হল ইরিনার উপরে। এই সময়েই তাকে আসতে হল। একটু পরে আসলে কি ক্ষতি হতো। তেমন কিছু না হলেও ধন্যবাদটা বলতো সুন্দর করে। এখন হয়তো সেটাও আর বলবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। একটা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়তেই ইভান বলল
–তুই একটু ভুল বলেছিস। সবে আদান হয়েছে। এখনও প্রদান বাকি।

ইরিনা আর ঈশা দুজনেই এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভানের কথার মানে যে কেউ বুঝতে পারেনি সেটা বুঝেই সে একটু হাসল। আর একটু এগিয়ে এসে ঈশার কাছাকাছি দাড়িয়ে ইরিনাকে বলল
–তাহলে এখন প্রদানের কাজটা সেরে ফেলি। কি বলিস?

ইরিনা না বুঝেই মাথা নাড়তেই ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে গেলো। ডান গালে আলতো করে একটা হাত রেখে বাম গালে গভির ভাবে একটা চুমু দিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। আচমকাই এমন কিছু হওয়াতে ঈশা হা হয়ে গেলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটাই বুঝতে পারলো না। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম। গরমে ঘেমে পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি শাওয়ার না নিলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

দুই আঙ্গুলে আলতো করে গালে স্পর্শ করে বলল
–বি কেয়ার ফুল। ঠাণ্ডা যেন না লাগে।

বলেই চলে গেলো। ঈশা হা হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ইরিনা হেসে ফেলল। ঈশার দিকে তাকাতেই ঈশা বলল
–আমাকে একটা চিমটি কাটবে ইরিনা আপু? প্লিজ!

ইরিনা ঈশার কথা শুনে আরও জোরে হেসে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–পাগল হওয়ার কথা ছিল আমার আর পাগলামো করছ তুমি। আর আমি এখনও বুঝেই উঠতে পারলাম না বাস্তব না কল্পনা।

ইরিনা ঈশার হাতে জোরে চিমটি কাটতেই সে চিৎকার করে উঠল। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন ইরিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বুঝে উঠতেই মুচকি হেসে তার গালে একটা চুমু দিলো। ইরিনা আবারো হেসে বলল
–তোর উপরে ইভান ভাইয়ার ভুতটা ভর করেছে।

ঈশা হেসে বলল
–এরকম জানলে আরও আগে ভুতকে নিমন্ত্রন জানাতাম। নিমন্ত্রন জানাতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।

দুজন মিলে অট্ট হাসিতে মেতে উঠল। খানিকবাদেই ঈশা বলল
–থাক আমি বাসায় যাই। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?

ইরিনা বলল
–বড় মার কাছে যাচ্ছিলাম।

ঈশা বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছে আর কিছুক্ষন আগের কথা ভাবছে। ভেবেই ঠোট কামড়ে হাসল। বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজাতেই তার মা দরজা খুলে দিয়ে বলল
–কি রে এসেছিস? দেখি কি কি কিনলি?

ঈশা ব্যাগ গুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গালে একটা চুমু দিলো। ঈশার মা তার আচরনে বেশ অবাক হল। ভ্রু কুচকে বলল
–আজ হঠাৎ করে এতো ভালবাসা উতলে পড়ছে যে?

ঈশা ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পিছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–ভালবাসা তো হঠাৎ করেই আসে মা।

বলেই ঘরে চলে গেলো। মেয়ের এরকম উদ্ভট আচরন দেখে তার মা বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। ঈশা ঘরে গিয়ে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে। অনেকটা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। এসেই টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিন অন হতেই চোখে পড়ল ইভানের মেসেজ।

“যাকে এক পলক দেখার মাঝে এক আকাশ সম তৃপ্তি! যার কাজল জড়ানো মায়াবি চোখে হৃদয় হরনের ক্ষমতা। যার মুচকি হাসিতে অনাবিল সুখ! সেই তুমিটা শুধুই যে আমার।”

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here