এসো শব্দহীন পায়ে মিশু মনি সূচনা পর্ব

0
641

এসো শব্দহীন পায়ে
মিশু মনি
সূচনা পর্ব
. ১
সাদা রঙের বাড়িটার সামনে শিউলী ফুলের ডানা মেলে দেয়া প্রশস্ত ডালপালা ওয়ালা গাছটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তিতাস। গাছের নিচে পরে আছে মাটিমাখা শিউলী কতক। ফুলের ঘ্রাণ ভেতরে যেতেই মনটা ব্যকুল হয়ে উঠেছে। আর নড়তেই ইচ্ছে করছে না। ওদিকে ছোটমামা আর বন্ধু কায়েস, মন্তাজ মাস্টারের বাড়িতে পৌঁছে বসে আছে। তারাতাড়ি পৌঁছতে হবে সে ব্যাপারটা আপাতত ভুলেই গেছে সে। তিতাসের স্বভাবটা একটু ভিন্ন বটে, কোথাও মনোমুগ্ধকর কিছু পেলে সে জায়গাটিতে দাঁড়িয়েই তার বেলা বয়ে যাবে। ঝাঁকড়া চুল আর পাতলা চেহারার ছেলেটার মুখটা বড়ই মায়াবী। হাসিতে নয়ন জুড়িয়ে যায়।

ছেলেটা ছবি তুলতে বড্ড ভালোবাসে। গলায় সবসময় একটা ক্যামেরা ঝুলানো থাকবে। হাতে স্মার্টফোন। এ বাড়ির টিনের চালের উপরটায় একগাদা বৃক্ষলতা সবুজে ঝলমল করছে। জানালার সামনে নুইয়ে পড়েছে শিউলী গাছের লতাটা। ভারি সুন্দর একখানা পরিবেশ। ছবি না তুললে নয়। ফট করে ক্যামেরা বের করে দু একটা ক্লিক করতেই মনে পড়লো ক্যামেরায় জুম লেন্স লাগানো। কিট লেন্স বন্ধু কায়েসের ব্যাগে। ছবি মনের মত হচ্ছে না। অগত্যা মোবাইলটা বের করে ক্লিক করতে যাবে এমন সময় একজন মহিলার গলা শোনা গেল, ‘ কে ওইখানে খাড়ায় আছে?’

তিতাস চটজলদি একটা ক্লিক করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক বুড়ি, ‘কে ওইখানে খাড়ায় আছে? ওই রূপসা, কে আইছিলো?’

কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। দাদী হতাশ হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন।

তিতাস মন্তাজ মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত আসতে আসতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এসেছে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে। বাবার পরিচিত বন্ধু ঘটকালী করে এতদূর নিয়ে এসেছেন। মায়ের এক কথা সে কিছুতেই শহুরে মেয়ে নেবে না, গ্রামের কিংবা মফস্বলের মেয়েকে বউ করে আনা চাই। আর বাবার দাবী হচ্ছে মেয়ে পরহেজগার হতে হবে। সে কারণেই মফস্বলের দিকে মেয়ে দেখতে আসা। সাথে এসেছেন ছোটমামা দিলু ও বন্ধু কায়েস। দিলু মামার সাথে তিতাসের ভীষণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিতাস জন্মের পর থেকেই খেলার সাথী হিসেবে দিলু মামাকে পেয়েছে। দিলু মামা বড়বোন অর্থাৎ তিতাসদের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। সেই সুবাদে দুই মামা ভাগ্নেতে মধুর সম্পর্ক ঠিক যেন একই ক্লাসে পড়া দুই বন্ধু।

বাড়ির প্রধান দরজায় এসে দাঁড়ানো মাত্র একজন মুরুব্বি ছুটে এলেন। হাসিমাখা মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা আসতে পেরেছেন তো? ভেবেছিলাম রাস্তা ভুল করেছেন।’
তিতাস সহ্যাস্যে উত্তর দিলো, ‘না না। ছোটমামা আমাকে ফোনে বলে দিয়েছে কোন বাড়িটা। আসলে পথে আসার সময় একটা দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম কি না। আমার আবার ছবি তোলার বড্ড শখ।’

মন্তাজ মাস্টার আবারও মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ‘আপনার মত বয়সে আমিও একটু আধটু ছবি তুলতাম। হা হা হা।’

তিতাসকে সসম্মানে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন মন্তাজ মাস্টার। যদিও বাড়ির মহিলা দল ও পাত্রীর চাচাজানেরা কায়েসকে পাত্র ভেবে এতক্ষণ ধরে বহু আদর সমাদর করছিলেন। মহিলাগণ দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন পাত্রকে। কেউ কেউ মিটিমিটি হাসছিল, পাত্রীর বোন এক ফাঁকে ছবি তুলে বোনকে দেখিয়েও এসেছে। তার পরপরই দিলু মামা বললেন, ‘আমার ভাগ্নে পিছনে পড়ে গিয়েছিল। ও এসে পড়েছে।’

মন্তাজ মাস্টারের কায়েসকে ভীষণ ভালো লেগেছিল। ভাগ্নে পিছনে পড়েছে শুনে প্রথমদিকে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে তিতাসকে দেখে মুহুর্তেই সে মেঘ কেটে গেলো। তিতাস সুদর্শন, বিনয়ী ভাব আছে চেহারায়। প্রথম দর্শনেই তিতাসকে মনে ধরে গেলো মন্তাজ মাস্টারের।

তিতাস বসার ঘরে এসে দিলু মামার পাশে বসতে বসতে বললো, ‘তুমি আমাকে রেখে চলে এসেছো? একবার দেখবা না আমি পিছনে আছি কি না?’
মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘কায়েসের সাথে গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম তুই আছিস।’

বলেই হেসে উঠলেন মামা। মন্তাজ মাস্টার তিতাসের জন্য শরবত আনতে বললেন। পাত্রীর মা শরবত নিয়ে এসে ক্ষণিক চিন্তায় পড়ে গেলেন পাত্র কোনজন সেটা নিয়ে। উনি শুষ্ক মুখে ফিরে গেলেন রান্নাঘরে। ছেলে বড়ই সুন্দর, মেয়েকে পছন্দ করবে তো? পাত্রপক্ষ মেয়েকে দেখতে এলে কোনো এক অজানা কারণে মায়েদের চোখমুখ শুকিয়ে যায়। নিজের মেয়েকে রাজকন্যা জানলেও মুহুর্তের জন্য দুশ্চিন্তায় ডুবে যায়। সেই মুহুর্তে নিজের মেয়েই হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে। তবুও দুশ্চিন্তা! কেন যে হয়!

তিতাস শরবত খেয়ে বিনয়ের সাথে বসে রইলো। ছোটমামা জানতে চাইলেন, কি করছিলি এতক্ষণ?
তিতাস উচ্ছলতার সাথে বললো, ‘আরে একটা বাড়ির মেইন গেট খোলা ছিল। গেট দিয়ে ভেতরে চোখ যেতেই আমার চোখ ছানাবড়া। টিনের চালে যেন ছোটখাটো একটা স্বর্গ। একটা সাধারণ বাড়ি, অথচ কত নির্মল লাগছে। দাঁড়াও ছবি দেখাচ্ছি। যদিও তারাহুরোতে ভালো ছবি তুলতে পারি নি।’

তিতাস ফোনের গ্যালারিতে ছবিটা বের করে মামার দিকে এগিয়ে দিলো। দিলু মামা বেশ কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে তিতাসের কানের কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘বাড়িটা সুন্দর কিন্তু তুই কি আসলেই বাড়িটা দেখছিলি?’

তিতাস মামার মুখের দিকে তাকিয়ে কৌতুহল ভরা চোখে জানতে চাইলো, ‘কেন?’

মামা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘সবই তো বুঝি।’

তিতাস মোবাইলটা নিয়ে ছবিটার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো। সব সৌন্দর্যের বিশেষণ থাকে না। কাজেই এই সুন্দরকে বিশেষায়িত করা গেলো না। একটা খুব সাধারণ মেয়ে, সাধাসিধা চেহারায় নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে আছে তিতাসের দিকে। কখন এই মেয়েটি জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে তিতাস খেয়ালই করে নি। মুহুর্তের মাঝে ছবি তুলতে গিয়ে এ কোন আশ্চর্যের সন্ধান পেয়ে গেলো সে! ভাবতেই কেটে গেলো কয়েক মুহুর্ত।

দিলু মামার খোঁচা খেয়ে সম্বিত ফিরে পেলো তিতাস। মন্তাজ মাস্টার তিতাসের দিকে চেয়ে আছেন। কি ভাবছেন কে জানে। বিষয়টাকে স্বাভাবিক করার জন্য দিলু মামা গল্প শুরু করলেন। কায়েস সাথে তাল মিলাতে লাগলো। তিতাস এখানে পাত্র, তাকে অতি সুপাত্রের ন্যায় আচরণ করতে হবে। তাছাড়া পাত্রী দেখতে আসার ঘটনা এই প্রথম। বাবা মা তিতাস ও দিলুর উপর ভীষণ ভরসা করেন। মেয়েকে ভালো লাগলে পরবর্তীতে বাবা মা আসবেন একেবারে পাকা কথা বলতে। দিলু মামাই সবকিছু সামাল দেয়ার চেষ্টা করবে। তিতাস এখানে শান্ত অতিথি ছাড়া আর কিছুই নয়।

নাস্তা করার এক পর্যায়ে মামা বললো, ‘মেয়েকে নিয়ে আসতেন। একসাথে নাস্তা করতাম।’

মন্তাজ মাস্টার ইতস্তত করছিলেন। মামার জোরাজুরিতে খাবারের মাঝখানেই মেয়েকে সামনে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। হালকা বেগুনী রঙের বেনারশী শাড়িতে ছোট করে ঘোমটা দেয়া এক মেয়ে প্রবেশ করলো ঘরে। মেয়েকে ধরে রেখেছে ওর ছোটবোন। সবসময় মেয়েরা একাই চলাফেরা করে। তবুও পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে যাওয়ার রীতি কেন প্রচলিত আছে কে জানে। হয়তো মেয়ে মাথা টাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে তাই কি না।

তিতাস মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। মেয়েটা ফর্সা, চিকন ঠোঁট। সুশ্রী বলা যায়। দিলু মামা মেয়েটা বসার পরপরই নাস্তা খেতে বললো। অপ্রস্তুত বোধ করছে মেয়েটা। মন্তাজ মাস্টার মেয়েকে খেতে বললে এক টুকরো আপেল হাতে নিয়ে বসে রইলো মেয়েটা। তিতাসের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো খাচ্ছে না কেন? কিন্তু করতে পারলো না।

মেয়েটার নাম ওয়ামিয়া। খুব মৃদু স্বরে কথা বলে। হাতের নখগুলো ভীষণ পরিষ্কার। কখনো রান্নাঘরে যায় নি তা স্পষ্ট। সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছে কায়েস ও দিলু মামা। কিন্তু তিতাসের সেদিকে মনোযোগ নেই। ওর মনে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে সেই সাধাসিধা নিষ্পাপ চাহনির মেয়েটা। মেয়েটাকে দেখার জন্য যেকোনো কৌশলে তিতাস ও বাড়িতে যাবে, এটা মনস্থির করে ফেললো। কতক্ষণে এখান থেকে ছুটি পায় সে অপেক্ষা করতে লাগলো। মামা যখন কথা বলছে তিতাস চুপিচুপি মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকে ছবিটা বের করলো। মেয়েটার মুখটা অতটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু ঢের মায়া আছে তা বুঝা যাচ্ছে। মাথায় ওড়না টেনে দেয়া। ওড়না দেয়ার কারণে বোধহয় আরো নিষ্পাপ লাগছে। মেয়েটাকে দেখতে না পারা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না তিতাসের।
এমন সময় ছোটমামা বললো ওয়ামিয়ার সাথে আলাদা করে কথা বলতে হবে। চমকে মুখ তুলে তাকালো তিতাস।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here