অতিথি
পর্ব:০৮
লেখা:মিশু মনি
.
জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস এসে মনটাকে ফুরফুরে করে দিচ্ছে।
মিশু হঠাত মৈত্রীর মুখের দিকে একদৃস্টিতে তাকিয়ে রইলো। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।মৈত্রীর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।
বলল,মিশু এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– আপনার চুল গুলা এত্ত সুন্দর কেন? আগে তো খেয়াল করিনি।বলেই মৈত্রির চুলে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলো। মৈত্রী থ মেরে বসে আছে।কি বলবে বুঝতে পারছে না।
মিশু বলল,আপনার চোখ সবচেয়ে বেশি সুন্দর! এত সুন্দর কেন এই চোখ গুলো?
মিশুর কথা আর প্রশংসাময় বাক্যের সুর টাই অন্যরকম শোনাচ্ছে।মৈত্রীর কেমন যেন লাগছে।
মিশু একদৃস্টে তাকিয়েই আছে।মৈত্রী চোখ নামিয়ে নিলো। মিশু এভাবে পলকহীন ভাবে তাকাচ্ছে ব্যাপার টা অস্বস্তিকর।
মিশু বলল,জানেন জীবনে আজ ই প্রথম কোনো ছেলে মানুষ কে এত কাছ থেকে দেখছি।
মৈত্রী মাথা নিচু করে আছে।ওর ও ইচ্ছে করছে মিশুর চোখের দিকে তাকাতে।কিন্তু মিশু যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে চোখাচোখি হলেই বিপদ।মিশু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। মৈত্রী নিজের দায়িত্ববোধ নিয়ে ভাবছে।দুই পরিবার অনেক ভরসা করে মৈত্রীর সাথে মিশুকে পাঠিয়েছে।তাছাড়া মিশুও মৈত্রীকে অনেক বিশ্বাস করে।কারও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অন্যপ্রকার কিছু ভাবা টা অন্যায় হয়ে যাবে।মিশুর বয়স কম।এভাবে তাকিয়ে থাকা টা ভয়ংকর, মেয়েটা সেটা বুঝেনা।অবুঝ মেয়ে।
মৈত্রী ফেসবুকে মনোযোগ দিলো। সে কোনোভাবেই মিশুর দিকে তাকাবে না আর।মিশুকে তো নিষেধ করাও যাচ্ছেনা।নিষেধ করলেই মুখ কালো করে ফেলবে।
মিশু বলল,কাজী সাহেব কি করছেন?
– ফেসবুকিং করছি।
– কিভাবে?
– বাসায় গিয়ে মর্ম’র কাছে শিখে নিও।
– আপনি শিখিয়ে দিন না।
– মর্ম বলেছে তুমি আসলে শিখিয়ে দিবে।ও তো সুন্দর কিছু প্রোফাইল পিক বেছে রেখেছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।আপনার মন খারাপ হলো কেন হঠাত?
– কই না তো।
– আমি দেখছি আপনার মন খারাপ। বলুন না কি হয়েছে? ফেসবুকে কি দেখে মন খারাপ হলো?
মৈত্রী মোবাইল টা পকেটে রেখে বলল,তোমাকে একটা কথা বলি মিশু? রাগ করবা না তো?
– নাহ।বলুন,
– তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি কি জানো এভাবে পলকহীন ভাবে তাকানো ঠিক না?
– কেন? তাকালাম বলেই তো বুঝতে পারলাম আপনার চোখ সুন্দর! দেখতেই ইচ্ছে করছে।
– এখানেই তো ভয় মিশু।এভাবে তাকালে কি হয় জানো?
– না তো। কি হয়?
– প্রেম হয়।
মিশু হঠাত কেমন যেন একটা ধাক্কা খেল।মনটা নিমিষেই অনেক খারাপ হয়ে গেল।মাথা নিচু করে ফেলল।
মৈত্রী বলল,কখনো কারও দিকে এভাবে তাকাবে না।তোমার বয়স অল্প,সবকিছু বুঝো না।এভাবে কাউকে দেখা খুব ভয়ংকর। আমি যদি তোমার দিকে এভাবেই তাকাই,তুমি নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবে।তুমি বড় হচ্ছ।এই ব্যাপার গুলো মাথায় রাখবা।
মিশু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।কিন্ত সবকিছু ঝাপসা দেখছে।চোখ ছলছল করছে।
মৈত্রী বলল,তুমি অবুঝ একটা মেয়ে।বড় হচ্ছ,এটা ভুলে যেও না।
মিশু বলল,আমি আর কোনোদিনো কারও চোখের দিকে তাকাবো না।
বলেই জানালায় হাত রেখে হাতের উপর মাথা দিয়ে চুপ হয়ে গেল।
মৈত্রী ভাবছে কি বলতে কি যে বললাম।ভালো কথাই তো বললাম।কিন্তু মিশু কি কাঁদছে!
– মিশু,
মিশুর কোনো সাড়া নেই।
– এই মিশু,
– হুম।
– রাগ করলা? ছোট আপু,রাগ করেনা।দেখো আমি তোমাকে একটা জিনিস বুঝিয়ে দিলাম। তুমি হচ্ছ,তোমার জানা দরকার। কখনো কোনো ছেলে তোমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে তুমি দৃস্টি সংযত করে নিবা।বুঝেছ?
মিশু কাঁদছে। কোনো জবাব নেই। কাজী অনেক কিছু বলেও মিশুর কোনো জবাব পেল না।মেয়েটা খুব মন খারাপ করেছে।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এটা বলা দোষের কিছু হয়নি।মৈত্রী চুপ করে ভাবছে।ব্যাপার টা কেমন যেন হয়ে গেল।ছোট মানুষ গুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
– মিশু,গল্প শুনবা?
– কি গল্প?
– আমি বিদেশে ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলাম তার গল্প।শুনবা?
মিশু চোখ মুছে মাথা নিচু করে বলল,বলুন শুনি।
– জানো আমি যে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম ওখানে একজন লন্ডনের ম্যাম ছিলেন। ম্যামের চেহারা দেখতে ছিল অনেকটা ঐশ্বর্য রায়ের মত।প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম ইনি বোধহয় ঐশ্বরিয়ার বড় বোন।তারপর একদিন কি হলো জানো?
– থামুন। ম্যামের গল্প শুনবো না।অন্য গল্প বলুন?
– কেন?
– ভালো লাগছে না শুনতে।
– তাহলে কিসের গল্প শুনবা?
– আপনার কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে না।কিছু মনে করবেন না।প্লিজ চুপ করে থাকুন।
মৈত্রী চুপ করে গেল।মিশু খুব মন খারাপ করেছে বোঝাই যাচ্ছে।আর কিছু বলতে সাহস করল না মৈত্রী।
মিশু হেডফোনটা বের করে বলল,আমাকে ডাকবেন না।আমি এখন গান শুনবো আর কাঁদবো। আর্টসেলের গান ছেড়ে দিন।
– কিন্তু তুমি তো আর্টসেলের গান পছন্দ করোনা।
– এখন শুনবো। আপত্তি আছে আপনার?
মৈত্রী কিছু না বলে ওর মোবাইল টা মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো- যা খুশি শুনো।
মিশু চুপচাপ গান শুনতে লাগল।মৈত্রী চোখ বন্ধ করে আছে।জার্নির শুরু টা যেমন ছিল,শেষ টা তেমন হচ্ছেনা।আর বোধহয় হবেও না।মেয়েটা কাঁদছে।
মৈত্রী মনে মনে নিজের উপর ই রেগে গেল।কি দরকার ছিল ওকে কিছু বলার? ও বাচ্চা মেয়ে,আমার দিকে তাকিয়ে থাকত যতক্ষণ ইচ্ছে।আমার তো কোনো অসুবিধা ছিল না।অযথা কিছু বলতে গিয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দিলাম।ভাবতে ভাবতে মৈত্রী ঘুমিয়ে পড়ল।
মিশু বাইরে তাকিয়ে আছে।গান শুনছে আর কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ও নিজেও জানেনা।
.
মৈত্রীর ঘুম ভাংল প্রায় দুই ঘণ্টা পর।চোখ মেলে দেখল মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে।মুখ দেখা যাচ্ছে না।
অনেক্ষন মৈত্রী চেষ্টা করল কথা বলতে।কিন্তু মিশু এদিকে ফিরেও তাকাল না।মৈত্রীর ও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
হঠাত মিশু লাফিয়ে উঠে বলল,যমুনা সেতু!
মাথা বাড়িয়ে সেতু দেখতে লাগল।খুব উতফুল্ল দেখাচ্ছে।মৈত্রীর ভালো লাগল।এতক্ষনে মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে।মনটা ভালো হয়ে গেল।
মিশু বলল,সেতুর ঢোকার আগেই জায়গা গুলা বেশি ভালো লাগে।দুপাশে গাছের সারি,খুব সুন্দর না?
– হুম খুব সুন্দর।
– আমাকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসবেন?
– আচ্ছা নিয়ে আসবো।
– এতদূর নিয়ে আসবেন?
– তুমি যেখানে যেতে চাইবে, সেখানেই নিয়ে যাবো।
মিশু খুশি হয়ে বলল,আমি আপনাকে রংপুর দেখিয়েছি।আপনি আমাকে ঢাকা ঘুরে দেখাবেন।
– সারছে রে।রংপুর ঘুরতে তো বেশি সময় আর টাকা লাগেনি।কিন্তু তুমি ছয়মাসেও ঢাকা ঘুরে শেষ করতে পারবা না।আর টাকা কিরকম লাগতে পারে আইডিয়া আছে?
– তাহলে কোথাও যাবো না।সারাদিন রুমে বসে থাকবো।
– আহা! রাগ করো কেন মেয়ে? এটা এমনি বললাম। সত্যি তুমি যেখানে যেতে চাইবে,সেখানেই নিয়ে যাবো। খুশি?
– হুম।চিপস খাবেন?
– এই প্রথম আমাকে খেতে বললা।
মিশু হেসে এক প্যাকেট চিপস বের করে দিলো।
মৈত্রী চিপস খাচ্ছে।মিশু বাবল গাম ফুলাচ্ছে।
– কাজী সাহেব,আপনি কিন্তু বল ফুলাতে অক্ষম।আমার সব বান্ধবীকে বলে দিবো।
– আচ্ছা।
– আপনার মোবাইলে একটা কল রেকর্ড পেয়েছি।শুনে ফেলেছি কিন্তু।এটাও সবাইকে বলে দিবো।
মৈত্রী হাসল।এখন মিশুকে আগের মতই লাগছে!
মিশু বলল,আপনি খুব ভালো।
– তুমিও খুব ভালো মেয়ে মিশু।
– আমি ভালো? দাড়ান জব্দ শুরু করছি।
বলেই মুখ থেকে চুইংগাম বের করে মৈত্রীর চুলে লাগিয়ে দিলো।
মৈত্রী হতভম্ব! কিন্তু কিছু বলল না।মেয়েটি শান্ত থাকলে ভালো লাগেনা।যা খুশি করুক,কিচ্ছু বলবো না।
.
মিশু খিলখিল করে হাসছে।মৈত্রী চুলে হাত ও দিলো না।
বলল,এটা চুলেই থাক।তুমি দেখবা আর হাসবা।
– হা হা হা।তাহলে আপনার গায়েও একটা লাগিয়ে দিই?
– কি পাজি মেয়েরে বাবাহ!
– হা হা হা…
.
বাসায় পৌছেই মিশু দৌড়ে সবার সামনে গিয়ে আলাপ জমাতে লাগল।
মৈত্রীর বাবা মা মেয়েটির আনন্দ দেখে খুব খুশি!
মাত্রা এসে বলল,হ্যালো মিশু আপু।
– হ্যালো মুলভাব,
– মুলভাব মানে?
– বড় জন সারাংশ, মেজ জন সারমর্ম আর তুমি মুলভাব।
– হা হা হা।
মিশু হেসে কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,এই ছকিনা কেমন আছো?
– ভালো আপা।কিন্তু আমার নাম তো ছকিনা না।
– হা হা।আমি জানি, তুমি হচ্ছ ছকিনা হিমু।
হিমুও হাসতে লাগল।মিশুকে ওর খুব ভালো লাগে।
– এসেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে রে।রাক্ষসী রানী কটকটি।
মিশু তাকিয়ে দেখে মর্ম।
মিশুকে দেখে সকলেই অনেক খুশি আর মর্ম বলছে রাক্ষসী!
মিশু রেগে মর্ম’র সামনে এসে দাড়ালো।
মর্ম বলল,রাক্ষসী তো এক সপ্তাহেই বড় হয়ে গেছ।
– পরে কথা বলছি।আগে তোমার রুম টা দেখিয়ে দেখিয়ে দাও।
– কেন?
– মুত্রথলির প্রেশার কমাবো।
মর্ম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,সর্বনাশ! তুমি চিঠিতে যা লিখেছ তা কি সত্যিই করবা নাকি?
– জ্বি।
– মিশু প্লিজ।এসব করিও না।তুমি আমার বোনের মত।
মিশু রেগে বলল,আমি তোমার বোনের মত?
– হ্যা আপু।অনেক দূর জার্নি করে এসেছেন। আপু এখন ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করুন।কি খাবেন বোন?
– হারামি তোর ঘাড় মটকে তোর রক্ত খাবো।
– সে জন্যই বলছি রাক্ষসী রানি কটকটি।রাক্ষসী আপা আমি রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াই আর আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
– আমাকে আপা বলবা না।
– ওকে বোন।আপনাকে বোন বলবো।
– ওয়াশরুম কোনদিকে?
– হিমু দেখিয়ে দিবে।হিমু মিশুকে নিয়ে যাও তো।
.
মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসল।
মর্ম হঠাত হো হো করে হেসে উঠল। সবাই তাকাল ওর দিকে।
মৈত্রী বলল,হাসছিস ক্যানো?
– ভাইয়া তোর চুল গুলা দলা পাকিয়ে আন্দোলন করছে কেন বলতো?
– চুইংগাম খেয়ে চুলে লাগিয়েছি।
– কেন?
– অনেকদিন থেকে চুল উঠেনা।তাই যাতে চুল উঠে, সেই ব্যবস্থা করছি।
– হা হা হা।
মিশু বলল,মিথ্যে কথা।ওটা আমি লাগিয়ে দিয়েছি।
মৈত্রীর বাবা বলল,সেটা আমাদের বুঝতে বাকি নেই।
– আংকেল আপনি কি বকা দিবেন?
– না।
– আংকেল তাহলে আপনার চুলে লাগিয়ে দেই?
মৈত্রীর বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। সবাই তো থ! কি বলে এই মেয়েটা!
( চলবে….)