গহন_কুসুম_কুঞ্জে ২৮.

0
73

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৮.

মিলি এই ঝামেলার মধ্যেও অফিস কামাই করে না। উল্টো সে যখন অফিসে যায় তাকে দেখলে বোঝা যায় না এতকিছু তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বেশ ফিটফাট আর স্বাভাবিক থাকে। তনয়া অবাক হয় ওকে দেখলে। খুব শক্ত মনমানসিকতা না থাকলে এটা সম্ভব না৷ তার নিজের সাথে এরকম হলে সে কেঁদেই অর্ধেক হয়ে যেত। অথচ সে মিলিকে কাঁদতে দেখেছে দুই একবার। তাও চোখে পানি আসার পরপরই সে মুছে ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এটা আবার একদিক দিয়ে খারাপও, কারন কষ্ট ভেতরে চেপে রাখতে রাখতে ভেতরটা শুকিয়ে মন মরে যায়।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া একা হয়ে যায়। কেন যেন এখন তার আর আগের মতো সবকিছুতে মন বসে না। বরং শুয়ে শুয়ে দিন কেটে যায়। শুধু একবার কষ্ট করে ওঠে রান্না করার জন্য। গাছগুলোতে আগের মতো যত্ন নিতে ইচ্ছে করে না। কী হলো তার?

হতে পারে সবকিছুর কারন স্বরূপ। সে তনয়ার সাথে ঠিকমতো কথাই বলে না। মিলির ঘটনাটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো ভাবছে তনয়াও কোনোদিন মিলির স্বামীর মতো করবে! এসব ভাবলে তনয়ার আরও খারাপ লাগতে থাকে৷ নাহ্ আজ স্বরূপ এলে সে এসবের সমাপ্তি ঘটাবেই। আর ভালো লাগছে না। ঘরের ভেতরটা গুমোট দীর্ঘশ্বাসের আড্ডা হয়ে উঠেছে।

আজ সে আগেভাগে রান্নাবান্না শেষ করল। গাছগুলোর যত্ন নিল। সময় নিয়ে গোসল করে সুন্দর একটা শাড়ি পরল। দূরী খালার সাথে গল্পগুজব করল। ফোনে মা বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল। সব মিলিয়ে ওর মন ভালো রইল।

সন্ধ্যায় স্বরূপ ফিরলে তাকে সুন্দর করে চা বানিয়ে দিল। সাথে মাখন দেয়া টোস্ট। স্বরূপ ভালো চা খুবই পছন্দ করে। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলল, “বাহ! চমৎকার হয়েছে। তো, ব্যাপারটা কী?”

তনয়া একটু হেসে বলল, “কিসের ব্যাপার?”

“মনে হচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে।”

“কী হবে?”

“সাজগোজ করেছ যে?”

“খেয়াল করেছ তাহলে!”

স্বরূপ চোখ মটকে বলল, “তুমি কি আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছ?”

তনয়া রহস্য করে বলল, “বলতে পারো…”

“ওহ, কয়েকদিন তো দূরে দূরে আছি। কত আর ভালো লাগে তাই না?”

দুজনেই হাসল। স্বরূপ চা শেষ করতে করতে অফিসের জরুরি একটা কল আসায় উঠে বারান্দায় চলে গেল। তনয়া গেল কাপ পিরিচ ধুয়ে রাখছে৷ এর মধ্যে মিলি চলে এলো। তনয়া মিলির জন্য চা বসিয়ে দিল। সাথে রাতে খাবার জন্য ভাতও বসাল।

স্বরূপ ততক্ষণে ল্যাপটপে বসে গেছে। অফিসের একটা মেইল সেন্ড করে খেয়াল করল দরজায় টোকা পড়েছে। পর্দার ওপাশ থেকে মিলি বলল, “আসতে পারি?”

স্বরূপ বলল, “আরে, আয়।”

মিলি ঘরে ঢুকল। বিষন্ন মুখ। আজ চেহারাটা একটু বেশিই বিমর্ষ লাগছে।

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “নতুন কিছু হয়েছ?”

“আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি ডিভোর্সের বিষয়ে। সাফাতকে আজ নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম। পেয়েছে কিনা কনফার্ম হতে কল করলাম, রিসিভ করল সেই মেয়ে। বলল, সাফাত ওয়াশরুমে গেছে। আমি আর কিছু বলিনি জানিস, কল কেটে দিয়েছি।”

স্বরূপ খেয়াল করল ওর হাত কাঁপছে রাগে। চেয়েও কিছু বলতে পারল না।

মিলি মৃদু স্বরে বলল, “ওটা আমার বাসা ছিল স্বরূপ। ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি আমার হাতে সাজানো। ও এতদিন যা করেছে, লুকিয়ে করেছে৷ আমার সামনে তো ভালোই থাকত। এখন সব খোলাখুলি চলছে। যেন হুট করেই সবটা জবরদখল হয়ে গেল। ছেড়ে আসতে হবে জানতাম, কিন্তু এভাবে তা তো ভাবিনি।”

স্বরূপ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই আবার মহান সাজছিস। একবার বল, ওকে সাইজ করে দেই। মেয়েটাকেও দেখে নেব।”

মিলি বাঁকা হাসল, “এত সহজ না স্বরূপ। ও এত অল্পতে পাড় পেয়ে যাবে না। ওর জন্য অনেক বড় শিক্ষা অপেক্ষা করে আছে।”

“তুই কোন ভিত্তিতে বলছিস ও একটা শিক্ষা পাবেই? হতেও তো পারে সারাজীবন তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভালো থাকল?”

মিলির হাসিটা এবার চওড়া হলো। সে বলল, “আমি কোনোদিন কাউকে জ্ঞানত কষ্ট দেইনি। আল্লাহর ওপর পুরো বিশ্বাস আমার আছে। হ্যাঁ, আমি ধর্মের সব নির্দেশ ঠিকমতো পালন করি না, কিন্তু আমার বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। আমি জানি, আল্লাহ আমাকে ন্যায়বিচার দেবেন। সেটারই অপেক্ষা করছি। তোদের বিচার আমার চাই না।”

স্বরূপ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাকে সে কখনোই বুঝতে পারেনি। সে নরম নাকি কঠিন এটা পর্যন্ত বোঝা শক্ত।

মিলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “যাকগে, তোর সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো কথাটা। তাই করলাম। মা বাবাকে কী বলব সেটাও অলমোস্ট ঠিক করে ফেলেছি।”

“কী ঠিক করেছিস?”

“বিশেষ কিছু না। আমি দুই-তিনদিনের মধ্যে চলেও যাব। নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে এই যা! যখন বুঝব ঠিকঠাক হয়ে গেছি, তখন বাড়ি চলে যাব। মায়ের কোলে ঘুমালে একটু শান্তি লাগবে বুঝলি!”

“হুম।”

মিলি উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। তনয়া চা নিয়ে গিয়ে দেখল মিলি জানালার পাশে বসে রাতের আকাশ দেখছে। সে বলল, “আপু চা এনেছি।”

মিলি হঠাৎ বলল, “তনয়া, একটা কথা বলি তোমাকে?”

“বলো আপু।”

“এত ভালো হয়ে থেকো না৷ একটু খারাপও হতে শেখো। পৃথিবীতে ভালো মানুষের দাম খুব কম। সবাই সস্তা ভেবে বসে।”

তনয়া কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

রাতের খাবারের পর সব গুছিয়ে তনয়ার ফুরসত মিলল শোবার ঘরে ঢোকার। স্বরূপ মোবাইলে কী যেন দেখছে। তনয় শোবার প্রস্তুতি নিতে বাথরুমে ঢুকল।

স্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটছে কোনো কারন ছাড়াই। তার শরীর জ্বলছে। মাথা কাজ করতে চাইছে না। তার সাথে যেটা ঘটেছিল সেই ঘটনাটা এতদিন ধরে চাপা আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে জমা ছিল। সে ভেবেছিল আগুন নিভে গেছে। কিন্তু না, জেগে উঠছে আবার। মানুষ কেমন করে নির্মমভাবে ধোঁকা দিতে পারে? দিনের পর দিন মিথ্যে বলতে পারে? আরেকটা মানুষকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে পারে?

লোপার সাথে তার শেষবার ভালোভাবে কথা হয়েছিল সেই বিশেষ দিনেই সকালবেলা। আহ্লাদী গলায় মেয়েটা তাকে বলছিল, একা একা ঘুমাতে তার কী ভীষণ খারাপ লাগে! বিয়ের পর সে স্বরূপকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না। স্বরূপ সেই শেষবারের মতো লোপাকে বলেছিল, “ভালোবাসি।” এরপর এই শব্দ সে আর উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। কোনোদিন হয়তো পাবেও না।

সেই মেয়েই বিকেলবেলা অন্য লোকের বাহুলগ্না হয়েছিল তার নিজেরই সেই তথাকথিত একলা বিছানায়। পৃথিবীর সবকিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল তার। মিলির সাথেও কি এটাই হয়নি? মিলি সেদিন জলদি বাসায় না ফিরলে কি জানতে পারত তারই বিছানায় অন্য কারো সাথে তার স্বামীর অভিসার চলে?

চিন্তাগুলো মাথায় দপদপ করছে ওর। মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। কঠিন মুখে বসে রইল।

তনয়া ততক্ষণে শুতে চলে এসেছে৷ সে একপাশে শুয়ে হাত বাড়িয়ে স্বরূপকে ডাকল। স্বরূপ তাকাল না তার দিকে। তনয়া ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, “কী হলো তোমার? শোবে না?”

“না।”

“কেন?” উঠে বসল তনয়া।

“ভালো লাগছে না।”

তনয়া ওর কপালে গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখে বলল, “কী হয়েছে বলোতো? চোখ লাল কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

স্বরূপের রাগটা বের হয়ে আসতে চাইছিল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সমস্যা কী? এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন? সব বিষয়ে নাক গলাতে হবে কেন? আমি কি আমার বাসায় চাইলেও একটু একা থাকতে পারব না?”

তনয়ার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। এত কড়া ভাষায় এমন মেজাজ দেখিয়ে স্বরূপ কখনোই তার সাথে কথা বলেনি। সে তবুও ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি কী করেছি?”

স্বরূপ গলা আরেকটু চড়িয়ে বলল, “কিছুই করোনি তুমি। আমাকে এবার একটু একা থাকতে দিয়ে উদ্ধার করো! মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। তোমার ন্যাকামি দেখার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। পরিস্থিতি বোঝো না তুমি? সবসয়ম তো একরকম ভালো লাগে।”

তনয়ার গাল বেয়ে তখন চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। স্বরূপ যেন হঠাৎ খুব নির্দয় হয়ে উঠল। লোপাও সেদিন খুব কেঁদেছিল তার সামনে। পায়ে ধরেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ওর জামা ভিজে গিয়েছিল। কথাটা মনে হতেই স্বরূপের রাগ আরও বাড়ল। বলল, “কিছু হলেই তো চোখের পানিতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে চাও। আদৌ কিছু হয় চোখের পানি দিয়ে? ভুলটা ভুলই থাকে।”

সে উঠে ড্রয়ের থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তনয়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার সাথে কেউ কোনোদিন এভাবে কথা বলেনি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত পড়তে দেননি তারা। অথচ আজ কতগুলো কঠিন কথা শুনতে হলো। স্বরূপ যেভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ কঠিন করে কথাগুলো বলছিল, তনয়ার মনে হচ্ছিল প্রতিটা কথা কাঁটার মতো বিঁধছে তার গায়ে। এমন কী করেছে সে? কিছুই তো করেনি। অন্য কারো রাগ তার ওপর এভাবে কেন ঝাড়া হবে? সে তো রাগ করার মতো কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। ভুল করলে ভুলের মাশুল হিসেবে কথাগুলো নেয়া যেত নাহয়। কিন্তু বিনা কারনে এসব কেন সে সহ্য করবে?

তনয়া কাঁদতেই থাকল। তার মাথায় স্বরূপের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারবার। মাথা ব্যথা হতে লাগল ক্রমশ। প্রায় সারারাত সে এভাবেই বসে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মনের কোথাও ক্ষীণ আশাও ছিল স্বরূপ হয়তো এসে এক্ষুনি ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সারারাতে একবারের জন্যও স্বরূপ ঘরে ঢুকল না। বারান্দায়ই সিগারেট পুড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিল।

তনয়া একসময় বসে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়ল। খুব দু্র্বল লাগছে। কাঁদার শক্তিও একসময় শেষ হয়ে গেছে। তবে ঘুম এলো না।

স্বরূপ সকালে ঘরে এসে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। মিলিও বোধহয় ওর সাথেই বের হলো। তনয়া ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। উঠল না, কথা বলার প্রশ্নই আসে না।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া উঠল। তার মন বিষিয়ে উঠেছে। স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরেও নিশ্চয়ই একই মূর্তিতে থাকবে। ওর সাথে কথা বলারও রুচি হচ্ছে না। স্বরূপ ঠিকই বলে, সে তাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে এভাবে কথা বলা যায় না। তারা শুধু কিছু ভালো সময় একসাথে ভাগ করে নিয়েছে। স্বরূপ তার দায়িত্ব পালন করে গেছে এই-ই! এর বেশি কিছু নয়। তনয়ার ক্রমশ মন ভারী হতে লাগল। বারবার স্বরূপের কথা কানে বাজছে৷ না, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবে না সে। চলে যাবে। যার বাসা তাকে একা থাকতে দিয়ে চলে যাবে সে। থাকুক, নিজের যতটা স্পেস লাগে ততটা নিয়ে সে ভালো থাকুক।

তনয়া নিজেকে টেনে ওঠাল কষ্ট করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে সে গাড়ি ডেকে বাপের বাড়িতে রওনা দিল।

তনয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না এভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার। একদিন আগেও কল্পনা করেনি এমন হতে পারে। গাড়িতে উঠে বারবার মনে হচ্ছিল, স্বরূপ একবার নিজের ভুলটা বুঝুক! তাকে স্যরি বলুক। ভালো করে কথা বলুক।

সে বারবার ফোন চেক করে গেল। কিন্তু কোনো কল বা মেসেজ এলো না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here