শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর লেখক- এ রহমান বোনাস পর্ব

0
539

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
বোনাস পর্ব

সকাল সকাল কারো চাপা গলায় নিজের নামটা উচ্চারণ করতে শুনে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে পড়ল ঈশা। কোথা থেকে এই আওয়াজ আসছে সেটাই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে গভির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় এলোমেলো লাগছে সব কিছু। কিছুক্ষন বসে থেকে মস্তিষ্ককে ঠিক করে নিতেই আবার কানে এলো নিজের নামটা। ভ্রু কুচকে নিজে নিজে আওড়াল
–এটা তো বড় মার গলা।

পাশের বারান্দা থেকে ডাকছে। দরজা খুলে দেখল গ্রিল ধরে অস্থির ভঙ্গিতে ইভানের মা তার বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঈশা তাকে এভাবে দেখে চিন্তিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে বড় মা?

ইভানের মা এক প্রকার হাপাতে হাপাতে বলল
–তাড়াতাড়ি একটু বাসায় আয় না মা।

কথাটা শুনে ঈশার বুকের ভিতরে ছ্যত করে উঠলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের আভাষ জানিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কোন সমস্যা হয়েছে? কারো কিছু হয়েছে?

ইভানের মা কাদ কাদ কণ্ঠে বললেন
–ইভানের খুব জ্বর। তুই একটু আয় না।

ঈশা থেমে গেলো। ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি আসছি বড় মা। এখনি আসছি।

ইভানের মা ভিতরে চলে গেলো। ঈশা কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে মাথায় ওড়না টেনে বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই তার মা জিজ্ঞেস করলো
–এতো সকালে কই যাস?

ঈশা একটু ভাবল। তারপর চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–ইভান অসুস্থ মা। ঐ বাড়িতে যাচ্ছি।

ঈশার মাও আর দেরি না করে মেয়ের সাথে বেরিয়ে গেলেন। বাসায় ঢুকে দেখে সবাই ইভানের ঘরে। প্রচণ্ড জ্বরে কাতর ইভান। কোন হুশ নেই। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কাউকে এই মুহূর্তে চিনতে পারছে কিনা কে জানে। মুখ চোখ সব রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। কিছুক্ষন পরেই ডক্টর আসলো। ইভান কে দেখে বলল
–সারা রাত তীব্র জ্বর থাকায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আমি ইনজেকশন দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়বে এখন। নিজে থেকে না উঠা পর্যন্ত ঘুম ভাঙ্গাবেন না। আর জ্বর জতক্ষন নামেনি ততক্ষণ পর্যন্ত মাথায় জলপটি দিতেই থাকবেন। আশা করা যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্বর কমে যাবে।

প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে ডক্টর চলে গেলো। ইভানের মা মুখে আচল চেপে কাদছেন। ঈশার মা তাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল
–রাত থেকে ছেলেটার এমন অবস্থা একবার ডাকবেন না ভাবি?

ইভানের মা মৃদু গলায় বলল
–আমিও তো জানতাম না। কখন জ্বর এসেছে কাউকে বলেনি। কিছুক্ষন আগেই আমি ঘরে এসে দেখি কাপছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রচণ্ড জ্বর।

ঈশার মা একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–হবেই না বা কেন? কাল অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে সব কয়টা। বকতে গেলাম আমাকেই আরও উলটা বুঝিয়ে দিলো।

ইভানের মা কিছু বলল না। কাদতে লাগলো। ঈশার মা ইভানের মাকে বললেন
–কিছু খেয়েছেন আপনারা?

ইভানের মা না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশার মা বলল
–আমি নাস্তা বানাই।

বলেই পা বাড়াতেই ইভানের মা ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই এখানে থাক মা। আমি তোর মায়ের সাথে রান্না ঘরে যাই।

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–যাও। আমি আছি।

সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ঈশা ইভানের মাথার কাছে বসে জলপটি দিতে লাগলো। তীব্র জ্বরের ঘোরে ইভান ঈশার হাত শক্ত করে ধরে বিড়বিড় কি যেন বলল। ঈশার কানে আসলো না। কিন্তু বুঝতে পারলো ইভান খুব করে ঈশাকে কাছে চাইছে। ঈশা একটু ঝুকে মাথাটা বুকে নিয়ে আলতো করে বলল
–আমি তোমার কাছেই আছি। একদম কাছে। চোখ মেলেই আমাকে দেখতে পাবে।

ইভান ঠিক কতটা তার কথা বুঝল সেটা জানা সম্ভব হল না। কিন্তু ঈশার মনে হল তার কথা শোনার পরে ইভানের অস্থিরতা কমে গেলো। গভির ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। অনেক সময় পর ইভানের জ্বর নেমে গেলো। সে এখন গভির ঘুমে আচ্ছন্ন। ইভানের মা কয়েকবার এসে দেখে গেছে। এবার এসেছে ঈশার জন্য খাবার নিয়ে। ঈশাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো। ঈশা আলতো হাতে ইভানের মাথা টিপে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ করে তিনি মৃদু সরে বলল
–আমি চা এনে দিচ্ছি।

ঈশা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। ইভানের মা চলে গেলো।

————-
কপালে কচি হাতের নরম ছোঁয়ায় ইভানের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। চোখ খুলতেই পারছে না কিছুতেই। এমন হওয়ার কারন বুঝতে না পেরে কষ্ট করে চোখ খুলে ফেলল। সাদা আলো এসে সোজা চোখের মনিতে আঘাত করতেই আবার বন্ধ করে ফেলল। চোখ খিচে বন্ধ করে কিছুক্ষন পর খুলে তাকাল। পাশেই ইরাকে বসে থাকতে দেখল। তার মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–তুই কি করছিস টুনটুনি?

ইরা একটু চমকে গেলো। ইভান যে চোখ খুলেছে সে এতক্ষন বুঝতে পারেনি। চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল
–তুমি উঠলে কেন? আবার ঘুমাও।

ইভান হাসল। উঠে পিছনে হেলানি দিয়ে বসে বলল
–আবার কেন ঘুমাব?

ইরা হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ইভানের কপালে হাত রেখে বলল
–তোমার যে জ্বর হয়েছে।

ইভানে ভ্রু কুচকে ফেলল। কাল রাতে শোয়ার সময় শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল। কিন্তু এখন এরকম টায়ার্ড লাগছে আর মাথা ব্যাথা করছে কেন সেটা ইরার কথায় বেশ ভালভাবে বুঝতে পারলো। ভাবনার মাঝেই ইরা আবার বলল
–মাথা ব্যাথা হইছে। দাও টিপে দেই।

ইভান হেসে ফেলল। ইরাকে কোলে বসিয়ে বলল
–কে বলেছে আমার মাথা ব্যাথা?

–আপু যে টিপছিল এতক্ষন।

ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। একটু ভেবে অবাক সরে জিজ্ঞেস করলো
–তোর আপু কোথায়?

ইরা হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলল
–ঐ যে।

ইরার কথা শুনে ইভান দরজার দিকে তাকাল। ঈশা অসহায়ের মতো ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান খেয়াল করলো ঈশার সেই অসহায় দৃষ্টি। ঈশা ইরার দিকে তাকিয়ে হতাশ সরে বলল
–বাইরে গিয়ে খেল ইরু। ভাইয়াকে রেস্ট নিতে দে।

ইরা উঠতে নিলেই ইভান থামিয়ে দিয়ে বলল
–থাক না। বিরক্ত করছে না তো।

ঈশা কোন কথা বলল না। বের হয়ে গেলো ইভানের জন্য খাবার আনতে। ইরা কোল থেকে নেমে পাশে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। কিছুক্ষন পরেই ঈশা খাবার নিয়ে আসলো। ইভান চোখ তুলে তাকাল। মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে। খাবারের গন্ধটাই অরুচি ধরিয়ে দিচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে বলল
–খেতে ইচ্ছা করছে না। খাবো না।

ঈশা নরম সরে বলল
–কি খাবে? বল। বানিয়ে দিচ্ছি।

ইভান অবাক চোখে তাকাল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–থাক কিছু বানাতে হবে না। এগুলাই খাবো। কিন্তু অল্প।

ঈশা বসে পড়ল। ভাত মেখে মুখের সামনে ধরল। ইভান তাকিয়ে আছে। এসব কিছু এক সময় তার কাছে স্বপ্ন মনে হতো। কিন্তু এখন বাস্তবে হচ্ছে। ইভান মুখে খাবার নিলো। ঠোটে প্রশান্তির চাপা হাসি। কয়েকবার মুখে নিয়ে বলল
–আর খাবো না।

ঈশা জোর করলো না। পানি এগিয়ে দিলো। প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে ইভানের হাতে ঔষধ ধরিয়ে দিলো। ইভান ঔষধ খেয়ে পানির গ্লাস ঈশাকে দিলো। সে গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। ইভান ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–মুড অফ কেন?

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই সোজা সাপটা জিজ্ঞেস করলো
–তুমি সিগারেট খাও?

ঈশার মুখে এমন কথা শুনে ইভান চরম বিস্ময়ে তাকাল। তার এই অভ্যাসের কথা বন্ধু মহলের বাইরে কেউ জানে না। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই সখের বসে খাওয়া হয়ে উঠে। কিন্তু ঈশা জানল কিভাবে? ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা কোনভাবেই প্রকাশ করতে চাইছে না সে। পিছনে মাথাটা ঠেকিয়ে নরম সরে বলল
–মাঝে মাঝে।

ঈশা আবারো কঠিন কণ্ঠে বলল
–আমি জতদুর জানি যারা সিগারেট খায় তাদের জীবনে ডিপ্রেশন থাকে। তোমার জীবনের ডিপ্রেশন কি? আমি?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–এটা কি ধরনের প্রশ্ন ঈশা? সিগারেট খাওয়ার জন্য যে ডিপ্রেশন থাকতেই হবে এমন কোন কথা নাই। আর আমি বলেছি মাঝে মাঝে খাই। সখের বসে। আমি এডিক্টেড না।

ঈশা হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–আচ্ছা? সিগারেটের প্যাকেট পকেটে রাখার মানে মাঝে মাঝে খাওয়ার অভ্যাস বলে তো মনে হয়না।

ইভান হতবিহবল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ঈশা বিষয়টা কিভাবে জানল সেটা এখন স্পষ্ট তার কাছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঈশার মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন পরে হাত বাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলল
–আসো।

ঈশা বিস্ময় মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। একটা দুইটা নয় হাজারটা ময়ুর পেখম মেলে নেচে উঠলো মনের মাঝে। ভোতা অনুভুতি গুলো ধারালো ফলার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো উচ্চারিত এই একটা শব্দে। ইভান আবার বলল
–নিজে থেকেই আসবা নাকি আমি কাছে যাব। আমি গেলে কিন্তু……

কথা শেষ করার আগেই ঈশা এগিয়ে এসে ইভানের হাত ধরল। কারন ইভান এরপর কি বলবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে সে। ইভান আলতো করে পাশে বসিয়ে দিলো। এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল
–মন খারাপের কারন কি শুধু এটাই?

ঈশা নিচে তাকিয়ে আছে। কোন উত্তর দিলো না। ইভান কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো উত্তরের জন্য। তারপর গম্ভির গলায় বলল
–ঠিক আছে। আর কখনও সিগারেট খাবো না। খুশি?

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–অন্য কারণটা বল এবার।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কেন অত সময় বৃষ্টিতে ভিজলে? আমি বললাম সেটা কানেই নিলেনা। আবার রাতে জ্বর এসেছিলো সেটাও কাউকে জানাওনি।

ইভান অপরাধীর মতো বলল
–আমি যখন ঘুমাতে যাই তখন একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেটা যে জ্বরের কারনে বুঝতে পারিনি। পারলে ঔষধ খেয়েই ঘুমাতাম। পরে কি হয়েছে সেটা তো আর বলতে পারিনা।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল
–কি অবস্থা হয়েছে সেটা যদি বুঝতে তাহলে এরকম বলতে না।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–আচ্ছা সরি।

ঈশা নিচেই তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলছে না দেখে ইভান ঈশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টেনে বলল
–এভাবে সরি বলে লাভ না হলে আর কিভাবে বলতে হয় সেটা কিন্তু আমি জানি।

ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল
–কি করছ? ইরা আছে।

ইভান ঈশাকে ওভাবেই ধরে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–টুনটুনি ইফতি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বল ইভান ভাইয়া চকলেট দিতে বলেছে।

ইরা ইভানের কথা শুনে আর দেরি করলো না। এক দৌড়ে চলে গেলো। ইরা ঘর থেক বের হয়ে যেতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসল। তারপর দুই হাতে ঈশাকে জড়িয়ে কাছে টেনে দুষ্টুমির সুরে বলল
–কোনটা দিয়ে শুরু করবো? আগে রাগ ভাঙ্গাব নাকি অভিমান।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান হাতের বাধন আরও শক্ত করে বলল
–এতো সহজ না। তোমার উপরে সবটা ছেড়ে দিয়েছি। তাড়াতাড়ি ডিসাইড করো। যত দেরি করবা তোমার বিপদ তত বাড়বে ঈশা পাখি। আজ তো আমি কোন ভাবেই ছাড়বো না। এতো অভিযোগ আমি আর নিতে পারছি না।

চলবে………

(আপনাদের অনুরধে ছোট করে একটা বোনাস পার্ট দিলাম। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here