এসো শব্দহীন পায়ে দ্বিতীয় পর্ব মিশু মনি .

0
412

এসো শব্দহীন পায়ে
দ্বিতীয় পর্ব
মিশু মনি
.

তিতাসের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হবে শুনে ওয়ামিয়ার চোখমুখ শুকিয়ে গেলো। এখনো মুখ তুলে তিতাস কে দেখে নি ও। কিছুক্ষণ আগে ছোটবোন যে ছবিটা দেখিয়েছে তাতেই মনের ভেতর উথাল পাথাল শুরু হয়ে গেছে ওয়ামিয়ার। ছেলেকে ভীষণ ভালো লেগেছে, এখন ওদেরও ওয়ামিয়াকে ভালো লাগলেই টেনশন কিছুটা কমে।

মৃদু পায়ে হেঁটে বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ওয়ামিয়া। পিছনে তিতাস এসে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা সময় নিরবেই কেটে গেলো। কে কিভাবে প্রথমে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। তিতাসের মন পড়ে আছে সেই ছায়াঘেরা বাড়িটা আর সেই বাড়ির সাধাসিধা মেয়েটাতেই। এখন সামাজিকতা সামলোনোর জন্য কিছু একটা বললেই হয়। ভেবে বললো, ‘নাম কি আপনার?’
মেয়েটা মৃদুস্বরে উত্তর দিলো, ‘ওয়ামিয়া নাহার।’
– পড়াশোনা শেষ?
– না। শেষ করার ইচ্ছা আছে।
– আমি আসলে আপনার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। মা আমাকে কিছুই বলে নি। বলেছে আপনার সাথে কথা বলে জেনে নিতে।

ওয়ামিয়া মাথাটা বাঁকিয়ে বললো, ‘জ্বি বলুন কি জানতে চান?’
– আপনি মাথা নিচু করে আছেন কেন? আমি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। প্লিজ মুখটা তুলুন, আমাকে দেখুন। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে ঘাড় বাঁকা হয়ে মাথা খুলে পড়বে।

হেসে ফেললো ওয়ামিয়া। মাথাটা উঁচু করে তুলতেই মাথার ঘোমটা টা পিঠের উপর পরে গেলো। কিন্তু তিতাস কে দেখেই ওয়ামিয়ার শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে গেলো। তখন যে ছেলেটার ছবি দেখেছিল এটা তো সেই ছেলে নয়। ইনি ই হচ্ছে আসল পাত্র! তবে এতক্ষণ মনে মনে কার নাম জপছিল ওয়ামিয়া? দুই পা পিছিয়ে গেলো ও।

তিতাস বললো, কোনো সমস্যা?
– না। মানে আপনি কে?

তিতাস হেসে উত্তর দিলো, আমার সম্পর্কে আপনি তো কিছুই জানেন না। আমি তিতাস মাহমুদ। ছোটখাটো একটা চাকরি করছি। পড়াশোনা শেষ, চাকরির ফাঁকে সময় পেলে ঘুরে বেড়াই।

ওয়ামিয়া অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। তবে ভেতরের ঘরে যিনি বসে আছেন সেই ছেলের ছবি ই দেখেছিল ও। যা হবার হয়ে গেছে, তিতাসের দিকে আরেকবার তাকালো ওয়ামিয়া।

আবারও নিরবতা। ক্ষণিক সময় পার হলে তিতাস বললো, আপনার কি করতে ভালোলাগে?
ওয়ামিয়া দেরি না করেই উত্তর দিলো, ঘুমাতে।

ভ্যাবাচেকা খেয়ে তিতাস বললো, ঘুমাতে?
– হ্যাঁ।
– আমি জানতে চাইছি কোনো প্যাশন? যেমন আমার ট্যুর দিতে ভালো লাগে, ফটোগ্রাফি ভালোলাগে, মুভি দেখতে ভালো লাগে।
– আমার টিভি দেখতে ভালো লাগে।
– কি দেখা হয় টিভিতে?
– যখন টিভিতে যা হয়।
তিতাস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও আচ্ছা।

তিতাস কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, আপনার কি কি করতে ইচ্ছে হয়?
– যেমন?
– আমার খুব স্কাই ডাইভিং করতে ইচ্ছে করে, প্যারাসেলিং করতে ইচ্ছে করে, চাকরি করতে ইচ্ছে করে না, প্রচুর ন্যাচার ফটোগ্রাফি করতে ইচ্ছে করে। এরকম?
ওয়ামিয়া অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। উত্তর না পেয়ে তিতাস বললো, আচ্ছা ধরুন আমাদের বিয়ে হলো। আমি যেসব পছন্দ করি, সেসব কি আপনার ভালো লাগবে?
– আপনার ভালো লাগলে আমারও ভালো লাগবে।

তিতাস বললো, দেখুন, আমার ভালো লাগা আর আপনার ভালো লাগা এক নয়। আমি রাত জেগে মুভি দেখবো, আমি চাইবো আপনিও আমার সাথে মুভি দেখুন। কিন্তু আপনি ঘুমাতে ভালোবাসেন। মাঝেমাঝে আমার জন্য রাত জাগতে পারবেন?

ওয়ামিয়া মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ পারবো।
– আমাকে আপনার ভালো লেগেছে?
– হুম।
– আচ্ছা। আমার আরো অনেক কিছুই জানার আছে। যদি কথা আগায়, তবে আরো অনেক কথা হবে। এখন তাহলে আসুন।

ওয়ামিয়া ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের খোলা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল তিতাস। আকাশে কয়েকটা পাখি উড়ছে। এলোমেলো ভাবে উড়ছে। মাঝেমাঝে খুব পাখি হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তিতাসের। ওদের জীবনে এভাবে মেয়ে দেখে বিয়ে করার মত সামাজিকতা নেই। একসাথে উড়তে উড়তে কাউকে ভালো লেগে গেলো, টুপ করে বিয়ে করে ফেললাম। ব্যাপারটা এরকম হলে মন্দ হতো না। একটা মেয়ের গায়ের রং নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তিতাসের। মেয়ে রান্না জানুক বা না জানুক তা নিয়েও ভাবনা নেই। কিন্তু যে মেয়েটা তিতাসের মতই হবে, তাকেই তো চাই। ওই নিষ্পাপ চাহনির মেয়েটাকে কেন যেন তিতাসের বড্ড আপন মনে হচ্ছে। হয়তো বা সেই মেয়েটিই হবে সেই মেয়ে, যাকে মন বলবে, “সে আমার মত। আমার তো একেই চাই”।

বসার ঘরে ফিরে এলো তিতাস। দিলু মামা আসর জমিয়ে ফেলেছেন। ঘরে আরো কয়েকজন মুরুব্বি লোক এসেছেন, তাদের সাথে মিশে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে মামা। কায়েস তিতাসের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু জানতে চাইলো বোধহয়। তিতাস ইশারায় বলল, পরে।


জানালা দিয়ে বিষন্ন নয়নে বাইরে তাকিয়ে আছে রূপসা। আজ মনটা ভীষণ রকমের খারাপ। মা বকেছে অনেক। মায়ের স্বভাবটাই ওরকম। মেয়ে কত বড় হয়ে গেছে, তবুও কারণে অকারণে নানারকম বাজে ভাষায় কথা শুনান রূপসা কে। বাবাও তিরিক্ষি মেজাজের। বাড়ির সবাই ভয় পায় বাবাকে। বিশেষ করে মা। বাবার ভয়েই সারাক্ষণ এতবেশি সতর্ক হয়ে থাকেন যে, সামান্য দোষ ত্রুটি তেও ছাড় পায় না রূপসা। ঘরে থেকে এতটুকুও শান্তি নেই ওর। ঘরের বাইরে গেলে একটু শান্তি মেলে, কিন্তু সে টুকুও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাড়ি থেকে বের হবার সময়ই মা সময় নির্দিষ্ট করে দেন। সেই সময়ের মধ্যেই ফিরে আসতে হয় রূপসা কে।

এমনিতেই আজ মনটা খারাপ ছিল, তার উপর কিছুক্ষণ আগে একটা ছেলে ফোনে ছবি তুলে নিয়ে গেলো। কি জানি রূপসার ছবি উঠেছে কি না। আজকাল কার ছেলেদের উপর বিশ্বাস নেই। আবার ইন্টারনেটে ছেড়ে টেরে দেবে না তো? বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে রূপসার।

রূপসা অতি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। তথাকথিত ‘কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলি’ যাকে বলে। প্রতি পদক্ষেপ ফেলতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে। পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। বাবাকে ভীষণ ভয় পায় রূপসা। মাঝেমাঝে নিজেকে খাঁচায় বন্দি পাখি মনে হয় ওর। কেউ যদি একবার খাঁচা থেকে মুক্তি দিত, তবে খোলা আকাশে পাগলের মত উড়ে বেড়াত ও। মাঝেমাঝে মুক্তির জন্য মনটা বড় ব্যকুল হয়ে ওঠে। যেমন আজকে হচ্ছে।

করুণ চোখে বাইরে তাকিয়ে রইলো রূপসা। এমন সময় বাড়ির প্রধান দরজা ঠেলে সকালের সেই যুবকটি উঠোনে পা ফেললো। বুকটা ধড়াক করে উঠলো রূপসার। এই লোকটা আবার এসেছে! জানালা থেকে সরে গেলো মুহুর্তেই।

কিছুক্ষণ পর উঁকি দিয়ে দেখলো উঠোন ফাঁকা। কেউ নেই! ছেলেটা নিশ্চয়ই বদ মতলব নিয়ে এসেছে। মাকে জানাতে হবে ব্যাপারটা। মাকে ডাকতে ডাকতে ভেতরের ঘরে যাচ্ছিল রূপসা। বারান্দায় কার যেন ছায়া পড়লো। মাথা তুলে তাকাতেই চোখাচোখি তিতাসের সাথে। লোকটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েছে! কি ভয়ংকর। ছোটখাটো একটা চিৎকার দিলো রূপসা।

চিৎকারের শব্দে হতভম্ব তিতাস কি করবে ভেবে পেলো না। ও বিনয়ের সাথে বললো, আমাকে ভয় পাবেন না। প্লিজ ভয় পাবেন না। আমি ভূত নই।

ততক্ষণে মা, চাচী ও দাদী এসে পড়েছেন। তিতাস কে দেখে থমকে দাঁড়ালেন সবাই। ছেলেটাকে ভদ্র বাড়ির ছেলে ই মনে হচ্ছে। ওনারা রূপসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? ইনি কে?’

তিতাস সালাম দিয়ে বললো, ‘আসলে চাচী আমি অনেক্ষণ থেকে ডাকছিলাম। কেউ বোধহয় শুনতে পাননি, তাই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ফেলেছি। মাফ করবেন।’

রূপসার মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা। কে আপনি? এখানে কি চাই? বাড়ির গেট কি খোলা ছিল?’
– ‘জ্বি খোলা ছিলো। আমি তিতাস মাহমুদ। আমি মন্তাজ মাস্টারের বাড়ির মেহমান।’

এতক্ষণে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। রূপসা এখনো মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ছবি তুলে নিয়ে গেছে, এই ছেলের প্রতি সন্দেহ দূর হচ্ছে না ওর।

তিতাস বলল, ‘চাচী, বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক নেই? আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।’
– ‘পুকুর ধারে আছে। আপনি বসেন, আমি ডাক দেই।’

রূপসার চাচী চলে গেলেন বাড়ির বাইরের দিকে। তিতাস রূপসার দিকে এক পলক তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মেয়েটার চোখদুটো ই ওর পুরো মুখশ্রীর মায়া বাড়িয়ে দিয়েছে। মনটা এতক্ষণে শান্ত হলো তিতাসের।

বাড়ির পুরুষ লোক এলে তিতাস ভদ্রতার সাথে কথা বলে বাড়ির জানালা ও শিউলী গাছের কয়েকটা ছবি তোলার অনুমতি চাইলো। ওর আচরণে মুগ্ধ হয়ে রূপসার চাচা বসার ঘরে এনে বসালেন। দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল রূপসা। শরবত ও নারকোল পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। তিতাসের চোখ জোড়া কেবল রূপসাকেই খুঁজে চলছিলো। গল্পে, কথায়, আচরণে চাচাকে বশ করে ফেললো তিতাস। চাচার বয়স বেশি নয়। উনি রূপসার বাবার মত অতটা রাগী নন। বেশ ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। দিলখোলা, শিল্প সাহিত্য বোঝেন। তিতাসের ক্যামেরায় আগ্রহ নিয়ে কয়েকটা ছবি দেখলেন উনি। দেখে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তিতাসকে বললেন আরেকবার এ বাড়িতে আসতে। ছবি তোলার কাজ শেষ করে হাসিমুখে আরেকবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলো তিতাস। এর মাঝে মাত্র দুয়েকবার মেয়েটাকে দেখতে পেয়েছে। তাতেই তিতাসের মন শান্ত। আরেকবার এলে কিছু একটা হবে।

গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে মন্তাজ মাস্টারের বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here