#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
অতঃপর শায়লা সেজানের দিকে এগুতে পারে না। কারণ একটা পারিবারিক অশান্তি সুখের সংসারকে মূহুর্তে নরক বানিয়ে ফেলতে পারে। আর ওই নরক থেকে সংসারের কারোর মুক্তি মেলে না। তাই শায়লার বিয়ে করে সংসার পাততে বড্ড ভয় হয়।
এদিকে শায়লার মা শায়লাকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়। যে মারণ রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে হুটকরে হয়ত একদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তখন মেয়েটার কি হবে এই কথা ভেবে শায়লার মা মিনারা বেগমের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শরীরটাও ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে আবারও ছয়টা কেমো দিতে হবে। আজকে ক্লিনিকে ভর্তি হতে হবে। এদিকে মাথা গোঁজার এই ঠাইটুকু নিয়ে মিনারা বেগম বড্ড চিন্তায় আছেন। এই ফ্লাটটা ওর বাবার নামে। শায়লার নামে লিখে দিলে আর কোন চিন্তা ছিলো না। শায়লার নামে বাড়িটা লিখে দিতে ওর চাচা কি মানবে? হয়ত শায়লা মেয়ে বলে ওর চাচার ছেলেরা ভাগ চাইতে পারে। শায়লার বিয়ে নিয়েও অনেক টেনশনে আছেন মিনারা বেগম। মায়ের চাপাচাপিতে শায়লা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তাই শায়লা সেজানের কথা ওর মায়ের কাছে বলেছে। মিনারা বেগম সেজানকে দেখতে চেয়েছে। শায়লার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে মিনারা বেগম ফিরে আসে।
—–আম্মু সকাল দশটা বাজে,তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। কেমো দিতে অনেক সময় লাগে। তুমি নাস্তা করেছো?
—–আমি রেডী। যদি বমি হয় এই জন্য হালকা কিছু খেয়ে নিয়েছি। তুই ভালোভাবো নাস্তা করে নে।
শায়লা মাকে নিয়ে কল্যাণপুর স্পেশালাইজড হাসপাতালে চলে গেলো। যথাসময়ে ওর মার কেমো দেওয়া শুরু হয়ে গেলো। ওর ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা ওর মাকে দেখতে আসলো। ওদের সাথে সেজানও শায়লার মাকে দেখতে এসেছে। শায়লা সেজানকে সাথে নিয়ে রিমা আর লুনা সহ মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো।
—-আম্মু তুমি রিমা আর লুনাকে আগে থেকেই চেন। আর তোমাকে সেজানের কথা বলেছিলাম না। এই হচ্ছে সেজান।
—-আসসালামুআলাইকুম আন্টি।
—ওয়া আলাইকুমুসসালাম।
—-আন্টি ভাল আছেন? শায়লা আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে।
—-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহপাক ভালই রেখেছেন। আমি ছাড়া আমার মেয়েটার আপন বলে আর কেউ নাই। তাই আমাকে নিয়ে ওর যত ভাবনা।
শায়লা ওর মাকে বললো,
—-আম্মু একটু আগে তোমার কেমো দেওয়া শেষ হয়েছে। এখন সেন্টিমেন্টাল হওয়া চলবে না। মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। তুমি রেস্টে থাকো। আমি ওদের নিয়ে বাইরে যাচ্ছি।
শায়লা ওর বন্ধুদের বিদায় দিলো। সেজান আরও কিছুক্ষণ শায়লার সাথে থাকলো। হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সেজানকে বিদায় দিয়ে মাকে নিয়ে শায়লা বাসায় চলে আসলো। শায়লার একটু টেনশন হচ্ছে। কেমো দেওয়ার পর শরীর অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়। মিনারা বেগম আল্লাহর রহমতে আস্তে আস্তে সামলে উঠে। ছ,টা কেমো দেওয়ার পর অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। আর শায়লারও ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। এতো ঝামেলার মধ্যেও মেয়েটার ভালভাবে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করলো। আসলে লেখাপড়া করে ওকে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এছাড়া আরতো কোন উপায়ও নেই। যেহেতু গ্রাজুয়েশনটা শেষ হয়েছে তাই উনি আর শায়লার বিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে চান না। শায়লার সাথে কথা বলে সেজানদের পরিবারের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চান। মার কথা শুনার পর শায়লা ওর মাকে বলে,
—-আম্মু আমি সেজানকে খুব ভালভাবে চিনি। তারপরও আমার বিয়ে করতে ভয় লাগে। আব্বুর ঐ ঘটনার পর পৃথিবীর কোন পুরুষ মানুষকে আমার বিশ্বাস করতে মন চায় না। যাকে বিশ্বাস করতে পারবো না তার সাথে এক ছাদের নীচে থাকা যায় না।
—-শায়লা, তুই তোর বাবার দোষটা দেখছিস। ঐ মহিলাই বা কতটুকু ভাল ছিলো। ওর তো প্রশ্রয় থাকতে পারে।
—-মা তারপরও মানুষের নৈতিকতা বোধ থাকবে না? এরপরও তুমি বাবার সংসার করেছো। অথচ একটা মহিলা যদি এই কাজটা করতো তাহলে একদিনও স্বামীর ভাত কপালে জুটতো না।
—-আমার মতো এই রকম বহু নারী আছে যারা স্বামীদের দোষত্রুটি মেনে নিয়ে সংসার করে খায়।
—-এই জন্য আমার বাবার মতো পুরুষরা সংশোধন হয় না। যাক এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না। তবে আমি যাকে বিয়ে করবো তার সাথে আমার কিছু চুক্তি থাকবে।
—-চুক্তি করে বিয়ে করবি এরকম কথা আগে কখনও তো শুনিনি?
—-শোননি,এখন শুনবে। কারণ আমি তোমাকে আমার সাথে রাখবো। এটা তাকে মানতে হবে। আর যদি আমার কখনও মনে হয় তার সাথে আমার পক্ষে
সংসার করা সম্ভব না তাহলে মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে নিবো। কেউ কারো সাথে কোন ঝামেলায় যাবো না।
—–সেজানদের পরিবার তোর এই শর্ত মানবে?
—-মানলে বিয়ে হবে, না মানলে হবে না। আমি তোমাকে কার কাছে রাখবো। তুমি একজন অসুস্থ মানুষ। আবার আমার মা হও। তোমাকে ফেলে রেখে আমি তো আমার সুখের কথা ভাবতে পারবো না। আর আমি ছাড়া তোমার আর কোন সন্তান নেই। সেক্ষেত্রে আমার হাতেও তো আর কোন অপশন নেই। সেজানের মা যদি অসুস্থ হয় সেজান কি ফেলে দিতে পারবে? পারবে না। ওর ক্ষেত্রে যদি এই বিষয়টা স্বাভাবিক হয় তাহলে আমার ক্ষেত্রে হবে না কেন?
—-শায়লা আমাদের সমাজ এখনও এতো উদার হয়নি। নিজেদের ক্ষেত্রে সবাই মানবে আর ঘরের বউয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা বলবে। এটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা। আমার কথা ভাবিস না। দরকার হলে আমার জন্য নার্স রেখে দিস।
—-না, মা এটা হয় না। তুমি সুস্থ থাকলে এতো ভাবনা চিন্তার দরকার ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে তোমার শারীরিক অবস্থার কারনে অনেক কিছুই আমাকে আগাম ভাবতে হবে। এই বিষয়টা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।
শায়লা আর সেজান দু,জনেই কর্পোরেট সেক্টরে ভাল জব পেয়েছে। সেজান বিয়ের জন্য শায়লাকে চাপ দেওয়াতে শায়লা ওর শর্তের কথা জানালো। সেজান শোনার পর শায়লাকে বললো,
—-এই বিষয়টা শুধু তোমার আর আমার মাঝেই থাক। মাকে তুমি আমাদের সাথে রাখতে চাও এটা এই মূহুর্তে আমার পরিবারকে জানানোর দরকার নেই। আমাদের বিয়েটা আগে হয়ে যাক তারপর সব স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। তুমি আমার উপর ভরসা রাখতে পারো।
এদিকে সেজানদের পরিবারেও একটু ঝামেলা হচ্ছে। সেজানের বাবা মা বাড্ডায় থাকেন। সেজানের বাবা সরকারি হাইস্কুলের মাস্টার। পেনশনের টাকা দিয়ে আর কিছু লোন নিয়ে পাঁচতলা বাড়ির ভিত দিয়েছেন। আপাতত একতলা করে বসবাস করছেন। সেজানরা একভাই একবোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সেজানের বাবার থেকে এই বিয়েতে মার আপত্তি বেশী। সেজান অনেক টাকা বেতনের চাকরি করে। তাই সেজানদের পরিবার মেয়ের পরিবারের কাছে চাওয়াটা আকাশচুম্বী।
সেজানের মা সেজানকে বলে,
—-সেজান এখনও সময় আছে আর একটু ভেবে দেখ। আমার মনে হয় এই মেয়েটা অপয়া।
—-মা তোমার কি দেখে মনে হলো ও অপয়া। ওকে আমি চার বছর ধরে চিনি। খুবই দায়িত্ববান একটা মেয়ে। ওর এইটুকু বয়সে এক হাতে ওর অসুস্থ মায়ের দেখভাল করছে পাশাপাশি লেখাপড়াও ভালভাবে শেষ করলো। আমার মতো ও অনেক ভালবেতনে চাকরি করছে। মানসিকভাবে শায়লা অনেক শক্ত। ওর বাবা এতো অল্প বয়সে মারা গেলো অন্য কেউ হলে ভেঙ্গে পড়তো। অথচ ও সবটা কি সুন্দরভাবে সামলে নিলো। ওর এই গুনগুলো তোমার চোখে পড়লো না।
—-সাধে কি বলি অপয়া? সময় হলে তখন ঠিক বুঝবি। এই বয়সে বাপকে হারিয়েছে। মা,টাও সুস্থ না। আমার সংসারে আসলে না জানি কি অঘটন ঘটে যায়।