শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর লেখক- এ রহমান পর্ব ২৪

0
491

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৪

মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইভানের। চোখ বন্ধ করে পাশে হাত রাখতেই খেয়াল করলো ঈশা বিছনায় নেই। চোখ খুলে বোঝার চেষ্টা করলো। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল ঈশা জানালার পাশে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। উদাসিন চোখ আর সাথে খুব যত্ন করে দুই হাতে চেপে ধরা ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ইভান ঘুম কাটিয়ে উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে ভাবল তখন একটু বেশিই খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছে। এমনিতেই মেয়েটা কষ্টের মধ্যে আছে। তার উপর ইভান তাকে সময় দিতে পারছে না। নিজের মনের কথা গুলো কাউকে বলতেও পারছে না। কথাটা ভেবেই নিজের উপরে রাগ হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো ঈশার কাছে। ঈশা খেয়াল করেনি। কফিটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই ইভান হাত ধরে ফেলল। ঈশা ভয় পেয়ে চমকে তাকাল। ইভান কে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি? উঠলে কেন?

ইভান কোন উত্তর না দিয়ে কফির মগটা হাত থেকে নিয়ে চুমুক দিলো। ঈশা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বেকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
–মিষ্টিটা কম মনে হচ্ছে।

ঈশা চোখ পিটপিট করে তাকাল। ঈশার কাছে তো কম মনে হল না। সে তো নিজে হাতেই কফি বানাল। হুট করেই ইভান একটু ঝুকে ঈশার গালে এক হাত রাখল। মুখটা একটু উচু করে ঠোটে গাড় চুমু খেলো। একটু সরে গিয়ে জিভ দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বলল
–নাহ! ঠিক আছে। কফিটাই অনেক স্ট্রং। মাঝ রাতে এতো স্ট্রং কফি খাওয়ার কি দরকার?

বলেই কাপটা নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমের দিকে গেলো। দরজা খুলে বেসিনে পুরো কাপটা উল্টে দিলো। ঈশা হা করে তাকিয়ে আছে। মাঝ রাতে হুট করে এমন অপ্রত্ত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তাই বুঝতে একটু সময় লেগে গেলো। বসেই থা্কল চেয়ারে। ইভান বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ করেই বলল
–৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিছানায় না আসলে কিন্তু সারা রাত আর ঘুমাতে হবে না।

ঈশা আর কিছু ভাবতে পারলো না। এমন কড়া হুমকির মাঝে ভাবার সময়টাও পেলনা। উঠে বিছানায় যেতে যেতে ভাবল এটা আবার কোন সময় হল। ২ মিনিট দিতে পারত। একটু হাত মুখ ধুয়ে আসত। বিরক্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। সোজা হয়ে ভাবছে। ইভান পাশ ফিরে ঈশার কাছাকাছি এসে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরল। শীতল হাত শাড়ির ভাজ গলিয়ে স্পর্শ করতেই ঈশা কেপে উঠলো। গলায় মুখ ডুবাল ইভান। আদুরে কণ্ঠে বলল
–সরি। তখন ওভাবে বলতে চাইনি। রাগ হয়েছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।

ইভানের এমন আদুরে কথা শুনে ঈশার মন হালকা হয়ে গেলো। ঈশা হেসে ইভানের মাথায় হাত রাখল। ইভান মুখটা তুলে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–মন ভালো হয়েছে নাকি আরও ভালো করে দিতে হবে?

ঈশা চোখ বন্ধ করে লাজুক হাসল। ইভান অন্ধকারেও ঈশার সেই লাজুক হাসির মায়ায় হারিয়ে গেলো। কোন ভাবেই এই মায়া থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব না। আরও যেন গভির ভাবে জাপটে ধরল সেই মায়া। মনের গভিরে জমে থাকা অনুভুতি হুট করেই বাধন হারা হয়ে গেলো। সাথে হাতের স্পর্শও অবাধ্য হয়ে উঠলো নিমেষেই।

————–
ঈশা সকাল সকাল উঠে গেলেও ইভান এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। ঈশা বুঝে গেলো রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য এখনও ঘুম ভাংছে না। কিন্তু তার তো বাইরে কাজে যাওয়ার কথা। তাই ঈশা ঘরে গেলো ডাকতে। বিছানায় বসে ইভানকে দেখল কিছুক্ষন। ডাকবে কিনা বুঝতে পারছে না। একটু ভেবে আলতো হাত মাথায় রাখতেই ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা নরম সরে বলল
–এখনও উঠছ না যে? আজ কোন কাজ নেই?

ইভান পাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে ধরে বলল
–আজ কোথাও যাব না। ভালো লাগছে না।

ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কেন শরীর খারাপ? কি হয়েছে?

ইভান চোখ বন্ধ করেই বলল
–কিছু না। এমনিতেই বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। বাসাতেই থাকব।

ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ঘুমাতে চাইলে খেয়ে আবার ঘুমাও। এখন উঠ।

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। মৃদু সরে বলল
–একটু পরে উঠি?

ঈশা মৃদু হেসে নাড়ল। উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দরজার কাছে যেতেই ইভান ডাকল।
–ঈশা।

থেমে গেলো। ইভান উঠে ঈশার সামনে এসে দাঁড়াল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলো। গভির ভাবে তাকিয়ে চুলের খোপাটা খুলে দিলো আচমকা। এমন হওয়াতে ঈশা একটু বিরক্ত হল। এখন সে রান্না ঘরে কাজ করবে। আর খোলা চুল গুলো বিরক্ত করবে। কিন্তু ইভান সেটার তোয়াক্কা না করে বলল
–খোলাই থাক।

ঈশা বিরক্ত হলেও কোন কথা বলল না। মৃদু হাসল। ইভান একটু হেসে ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ঈশা রান্না ঘরে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে বাইরে চলে গেলো। গিয়েই দেখল ইলু ইরিনা আর ইফতি বসে আড্ডা দিচ্ছে। ইভান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–কি রে তোরা এতো সকাল সকাল?

ইলু বলল
–আমরা সকাল সকাল না। তুমি উঠতে লেইট করেছ।

ইভান বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল। ইভান কে খাবার দিয়ে ঈশা রান্না ঘরে চলে গেলো চা বানাতে। সবার জন্য চা বানাচ্ছে। ছেড়ে রাখা চুল গুলো প্রচণ্ড বিরক্ত করছিল। কাজের ফাকে ইভানের কথা ভুলে গিয়ে আনমনেই খোপা বেধে নিলো। চা বানানো শেষে কাপে ঢেলে এনে টেবিলে বসল। সবার হাতে কাপ দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে বসে পড়ল। ইভান নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে। ঈশা চায়ের কাপটা মুখের সামনে ধরতেই ইরিনা প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে বলল
–ঈশা তোর গলায় ওটা কিসের দাগ?

কথাটা কানে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার দিকে না তাকিয়েও বুঝে গেলো সে আবার খোপা বেধেছে। চোখ খুলে স্বাভাবিক ভাবে খাবার মুখে দিলো ইভান। প্রচণ্ড অসস্তির মধ্যে পড়ে গেলো সে। এই অবস্থায় ঠিক কি করা বা বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। মাথা নামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খেয়ে যাচ্ছে। ঈশা কিছু না বুঝেই ভ্রু কুচকে সবার দিকে তাকাল। ইফতি মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল
–ভাবি আপু তুমি কি কোনভাবে ব্যথা পেয়েছ গলায়?

কথাটা বোধগম্য হতেই ঈশাকে প্রচণ্ড অসস্তি ঘিরে ধরল। আড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান খুব স্বাভাবিক। এখানে কোন কথা হচ্ছে সেটাও সে শুনতে পাচ্ছে না এমন ভাব। ঈশা প্রচণ্ড লজ্জায় পড়ে গেলো। ইভানের উপরে খুব রাগ হল তার। ইরিনা এবার পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজের করা বোকামির জন্য লজ্জা পেলো। মুখ ফিরিয়ে ইলুর দিকে তাকাতেই দেখল ঠোট চেপে হাসছে। ইরিনাও নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না। ঈশা তাদেরকে এভাবে হাসতে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইভানের ফোন বেজে উঠলে সে সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা নিয়ে উঠে গেলো। কারন বুঝতেই পারছে এখানে এখন কি হবে। থাকা মানেই তার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ পর কথা শেষ করে ইভান টেবিলে এসে বসলো। ঈশা একা বসে আছে। আশে পাশে এখন কেউ নেই। ইভান চেয়ারে বসে দেখল ঈশা প্রচণ্ড অসস্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল
–সবাই কই গেলো?

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান চোখ ফিরিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। নিজের মুখে খাবার দিয়ে আবার খাবার তুলে ঈশার মুখের সামনে ধরল। ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হেসে বলল
–মান সম্মানের যা ফালুদা বানানোর ছিল বানানো শেষ। এখন খাবারের উপরে রাগ দেখিয়ে কি লাভ। খাবারের আর কি দোষ।

বলেই ঈশার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল
–আমাকে রাগ দেখানোর কি আছে? আমার কি দোষ? আমি কি ইচ্ছা করে করেছি নাকি?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার ঠোটের কোনে লেগে থাকা খাবার মুছে দিতে দিতে বলল
–আমার কি দোষ বল। চুল বাধতে নিষেধ করেছিলাম। আমার কথা না শুনলে এমনি হবে।

ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–স্পষ্ট করে কথা বলতে পারনা? অর্ধেক কথা বল কেন সব সময়? ভালো করে বললে কি আমি চুল বাধতাম?

ইভান খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল
–পারি। কিন্তু বলতে ইচ্ছা করেনা।

ইভানের এমন হেয়ালিপূর্ণ কথা শুনে ঈশা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে ঘরে চলে গেলো। ইভান হেসে ফেলল।

—————
সন্ধ্যার পরে ইভান একটু বাইরে গেছে। ছোট কি যেন কাজ আছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি আসবে। ঈশা শুয়েছিল একটু। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলো। কেমন এলোমেলো লাগছে। কাজল গুলো চোখের নিচে লেপটে গেছে। ওয়াশ রুমের দরজা খোলা রেখেই আঁচলের কোনা দিয়ে চোখের নিচে লেপটে থাকা কাজল ডলে ডলে মুছার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিক মতো উঠছে না। চোখের নিচেটা কালো হয়ে যাচ্ছে। ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলার মতো অবস্থা করে ফেলেছে। ইভান অনেক আগেই এসেছে বাসায়। চুপচাপ ঈশার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি করতে চাইছে। এক সময় এগিয়ে গিয়ে ঈশাকে নিজের দিকে ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা চমকে উঠে বলল
–কি করছ?

ইভান নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিলো। ঈশার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই ঈশা পিছিয়ে বেসিনের উপরে ঝুকে গেলো। ইভান কোমর জড়িয়ে ঈশাকে নিজের কাছে এনে টিস্যু ভিজিয়ে নিয়ে আলতো করে মুছে দিলো। ঈশা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। ভেজা টিস্যু দিয়ে পুরো মুখটা মুছে দিয়ে বলল
–হয়েছে।

ঈশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে গেলো। আয়নায় ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–কিভাবে হল?

ইভান হেসে ফেলল। ঈশা আয়নায় ইভানের দিকে তাকাল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–হাসার কি হল? আমি কখন থেকে চেষ্টা করছিলাম মুছে ফেলতে। কিছুতেই পারছিলাম না।

ইভান বেসিনের উপরে দুই হাত রেখে ঈশাকে আটকে দিলো। ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল
–সব কিছু কি সবাইকে দিয়ে হয় ঈশা পাখি। কিছু কিছু বিষয়ে স্পেশাল কাউকে লাগে। তোমার সেই স্পেশাল মানুষটা আমি।

ঈশা হাসল। মৃদু সরে বলল
–সত্যিই তাই।

চোখ নামাতেই ইভানের ডান হাতে চোখ পড়ল। কেটে গেছে কোন ভাবে। রক্ত জমাট বেধে আছে। ঈশা হাত ধরে বিচলিত হয়ে বলল
–কিভাবে কাটল?

ইভান সেদিকে তাকাল। কিভাবে কাটল আসলে সেও খেয়াল করেনি। কোন ভাবে হয়তো কেটে গেছে। বলল
–জানিনা।

ঈশা ইভানের দিকে ঘুরে বলল
–জাননা মানে কি? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা?

ইভান নিশ্বাস ছেড়ে বলল
–কেটেছে কোন ভাবে খেয়াল করিনি। তেমন কিছুই না।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–তেমন কিছু না তাই না? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা। কোথায় থাকে মন?

ইভান মুচকি হেসে ঈশাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
–এখানে থাকে।। বাকি কিছুর তো খেয়াল থাকে না।

ঈশা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে ডেটল নিয়ে ইভানের হাতে আলতো করে লাগিয়ে দিলো। ইভান ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভান কে ঠিক করে দিয়ে বলল
–ফ্রেশ হয়ে এস। খাবো।

বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে আটকে দিলো। যত্ন করে কপালে চুমু দিয়ে বলল
–আসছি। যাও।

ঈশা সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই রান্না ঘর থেকে ঈশার চিৎকার কানে এলো। শুন্য মস্তিষ্কে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে সেদিকে দৌড় দিলো।

চলবে………

(মান অভিমান শেষ। এখন আপনারা খুশি তো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here