(Writer এর অনুমতি নিয়ে গল্পটা post করা হচ্ছে।)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৪_৫_৬
বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবার কারণে বাড়ি না ফেরার সিদ্ধান্ত নিল চৈতালি। একদম কাল সকালেই না হয় বাড়ি ফেরা যাবে। তবে বাবাকে খবর খানা পৌঁছে দিতে হবে। অনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চৈতালি এগুলো আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। ওঘরে একটি টেলিফোন রয়েছে। যা দিয়েই বাড়ির বাইরে থাকা সকল সদস্যের খবরাখবর নেয়া হয়। তাদের বাড়িতেও অবশ্য একটি টেলিফোন রয়েছে। তবে তা বেশ পুরোনো আমলের। দাদার কালের। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ধীর পায়ে লম্বা বারান্দা ধরে এগুচ্ছিল চৈতালি। আচমকা পেছন থেকে হালকা টান অনুভব করলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকার আচ্ছন্ন এক ঘরে নিজের উপস্থিতি টের পেয়ে আঁতকে উঠলো বুকের ভেতরটা। তবে পরমুহূর্তেই ঘাড়ে পড়া একেকটি চিরচেনা নিঃশ্বাসে আত্মায় পানি ফিরে এল তার। ঠোঁটে ফুটলো একরাশ মিষ্টি হাসি।
-“খুব প্রেম পাচ্ছে বুঝি?”
জবাবে চৈতালির কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে মুবিন বললো,
-“ভালোবাসি..”
পরম আবেশে চৈতালি চোখজোড়া বুজে সজোরে কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছন ফিরে জড়িয়ে ধরলো মুবিনকে। দুমাস আগে রোযার ঈদের ভেতর শেষ দেখা হয়েছিল তার মুবিনের সঙ্গে। তারপর মাঝেমধ্যে টেলিফোনে কথা হলেও তার স্থায়িত্বকাল খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না। তবে ভালোবাসায় দূরত্ব থাকা উচিৎ। দূরত্ব কখনোই ভালোবাসা কমাতে পারেনা, সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনা। এতে শুধুই ভালোবাসা বাড়ে। যে ভালোবাসার নেই কোনো সীমাপরিসীমা।
-“কাঁদছো?”
মুবিনকে ছেড়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চৈতালি বললো,
-“তোমার জন্য কাঁদতে আমার বয়েই গেছে!”
-“না কাঁদলেই ভালো। এখন কাঁদতে দেখলে মার একটাও মাটিতে পড়তো না। তা বই পেয়েছো?”
-“পেয়েছি। নিজে না দিয়ে অনাকে দিয়ে দেয়ানোর কী দরকার ছিল? আবার ওকে এও নাকি বলেছো চৈতালি কে?”
হেসে উঠলো মুবিন। দু’হাতে চৈতালির কোমর চেপে তাকে শরীরের সাথে লেপ্টে নিয়ে বললো,
-“আর নিজে যে আমাকে পানিতে চুবানি খাওয়ালে.. তা কিছুই না?”
-“ইশ! নিজে কেনো আমার উপর চোখ রাঙ্গালেন?”
-“আর নিজে যে বললে আমার নাকি ভার্সিটিতে কাকে মনে ধরেছে!”
-“তো ধরেনি? কাওকে মনে না ধরলে আমাকে ছাড়া দিনের পর দিন কীভাবে কাটাও তুমি? কষ্ট হয় না একটুও বুঝি?”
-“হয় তো.. প্রচুর কষ্ট হয়৷ তাই তো একবার কাছে পেলেই সবটা একেবারে উশুল করতে লেগে পড়ি।”
বলেই চৈতালির গালে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে শুরু করতেই নিজেকে মুবিনের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো চৈতালি। দু’হাতে মুবিনের ঠোঁট চেপে ধরে লাজুক এক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে সে বললো,
-“কেউ দেখে ফেলবে তো! দেখি ছাড়ো। আজ রাতে এখানে থাকবো তা বাবাকে জানাতে হবে। বেশি রাত হয়ে গেলে আবার তোমার আব্বা শুয়ে পড়বেন।”
হাতের বাঁধন শিথিল করে মুবিন বললো,
-“তাহলে চাচাকে খবরটা দিয়ে দ্রুত ছাদে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করবো।”
-“মোটেও না। ঘুম ভেঙে অনা আমাকে কাছে না পেলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
-“আরে! ও উঠবেই না। সারাদিন প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করেছে। শুলেই দেখবে ঘুমে তলিয়ে গেছে।”
-“জ্বি না। আপনার চালাকি আমি খুব বুঝি! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে যান ঘুমিয়ে পড়ুন।”
নিজেকে মুবিনের হাত থেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে অন্ধকারে মিশে গেল চৈতালি। মুবিন গ্রামে এলেই বুকের ভেতরটা সবসময় ছটফট করতে থাকে তার। এই বুঝি মুবিন আসবে আর তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভালোবাসার অথৈ সাগরে! এত সুখ কেনো ভালোবাসায়?
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুতেই মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা উল্লাসী নজরে এল মেসবাহর। মেয়েটির গায়ে ব্লাউজ এবং পেটিকোট ছাড়া তৃতীয় কোনো বস্ত্র নেই। বিয়ের শাড়ি পরে রয়েছে মাথার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিক থেকে নজর সরিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অনার উদ্দেশ্যে সে বললো,
-“নিচে আসছি। তুই যা।”
তারপর এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। চোখমুখে কোনোরকম পানির ঝাপটা মেরে আবারও ফিরে এল ঘরে। উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো তাকে।
মোটা পুরুষালী গলায় নিজের নাম উচ্চারিত হচ্ছে শুনেও চোখ মেললো না উল্লাসী। গতকালের সারাদিনের ধকলের পর মেঝেতে শরীর মেলে দেয়ার পরপরই শরীরের ব্যথায় পুরো শরীর চিনচিন করছিল তার। ব্যথাজর্জর শরীর নিয়ে কখন ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সেটিও অজানা। তবে আপাতত ঘুমের ভাব কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। আরও কয়েকদন্ড শুয়ে শুয়ে সুহার সঙ্গে কাটানো মধুর কিছু সময়ের স্মৃতিচারণ করতে মন উঠে পড়ে লেগেছে।
-“এই উল্লাসী? উঠো। উঠে দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি।”
মেসবাহর অনুপস্থিতিতে খানিকক্ষণ সেভাবেই কাটানোর পর চোখজোড়া মেলে চারপাশটায় নজর দিল উল্লাসী। এবং প্রায় সাথেসাথেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো তার। তার স্বামী তাকে ডাকছিল, অথচ সে তার কথার অবাধ্য হয়ে নিঃশ্চিন্তায় সেভাবেই পড়ে রয়েছিল? তার এ কাজের ফলে উনি কী অসন্তোষ হবেন? আর অসন্তোষ হলেই বা কী করবেন? বকবেন নাকি মারবেন? আঁতকে উঠা মন নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো উল্লাসী। মেঝেতে বিছানো চাদর এবং বালিশ উঠিয়ে শাড়ি গায়ে জড়াতেই ঘরে আগমন ঘটলো মোরশেদা বেগমের। একনজরে ছেলের বউকে আদ্যোপান্ত দেখে তিনি বললেন,
-“মেসবাহ তোমার সঙ্গে কোনো বাজে ব্যবহার করেছে কী?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল উল্লাসী। ঢোক চেপে ধীর গলায় বললো,
-“উহু…”
অস্থির মনে শান্তি ফিরে পেলেন মোরশেদা বেগম। এগিয়ে এসে উল্লাসীর চুলে হাত রেখে জানতে চাইলেন,
-“গোছল দাও নি?”
-“উহু…”
-“কেনো? তেমন কিছু কী হয় নি?”
মোরশেদা বেগমের ছোঁড়া প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না উল্লাসী। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে হাতের নখ কচলাতে শুরু করতেই ওপাশ থেকে মোরশেদা বেগম আবারও বললেন,
-“পাক পবিত্রতা আল্লাহর নেয়ামতের অংশ। এসব করার পর সবসময় গোছল করে নাপাক শরীর পবিত্র করে নিবা। বুঝছো?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই তার শাড়ির দিকে নজর দিলেন মোরশেদা বেগম। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
-“শাড়ি পড়তে জানো না?”
-“উহু…”
-“সমস্যা নেই। তুমি গোছলের জন্য ঢোকো। আমি অর্পাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ.. কলা পাতা রঙের শাড়িটা পড়বে। মেসবাহর পছন্দের রঙ ওইটা।”
মিষ্টি এক সকাল। চারিপাশ থেকে বেয়ে আসা হিমেল হাওয়া, নরম দু’টুকরো রোদ, আশপাশের সজীব করা প্রকৃতি, সবুজে ঘেড়া গাছগাছালীর ডালে বসে নির্বিকারভাবে ডেকে যাওয়া পাখির সুমধুর কন্ঠ… সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। মুগ্ধতায় মন ভরে উঠার মত পরিবেশ হলেও তা স্পর্শ করতে পারলো না মেসবাহকে। মনের গহীনে ভেসে বেড়ানো মেয়েটির সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই মিল নেই উল্লাসীর। নিজের সহধর্মিণীর বেশে কোনোভাবেই সে বসাতে পারছেনা তাকে। অস্থির লাগছে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের রেলিঙে হাত রাখতেই পেছন থেকে বড় বোন অর্পার গলার স্বর শুনতে পেল মেসবাহ। চাপা গলায় সে কাওকে আদেশ দিয়ে যাচ্ছে, ‘সাঁজ যেনো কোনোভাবেই নষ্ট না হয় এবং মেসবাহ যা বলবে সবটাই চুপচাপ শুনে তা মেনে নেবে। ঠিকাছে?’ বোনের কথা শুনে আর বুঝে উঠতে বাকি রইলো না ঠিক কাকে আদেশ দিয়ে তার কাছে পাঠানো হচ্ছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে আকাশপানে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পেছন ফিরলো মেসবাহ। তার সম্মুখে দাঁড়ানো উল্লাসীর আপাদমস্তক দেখে গম্ভীরমুখে বললো,
-“কে সাজিয়ে দিয়েছে?”
জবাবে ক্ষীণ গলায় উল্লাসী বললো,
-“অর্পা আপা।”
-“আর সাজবে না ওর কাছ থেকে।”
-“জ্বি, আচ্ছা।”
-“তোমাকে মোটেও ভালো দেখাচ্ছে না এই সাজে। তাছাড়া তোমার বয়সও নয় এখন সেজেগুজে স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার।”
-“আচ্ছা..”
-“যাও.. গিয়ে শাড়ি বদলিয়ে অন্যকিছু পড়ে নাও। শাড়ি পড়ার সময় এখনো হয়নি তোমার। তাছাড়া ক্যারি করারও একটি ব্যাপার আছে। বুঝি না আমি! যে যা বলবে তাই তুমি করবে? একজন শাড়ি পড়তে বলবে আরেকজন সঙ সাজিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেবে.. তাই তুমি মেনে নেবে? একবার আয়নায় তাকিয়ে দেখে নেবে না নিজেকে? এই হচ্ছে বাচ্চা মেয়েদের সমস্যা। নিজস্বতা বলতে এদের কিছুই থাকে না।”
ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না উল্লাসীর। সে নিজেকে দেখেছে আয়নায়। দেখতে তো বাজে দেখাচ্ছিল না তাকে। তারপরও কেনো ভালো লাগলো না উনার? ছোটমা বারবার বলে দিয়েছেন স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে। কিন্তু ঠিক কী করলে, কীভাবে সাজলে স্বামীর মন জোগাতে সফল হবে সে?
(চলবে)
বি দ্রঃ আজকের এই পর্বটি আমার তরফ থেকে দোলন আপুর জন্মদিনের ছোট্ট একটি উপহার। আগাম দিনের পথ চলা শুভ হোক তোমার। সর্বসময় ভালো থেকো দিদারকে নিয়ে।❤
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৫
সকালের খাবারের পাঠ চুকেছে বেশ খানিকক্ষণ। তবে এবাড়ির সকল সদস্যর সাথে একসাথে খেতে বসে সংকোচে কাজ করছিল উল্লাসীর। যার ফলে ইচ্ছে থাকা সত্বেও তেমন কিছু পেটে পুড়তে পারেনি সে। এখন হালকা ক্ষুধাভাব পেলেও কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে একরকম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। এমতবস্থায় শাড়ির আঁচলে টান অনুভব করতেই পিছন ফিরলো উল্লাসী। ছোট্ট বছর চারেকের মত এক বাচ্চা ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে তার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে আসার আগে অবশ্য ছোটমা এবাড়ির আদ্যোপান্ত জানিয়েছে তাকে। ছোট থেকে শুরু করে এবাড়ির প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে দিয়েছে নানান তথ্য। যা ভুল না হলে এমেয়ের নাম মৌমি। জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গেলে বাবার ছায়ায় যে বেড়ে উঠছে ধীরেধীরে। আশ্চর্যজনক হলেও তার নিয়তির সঙ্গে মেয়েটির নিয়তি অনেকটাই মিলে যায়। তবে অমিল শুধু রয়ে যায় একটি জায়গায়। মেয়েটির বাবা মায়ের ছায়া না খুঁজে নিজেই তার মা হয়ে উঠেছে। যা আজকালকার দিনে দূর্লভ এক ব্যাপার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে মৌমিকে কোলে উঠালো উল্লাসী। তারপর ধীরপায়ে এগুলো বিছানার দিকে।
-“তুমিই কী আমার আম্মু?”
মৌমির ছোঁড়া প্রশ্নে একদন্ড ভেবে উল্লাসী জবাব দিল,
-“উহু..”
-“বাবা যে বললো তুমিই আমার আম্মু!”
-“বাবা যেহেতু বলেছে তাহলে হয়তো আমিই তোমার আম্মু।”
-“তাহলে প্রথমে কেনো উহু বললে?”
এপ্রশ্নের ঠিক কি জবাব দেবে তা ভেবে পেল না উল্লাসী! মৌমির চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-“জানো? তোমার মত আমার ছোট্ট একটি বোন আছে?”
-“কী নাম ওর? আর কোথায় ও?”
-“আমাদের বাড়িতে।”
-“অহ বুঝেছি! তাহলে তুমি ওর জন্যই এতদিন আমার কাছে আসোনি.. না?”
বিবর্ণ ঠোঁটে হাসি ফুটলো উল্লাসীর। মৌমির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“জানি না। তবে তোমার বাবা বললে ঠিকাছে।”
-“কেনো? বাবা বললে ঠিক থাকবে কেনো?”
-“কারণ, বড়রা কখনোই মিথ্যে বলেনা। তাছাড়া ছোটমাও বলে দিয়েছে এবাড়ির সকলের কথা মেনে চলতে।”
-“ছোটমা কে?”
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করলো মেসবাহ। তার উপস্থিতিতে চুপসে গেল উল্লাসী। শান্ত বেশে মৌমির হাত চেপে চুপচাপ বসে রইলো সে।
-“মেজ বাবা? ও মেজ বাবা…”
হাতের ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মৌমির দিকে এগিয়ে এল মেসবাহ। একটি চেয়ার টেনে বসে আদুরে গলায় বললো,
-“কী লাগবে আমার আম্মার?”
-“কিচ্ছুটিই না। জানো? আম্মু এতদিন আম্মুর বোনের জন্য আমার কাছে আসেনি? আমার তো ওর জন্য রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে একটি মেরে দাঁত ফেলে দেই।”
মৌমির কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গেল উল্লাসীর। মৌমি তাকে আম্মু বলায় কী রাগ করেছেন উনি? কিন্তু সে নিজে তো কিছু বলেনি। মৌমির বাবাই তো ওকে শিখিয়ে দিয়েছেন!
-“ও বাবা! শিশি পেয়েছে।”
মৌমির কথায় তাড়াহুড়ো করে মেসবাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে হাত বাড়াতেই পিছিয়ে গেল মৌমি। আহ্লাদী গলায় বললো,
-“আম্মুর কাছে শিশি করবো।”
একপলক মেসবাহর দিকে তাকিয়েই মৌমিকে কোলে চাপিয়ে দ্রুতপায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগুলো উল্লাসী। উনি ক্ষেপেছেন। প্রচুর ক্ষেপেছেন। হয়তো সকালের মতো খানিকক্ষণ বকাবকিও করবেন! উল্লাসী সচকিত মনে মৌমিকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেই তার কোল ছেড়ে নেমে একদৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মৌমি। তার যাত্রাপথের দিকে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহ। এরপর গম্ভীর গলায় বললো,
-“আম্মু তোমায় ডাকছে মৌমি?”
ঢোক চেপে হালকা মাথা নেড়ে উল্লাসী সম্মতি জানাতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-“কে শিখিয়েছে?”
-“ওর বাবা…”
ভাইয়ের কথা আসতেই খানিকটা নরম হয়ে এল মেসবাহ। দু’কদম এগিয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে চোখজোড়া বুজে কিছুক্ষণ কাটানোর পর ধীর গলায় সে বললো,
-“শাড়ি এখনো বদলাওনি কেনো? যা তুমি ঠিকঠাক রাখতে পারবে না সেগুলো পড়বেও না। যে কাজে নিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেগুলোই করার চেষ্টা করবে।”
-“জ্বি আচ্ছা।”
-“যাও.. শাড়ি বদলে অন্যকিছু পড়ে নাও।”
-“কিন্তু শাড়ি ছাড়া তো অন্য কিছু নেই আমার।”
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“তোমার বাড়িতে কী পড়েছো তুমি?”
-“সালোয়ার কামিজ।”
-“তাহলে ওগুলোই পড়ো।”
-“কিন্তু ছোটমা তো বলেছে মেয়েদের বিয়ের পর শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়তে হয় না।”
বিরক্ত হলো মেসবাহ। আবারও চোখ বুজে ছোট্ট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে সে বললো,
-“ইললজিক্যাল কথাবার্তা যতসব! চোখে আলো লাগছে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে তুমি এখন যাও। আমি ঘুমোবো কিছুক্ষণ।”
মেসবাহর আদেশ পেয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উল্লাসী। দরজা টেনে লম্বা বারান্দা ধরে সামান্য এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লো সে। ভর দুপুরের চড়া রোদ গায়ে এসে লাগছে তার। তীব্র এই রোদের প্রখরতায় গায়ে জ্বালা ধরলেও নড়লো না উল্লাসী। রাশভারী চোখে তাকিয়ে রইলো উঠানের দিকে। সেখানে ছোট একটি বিড়ালের পেছনে পেছনে দৌড়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে মৌমি। তীব্র রোদে তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে উঠলেও চোখেমুখে তার অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম.. বিছানায় শরীর মেলে জোর গলায় কয়েকবার অনাকে ডেকে উঠলো মুবিন। হঠাৎ করেই মাথাটা ধরেছে। একজন মাথা বানিয়ে দিলে হয়তো আরাম পাওয়া যেত!
-“ডাকছিলে?”
অনার উপস্থিতিতে স্বস্তি ফিরে পেল মুবিন। চোখজোড়া বুজে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
-“একটু মাথাটা টিপে দে। মাথার ব্যথার অসহ্য লাগছে।”
-“মাথা টিপে দিলে তাহলে কী পাবো আমি? বিনামূল্যে আমি কোনো কাজ করিনা।”
-“রাতে ঠান্ডা খাওয়াবো.. যা।”
চোখমুখ কুঁচকে অনা বললো,
-“শুধু ঠান্ডা?”
-“আর কী চাস? দু’দন্ড কাজের কত পারিশ্রমিক চাস তুই?”
-“পারিশ্রমিক বলছো কেন? এগুলো হচ্ছে বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা।”
মুবিনের পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখলো অনা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“এর পরের বার আসতে আমার জন্য সাজুগুজুর জিনিস আনবে মনে করে। এসব বই-পুস্তক আর আনবে না। ওসব কী আমি পড়ি?”
পরম শান্তিতে চোখজোড়া বুজে হালকা হেসে মুবিন বললো,
-“ওসব সাজুগুজুর জিনিস আমায় দ্বারা কেনা হবে না।”
-“এহ! ঠিকই কিনবে একসময়। আজ বোন বলে এসব বলছো। কাল যখন বউ চাইবে তখন কী বলবে?”
-“তোর মতো সাজুনী হবে নাকি আমার বউ!”
-“তো চৈতালির মতো বই পড়ুয়া হবে?”
অনার কথার পিঠে কিছু বললো না মুবিন। নীরবে খানিকক্ষণ কাটানোর পর নরম গলায় বললো,
-“তোর বান্ধবী চলে গেছে?”
-“হ্যাঁ.. একটু আগেই গেছে। জানো, আমার মাঝেমাঝেই মনে হয় ও আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে!”
-“হঠাৎ এমন মনে হবার কী কারণ?”
-“ছোট বেলা থেকেই তো ওকে দেখে আসছি। তাছাড়া ও নিজেও ওদের বাড়ির চেয়ে আমাদের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়। আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি, ভাই। ও কিছু তো একটা নিশ্চিত লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে!”
আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেল মুবিন। মাথার ব্যথা অনেকটাই কমে এসেছে। শুধু মাঝেমাঝে কপালের ডান পাশটায় হালকা ঝিনঝিন করে উঠছে।
রাতে সকলে একসাথে খেতে বসে আলাউদ্দীন শেখ কোরবানির গরুর কথা উঠালেন। সকলের সাথে আলোচনা করে মাজহারুলের উপর গরু কেনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি মেসবাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“বাপজান ঈদের পর কয়দিন আছাও?”
-“একদিন আছি।”
-“অহ.. তা বৌমারে নিতেছো তো?”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
-“জ্বি না, আব্বা।”
-“কেন?”
ঠিক কি উত্তর দেবে না ভেবে পেল না মেসবাহ। শিক্ষিত এক লোক বাল্যবিবাহর মত নিকৃষ্ট এক কাজ করেছে! তার সোসাইটির লোকেরা একাজ কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। সকলের চোখে তাকে নিয়ে যে সম্মান ছিল তা হারিয়ে ফেলবে সে। তাকে নিয়ে নানান সমালোচনা হবে, হাসাহাসি করবে সকলে। এমনকি তার পেশাগত দিকেও এর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া তার স্ট্যাটাস, পজিশন.. কোনোএকটার সাথেও যায় না উল্লাসী। আর না উল্লাসী সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। আজ বাচ্চা একটি মেয়ের জায়গায় প্রাপ্ত বয়স্ক কোনো গ্রাম্য মেয়ে হলেও তার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা রাখতো মেসবাহ। নিজেই তাকে তৈরি করে নিত নিজের চাহিদা মতো। কিন্তু উল্লাসী.. বাচ্চা একটি মেয়ে। তার কাছে কী প্রত্যাশা রাখবে সে? প্রত্যাশার মানেই হয়তো জানা নেই তার।
-“তুমি থাকবা ওইখানে আর বউ থাকবো এইখানে। তাইলে আর প্রেম পিরিত কেমনে হইবো তোমাগো মাঝে? দেখা যাইবো কিছুদিন পর খবর আসবো হাজীসাবের মেজ বউ কোন পোলার লগে ভাগছে। খুব সুন্দর কথা হইবো.. না?”
ভাতের প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে মেসবাহ তাকালো তার বাবার দিকে। ক্ষীণ গলায় বললো,
-“আব্বা, এবিষয়ে আমাকে জোর করবেন না। আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করে আমি বিয়েটা করেছি। কিন্তু তাই বলে…”
-“তুমি যা বললা আরেকবার বলো! তোমার সাহস হয় কেমনে এই কথা মুখ দিয়া বাইর করার?”
আলাউদ্দিন শেখের মেজাজের সাথেসাথে তার গলার স্বর বাড়তে দেখে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মাজহারুল। মুখে কথা আসলেও কিছুই বললো না সে। নির্বাক শ্রোতা বেশে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মেসবাহর দিকে।
-“তোমারে আবারও আমি জিগাইতেছি। তুমি বৌমারে নিবা কী নিবা না?”
-“আব্বা, প্লিজ।”
-“এই শেষবার ভালো করে জিগাইতেছি। তারপর যা হইবো তার জন্য শুধু দায়ী হইবা তুমি। কথা খানা মাথায় রাইখা উত্তর দিও। তুমি তোমার লগে বৌমারে নিবা?”
-“জ্বি.. নিব।”
লম্বা একটি দম ছেড়ে চোখজোড়া বুজে মেসবাহ কথাটি বলেই উঠে পড়লো টেবিল ছেড়ে। কিছুসময় তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল মোরশেদা বেগম। ইশারায় তাকে মেসবাহর পিছুপিছু যেতে আদেশ করলেও তা বোঝায় ব্যর্থ হলো উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই পাশ থেকে অর্পা ধীর গলায় মেসবাহর পিছুপিছু তাকে যাবার কথা বলতেই খাবার ফেলে উঠে পড়লো সে। দ্রুত পায়ে ছুটলো সেদিকে।
-“কী সমস্যা? তুমি কেনো এখানে এসেছো? তোমাকে আসতে বলেছি আমি? তাহলে কেনো এসেছো? নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তুমিও কুকুরের মতো ওদের কথা শুনে নাচতে নাচতে এখানে চলে এসেছো! নিজস্বতা বলতে কিছু নেই তোমার? অবশ্য তোমার কীভাবে থাকবে যেখানে আমার নিজেরই নেই! এবাড়িতে কারো সেই অধিকার নেই। দিস হাউজ ইজ রুইননিং মাই লাইফ।”
রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে মেসবাহর। খুবই ঠান্ডা মাথার একজন মানুষ তিনি। সকলের সঙ্গে ঠান্ডা মেজাজেই কথা বলে অভ্যস্ত। তাছাড়া মাঝেমাঝে কারো উপর রেগে গেলেও তা শুধু গম্ভীরমুখে কথা বলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে আজ নিজের ভেতরের এই ক্রোধকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না মেসবাহ। হাতের পাশের ফুলদানিটি ছুঁড়ে ফেলে আবারও চেচিয়ে উঠলো সে। ক্ষিপ্র গলায় বললো,
-“বের হও। এখনি বের হও। তোমার চেহারাও দেখতে চাই না আমি। বের হও বলছি!”
আতংকে কাঁপা বুক নিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল উল্লাসী। প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার। কেনো শুধুশুধু বকেন উনি? সে নিজে তো কিছু বলেনি। যা বলেছেন উনার বাবা বলেছেন। উনাকে বকেছেন। এখানে ঠিক তার দোষ কোথায়? চোখভর্তি জল নিয়ে দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো উল্লাসী। আজ অনেকদিন পর মাকে খুব করে মনে পড়ছে। মায়ের কোলে মাথা গুঁজে অঝোর ধারায় কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একটিবার কী আসবে তার মা মেয়ের আবদার পূরণ করতে?
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৬
বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে পদার্পণের দিন দশেকের মতো হয়ে এসেছে উল্লাসীর। এর মাঝে না বাবার বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এসেছে তাকে আর না সে নিজে গিয়েছে সেখানে। ছোট্ট বোনটির জন্য মন সবসময় আকুপাকু করলেও কাউকে কিচ্ছুটি বলার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। তবে আজ তো ঈদ। মিলনের দিন। সকল কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠার দিন। ঈদের মত একটি দিনেও কী তাহলে সে দেখা পাবে না সুহার? সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই বাড়িতে কাটানো ঈদের সকালগুলো খুব করে মনে পড়ছে। সকল বাঁধা অতিক্রম করে একটিবার দৌড়ে নিজের সেই কুটিরে যেতে মন টানছে৷ সে না হয় এবাড়ির মানুষজনকে সাহস করে কিছু বলে না উঠার ফলে যেতে পারছে না বাড়িতে। কিন্তু বাবা? সে কেনো এখানে আসেনা একটিবার তাকে দেখতে? তার বুঝি মনে পড়ে না তার এই মেয়েকে! একটিবার বুকে আঁগলে নিতে ইচ্ছে করেনা? তাছাড়া খুব বেশি ভুল না হলে কালই তাকে স্বামীর সঙ্গে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। তাহলে কী শহরে যাবার আগে সুহা, বাবা.. এদের সঙ্গে দেখা হবে না তার? উত্তরে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল উল্লাসীর। খিচুড়ির চুলোর আঁচ কমিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে পা বাড়ালো উঠোনের দিকে। উঠোনের দক্ষিণ দিকে গরুর মাংস নিয়ে বসেছেন মোরশেদা বেগম সহ কিছু মহিলা। মোরশেদা বেগম তদারকি করে যাচ্ছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন মহিলাগণ। কেউবা মাংস কেটে কেটে ছোট টুকরো করে যাচ্ছেন কেউবা ভূরি পরিষ্কারে লেগে আছেন। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর শাশুড়ির দিকে এগুলো উল্লাসী৷ পাশে বসে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“খিচুড়ি হয়ে গেছে।”
-“মাংস রান্নার জন্য তাইলে পেঁয়াজ মরিচ কেঁটে নাও। এই রহিমা, এক পাতিল মাংস ধুয়ে রান্নাঘরে দিয়া আসো তো।”
মোরশেদা বেগমের আদেশ পেয়ে বয়স্ক এক মহিলা কলাপাতার উপর থেকে কিছু মাংস বড়সড় এক পাতিলে উঠিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরের দিকে। তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটি দম ফেললো উল্লাসী। তারপর আমতাআমতা করে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,
-“আমি কী আজ বাবার বাড়িতে যেতে পারি?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মোরশেদা বেগমের। ছেলের বউয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললেন,
-“এই কথা আমারে বলছো ঠিকাছে। তোমার শ্বশুরের কানে যেন এই কথা না যায়!”
ঢোক গিলে মাটির দিকে তাকিয়ে উল্লাসী মোরশেদা বেগমের কথায় সম্মতি জানাতেই তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-“স্বামীর ঘরই মেয়েদের সব। একবার বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি আসার পর ভুলেও মুখের ফাঁক দিয়ে বাবার বাড়ির নাম নেয়া বারণ। আর এ নিষেধ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার কুরআনে করেছেন। বুঝেছো?”
-“হু..”
-“সর্ব সময় মাথায় রাখবা তুমি হাজী বাড়ির বউ। তোমার যেন ধ্যানজ্ঞান চিন্তাভাবনা এখন সবটাই এই হাজী বাড়িকে ঘিরেই হয়৷”
-“জ্বি, আচ্ছা..”
-“আর সবসময় এটা মাথায় রাখবা স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একথা তার কুরআনে বলেছেন। স্বামী যা আদেশ দেবে চোখবুঁজে তা পালন করবা। কোনোরকম টুশব্দ তার বিপরীতে করবা না। এতে স্বামী তো নারাজ হবেই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিজেও নারাজ হবে। বুঝলা কিছু?”
-“হু..”
-“তাইলে এখন যাও। মাংস তাড়াতাড়ি তুলে দাও। তোমার শ্বশুর নামায পড়ে আসলো হয়তো!”
মোরশেদা বেগমের আদেশ অনুযায়ী বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়াতেই তার ডাকে আবারও ফিরে এল উল্লাসী। নিরব দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে বললো,
-“বলুন..”
-“শহরে যাচ্ছো.. ভালো কথা। তবে বাইরে বেরুলে ঢেকে ঢুকে চলবা। খোলামেলা যা হবা সব স্বামীর সামনে। পরপুরুষদের সামনে শরীর দেখিয়ে চলা মেয়েরাই বেশ্যা। তাছাড়া…”
মোরশেদা বেগমের কথার মাঝে তাকে থামিয়ে দিল চৈতালি। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে সে বললো,
-“এসব কে বলেছে তোমাকে, চাচী? কুরআনে এসবের উল্লেখ আছে?”
-“তোর চাচাজান বলছে। কেন? তোর কী উনার কথায় সন্দেহ আছে?”
-“সন্দেহ না তবে চাচাজানের জানায় তাহলে ভুল আছে। এমন কিছুই কুরআনে লেখা নেই যাতে একজন মেয়ের তার পিতামাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। বরং কুরআনে লেখা আছে রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাছাড়া তুমি যে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, কথাটি বললে এটা ভুল। সঠিক হচ্ছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তবে একটি মেয়ের জান্নাতে প্রবেশের জন্য যে চারটি জিনিস জরুরী তার মাঝে একটি হলো স্বামীর সন্তুষ্টি। স্বামীকে সম্মান করা প্রতিটি নারীর কর্তব্য।”
-“ওই একই তো হলো। ঘুরেফিরে বেহেশত যাওয়া তো স্বামীর উপরই নির্ভরশীল।”
-“২৫ শতাংশ.. বাদবাকি ৭৫ তো নয়।”
-“ধুর.. যা তো তুই। তুই কী তোর চাচাজানের চেয়ে বেশি জানোস? উনি হজ্ব করে আসছেন।”
-“হজ্ব করে আসলেই সবাই হাজী হয় না গো, চাচী।”
বলেই জিহবা কামড়ে মোরশেদা বেগমের দিকে তাকালো চৈতালি। প্রচুর ক্ষেপেছেন উনি। তবে আশেপাশে থাকা মহিলাদের জন্য তা মুখে প্রকাশ করতে না পারলেও তার বড়বড় দুটো চোখ দিয়ে ঠিকই গিলে ফেলছেন তাকে। সেদিক থেকে দ্রুত নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল চৈতালি। মেয়েটি অবুঝ বেশে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। এত অবুঝ মেয়েও বুঝি পৃথিবীর বুকে আছে! মেয়েটির বয়স খুব বেশি না হলেও কমও তো নয়। সংসার জগৎ নিয়ে এসব সাধারণ কথা বোঝার মত বয়স তার হয়েছে। সে নিজেও এবয়সী থাকতেই প্রেম শুরু করেছিল মুবিনের সঙ্গে। সেসময়ে খুব বুঝতো সে এসব। তবে তার মতোই কেনো হতে হবে উল্লাসীকে? সকলের বিকাস শক্তি তো এক নয়। তাছাড়া এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার মত তার হাতে বহু সময় ছিল। সেসময় টুকু তো উল্লাসীর নাও থাকতে পারে! সে হয়তো ঘোরপ্যাঁচযুক্ত এই জগত নিয়ে কখনো ভাবেই নি! তাছাড়া মেয়েটি তো সৎমার কাছে থেকে মানুষ। প্রতিবন্ধী এক বোনও রয়েছে। বাস্তব হোক বা কল্পনা.. এসব নিয়ে ভাবার তার সময় কোথায়? হঠাৎ চৈতালির মনে পড়লো শিশুর পরিচর্যা নামের বইটির কথা। যার মলাটে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে, প্রতিটি শিশুর মানসিক বিকাসে তার বাবামায়ের ভালোবাসা এবং সান্নিধ্যের বিকল্প নেই। বইটি গতবছর মুবিন দিয়েছিল তাকে। এবং বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিল, বাবুর মাকে আদর্শ মা হবার পথ খুঁজে দিল বাবুর বাবা। যা দেখে দুদিন যাবৎ লজ্জায় মুবিনের সামনে যেতে পারেনি সে। এত বেশি অসভ্য কেনো মুবিন?
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল মুবিন। দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। সারাদিনের খাটাখাটির পর এর মাঝে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ধীরে সদর দরজা খুলে চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। সাড়ে দশটার সময় বাড়ির পেছনের বাগানে তাকে উপস্থিত থাকতে বলেছে চৈতালি। নানান ঝামেলার কারণে সারাদিনে চোখাচোখি হলেও ভালোভাবে একটিবারও দেখা হয়নি দুজনের। কথা তো দূরস্থান!
উড়ুউড়ু মনে বাগানে পায়চারী করছিলো মুবিন। হঠাৎ পাশ থেকে চৈতালির মধুর গলার স্বর কানে এল তার। অদ্ভুত এক মায়া আছে এই মেয়ের গলায়। একবার শুনলে তার ঘোর কানে লেগে থাকে বহুদিন…
-“নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…
জ্বালায়ে চান্দের বাতি
আমি জেগে রব সারা-রাতি গো।
কব কথা শিশিরের সনে রে ভোমরা।
নিশিতে যাইও ফুলবনে…”
চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠা চৈতালির মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম এগুলো মুবিন। তার কোমর চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে বললো,
-“অসাধারণ… বিয়ের পর প্রতি রাতে আমি, তুমি, আমাদের ভালোবাসাবাসি এবং তোমার এই গান… ভাবলেই মন চায় তোমাকে আজই নিজের করে নেই!”
-“তো নাও না! কারো বারন আছে?”
-“অধৈর্য হয়ও না বালিকা। সবুরে মেওয়া ফলে।”
-“কচু ফলে.. দেখি, চশমাখানা খোলো তো।”
-“কেনো?”
নিজেই মুবিনের চশমা খুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চৈতালি বললো,
-“এবার চোখজোড়া বন্ধ করো।”
সময় নিল না মুবিন। পরম সুখে চোখজোড়া বুজতেই পা উঁচিয়ে তার চোখে উপর নিজের ঠোঁটজোড়া ঠেকালো চৈতালি। নিজের ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে দিল মুবিনের চোখজোড়ায়।
ট্রেন ছেড়েছে অনেক্ক্ষণ। ফার্স্ট ক্লাসের একটা কামড়া বুক করেছে মেসবাহ। সেখানে অস্থির মনে পায়চারী করে যাচ্ছে সে। বাবার কথামতো উল্লাসীকে সাথে নিয়ে এলেও অস্থির মন কোনোভাবেই শান্ত হচ্ছে না তার। কয়েক দন্ড চুপচাপ বেডে বসে পাশে বসা উল্লাসীর উদ্দেশ্যে মেসবাহ বললো,
-“ঢাকায় পৌছুতে আরও পাঁচ ঘন্টা লাগবে। খারাপ লাগছেনা তো তোমার?”
-“না..”
-“এই প্রথম ট্রেনে চড়লে?”
-“উহু.. ছোটমার বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার ট্রেনে।”
ছোটমা কে? প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না মেসবাহ। অযথা কথাবার্তা না চালিয়ে আসল কথা বলা উচিৎ ভেবে ধীর গলায় বললো,
-“আমি একজন ডক্টর। সোসাইটিতে আমার সম্মান রয়েছে। আলাদা জায়গা রয়েছে। আর আমি চাইনা তা নষ্ট হোক।”
থামলো মেসবাহ। লম্বা একটি দম ছেড়ে গলা খানিকটা গম্ভীর করে আবারও বললো,
-“আমাদের বিয়ের ব্যপারটা আমরা দুজনেই গোপন রাখবো। যদি ওখানের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তুমি তার জবাব দেবে না। মোটকথা তুমি ফ্ল্যাট ছেড়ে কখনো বেরুবেই না। আশেপাশের সকলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে।”
-“আচ্ছা..”
-“আর আমি তোমাকে আমার দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিব। আমার খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হয় বলে আম্মা গ্রাম থেকে তোমাকে পাঠিয়েছে রান্নাবান্না করার জন্য। তোমার এতে কোনো সমস্যা আছে?”
-“উহু…”
-“থ্যাংকস…”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। যদিওবা তার জানা নেই ঠিক ক’দিন এভাবে সকলের কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে সে। তবুও আগবাড়িয়ে নিজের এই জঘন্য অপরাধের কথা কাওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো সে। এতে শুধু তার সম্মানহানি নয় সাথে চরিত্র নিয়েও নানান বাজে কথা শুনতে হবে তার। যা একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে মোটেও কাম্য নয়। অপরদিকে শাশুড়ির কথামতো স্বামীর কথার বিপরীতে টু শব্দ করলো না উল্লাসী। উদাস মনে সে তাকিয়ে রইলো ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার ফেলে আসা গ্রামটির জন্য। সুহার জন্য, বাবার জন্য। আর কী কখনোই সে দেখা পাবে না তাদের?
(চলবে)