কলঙ্কের বোঝা পর্ব-দশ

0
162

#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

ক্রমাগত শায়লার মার শরীরটা খারাপের দিকে যেতে লাগলো। শায়লাও মায়ের অসুস্থতার কারনে শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারছে না। সেজানের সাথেও দিন দিন দুরত্বটা বেড়েই যাচ্ছে। ওর সাথে মাঝে মাঝে শায়লার ফোনে কথা হয়। খুবই ফরমাল কথা। ওরা দুজনেই যেন অস্থির সময়ের হাতে বন্দী। শায়লার মা অসুস্থ তাও সজ্ঞানে থাকলে মেয়ের সংসার নিয়ে ভাবেন। যদিও শারীরিক যন্ত্রণায় ওনার তেমন কিছু করার সামর্থ নেই। আর সেজানের মার সামর্থ থাকলেও ছেলের জীবনের সুখ নিয়ে ওনার ভাবনা নেই। উনার কথা হচ্ছে বউ গেলে অনেক বউ পাওয়া যায়। কিন্তু মা,বাবা গেলে এই পৃথিবীতে আর মা, বাবা পাওয়া যাবে না। এদিকে সেজানের বাবার শরীর পুরোপুরি সেরে উঠেনি। শরীরের বাঁ পাশটা অবশ হয়ে আছে। ওর মায়ের উপর চাপ পরে যাচ্ছে। সংসারের কাজ সামলিয়ে আবার রোগীর সেবা করা। উনিও আর পেরে উঠছেন না।
সেদিন ছিলো শুক্রবার। অফিস ছুটির দিন।শায়লা ওর মাকে দুপুরের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। এর মাঝে তিন মাস কিভাবে পার হয়ে গেলো ও টের পেলো না। এবার ওর মা কেন যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারছে না। শায়লা মাঝে মাঝে মানসিক শক্তিটা একদম হারিয়ে ফেলে। আদৌ কি ওর মা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? তা একমাত্র আল্লাহপাক ভালো জানেন। এমন সময় ওদের বাসার ডোর বেল বেজে উঠলো। শায়লা জোহরাকে ডেকে বললো,
—-জোহরা কে এসেছে দেখ? তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দে। আম্মুর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে।
জোহরা দরজাটা খুলে দিয়ে বললো
—-আফা, দুলাভাই আইছে।
শায়লা একটু অবাক হলো। ওকে না জানিয়ে সেজান হঠাৎ আসলো। ওর বাবার শরীর ভাল আছেতো?
শায়লা ড্রইংরুমে গিয়ে সেজানকে বললো,
—-বাসার সব খবর ভালোতো?
—-সবাই আছে একরকম। মায়ের উপর খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে।
এমন সময় শায়লার মার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে শায়লাকে বললো,
—-শায়লা,বাসায় কে আসলো?
—-সেজান এসেছে মা।
—-ওকে আমার কাছে আসতে বল। কতদিন ওকে দেখিনা।
শায়লার কেন যেন সেজানকে অপরিচিত লাগছে। ওর মায়ের কষ্টটা ওর ঠিক নজরে পড়লো আর শায়লার মনের কষ্টটা ও আজও বুঝলো না। শায়লা সেজানকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে গেলো। সেজানকে দেখে মিনারা বেগম বললেন,
—-ভালো আছো বাবা? তোমার বাবার শরীর এখন কেমন আছে?
—-আব্বার শরীর খুব একটা ভালো নেই। মুখে কিছু খেতে পারেন না। নল দিয়ে খাওয়াতে হয়। মায়ের উপর অনেক চাপ পড়ে যায়।
—-তাতো অবশ্যই। রোগীর সেবা করা চাট্টিখানি কথা না। এদিকে আমারও শরীরটা সুস্থ হচ্ছে না। আমি একটু সুস্থ থাকলে শায়লা তোমাদের ওখানে থাকতে পারতো। তোমার মায়েরও হেল্প হতো।
—-মা, তোমার কাছে কেউ কৈফিয়ত চায়নি। আর তুমিও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নও। যার যার মাথা ব্যথা তার তার বুঝা উচিত।
—-আচ্ছা এখন বাড়তি কথা না বলে সেজানকে খেতে দে।
—-না, আমি খেয়ে আসছি।
—-খেয়ে আসলে কেন বাবা? শ্বশুরবাড়িতে আসলে খেয়ে আসতে হয় না। তাহলে শ্বশুর বাড়ির মানুষগুলো আদর আপ্যায়ন করতে না পেরে কষ্ট পায়।
সেজান শাশুড়ীর কথার উত্তর না দিয়ে শায়লাকে বলে,
—-শায়লা তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।
শায়লা সেজানকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,
—-বলো, কি বলবে আমায়?
সেজান বললো,
—-আজ তিন মাস হয়েছে তুমি এখানে আছো। আমার মনে হয় তুমি ভুলেই গেছো তুমি বিবাহিতা।
—-আমার মনে হয় সেজান তুমি আমার সব শর্তই ভুলে গেছো। আমি এই কারনে তোমাকে বলেছিলাম যেখানেই থাকবো দুজনে একসাথে থাকবো। কিন্তু তুমি আমার কথারও মুল্যায়ন করোনি। আমারও কোনো মুল্য ছিলো না তোমার কাছে। আমি তোমাকে হাসবেন্ড হিসেবে না বন্ধু হিসাবে পাশে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার বন্ধু হতে পারলে না।
শায়লার কথাগুলো যেন সেজানকে স্পর্শ করলো না।
সেজান একজন অপরিচিত মানুষের মতো শায়লাকে বললো,
—-আমরা পুরোনো প্যাঁচাল না পেরে বরং একটা সমাধানের পথ বের করি।
শায়লাও আবেগকে দমন করে সেজানের সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
—-বল সেজান,তোমার কাছে কি সমাধান আছে?
—-আম্মার জন্য তুমি দু,
জন প্রফেশনাল নার্স রেখে দাও। ওরাই পালাক্রমে আম্মাকে দেখবে। আর তুমি প্রতিদিন একবার করে এসে আম্মাকে দেখে যাবে।
—-সেজান তুমি আসলেই খুব স্বার্থপর। তুমিই কোনদিন জানতে চাওনি আমার মায়ের শরীরটা কতটা খারাপ। আমার বুকের গহীনের কষ্টগুলোকে তোমার বুকে নিতে চাওনি। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার কষ্টের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হবে। আমি ভুল ভেবেছিলাম। হালকা তো হয়নি বরঞ্চ দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে। এখন তোমার মার কষ্ট হচ্ছে বলে নিজের মতো করে সমাধানের রাস্তা বের করেছো। দেখ আমার পক্ষে আমার মাকে ছেড়ে এই মূহুর্তে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এতে যদি তোমার মনে হয় তুমি আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে না তাহলে জোর করে সম্পর্ক ধরে রেখো না। তোমার কাছে যেটা ভালো মনে হয় তুমি সেটাই করো। এতে আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি মাকে ছেড়ে এখন কোথাও যাবো না।
—-শায়লা এটাই তোমার শেষ কথা?
—-হ্যাঁ, এটাই শেষ কথা।
সেজান শায়লাদের বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। শায়লা সেজানের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর মনের অজান্তে দুফোঁটা জল চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরে পড়লো। হয়ত অনেক দিনের জমানো কষ্টের জল। শায়লা কাঁদেনি। নিজেকে একটু একটু করে শক্ত করে গড়ে তুলেছে। মায়ের ডাকে শায়লা সম্বিত ফিরে পেলো।
শায়লা মায়ের রুমে ফিরে আসলো।মিনারা বেগম বললেন,
—-শায়লা, সেজান চলে গেলো। আমার সাথে দেখা করে গেলো না। ও কি বলেছে তোকে? তুই ওদের বাড়ি এখন যাচ্ছিস না বলে ওর কি অভিমান হয়েছে?
—-মা,এই পৃথিবীতে তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সুতরাং কে অভিমান করলো তা নিয়ে ভাবার সময় আমার নেই। আর ওর অনেক ব্যস্ততা। ওকে ওর মতোই থাকতে দেওয়া উচিত। আমিও আমার মতো থাকতে চাই। বিকেল হয়ে গেলো। তোমাকে সুপটা দেই। আর ডাক্তার তোমাকে ডিমের সাদা অংশ খেতে বলেছে। হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে। রেড ব্লাডসেল কমে যাচ্ছে। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসো। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।
শায়লা ওর মায়ের জন্য সুপ আর ডালিমের জুস নিয়ে আসলো। মাকে খাইয়ে নিজে ওজু করে আসরের নামাজ পড়ে নিলো।
ওই রাত্রিতে শায়লার মার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলো। রক্তবমি হলো। কোনরকমে রাতটা পার করে ভোরে মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। সাথে সাথে ডাক্তার শায়লার মাকে আইসিইউতে নিয়ে গেলো। এদিকে মাকে নিয়ে শায়লা জীবনের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। এর মাঝে সেজান ডিভোর্সের চিঠি পাঠিয়ে দিলো। এমনটা হবে শায়লা আগেই ভেবেছিলো। তাই একটুও অবাক হয়নি। সেজান হয়ত ভেবেছিলো ক্যান্সারের রোগী কদিনেই বা বাঁচবে। সুতরাং ও শায়লার সাথে সুন্দরভাবে সংসার করতে পারবে। এটা শায়লার ধারনা। অভিমান করে হোক কিংবা নিজের মতো করে ভেবে নেওয়া হোক শায়লা সেটা নিতেই পারে। ওযে কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা শুধু ওই জানে।
টানা সাতদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে শায়লার মা না ফেরার দেশে হারিয়ে গেলো। যাক ওর মায়ের মৃত্যুর সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা ওর চাচাতো আর ফুফাতো ভাইবোনরা সামলে নিলো। যদিও চাচী ফুফুকে বলেছিলো,
—-এখনকার কিছু ছেলের স্বভাব হচ্ছে বিয়ে করে মজা লুটা শেষ হয়ে গেলে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।
শায়লা এই কারনে নিজের মুখে সেজান সম্পর্কে কোন কথা কাউকে জানায়নি।
ও এখন মায়ের মৃত্যুর শোকে কাতর। মানুষের কটু কথা হজম করার মতো শক্তি ওর শরীরে নেই।
কিছুদিন পার হয়ে যাবার পর শায়লা নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। এর মাঝে ইন্টারনেটে অ্যামিরাটসে একটা চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখতে পেলো। ও একটু কৌতুহলী হয়ে সিভি সাবমিট করলো। ও আসলেই এখানে থাকতে চাচ্ছে না। এই বাসার ভিতরে বাবা মায়ের সাথে ওর এতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে ও এখান থেকে এখন পালাতে চাইছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here