#এসো_করো_স্নান-09,10
রোকেয়া পপি।
৯ম পর্ব
দুপুরে খেতে বসলাম শুধু আমি আর বাবা।
অনেক আয়োজন। কিন্তু বাবার মুড অফ, বাবা ঠিক মতো খেতেও পারছে না।
ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে করতে বললেন, শুনলাম ইফতি তোমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে
কথাটা কি সত্যি?
জ্বী বাবা।
আমি সই করে রেখেছি।
বাবা বাক্য হারা হলেন।
অতিরিক্ত বিস্ময়ে তার শুধু খাওয়া বন্ধ হলো না, মুখের কথা ও বন্ধ হয়ে গেল। তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন,
তুমি সই করে দিয়েছো!
জ্বী বাবা।
তোমার মাথায় সমস্যা হয়েছে। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। কোন সুস্থ মানুষ এভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিতে পারে?
বাবা প্লিজ শান্ত হয়ে খাও তো।
এতো উত্তেজিত হবার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।
শরাফত আলী মেয়ের কথা শুনে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ।
কি বলছো তুমি এসব!
এটা উত্তেজিত হবার মতো ঘটনা না?
না বাবা।
এটা এতো উত্তেজিত হবার মতো কোন ঘটনা না।
তুমি কেন বুঝতে পারছো না, যে সম্পর্কে কোন ভালোবাসা নেই।
সে সম্পর্ক জোর করে টেনে নেওয়ার কোন মানে হয় না।
তাই বলে ঐ হারামজাদাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিব।
কতো বড়ো সাহস হলে ও আমাকে ফোন দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ের দাওয়াত দেয়।
আমি ওকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।
চাবকিয়ে পিঠের ছাল তুলে দিব।
আমার নাম ও শরাফত আলী।
আমি এমনি এমনি কাউকে ছেড়ে দেই না।
বাবা তুমি এ বিষয়ে আর কোন কথা বলবে না।
আমি জোর করে কোন সম্পর্ক ধরে রাখতে চাই না।
আমি নিজেই ওকে বিয়ের পারমিশন দিয়ে আসছি।
আমি কথা গুলো বলেই ভয়ে ভয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালাম।
বাবার রিএ্যাকশন ধরতে পারছি না। তবে বেশ বুঝতে পারছি–তার আক্কেলগুড়ুম।
বাবা থমথমে মুখে বললো, তুই দেখি সত্যি সত্যি বিয়ের পারমিশন দিছিস?
অকল্পনীয় ব্যাপার!
এসব পাগলের লক্ষণ, তুই পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছিস। তোর চিকিৎসা হওয়া দরকার। কোনো সুস্থ মানুষ এমনটা করতে পারে না।
বাবা খাবারের ওপরে হাত ধুয়ে উঠে গেলেন।
রান্নাটা এতো ভালো হয়েছে।
আমি বেশ আরাম করেই খাওয়া শেষ করলাম।
রাত সাড়ে নটায় শরাফত আলীর একটা ছোট খাটো মাইল্ড স্ট্রোক হল। জয়ীদের বাসার সবার রাত কাটল বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে।
জয়ীর খুব খারাপ লাগছে।
সে মনে মনে নিজেকে প্রচন্ড রকম দোষী সাব্যস্ত করছে।
আমার জন্য আজ বাবার এমন দুরাবস্থা।
আসার পর পর যদি বাবাকে পুরো সমস্যাটা বুঝিয়ে বলতাম।
তাহলে বাবার এমন রিএ্যাকশন হতো না হয়তো।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই রাজু এসে হাজির। সে রাতেই শুনেছে।
কিন্তু ওর মা ছেলের শরীর খারাপ নিয়ে রাতে বের হতে দেয়নি। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ছুটে এসেছে হাসপাতালে।
হাসপাতালের গেটে ঢুকেই রাজু একটা ধাক্কার মতো খেলো।
জয়ী এই সাত সকালে একা একা বাগানে হাঁটছে।
ও বিস্ময় গোপন করে জয়ীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
কি ব্যাপার জয়ী?
তোমার বাবা ভালো আছেন তো?
তুমি একা একা এখানে কি করছো?
জয়ী ঠোঁট টিপে হাসলো।
হুম বাবার শরীর এখন ভালো।
ডাক্তার বলেছে সকালেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবো।
আর সবাই সারা রাত জেগে এখন ঘুমাচ্ছে।
আমার ঘুম আসছে না তাই হাঁটছি।
চলো তাহলে আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
সারা রাত নিশ্চয়ই অনেক ধকল গিয়েছে, এক কাপ চা খেলে ভালো লাগবে দেখো।
ঠিক আছে চলো।
রেস্টুরেন্টে এসে জয়ী তেমন কোন কথা বলছে না। রাজু হড়বড় করে অনেক কথা বলে যেতে লাগলো। জয়ীর কেন জানি মনে হয়েছিলো রাজুর গল্প এখন আর তাকে আকর্ষণ করবে না। দেখা গেল–তা নয়। পাঁচ বছর পরেও রাজুর গল্প শুনতে তার খুব ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, অসম্ভব ভালো লাগছে।
তার কারণ কী? বালিকা বয়সের তীব্র আবেগের স্মৃতির কারণে?
পাঁচ বছর অন্য আরেকজনের সাথে সংসার করার পরও এই আবেগের একটি অংশ কি এখনাে রয়ে গেছে?
তাহলে কি রাজু ভাইয়ার ও আমার প্রতি একি রকম আবেগ কাজ করছে!
শরাফত আলী কে বাসায় আনা হয়েছে।
তার যত্ন আত্তির চুড়ান্ত হচ্ছে।
তার তিন ছেলে আজ অফিসে যায়নি।
তিন ছেলেই বাবার চারপাশ ঘিরে বসে আছে।
আর দুই বউ কার কি লাগবে, সেই তদারকিতে ব্যস্ত।
গ্রামের লোকজন এক নজর চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছে।
তাদের কাউকেই দেখা করার কোন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
সবাইকে বাংলা ঘরে বসিয়ে চা নাস্তা খাওয়ায় বিদায় করা হচ্ছে। ডাক্তার সাহেবের কড়া নির্দেশ, তাকে একদম রেস্টে থাকতে হবে।
কোন রকম উত্তেজনা বা বেশি কথা বলা একদম নিষেধ।
বিশেষ বিশেষ গন্যমান্য ব্যক্তি ছাড়া আজ আর কেউ ভেতর বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পায়নি।
শরাফত আলী বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে।
জয়ী তাকে এভাবে বসিয়ে দিয়েছে।
প্রথমে আরাম লাগছিলো।
এখন খুব একটা ভালো লাগছে না।
তবুও তিনি এই ভালো না লাগাটাকে পাত্তা দিতে চাইছেন না।
তাকে যতো দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হবে।
তার চাঁদের মতো সুন্দর মিষ্টি মেয়েটার জীবনে এতো বড় একটা ঝড় এসেছে।
এ সময় তার এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকা মানায় না।
মরার আগেই দেখে শুনে মেয়েটার একটা ভালো গতি করে যেতে হবে। তা না হলে মরেও শান্তি পাওয়া যাবে না।
মা মরা মেয়েটার সুখ দেখে যেতে হবে যেভাবেই হোক।
উনি সাথে সাথে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন,
আমার সমস্ত সম্পত্তির বিনিময়ে হলেও মেয়েকে আমি সুখি দেখে যেতে চাই।
রাজু আজ রাতের লঞ্চে ঢাকা যাবে। সকালে অফিস। ওর কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে চাকরি বাকরি ছেড়ে ছুড়ে গ্রামে থেকে যেতে।
ও এখন দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারম্যান বাড়ির গেটের সামনে।
বাড়ীর চারদিকে বিশাল ওয়াল দেওয়া। বড়ো একটা লোহার গেট বাড়ির সামনে।
এ বাসায় রাজু এর আগে কখনো আসেনি।
পাঁচ বছর আগে যখন ওকে উঠিয়ে এনেছিলো জয়ীর বাবা। তখন চোখ ছিল শক্ত করে বাঁধা।
তখন কি তাকে এ বাড়িতে আনা হয়েছিল
নাকি অন্য কোন গোপন আস্তানায় নেওয়া হয়েছিলো, রাজু তা আজও জানে না।
কারণ আবার চোখ বেঁধে যেখান থেকে আনা হয়েছিল, সেখানেই রেখে আসা হয়েছিল।
আজকেও ওর বুকের মধ্যে সেদিনের মত ধুকধুক শব্দ হচ্ছে।
মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে খাঁচাটা এখনি বের হয়ে আসবে।
তবুও সে জয়ীর সাথে একবার দেখা করে যেতে চায়।
ওর মন বলছে এবার ঢাকা গেলেই দীর্ঘদিনের জন্য সে জয়ীকে আবারো হারিয়ে ফেলবে।
এখন আর সেই দিনের মতো আদরের ছোট বোন টাকে হারিয়ে ফেলার ভয় নেই।
বোনটা তার শশুর বাড়িতে বেশ ভালই আছে।
সব চিন্তা একপাশে ছড়িয়ে রেখে দুরু দুরু বুকে কলিং বেল চাপ দিলো।
এ ধরনের বড়ো বাড়ি গুলোতে সাধারণত কলিং বেল চাপ দিয়ে অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
অনেক পরে কেউ একজন এসে গেট খুলে।
কিন্তু আজ তা হলো না।
কলিং বেল চাপার কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট খুলে গেল।
আর যে গেট খুলেছে তাকে দেখে রাজু চমকে উঠলো। সে আশা করেনি, জয়ী নিজেই এসে গেট খুলে দিবে।
রাজু বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, তুমি?
জয়ী গেটটা ভিজিয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো।
হুম আমি।
চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
আমি ছাদে ছিলাম।
তোমাকে দূর থেকে এদিকে আসতে দেখেই নিচে নেমে এলাম।
বাবার এখন রেস্ট প্রয়োজন।
বাবা কারো সাথে দেখাও করছেন না।
আর আমি চাই না, তোমাকে দেখে বাবা আবার নতুন করে উত্তেজিত হোক।
দুই এ দুই এ চার মিলাক।
রাজু বিস্ময় গোপন করে বললো, পাঁচ বছর পর ও আমাকে দেখে তোমার বাবা উত্তেজিত হবে?
এখন তো তুমি বিবাহিত। তোমার একটা সংসার আছে। এখন তো আমাকে নিয়ে তার উত্তেজিত হবার কিছু নেই।
জয়ী রাজুর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তারপর পলক নামিয়ে বললো, চলো নদীর পাড়ে বসে কথা বলি।
ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে কীর্তন খোলা নদীর পাড়ে চলে এসেছে।
দুজনে পাশাপাশি বসে আছে।
কারো মুখে কোন কথা নেই।
নিরবতা ভেঙে জয়ীই প্রথম কথা বললো।
রাজু ভাইয়া তুমি হয়তো জানো না, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আর এই খবর শুনেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এই মুহূর্তে তোমাকে দেখলে ভাববে
তোমার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল সবসময়।
আর সেজন্যই আমি সংসার করতে পারিনি।
রাজু নিজের অজান্তেই জয়ীর হাত দুটো চেপে ধরলো।
সে তার আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো, তুমি সত্যি বলছো জয়ী।
সত্যিই তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে?
তাহলে কি এবার তুমি আমার হবে?
বিশ্বাস করো জয়ী তোমাকে ছাড়া আমি একটা দিন ও ভালো ছিলাম না।
এক মুহুর্তের জন্য ও আমি কখনো তোমাকে ভুলে থাকতে পারিনি।
তবুও আমি তোমার সামনে যাওয়ার চিন্তা করিনি।
সবসময় মনে প্রাণে চেয়েছি
আমার জয়ী ভালো থাকুক।
সুখী হোক।
জয়ীর চোখ ভিজে উঠতে চাইছে।
ওর ইচ্ছে করছে রাজুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কান্না করতে।
ঠিক সেই মুহূর্তে রাজুর মায়ের চেহারাটা জয়ীর মুখের সামনে ভেসে উঠলো।
জয়ী নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বললো, হাতটা ছাড়ো রাজু ভাইয়া।
রাজু চমকে উঠে জয়ীর হাত টা ছেড়ে দিল।
চলবে….
#এসো_করো_স্নান_(১০ম পর্ব)
রোকেয়া পপি।
জয়ী নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বললো, হাতটা ছাড়ো রাজু ভাইয়া।
রাজু চমকে উঠে জয়ীর হাতটা ছেড়ে দিল।
সরি
সরি জয়ী।
আমি আসলে সজ্ঞানে তোমার হাত ধরিনি। নিজের অজান্তেই কখন হাত ধরে ফেললাম নিজেও জানি না। প্লিজ তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
ইটস ওকে।
কিন্তু আজ যে কথাটা তুমি বললে, ভবিষ্যতে আর কখনো মুখে এনো না।
বাবা জানতে পারলে ঠান্ডা মাথায় তোমার শরীরে কোরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিবে।
তাই ভুলেও আর কখনো এমন চিন্তা মাথায় এনো না।
এখন থেকে আমরা দুজন শুধু ভালো বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। আমি চাই তুমি চাচি আম্মার পছন্দ মতো খুব ভালো দেখে একটা লক্ষী মেয়ে বিয়ে করে সংসারী হও।
কথাগুলো বলতে জয়ীর গলা ধরে এলো।
চোখের পানি যেন রাজু ভাইয়া দেখতে না পায়, তাই সে মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে রাখলো।
জয়ী তুমি না চাইলে আমি আর কখনও তোমাকে প্রপোজ করবো না। প্রমিজ।
তবে একটা কথা মনে রেখো।
তোমাকে না পেলে আমি আর নতুন করে আমার জীবনে কাউকে জড়াতে চাই না। আমার কোন লক্ষী মেয়ে দরকার নেই।
আমি শুধু আমার জয়ীর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকব।
আজ রাতের লঞ্চে আমি ঢাকা যাচ্ছি।
তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা।
তবে তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ
আমার ফোনটা তুমি ধরো।
আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করো না।
তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। তোমার বাবার প্রেশার না থাকলে আমি আজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাকে কেউ এভাবে জোর করে বিয়ে দিতে পারতো না।
ঐ বিয়েটা আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়।
আর আমি খুব অল্প সময়েই সেই কালো অধ্যায় থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।
বাকি জীবন বিয়ে না করে থাকতে রাজি আছি, তবুও তোমার জন্য আমার মনের মন্দিরে যে জায়গাটা যত্ন করে রেখেছি
সেখানে আর কেউ নতুন করে স্থান পাবে না।
জয়ীর খুব খারাপ লাগছে। রাজু কথাগুলো বলছে ধরা গলায়। ওর চোখ দিয়েও টপাস টপাস করে পানি পড়ছে। ও কখনো রাজুকে কাঁদতে দেখেনি।
ইচ্ছে করছে আলতো করে রাজুর চোখের পানি মুছে দিতে।
ও নিজেও চায় রাজু ওর জীবনে সুখ পাখি হয়ে ফিরে আসুক। কিন্তু চাচি আম্মা নিশ্চয়ই ছেলেকে ডিভোর্সী কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।
জয়ী চলো এবার ওঠা যাক।
তোমার জন্য বাসায় সবাই হয়তো চিন্তা করছে।
হুম চলো।
পুরোটা পথ দুজনে কেউ কারো সাথে কথা বললো না।
জয়ী গেটের ভেতরে ঢুকে না দাঁড়িয়ে ভেতর বাড়িতে হাঁটা দিলো।
খুব ইচ্ছে করছে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রাজুকে দেখতে। সে জানে রাজু এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু জয়ী ইচ্ছে টাকে পাত্তা দিল না।
ইচ্ছে করছে না পেছন ফিরে রাজুর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখতে।
তার নিজের চোখেও পানি চলে আসতেছে।
জয়ীকে যতোক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায়, রাজু দাঁড়িয়ে রইল।
আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পরা শুরু হয়েছে।
একটাও রিকশা নেই।
রাজু জোরে জোরে বড়ো বড়ো পায়ের ধাপ ফেলে সামনে এগিয়ে চললো। মাত্র জ্বর থেকে উঠেছে।
এখন বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত আবার জ্বরের কবলে পরতে হবে।
কিন্তু একটাও রিকশা নেই আশেপাশে।
যখন দরকার থাকে না তখন একসাথে তিন চারটা রিকশা সামনে এসে হাজির হয়। না থাকলেও যেচে পরে জানতে চায়, মামা কোই যাইবেন, উঠেন।
আর এখন হাতে সময় কম, তার ওপরে নেমেছে বৃষ্টি।
এখন আর রিকশার দেখা নেই।
বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে।
বেশ বড়ো বড়ো ফোঁটা শরীরে এসে পড়ছে।
বরফের মতো ঠান্ডা পানি। সুইয়ের মতো বিঁধে যাচ্ছে শরীরে। পুরো শরীরে কাঁপুনি উঠে গেছে।
রাজুর মা মাগরিবের নামাজের পর থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সাতটা একুশ বাজে।
নয়টায় লঞ্চ। রাজু এখনো ফিরছে না। কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয় নি তো! এত দেরি হবার তো কথা না। মায়ের বুক ধড়ফড় করছে। কাল রাতে সে বাজে একটা স্বপ্নও দেখেছে।
স্বপ্নের মধ্যেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ।
জেগে দেখে হাতপা কাঁপছে।
তারপর থেকেই মনটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে আছে।
তিনি বার বার আয়াতুল কুরসি পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিচ্ছেন।
বারান্দার রেলিঙ ভেদ করে বৃষ্টির পানি তার শাড়ির একটা পাশ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই।
তার একটাই চিন্তা রাজুর কোন বিপদ হলো না তো।
যাবে আর আসবে বলে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।
সে জানে এইসব কিছুই না, এতো দুশ্চিন্তার ও কোন কারণ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে রাজু রিকশা করে আসছে।
সেই কিছুক্ষণটাই অনন্তকালের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
বারান্দা থেকে সামনের রাস্তার অনেকটা দেখা যায়।
উনি দেখলেন রাজু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসছে।
তার খুব মন খারাপ হলো।
ছেলেটা একটা সময় নিজের প্রতি খুব যত্নশীল ছিল।
সেই ছেলেটাই জয়ীকে হারানোর পর থেকে কেমন বদলে গেছে! এমন দূর্বল শরীরে কেউ ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে ভিজে! নিজের অজান্তেই তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।
রাজু ঢাকায় এসেই বিছানায় পড়েছে। জ্বরে প্রায় অচেতন হয়ে পরে থাকে। মেসে কেউ কারো নয়। কে রাখে কার খবর। কারো দিকে তাকানোর সময় কারো নেই।
সকাল থেকে শুরু হয় হৈ হুল্লোড়।
শব্দ গুলো রাজুর মাথার ভেতরে গিয়ে বাড়ি দিচ্ছে।
শব্দের চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে জানালা দিয়ে রোদ এসে চোখে লাগছে।
ইচ্ছে করছে উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিতে।
কিন্তু এতো টুকু নড়া চড়া করার ক্ষমতা রাজুর নেই।
রোদ এসে চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে মাথা জ্যাম করে দিচ্ছে।
মাথাটা লোহার মত ভারি লাগছে।
রান্না ঘর থেকে ফুলির মায়ের হাড়ি পাতিল নাড়ার টুং টাং শব্দ আসছে। শব্দে মাথার তার গুলো ছিঁড়ে যেতে চাইছে।
রাজু হাত জোর করে মিনতি করলো, তোমরা থামো প্লিজ। একটু আস্তে কথা বলো।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাদের করা শব্দে।
কিন্তু রাজুর গলার স্বর এতোটাই আস্তে বের হলো যে
কারো কান পর্যন্ত সে শব্দ পৌঁছালো না।
একটা সময় রাজু জ্ঞান হারালো।
যখন জ্ঞান ফিরলো, ও বুঝতে পারল কেউ ওর মাথায় পানি ঢালছে।
পানির ঠান্ডা স্রোত ওর মাথার গরম ধুয়ে মুছে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাজু চোখ বন্ধ করে পরে আছে।
ও বুঝতে পারছে না কে ওর মাথায় এতো সুন্দর করে বিলি কেটে পানি দিয়ে দিচ্ছে।
ও জানে চোখ খুললেই তাকে দেখা যাবে।
কিন্তু এতোটাই আরাম লাগছে যে চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।
যে ঢালে ঢালুক।
চোখ খুললেই সব আলো চোখের মধ্যে ঢুকে যাবে।
চলবে…..