কলঙ্কের বোঝা পর্ব-সাত

0
167

#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

ভোরে শায়লার চাচা একটু বিরক্ত হয়েই শায়লাকে ফোন দিয়ে ওর মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দেয়। শায়লার মাকে ওর চাচা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শায়লা ওর মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মায়ের সাথে কথা বলতে চায়। ওর চাচা বলে,
—–তোর মাকে ডাক্তার দেখছে। এখন ফোন দেওয়া যাবে না। তুই ঢাকার বাইরে কবে গেলি?
—-আমি আর সেজান হানিমুন ট্রিপে সাইরুতে আসছি।
—তোরও আক্কেলবুদ্ধি বলিহারী। মায়ের অসুস্থতার দিকে খেয়াল নেই। উনি এখন হানিমুন করে বেড়াচ্ছেন। যত তাড়াতাড়ি পারিস ঢাকায় চলে আয়।
শায়লা দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। সেজান শায়লাকে বলে,
—-ঠিক আছে, ঢাকা যাবে ভাল কথা। আমরা মার সাথে কথা বলে তারপর ডিসিশন নেই।
—-সেজান আমি অপেক্ষা করতে পারবো না। তুমি চিটাগাং এয়ারপোর্টের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করো। তারপর ওখান থেকে এয়ারে করে আমি ঢাকা যাবো। আর এয়ারের টিকিট এখনি বুকিং দিয়ে দাও।
—-শায়লা মাথা গরম করো না। মার শরীর বেশী খারাপ হলে মা নিজেই আমাদের ফোন দিত। আমরা মাত্র তিনদিনের জন্য এসেছি। দুদিন তো চলেই যাচ্ছে। আমরা আগামীকাল যাই।
—-সেজান তুমি মনে হয় আমার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শোনার অপেক্ষায় আছো? ঠিক আছে বুঝতে পারছি তুমি অনেক টাকা খরচ করেছো। তুমি থেকে যাও আমি একাই যেতে পারবো।
সেজান আর কথা না বাড়িয়ে শায়লার কথামতো ঢাকার পথে রওয়ানা হলো। সেজান মনে মনে অনেক কষ্ট পেলো। এই হানিমুন ট্রিপ নিয়ে ওর কতো প্লান ছিলো। পাহাড়ের ঢালে ঝিরি ঝিরি বাতাসে মেঘের পালে প্রণয় আবেগে শায়লার হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে কল্পনায় সেজান কত ছবি এঁকেছিলো। সুইমিংপুলে দুজনে সাঁতার কাটবে। সব এভাবে মাঠে মারা যাবে সেজান কখনও ভাবেনি। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সেজান। এই হানিমুন নিয়ে কতই না স্বপ্নের জাল বুনেছিলো। স্বপ্নের এতো কাছাকাছি এসেও পুরো স্বপ্নটা সত্যি হলো না। সেজান বুঝতে পারছে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া এক নয়। মানুষ মুখে বলতেই পারে মেনে নিবো কিন্তু পরিবেশ পরিস্থতির সাথে সর্বক্ষণ নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক লড়াই করতে হয়।

শায়লাও বুঝতে পারছে সেজানের অবস্থা। ওর আসলে হাতে কিছু করার নেই। শায়লা তো জানে ওর মা আর বেশীদিন এই পৃথিবীতে নেই। ওর উপর দিয়ে যে কি ঝড় বইছে কাউকে বুঝাতে পারবে না। একমাত্র যে এই পরিবেশের ভিতর দিয়ে গিয়েছে সেই শুধু ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারবে। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে ওর আপনজন কেউ নেই। সেজানতো কিছুদিন হয়েছে ওর জীবনে এসেছে। এখনও ভালকরে ওকে চিনতেই পারেনি শায়লা। এই পৃথিবীতে মানুষ চেনা সবচেয়ে কঠিন। মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগার মূহুর্তেই চেহারা বদলে যায়। চেনা মানুষটা তখন বড্ড অচেনা হয়ে যায়। শায়লা ওর বাবা মারা যাওয়ার পর দেখেছে আপনজনের মুখোশপড়া মানুষগুলো মূহুর্তে অচেনা হয়ে গেলো। ওর বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবাদের একজন ছিলো। কত গর্ব ছিলো ওর বাবাকে নিয়ে। সেই মানুষটার চরিত্রের কালোদিকটা ওকে দেখতে হলো। তাই মানুষকে বিশ্বাস করতে খুব ভয় হয়। প্রকৃতিগত ভাবে পৃথিবীর প্রতিটা সৃষ্টির আলো আছে অন্ধকারও আছে। সূর্যের যেমন রাত আছে তেমনি দিনের আলোও আছে। চাঁদের যেমন পূর্নিমা আছে তেমনি অমাবস্যাও আছে। সুখ আছে দুঃখ আছে আনন্দ আছে বেদনাও আছে মিলন আছে বিচ্ছেদও আছে। তাই হয়ত মানুষের জীবনেও ভালো দিক আছে মন্দ দিক আছে। মাকে শান্তি দিতেই ও সেজানকে বিয়ে করেছে। শায়লা জানে না সেজান কিভাবে ওর সাথে নিজের জীবনটা মানিয়ে নিবে। সেজানের ডাকে শায়লা ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।
—শায়লা আমরা এয়ারপোর্টে চলে আসছি।
শায়লা আর সেজান ঘন্টাখানিকের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে কল্যাণপুরে চলে গেলো। বাসায় পৌঁছে সেজান অবাক হলো। ওর শ্বাশুড়ীতো দিব্যি সুস্থ আছেন। উনিতো দরজাটা খুলে দিলেন। শায়লা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—–আম্মু তুমি কেমন আছো? চাচা বললো তুমি অনেক অসুস্থ।
—–একটু অসুস্থ ছিলাম। বিয়েশাদীর আনুষ্ঠানিকতায় একটু উল্টাপাল্টা খাওয়া হয়েছে। তাই ডায়রিয়ার মতো হয়েছিলো। যাতে বেশীদূর না গড়ায় এই জন্য আগেই ডাক্তার দেখালাম। এখন ভালো আছি। তুই এভাবে চলে আসলি কেন? তোদের তো আর একদিন থাকার কথা ছিলো।
—আম্মু তুমি কি করে ভাবলে তুমি অসুস্থ থাকবে আর আমি মজা করে হানিমুন করে বেড়াবো। এই তুমি তোমার মেয়েকে চিনলে?
—-না, শায়লা তুই কাজটা একদম ঠিক করিসনি। আমার শরীর বেশী খারাপ হলে সবার আগে আমি তোকেই জানাতাম। তোর চাচার কথা শুনে নিজেদের আনন্দ এভাবে মাটি করা তোর উচিত হয়নি।
—-বাদ দাও তো মা ওসব কথা, এখন বলো তুমি কেমন বোধ করছো?
শায়লার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেজান ওর শাশুড়ীকে বললো,
—-আপনার কথাটাই আমি ওকে বলেছিলাম। মায়ের সাথে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নেই। কে শোনে কার কথা। আমি শায়লাকে অনেক ম্যাচিউরড ভেবে ছিলাম। বাস্তবে শায়লা ততটা নয়। যাক যা হবার তাতো হয়েই গেছে। ওই দিনতো আর ফিরে আসবে না।
—-আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করো তাহলেই উত্তরটা তুমি পেয়ে যাবে। আর আমি ম্যাচিউরড কিনা সেটাও বুঝে যাবে।
শায়লার মায়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আর শায়লার চাচার উপর খুব রাগ হলো। চাচা কোনদিন বাবা হয় না। ওর নিজের মেয়ে হলে কি পারতো এভাবে ডেকে আনতে,পারতো না। কারণ মেয়ের সুখের কথা সে চিন্তা করতো। যাক এটাই আমার ভবিতব্যে লেখা ছিলো।
সেজান আর শায়লা দুটোদিন থেকে বাড্ডায় রওয়ানা হলো। যাবার আগে শায়লা ফুলটাইম কাজের লোক মায়ের জন্য রেখে দিলো। বাড্ডায় পৌঁছানোর সাথে সাথে সেজানের মা বললো,
—-তোদের না আগামীকাল আসার কথা? এতো টাকা খরচ করে গেলি তবে পুরো সময়টা না থেকেই চলে আসলি?
—–এতো জেরা কেন করছো?এসে কি আমি অপরাধ করে ফেলেছি?কিছুই ভাল্লাগছে না। সবাই মিলে আমার জীবনটাকে তেজপাতা করে দিয়েছো।
কথাগুলো বলে সেজান ওর রুমে চলে গেলো। সেজানের মা শায়লাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-সেজানের কি হয়েছে?এতো হাসিমুখ করে গেলো। আর মেজাজ খারাপ করে ফিরে এসে তেজ দেখাচ্ছে।
শায়লা ওর শাশুড়ীকে সরল মনে মায়ের অসুস্থতা নিয়ে বিস্তারিত বললো। আর শায়লার শাশুড়ী ওতে লবন মরিচ লাগিয়ে সেজানের কান ভারী করার অস্ত্র যেন হাতের নাগালে পেয়ে গেলো।

ওদের ছুটিও শেষ হয়ে এসেছে। আগামীকাল থেকে অফিস শুরু হবে। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সেজানের মা সেজানকে একা পেয়ে বললো,
—-গরিবের কথা বাসি হলে ফলে। তোকে বিয়ের আগে কতবার বললাম আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখ। তুই আমার কথা কানেই তুললি না। এ হচ্ছে আকাশে উড়া মেয়ে। কোনদিনও খাঁচায় বন্দী করতে পারবি না। ও জানে খাঁচার অর্গল কি করে ভাঙ্গতে হয়। মুক্ত আকাশে কেমন করে নিজের মতো করে পাখনা মেলে উড়তে হয়।


চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here