কলঙ্কের বোঝা পর্ব-আট

0
171

#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী

শায়লা নিজের রুমে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছিলো। এমন সময় শাশুড়ীর কথাগুলো কানে আসলো। ওর অবাক লাগলো সেজান কোনো প্রতিবাদ করলো না। চুপচাপ শাশুড়ীর কথাগুলো শুনে গেলো। শায়লা ভাবছে সেজান তো সবটা জানে ওর মায়ের শারীরিক কন্ডিশন। তারপরও কি করে চুপ করে থাকলো? সেজানের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো। শায়লা সেটা জানে। ওরই বা কি করার ছিলো? মাকে নিয়ে সবসময় শায়লা ভয়ে থাকে। কখন যে মা ওকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। মা ছিলো বলে তাও বাবার মৃত্যুটা শায়লা সামলে নিয়েছে। কিন্তু মা চলে গেলে ও নিজেকে কিভাবে সামলাবে? কষ্টটা বুকের গভীরে চাপা দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সেজানের সাথে অফিসে রওয়ানা হলো। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা নিয়ে মানুষের জীবন বয়ে যায়। মানুষ তার মনের গোপনকুঠুরীতে যন্ত্রণাগুলো বন্দী করে আমৃত্যু হাসিমুখে সবার সাথে ভাল থাকার অভিনয় করে যায়। এরই নাম জীবন।

এর মাঝে ওদেরও বিবাহিত জীবনের ছমাস পার হয়ে যায়।
আজ শুক্রবার। অফিস ছুটির দিন। সেজানের কাছে ঈদের দিনের মতো লাগে। একটু বেলা করে সেজান আর শায়লা ঘুম থেকে উঠে। ঘড়ির এলার্মে শায়লার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল সাতটা বাজে। শায়লা উঠতে গেলেই সেজান ওকে হ্যাঁচকা টান মেরে জড়িয়ে ধরে। শায়লাও সেজানের আদর মাখা ভালবাসাটা এনজয় করে। তারপর শাওয়ার নিয়ে শায়লা সকালের চা নাস্তা বানাতে কিচেনে ঢুকে পড়ে। সেদিন সেজানের শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করাতে একটু দেরী করে মায়ের রুমে ঢুকে। সালেহা বেগম সকাল থেকে ছেলের দেখা না পেয়ে মনে মনে খুব রেগে গেলেন। তারপর ছেলে যখন মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো সালেহা বেগম সব রাগ উগড়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন,
—-এতো বউয়ের গাড়ল হলে শেষে সামলাতে পারবি না। রাশটা প্রথম থেকেই টেনে ধরতে হয়।
—মা আমার শরীরটা ভাল লাগছিলো না। সে জন্য রুমে শুয়ে ছিলাম।
—-শরীরের আর কি দোষ। একদিকে অফিস আবার শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব সবকিছু সামলানো কি মুখের কথা। তুই আমার ছেলে বলে তোর কষ্ট দেখে আমার বুকটা ফেটে যায়। কি এমন তোর বয়স অথচ এই বয়সে এতো বড় জোয়াল পড়লো তোর কাঁধে। তোর তো এখনও বিয়ের বয়সও হয়নি।

নাস্তা টেবিলে দিয়েছে বলে শাশুড়ীকে ডাকতে গিয়ে শায়লা ওর শাশুড়ী মায়ের সব কথাই শুনতে পায়। শায়লার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাদিনের ভাল থাকার মুডটাও নষ্ট হয়ে গেলো। আর একটা বিষয়ে শায়লা খুব অবাক হয় সেজান সহজে ওর মার কোনো কথার প্রতিবাদ করে না। রুমে না এসে দরজা নক করে নাস্তা করার জন্য মা ছেলেকে ডেকে দেয়।

অনেক টানাপোড়েনে শায়লা আর সেজানের সংসারের বয়স এক বছর হলো। আজ রবিবার। আবার ওদের ম্যারেজ ডে। শায়লা আর সেজান অফিস থেকে কল্যাণপুরে চলে যাবে। সেখানেই ওদের ম্যারেজ ডের আনুষ্ঠানিকতা শায়লার মা করবে। শায়লার সাথে ওর সেরকমই কথা হয়েছে।
শাশুড়ী জানলে নানারকম নাটক হবে বিধায় ওদের ম্যারেজ ডের কথা শায়লা বলেনি। প্রতিবার কল্যাণপুরে যাবার সময় ওর শাশুড়ীকে এমনিতেই নানা ফিরিস্তি দিতে হয়। উনি জানে যে সপ্তাহে তিনদিন শায়লা আর সেজান ওর মায়ের কাছে থাকে। এখন মাঝে মাঝে সেজান যায়ও না। গত দুসপ্তাহ শায়লা একা মায়ের কাছে গিয়েছে। মা এবার আসার সময় বলে দিয়েছে সেজানকে সাথে নিয়ে যেন যায়। শায়লা অবাক হলো সেজান তো ওকে ম্যারেজ ডের উইশ করলো না। কল্যাণপুরে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে বলে শায়লাও সেজানকে উইশ করেনি। এদিকে মা হয়ত ভয়ে থাকেন সাংসারিক টানাপোড়েনে না জানি শায়লার সংসারটা ভেঙ্গে যায়। এজন্য দু,জনকে একসাথে দেখলে মা অনেক খুশী হন। শায়লা এটা নিয়ে কোনো টেনশন করে না। যে যাবার সে কোনো বাহানা ছাড়াই চলে থাকবে। আর যে থাকবে সে নিজ থেকেই সবটা সয়ে থেকে যাবে।

শায়লা রবিবারে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা আর দুদিনের তরকারীটাও রান্না করে ফ্রিজে রেখে দেয়। শাশুড়ী শুধু রাইসকুকারে ভাতটা রেঁধে নেন। আর কেনা পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা করেন। শায়লা নিজে অবাক হয়ে যায় নিজের পরিবর্তন দেখে। ও শ্বশুর বাড়িতে মানিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ও তো সেজানকে ভালবেসেই বিয়েটা করেছে। সুখে সংসার করতে শায়লারও ইচ্ছে হয়। তাই এই সংসারটাকে ভালবেসেই প্রতিদিন সবার জন্য সকালের চা থেকে শুরু করে দুপুরের রান্না সবটা গুছিয়ে অফিসে যায়। তারপরও শায়লাকে শাশুড়ীর খোঁচা মারা কথাগুলো হজম করতে হয়। নাস্তার টেবিলে শায়লা শাশুড়ী মাকে বললো,
—-মা আমি আর সেজান অফিস ফেরত কল্যাণপুরে যাবো।
—-কই আমি তো কিছু জানি না। তুমি বা সেজান আমাকেতো আগে থেকে কিছু বলোনি।
—-আম্মু এখানে বলার কি আছে? তুমি তো জানো আমি আর শায়লা রবিবার কল্যাণপুরে যাই। এটাতো নতুন কোন বিষয় নয়।
—–সেজান তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই শায়লাকে বিয়ে করিসনি। শায়লা তোকে বিয়ে করেছে। এই দিন দেখার জন্য বুকের রক্ত পানি করে তোকে মানুষ করেছি। এও আমার কপালে লেখা ছিলো।
—–মা আমি বুঝি না তুমি সব বিষয়ে এতো ড্রামা কেন করো? আমি শায়লার সাথে ও বাড়িতে যাই এটা যদি তোমার পছন্দ না হয় সরাসরি বলো। প্রতিবার এতো নাটক দেখতে আমার ভাল লাগে না।
সেজানের বাবা রেগে গিয়ে সেজানের মাকে বলে,
—-তোমার স্বভাবটা আর পরিবর্তন হলো না। এক জিনিস মাথায় ঢুকলেই হলো। সেটা নিয়ে অনবরত ভ্যাজর ভ্যাজর করতেই থাকো। তুমি তো জানো,বেয়াইন অসুস্থ। শায়লার পাশাপাশি সেজানেরও কিছু দায়িত্ব বর্তায় শাশুড়ীকে দেখভাল করার। কেন শায়লা করে না?এই যে ও প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে আমাদের সবার খাবারের ব্যবস্থা করে যায়। ওতো ওর দায়িত্ববোধ থেকে এই কাজগুলো করে। সেজানেরও ওর শাশুড়ীর প্রতি সেরকম দায়িত্ববোধ থাকা উচিত।
সেজানের মা মনে মনে ভাবে,শায়লা ঐ টুকুন না করলে এ বাড়ির ভাত খাওয়া ওর জন্য বন্ধ হয়ে যেতো। দায়িত্বটুকু ঠিকঠাক ভাবে পালন করে বলে রক্ষে। মনের কথা মনে চেপে কাঁদ কাঁদ হয়ে সালেহা বেগম বললেন,
—-হ্যা সব তো এখন আমার দোষ।
শায়লা এত কাহিনী দেখে সেজানকে বলে,
—-ঠিক আছে তোমার ও বাড়িতে যেতে হবে না। আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। আমারতো যেতেই হবে। মাকে এবার ডাক্তার দেখাবো। শরীরটা আবার একটু খারাপ করেছে। কিছু রুটিন চেকআপ আছে। শায়লার সেজানের উপর অভিমান হলো। ও বললো যেতে হবে না আর সেজান কোনোও জোর খাটালো না। ও হয়ত ভুলেই গেছে আজ ওদের ম্যারেজ ডে।

শায়লা আর সেজান অফিসে রওয়ানা হলো। উবারে কেউ কারো সাথে কোনো কথা বললো না। শায়লার কেন যেন মনে হচ্ছে সেজান ওর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এই সেজান ওকে বিয়ের আগে পাগলের মতো ভালবেসেছে। আজ এতো কাছে থেকেও শায়লা যেন আগের সেই ভালবাসাটা খুঁজে পাচ্ছে না। শায়লার মনে হচ্ছে সেজান যেন হাঁপিয়ে উঠছে। জীবনের সাথে লড়াই করে ও আর পারছে না। সেজান ভাবছে মা হয়ত ঠিকই বলেছে। আর একটু ভাবনা চিন্তা করে বিয়েটা করলে ভালো হতো।
সেজান শায়লাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে নিজের অফিসে চলে গেলো। অফিস ফেরত শায়লা মায়ের বাড়িতে পৌছে গেলো। সেজান তো আসলো না।ডোর বেল বাজানোর আগে মাকে কি বলবে শায়লা মনে মনে কথাটা গুছিয়ে নিলো। ডোর বেল বাজানোর শব্দ শুনে শায়লার মা দরজা খুলে শায়লাকে একা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুই একা কেন?সেজান আসলো না?
—-মা ও আসতে চেয়েছিলো কিন্তু হঠাৎ করে অফিসের কাজে ওকে আজ রাতেই চিটাগাং যেতে হবে।
—-আজ তো তোদের ম্যারেজ ডে।
—–মা অফিস কি আর এটা বুঝবে?ওরা যেহেতু বেতন দেয় তাই ওদের পাওনাটা ষোল আনার উপর আঠারো আনা বুঝে নিবে। এখন তোমার কথা বলো। বুয়া ঠিকমতো সার্ভিস দিচ্ছে তো? আর ডাক্তারের রুটিন চেকআপটাও এবার করিয়ে নিবো।
—-সবই হবে। তোর মুখটা বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে। ফ্রেস হয়ে আয় আমি জোহরাকে টেবিলে খাবার দিতে বলি।
আসলে আজ শায়লার সকাল থেকে খাওয়াই হয়নি। সকালে খাবার টেবিলে এতো নাটকের পর গলা দিয়ে কোনো খাবার নামেনি। শায়লা ফোনটা খুলে দেখলো সেজান কোন মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here