এসো_করো_স্নান-07,08

0
359

#এসো_করো_স্নান-07,08
রোকেয়া পপি।
(৭ম পর্ব)

কলিং বেল টিপ দিয়ে জয়ী দাঁড়িয়ে আছে। জয়ীর হাতে তরতাজা দশটা গোলাপ ফুল। ফুল থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে।

এ বাড়িতে এই প্রথম আসা ওর।
রাতে রাজুকে এতোবার ফোন দেওয়ার পরও যখন ধরছিলো না, টেনশনে জয়ী সারারাত ছটফট করেছে। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

সকালে কোন রকম নাস্তা মুখে দিয়েই ছুটে এসেছে রাজুদের বাসায়।

এখন কেমন যেন সংকোচ বোধ করছে। এতো সকালে না আসলেও হতো। সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছে এখনো। তাই দরোজা খুলছে না।

ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে জয়ী আবারো বেল বাজালো।
এবার বুড়ো মতো এক ভদ্রলোক এসে দরোজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলো কাকে চাই ?

বুড়োর চেহারার মধ্যে একটা সুখী সুখী ভাব। সাদা ফকফকা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিতে চেহারায় একটা পরিপাটি সুখী সুখী ভাব চলে এসেছে।
মাথার চুল গুলো ও সব সাদা ফকফকা।

দাড়িতে লাল মেহেদী দেওয়া।
চেহারায় একটা পবিত্র পবিত্র ভাব আছে।
দেখলেই সন্মাণ করতে ইচ্ছে করে।

আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললাম আমি জয়ী চাচা জান।
রাজুর কাছে এসেছি।
ওকে কি একটু ডেকে দেওয়া যাবে?

অবশ্যই যাবে মা।
তুমি ভেতরে এসে বসো। খোকার সারা রাত জ্বর ছিল। এখন ওর মা মাথায় পানি ঢালছে।
তা তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি।
ঠিক চিনতে পারলাম না।

চাচাজান আমি চেয়ারম্যান শরাফত আলীর মেয়ে।
আমার নাম জয়ী।

ওহ তুমি জয়ী।
কি সৌভাগ্য, কি সৌভাগ্য আমার।
রাজুর মা এদিকে এসো। ধদেখে যাও গরীবের ঘরে কে এসেছে।

চাচাজান আপনি ব্যাস্ত হবেন না।

তা বললে কি হয়। তোমাকে কতো ছোট দেখেছি।
সেই তুমি কতো বড়ো হয়ে গেছো।
তুমি বসো মা। আমি দেখি বাড়িতে মিষ্টি আছে কিনা।
প্রথম এলে , তোমাকে মিষ্টি মুখ না করে তো ছাড়ছি না।
তুমি বসো আমি বাজার থেকে ঘুরে আসি।
বুড়ো বুড়ি দুজন মানুষ থাকি। ঘরে তো মিষ্টি থাকার কথাও না।

চাচাজান তার কোন দরকার নেই। তাছাড়া আমি মিষ্টি খেতে তেমন পছন্দ ও করি না।
আমি একটু রাজু ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই।
আমাকে একটু ভাইয়ার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।

এসো মা, তবে ভেতরে এসো। রাজু তো জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল সারারাত। বৃষ্টির পানি তার সহ্য হয় না। তবুও কাল বৃষ্টি তে ভিজে বাসায় আসছে।
তোমার চাচি আম্মা ভোরে নামাজ পড়তে উঠে দেখে রাজু গোঙাচ্ছে। সেই তখন থেকে চলছে মাথায় পানি ঢালা।

ও কি আর উঠে আসতে পারবে। তারচেয়ে তুমি ওর রুমে চলো।

জয়ীকে দেখে রাজুর মা মাথায় পানি দেয়া বন্ধ করে চুল মুছতে মুছতে বললো, তুমি বসো মা।
আমি তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি।
তুমি রাজুর সাথে কথা বলো। আমি চা, নাস্তা নিয়ে আসি।

আমার জন্য ব্যাস্ত হবেন না। আমি বাসা থেকে খেয়েই বের হয়েছি। আমি থাকব কিছুক্ষণ।

রাজু জয়ীকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করছিল।

জয়ী থামিয়ে দিলো।
তোমাকে উঠতে হবে না রাজু ভাইয়া। তুমি শুয়ে থাকো। এমন জ্বর বাধালে কিভাবে?

রাজু শুকনো হেসে বললো, তুমি একটু বসো।
আমি ফ্রেস হয়ে আসি।

জয়ী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রাজুর রুমটা।
ছোট্ট একটা পরিপাটি রুম। নীল আর কমলা দুই রঙের পর্দা। বিছানার চাদর টাও নীল।
বেশ ভালো লাগছে দেখতে। রঙটা গাঢ়, তবুও চোখে লাগছে না। সবকিছু তে রুচির ছাপ আছে।

সামান্য অসস্তি বোধ হচ্ছে।
কারণ যে রুমটায় জয়ী বসে আছে, এটা রাজুর শোবার ঘর। খুবই ব্যাক্তিগত একটা রুম।
তাছাড়া রাজু এখন ওয়াশরুমে।
যদিও ভেতর থেকে দরোজা বন্ধ। তারপরও ওদিকে তাকাতেও কেমন যেন অসস্তি হচ্ছে।

রাজু তাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিছানায় এসে বসা মাত্র জয়ী বললো, তোমার শরীরতো অনেক খারাপ করছে?

রাজু লাজুক হেসে বললো, রাতে সামান্য জ্বরের মতো এসেছিল— এখন শরীর ফিট। মাথায় পানি দেওয়ার পর হালকা ফুরফুরে লাগছে।

আসলে ঘটনা কিন্তু তা নয়। কিছুক্ষণ আগেও তার খুবই খারাপ লাগছিল। বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছিলো না। জয়ীকে দেখার পর থেকে সত্যি সত্যি ভালো লাগছে। মাথায় চাপ দিয়ে যে যন্ত্রণাটা বসে ছিলো সেটাও নেই। শরীরে এখন সত্যি সত্যি ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। জয়ীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে গল্প করবে, এটা ভাবতেই রাজুর অন্য রকম ভালো লাগছে। ভালো লাগাটা এত তীব্র যে বুকে সামান্য চিনচিনে ব্যথা বোধও করছে।
জয়ী এভাবে তাকে দেখতে বাসায় চলে আসবে, তা সে কল্পনা ও করেনি।
ইচ্ছে করছে সারাদিনের জন্য যদি জয়ীকে রেখে দেওয়া যেতো। সেই আগের মত জয়ী ননস্টপ কথা বলবে, আর রাজু মুগ্ধ হয়ে শুনবে।

জয়ী কে দেখে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটা যথেষ্টই আনন্দের ব্যাপার।

দুজনেই দুজনের দিকে কতোক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তারা তা কেউ জানে না।

রাজুর মা চা নাস্তা নিয়ে যখন দরোজায় নক করলো, দু’জনেই কেঁপে উঠলো।

রাজুর মা সাইড টেবিল টেনে নাস্তা রাখতে রাখতে বললো, তুমি কতো বড়ো ঘরের মেয়ে আমাদের সাথে আলু, ডাল দিয়ে পরোটা খেতে পারবে তো মা?
ঘরে ডিম ও নেই।
ডিম থাকলে তোমাকে একটা পোচ করে দিতাম।

জয়ী খুবই অপ্রস্তুত হয়ে বললো, চাচি আম্মা আমার সব রকম খাবার খেয়ে অভ্যাস আছে।
আমার জন্য ভাববেন না। তাছাড়া সকালে নাস্তা খেয়েই বের হয়েছি।
আমি শুধু চা খাবো।

তাই কি হয় মা।
প্রথম এলে। তোমার চাচাজি তো বাজারে গেলেন, মিষ্টি আনতে। এতো সকালে তো কোন দোকান খোলার কথা নয়। তারপরও গেলেন।
ওনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সাত সকালে তার বাসায় মেহমান আসবে, মিষ্টির দোকানদার সেটা জানেন।
সাত সকালে ওনার জন্য মিষ্টি বানিয়ে অপেক্ষা করছেন।

ঠিক আছে তোমরা নাস্তা খাও।
ফ্লাক্সে চা আছে।
খেও।

আর যাওয়ার আগে আমার সাথে একটু দেখা করে যেও। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
আমি আমার রুমে গেলাম মা।
তুমি মনে করে দেখা করে যেও।

জয়ী সেদিন ঘন্টা খানেকের মতো রাজুদের বাসায় ছিলো।
চলে আসার সময় রাজু খুব করে চাইছিলো জয়ীকে এগিয়ে দিতে।
কিন্তু জয়ী রাজি হয়নি।

রাজু খেয়াল করেছে, জয়ী এখানে আসার পর থেকেই চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে গেছে।
কিন্তু যাওয়ার সময় মুখটা কেমন যেন একটা মলিন ভাব।
ও ধরেই নিয়েছে যে, বিদায় বেলায় জয়ীর মন খারাপ হয়ে গেছে।

কিন্তু মূল ঘটনা ভিন্ন।
জয়ী যখন রাজুর মায়ের সাথে দেখা করতে তার রুমে গেলো।
তখন উনি মুখে হাসি ফুটিয়ে খুব আদর করে বললেন, মা জয়ী কিছু মনে করো না।
আমি তোমাকে আজ কয়েকটা কঠিন কথা বলবো।
তুমি মন দিয়ে শুনবে।

জয়ী মাথা নিচু করে বললো, জি চাচি আম্মা আমি মন দিয়ে শুনবো। আপনি বলেন।

তোমার….

চলবে…….

#এসো_করো_স্নান_(৮ম পর্ব)
রোকেয়া পপি।

জয়ী যখন রাজুর মায়ের সাথে দেখা করতে তার রুমে গেলো।
তখন উনি মুখে হাসি ফুটিয়ে খুব আদর করে বললেন, মা জয়ী কিছু মনে করো না।
আমি তোমাকে আজ কয়েকটা কঠিন কথা বলবো।
তুমি মন দিয়ে শুনবে।

জয়ী মাথা নিচু করে বললো,জি চাচি আম্মা আমি মন দিয়ে শুনবো। আপনি বলেন।

কিছু মনে করো না মা। শুনতে খারাপ লাগলেও আজ আমাকে বলতেই হবে কথা গুলো। তাই কোন ভনিতা না করে সরাসরিই বলছি।

তোমার বাবা একবার রাজুর সাথে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, সেই ঘটনার জের রাজু এখনো টানছে।
আমি তোমাদের ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতাম।
যদিও আমাকে কেউ বলেনি।
তারপরও মায়েদের সবকিছু জানতে হয়, সব খবর রাখতে হয়।

তোমার বাবার যে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তি আছে
আমরা কখনোই পারবো না তোমাদের সাথে। সে চেষ্টা ও আমরা করবো না।
ডাঙায় বসে তো আর কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যায় না। তাই না?

আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে শুধু তোমার আর তোমার বাবার কারণে।
অনেক কষ্টে আমার ছেলেটা যেই মুহুর্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি আবার নতুন করে ফিরে এসে আমার ছেলের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছো।
আমি মা হয়ে তোমার কাছে আমার ছেলেটাকে হাত জোর করে ভিক্ষা চাইছি।
তুমি আমার ছেলেটাকে নিয়ে খেলো না মা।

আমি জানি আমার কথাগুলো শুনতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি নিরুপায় মা।

তোমার বাবাকে কোন বিশ্বাস নাই। যে কোন সময় আবার নতুন করে রাজুর পেছনে লাগতে পারে। এমনিতেই উনি আমার রাজুর জীবন টাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছে।
আমি চাই না আমার ছেলেটা আবার নতুন করে কষ্ট পাক।

তাই আমি তোমাদের দুজনের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে তোমার কাছে হাতজোড় করছি, তুমি এভাবে যখন তখন আমাদের বাসায় এসো না।
রাজুর সাথে এভাবে মেলামেশা করার ও কোন দরকার নেই। আমার এই একটা মাত্র ছেলে।
তোমার জন্য একবার হারিয়েও ফিরে পেয়েছি।
এবার ছেলেটাকে হারালে আমি আর বাঁচবো না।

জয়ীর চোখ দুটো ছলছল করছে।
গলার কাছে কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইছে। ওর ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে বের হয়ে যেতে।
কিন্তু মানুষ যা চায়, তা সব সময় করতে পারে না।
ও ধরা গলায় বললো,
চাচী আম্মা আমার মনে থাকবে আপনার কথা গুলো।
আমি চেষ্টা করবো রাজুকে এড়িয়ে চলতে।
আমি এখন আসি। জয়ী যখন দরোজার পর্দা সরিয়ে বের হয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে, পেছন থেকে রাজুর মা বলে উঠলো,

আরেকটা কথা মা।
তোমার সাথে আমার যে কথা গুলো হলো, তা যেন রাজু কোনভাবেই জানতে না পারে। তুমি এখন আসতে পারো আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।

জয়ী পেছন না ফিরে সেখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে আলতো করে চোখের পানি মুছে রাজুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে
ঠিক সেই মুহূর্তে রাজুর বাবা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বললো, কি ব্যাপার মা, তুমি চলে যাচ্ছো কেন?

বসো মা।
আমি তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি।
তোমার উছিলায় আজ না হয় আমরাও তোমার সাথে একটু মিষ্টি খাই।

এতো দরদ দিয়ে কথা অনেক দিন জয়ী শুনেনি।
জয়ীর চোখ সাথে সাথে পানিতে ভরে গেল।
ও ধরা গলায় বললো, আরেকদিন এসে আপনার সাথে খাবো বাবা।
আজ আমার একটু জরুরী কাজ আছে।
বলেই জয়ী এতো জোরে ছুটে বের হলো যে দরোজার কপাটে বাড়ি খেয়ে কপাল ফুলিয় ফেললো।

সামনে একটা রিকশা পাওয়া মাত্র এই যাবে বলে উঠে বসলো।
রিকশা চলছে
জয়ীর প্রচন্ড রকম মন খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে। বুকের ভেতর যে কষ্ট দলা পাকিয়ে ভার হয়ে আছে, তা চিৎকার করে কান্না করে বের করে দিতে ইচ্ছে করছে।
ও না চাইলেও ওর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।

রিকশা চালক ঘুরে ঘুরে দেখছে।
একটা সময় না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, আম্মাজান আপনার কি হইছে?
এভাবে কান্না করতাছেন ক্যান?

জয়ী চোখের পানি মুছে জোরে বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে বললো, কিছু হয়নি চাচা। চোখে ময়লা পরছে।
আপনি বারবার পেছনে না ঘুরে ঠিকমতো চালান।
যে কোন সময় এক্সিডেন্ট হতে পারে।

চাচা তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো, এক্সিডেন্ট হইবো না আম্মাজান। তেইশ বছর ধইরা এই লাইনে আছি।
কোই যাইবেন আম্মাজান?
কিছুই তো বললেন না?

চেয়ারম্যান বাড়ি।

ও আপনি চেয়ারম্যান বাড়ির মাইয়া?
আগে কইবেন না।
আপনি টাইট হইয়া বহেন।
আমি উড়াল পঙ্খির ন্যায় উড়াইয়া লইয়া যামু।

চাচা আপনাকে উড়াল পঙ্খির মতো উড়ায় নিয়ে যেতে হবে না।
আমার কোন তাড়া নেই। আপনি আপনার মত ধীরেসুস্থে চালান।

জয়ী ভেবেছিলো সকালে এভাবে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়াতে বাসায় সবাই খুব চিন্তা করছে।
বাবা হয়তো হৈচৈ করে বাড়ি গরম করে ফেলেছেন।

কিন্তু বাসায় এসে দেখে সবকিছু স্বাভাবিক।
কোথাও কোন অসামঞ্জস্য নেই।

প্রতিদিনের মত বড়ো ভাবি (মিলি) রান্না ঘরে বসে কি কি রান্না হবে সেই হুকুম দিচ্ছে।
তার জন্য নিদৃষ্ট একটি কাঠের গদি আলা চেয়ার আছে রান্না ঘরে। সকালে নাস্তা খেয়েই সে এখানে এসে বসে।
এরপর চলে তার রান্নর তদারকি।

দুপুরে রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। তিনি নিজ হাতে রান্না না করলেও সবকিছু তার চোখের সামনেই হতে হয়।

কতোটুকু তেল দেওয়া হবে তরকারিতে, মাছ ভাজা হবে, না কাচা রান্না হবে। মাছের পাশে বেগুন দিয়ে ঝোল হবে না চচ্চড়ি সব তাকে দেখিয়ে নিতে হয়।

তিনি সারাক্ষণই নির্দেশ দিতে থাকেন— ময়নার মা! এটা তুমি কি করলা?
আট দশ পিস গলদা চিংড়ি রানতে এতো গুলো তেল ঢেলে দিলা?
দোপেঁয়াজা তেলে চপচপ করছে। আমার কি তেলের খনি আছে? একটা তরকারি রান্নার জন্য যে পরিমাণ তেল দিয়েছ এই তেলে ছোটখাট দুটা পরিবারের এক দিনের তিন আইটেম রান্না হয়। তোমাকে দিয়ে আমার পোষাবে না ময়নার মা। তুমি বরং বাসা বাড়িতে কাজ বাদ দিয়ে হোটেলের বাবুর্চির কাজ পাও কি-না দেখো। আমার বাড়িতে তোমাকে দিয়ে পোষাবে না।

ভাবির কথা শুনে জয়ী ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ভাবি এক কাপ চা পেতে পারি?

কেন পারো না?
অবশ্যই পারো। তুমি রুমে গিয়ে বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।
তোমার সাথে কথা আছে।

জয়ী আবারো হেসে দিয়ে বললো, মাই গড তুমি রান্না ঘর থেকে বের হলে এরা তো আজকেই তোমার তেলের টিন ফাঁকা করে ফেলবে।

জয়ী মজা করো না তো।
আমি সামনে না থাকলে এরা সত্যি সত্যি তেলের ঝোল খাইয়ে এতো দিনে সবাইকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলতো।

যাও রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বসো।

আমি নিজেও এক কাপ চা খাবো তোমার সাথে।
তুমি চায়ের সাথে আর কিছু খাবে?
তোমার নাকি সিঙ্গাড়া খুব প্রিয়। তোমার ভাইয়া সকালে বাজারের সাথে ফ্রোজেন সিঙ্গাড়া, সমুচার প্যাকেট পাঠাইছে।
ভেজে দিব?

থাক ভাবি।
এখন শুধু চা খাবো। খুব মাথা ধরেছে।
বিকেলে না হয় ভাজাভুজি করো।

মিলি দুকাপ চা নিয়ে জয়ীর রুমে এসে দেখে জয়ী শাওয়ার নিয়ে বের হচ্ছে।
খুব সতেজ লাগছে মেয়েটাকে দেখতে।

জয়ী চুল মুছতে মুছতে বললো, কি দেখছো ভাবি ওমন করে?
খুব মাথা ধরেছে, তাই ভাবলাম শাওয়ার নিয়ে তারপর চা খাই।
এরপর দিব একটা ঘুম।
পৃথিবী উল্টে গেলেও কেউ আমাকে যেন না ডাকে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার। দাও চা দাও।

মিলি জয়ীর হাতে চা দিতে দিতে বললো জয়ী একটা ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করি?

জয়ী চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল।
চোখ তুলে চেয়ে ইশারায় চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করলো ঘটনা কি?

জয়ী তোমার সাথে তোমার বরের সম্পর্ক কেমন?

চায়ে চুমুক দিয়ে জয়ী ম্লান হেসে বললো হঠাৎ এই প্রশ্ন?

না তেমন কিছু না।

আমার বিয়েতে তোমার ভাইয়া আনতে গিয়েছিলো শুনেছি। তোমরা কেউ আসোনি।
ছোটর বিয়েতেও বাবা তোমাকে খুব করে রিকোয়েস্ট করছিল আসার জন্য।
তখনো আসোনি।

বিয়ের পাঁচ বছর পর এই প্রথম আসলে তবুও একা।
স্বাভাবিক ভাবেই মনে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন এসে খেলা করে।

ইফতি মনে হয় বাবাকে ফোন করেছিল।
কি কথা হয়েছে জানি না। তবে বাবার খুব মন খারাপ দেখলাম।
সকালে খুব হৈচৈ করতে দেখেছি ফোনে।
তাই জানতে চাইছিলাম।
তুমি আবার কিছু মনে করলে না তো?

না ভাবি আমার এখন আর এসবে মন খারাপ হয় না।
আর আমি ও বাড়ি থেকে একবারে চলে এসেছি।
ইফতির সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়।
আর কিছু জানতে চাও?

মিলি থতমত খেয়ে বললো, না না আর কি জানতে চাইব?

তবে ওপাশের কথা তো শুনতে পারছিলাম না, বাবার কথা শুনে যা বুঝলাম , ইফতি হয়তো বিয়ের দাওয়াত দিতে ফোন করেছিলো।
বাবা খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
বলছে সে দেখে নিবে।
তার একমাত্র মেয়ের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার তাকে কে দিয়েছে তা সে দেখে নিবে।
এরপর নাস্তা না খেয়েই রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেছে।

জয়ীর চোখ আবারো ভিজে উঠতে চাইছে। সে কোন রকমে বললো, বাদ দাও ভাবি।
আমি একটু ঘুমাব।
তুমি এখন যাও।
আর বাবা বাসায় আসলে আমাকে ডেকে দিও।
এই বয়সে এতো উত্তেজিত হওয়া
ভালো না।

ঠিক আছে আমি যাই।
তুমি ঘুমাও।

মিলি দরোজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলো।

কিছু বলবে?

একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
তুমি ফেরার একটু আগেই তোমার নামে একটা রেজিস্ট্রি করা চিঠি এসেছে।

জয়ী বিস্মিত হয়ে বললো, এতোক্ষণ পর তুমি এ কথা বললে!
কোথায় চিঠি?
কার চিঠি?
আমার কাছে আবার কে চিঠি লিখবে?

তা জানি না।
তোমার ড্রয়ারে রেখে দিছি।
তুমি নিজেই দেখো।
আমার হাতে তখন কাজের চাপ ছিল। আমি শুধু সই করে রেখে দিছি।

মিলি বের হয়ে যাওয়া মাত্র জয়ী ড্রয়ার খুলে খামটা হাতে নিলো।
খুব আগ্রহ করে খামটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে কাগজটা বের করা মাত্র ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here