#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
আজ শুক্রবার। শায়লার বাবা গত রাতে স্ট্রোক করে হাসপাতালে মারা গিয়েছে। সকালে অ্যাম্বুল্যান্সে করে লাশ বাসায় আনা হয়েছে। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন চলে আসছে। এক মূহুর্তে শায়লাদের সাজানো গোছানো সংসারটা হঠাৎ কাশবোশেখী ঝড়ে তছনছ হয়ে গেলো।
শায়লার দাদুর বাড়ির আত্মীয়স্বজন শায়লার মাকে ওর বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। অথচ মানুষ কেন যে এই ভুলটা করে? আল্লাহপাক যার যতদিন হায়াত রেখেছে সে তো ততদিনই বাঁচবে। একটা দিন বেশীও বাঁচবে না একটা দিন কমও বাঁচবে না। শায়লার এক ফুফাতো শায়লার মাকে বলেই ফেললো,
—–ভাবী, ভাইয়ের যে হার্টের সমস্যা ছিলো আপনি জানতেন না?
—–ভাই ওতো খুব নিয়ম মেনে চলা মানুষ ছিলো। খুব পরিমিত খাবার খেতো। সকালে উঠে মর্নিং ওয়ার্ক করতো। প্রেসারের ওষুধও ঠিকমতো খেতো। আমি অসুস্থ হওয়ার আগে দেখাশোনা করতাম। তবে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ও নিজের সব কাজ নিজেই করতো।
—-আপনি কি এখন সুস্থ ভাবি?
—-আপাতত সুস্থ তবে ডাক্তার বলেছে নিয়মিত চেকআপে থাকতে।
শায়লার চাচা ফুফুরা দুই ভাই দুই বোন। ওর দাদী যতদিন বেঁচে ছিলো ওরা সবাই একসাথে কল্যাণপুরে থাকতো। কল্যাণপুরে নতুন বাজারের কাছে ওদের দাদার বাড়ি ছিলো। প্রথমে একতলা ছিলো। ওটা ভেঙ্গে পরে চারতলার বাড়ি করা হয়।
ওর চাচা ওখানেই দোতলায় থাকে। আর ওর বাবার অংশের তিনতলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর চারতলা দুইটা ইউনিট করে দুই ফুফুকে দেওয়া হয়েছে।
শায়লা ওর বাবা মার একমাত্র সন্তান। পাথরের মতো বসে আছে। চোখে এক ফোঁটা পানি নেই। ওর শুধু মনে হচ্ছে বাবা কেন নিজেকে কলঙ্কিত করলো? কলঙ্ক শুধু যে নারীর গায়ে লাগে তা নয় পুরুষও কলঙ্কিত হয়। পাপ তো পাপ। সে পুরুষ করুক আর নারী করুক। গোপন ইবাদত যেমন মানুষকে সম্মানিত করে তেমনি গোপন পাপ মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
যাক ওর এতো ভাল বাবাটার কলঙ্কিত মুখটা ওকে আর দেখতে হবে না এজন্য আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানায়। অনেক বেদনার ক্ষতে শায়লা নিজেকে এভাবেই সান্তনা জানায়।
শায়লার চোখে পানি নেই দেখে ওর চাচী বললো,
—-দেখেন বাপটা মারা গেলো মেয়েটার চোখে একফোঁটা পানি নেই। কি নিষ্ঠুর মেয়েরে বাবা! এখন প্রতি পদে পদে বুঝবি বাপ না থাকার কত জ্বালা। দাঁত থাকতে তো দাঁতের মর্যাদা দিসনি। এখন বুঝবি জীবনে কত ধানে কত চাল।
শায়লা আসলেই কাঁদতে পারছে না। ওর শুধু সেই ঘটনাটার কথা বারবার মনে পড়ছে। শায়লার মা অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে।
শায়লার মা এক বোন তিন ভাই। শায়লার বড় মামা গ্রামে থাকে। শায়লার মেজ মামা শান্তি নগরে থাকে। মেজ মামা ব্যবসা করে। আর ছোট মামা সাভারে থাকে। উনি বিএডিসি তে চাকরি করে।
শায়লারা আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে থাকে। ওর বাবা সরকারি অফিসার ছিলেন। মেজ মামা আর ছোটো মামাও ওদের বাসায় চলে এসেছে। ওরাও একটু এড়িয়ে থাকছে কারণ রোগাক্রান্ত বোন অবিবাহিত ভাগ্নির দায়িত্ব যদি নিতে হয়। তাই মেজমামা সান্তনা দেওয়ার ছলে ওর মাকে বলছে,
—-আপু এতো কাঁদিস না। তুইতো সুস্থ না।
—রায়হান, ভাইরে আমার এখন কি হবে?আর মেয়েটাকেই বা কে দেখবে?
—-আপু দুলাভাই সরকারি অফিসার ছিলেন। পেনশনের টাকা ভালই পাবেন। শায়লা এইচ এস সি পাশ করার পর ভালো ঘর বর দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দে। বিয়ের পর না হয় লেখাপড়া করবে। শায়লার গায়ের রংটা চাপা। ওর এখন যা বয়স এই বয়সে কালো হোক আর ফর্সা হোক সবাইকে সুন্দর লাগে। বিয়ে দিতে তোর বেগ পেতে হবে না। আর মেয়ে আর জামাই মিলে তোর দেখাশোনাও করতে পারবে।
শায়লা ভাবছে মানুষ কতটা স্বার্থপর হয়। ওর নানার বাড়ি হোক আর দাদার বাড়ি সবাই বিপদে পড়লে ওর বাবার কাছে সাহায্য সহযোগিতা নিতো। অথচ সবাই পাশ কাটিয়ে চলতে চাইছে। ওর মেজ মামার অবস্থা বেশ ভালই। গ্রামে চাতাল আছে। মুরগি, গরুর বিশাল খামার আছে। ছোটো মামারও অবস্থা বেশ ভালো।
এদিকে ওর চাচার দুই ছেলে। শায়লা যেহেতু ওর বাবা মেয়ে সন্তান সে ক্ষেত্রে ওর বাবার সম্পত্তিও নাকি ও পুরোটা পাবে না। মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে ওর বাবার লাশটা এখনও দাফন করা হয়নি তাতেই সম্পত্তির চুলচেরা হিসেব শুরু হয়ে গেছে।
অথচ একেই নাকি বলে রক্তের সম্পর্ক। শায়লা বারান্দা দিয়ে নীচে উঁকি মেরে দেখলো, কাপড় দিয়ে ঘিরে তখনও ওর বাবার গোসল করানো হচ্ছে। ও আবার চেয়ারে এসে বসলো। আর অতীতের ভাবনায় হারিয়ে গেলো।
ওদের খুব সুন্দর সুখী পরিবার ছিলো। আজিমপুরে বাবা মা আর শায়লা থাকতো। বছরে একবার বাবা ওদের নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যেতো। ঈদের সময় ওরা কল্যাণপুরে চলে যেতাে। সেখানে দাদী বাড়িতে চাচা ফুফুদের সাথে জমজমাট ঈদ হতো। গরমের ছুটিতে নানার বাড়ি যশোরে বেড়াতে যেতো। কত পদের ফলের গাছ আছে ওর নানা বাড়িতে। নানা যতদিন বেঁচে ছিলো আদরের অভাব হয়নি। পরবর্তীতে নানী যখন মামাদের কাছে থাকতো তখন আর আগের মতো আদর যত্ন হতো না। শায়লার মাও আর খুব একটা বাবার বাড়ি যেতো না।
ছোটোবেলা থেকেই শায়লা খুব বাপঘেষা ছিলো। ওর বাবা অফিস থেকে আসার পর বাবার কাছেই সময় বেশী কাটাতো। বাবার হাতে খেতে ও খুব পছন্দ করতো।
শায়লা খুব দুষ্ট ছিলো। তাই মাঝে মাঝে মায়ের হাতে মার খেতো। তখন ওর বাবা রেগে গিয়ে ওর মাকে বলতো,
—-তুমি আমার মেয়ের গায়ে যখন আঘাত করো, সেই আঘাত আমার শরীরে এসে লাগে। আমার মনে হয়, তুমি আমার রাগ মেয়ের উপর প্রয়োগ করো।
শায়লার মা অবাক হয়ে বলে,
—-আমি কেন মেয়ের রাগ তোমার উপর তুলবো? ও আমার একমাত্র সন্তান। ও যেন ঠিকমতো লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেইজন্য ওকে শাসন করি। তুমি বুঝবে না মেয়ে মানুষের যন্ত্রণা। ও নিজের পায়ে ভালোমতো দাঁড়ালে আমাদেরও দেখভাল করতে পারবে। কারণ আমাদের আর কোন সন্তান নেই। ছেলে হোক আর মেয়েই হোক ওই আমাদের এক মাত্র সন্তান।
—-দেখো শায়লার মা, মেয়ের ইনকাম খাওয়ার জন্য আমি মেয়েকে মানুষ করছি না। আর তোমারও উচিত হবে না এটা আশা করা। ওর স্বামী না চাইলে ও আমাদের দেখভাল করতে পারবে না।
—–শায়লার বাবা, তুমি তো পুরুষ মানুষ তাই পুরুষের দিকে ঝোল টেনে কথা বললে। কেন পারবে না? তুমি তোমার মা ভাইবোনদের দায়িত্ব পালন করোনি? ও তুমি পুরুষ বলে তোমার বেলায় একরকম আইন আর শায়লা মেয়ে বলে ওর বেলায় অন্যরকম।
—-শোনো শায়লার মা গরীবের কথা বাসি হলে ফলে। মেয়েকে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত করতো চাও ভাল কথা,কিন্তু বেশী আশা করা ঠিক হবে না। জীবনের বাস্তবতা বড়ই কঠিন।
শায়লার মনে হতো বাবা হিসাবে ওর বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবাদের একজন।
চলবে