#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
শায়লার মামা তার এক ব্যবসায়ী পার্টনার এর সাথে শায়লার বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছিলো। শায়লার মা বললো,
—-রায়হান, শায়লাতো এখন বিয়ে করতে চাইছে না। আর ওতো গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়ে যখন এইচএসসি পাশ করেছে আমিও চাইছি না এখন ওর বিয়েটা দিতে।
—-আপু তোর তো এক ঠ্যাং কবরে। তোর বয়স কম হতে পারে কিন্তু শরীরে তো রোগ বাসা বেঁধেছে। হঠাৎ করে যখন মরে যাবি তোর যুবতী মেয়েকে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে কুঁড়ে খাবে। আর ওর চাচা ফুফুরাতো কোন খোঁজখবর রাখে না। তাই তুই আর তোর মেয়ের ভাল চেয়ে আমি কত কাঠখড় পুড়িয়ে চেষ্টা করলাম। অথচ তোদের কাছে এর কোন মুল্য হলো না।
শায়লার মা একটু রেগে গিয়ে বললো,
—-তুই রাগ করছিস কেন? এই পৃথিবীতে কারোর নিঃশ্বাসের কোন বিশ্বাস নাই। মেয়েটা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। মনোযোগ দিয়ে মেয়েটা পড়াশোনাও করছে। আর তুই যে প্রস্তাব এনেছিস পাত্রের বয়স তো শায়লার থেকে অনেক বেশী হবে।
—-তা হবে। তাতেকি পুরুষের বয়সের হিসাব আবার কেউ করে নাকি? তোর আর তোর মেয়ের দুজনের দায়িত্ব যখন নিবে সেই পুরুষের বয়স তো একটু হবে। ছেলের ঢাকায় বাড়ি গাড়ি সবই আছে। আবার গ্রামে খামার আছে, রিসোর্ট আছে, তোর মেয়ে রাজরানি হয়ে থাকবে।
শায়লা ভাবলো, মানুষ কতটা নীচ হলে সদ্য স্বামী হারা অসুস্থ বোনকে এভাবে কথা শোনাতে পারে। অসুস্থ বোনকে এই কথাগুলো বলতে তার মুখে একটুও আটকালো না? শায়লা নিজের ঘরে আর চুপ করে থাকতে পারলো না। বের হয়ে এসে ড্রইংরুমে ওর মামাকে বললো,
—-মামা আমাদের নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে চিন্তা না করলেও আপনার চলবে। আমাদের চিন্তা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আপনি এখন আসতে পারেন।
—-আপু তুই তো তোর মেয়েকে আস্ত বেয়াদব বানিয়েছিস। এই মেয়েকে নিয়ে তোর অনেক ভােগান্তি আছে।
শায়লার মামা রাগ করে ওদের বাড়ি থেকে চলে যায়। ওদের সাথে ওর মামারা আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। ওর মাকেও সম্পত্তির অধিকার থেকে ওর মামারা বঞ্চিত করেছে। দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে চাচা ফুফুরাও তেমন একটা যোগাযোগ রাখতো না। আসলে বিপদে পড়লে আত্মীয়স্বজনের আসল চেহারা দেখা যায়। নয়ত এই পৃথিবীর মানুষগুলো মুখোশের আড়ালেই থাকতে চায়।
সেদিন কোচিং এর ক্লাস শেষ হবার পর শায়লা আর শিলা একটা কফিশপে নিরিবিলিতে বসেছিলো। আসলে শায়লা সাংসারিক কূটকচালে হাঁপিয়ে উঠেছে। বাসায় ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। নানা রকম স্মৃতি ঘুরপাক খেতে থাকে। ওর তো হাঁপিয়ে উঠলে চলবে না। অসুস্থ মাকে দেখতে হবে। ওর নিজের জীবনটাও পার করে নিতে হবে। তাই শিলার সাথে সময় কাটিয়ে একটু অক্সিজেন নিতে চায়। কথা প্রসঙ্গে শায়লা শিলাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোদের সংসারে তোর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কখনও অশান্তি হয় না।
—-শায়লা তুই খুব লাকি। এসব অশান্তি তোকে দেখতে হয়নি। তোর বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ট বাবাদের একজন। তবে আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে বাবা আমাকে খুব ভালবাসত। এইজন্য বাকি ভাইবোন আর মায়ের আমার উপর খুব রাগ ছিলো। অশান্তি যে একদম হয় নাই তা বলা যাবে না। মা যখন বাবাকে ওই মহিলাকে নিয়ে গালিগালাজ করতো বাবা তখন রেগে গিয়ে দুই একবার মার গায়ে হাত ও তুলেছে। তখন আমার ভাইরা ছোটো ছিলো। তবে ভাইরা বড় হওয়ার পর বাবাকে বলেছে তুমি অশান্তি করলে এবাড়িতে আসবে না। আর আমার মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারবে না কারণ তুমি আমাদের মাকে ঠকিয়েছো। তারপরও আমার মা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার সংসার করে গেছে। বাবা তখন আমার মা ভাইবোনদের বলে তোরা সবাই বেঈমান। আমারটা খাস আবার আমার দিকে আঙ্গুল তুলিস। ভাইরা বললো, তোমারটা খাই বলে তুমি আমাদের উপর অন্যায় করতে পারো না। ছোটো ছিলাম তাই তোমার সব অন্যায় হজম করেছি। এখন করবো না। তবে আমার কি মনে হয় জানিস ওই ঘরে বাবার ছেলে সন্তান ছিলো না বলে আমার ভাইদের বড় বড় কথাগুলো বাবা হজম করেছে।
—-শিলা তোর বাবার ওই ঘরে আর কোন ছেলেমেয়ে হয় নাই?
— না, ওই ঘরে আমার থেকে বছর খানিকের ছোটো একটাই মেয়ে হয়েছে। এরপরে আর কোন সন্তান হয় নাই। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। জানিস শায়লা, এই কষ্টটা কারো কাছে শেয়ার করা যায় না। জীবন নিয়ে ভাবতে বড় ভয় হয়। বাবা আমার মার উপর যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়টা যদি আবার আমাদের জীবনে ফিরে আসে? এসব যখন মনে পড়ে তখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় না। কারণ ঐ সংসারের প্রতিটা মানুষই তো অসুখী। ঐ সংসারের আনাচে কানাচে শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণা ছড়িয়ে আছে। শায়লা তুই অনেক ভাগ্যবতী।
—-শিলা আমার ভাগ্য যদি এতই ভাল হতো তাহলে আমার বাবা অকালে কেন চলে গেলো। তারপরও আমি আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করি। কারণ মানুষ যে অবস্থায় থাকুক না কেন আল্লাহর কাছে সন্তষ্টি প্রকাশ করলে আল্লাহপাক অনেক খুশী হন। মানুষের জীবন তো নদীর মতন। নদীর যেমন একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে তেমনি জীবনের একটা পাড় ভেঙ্গে গেলে আরও অনেক নতুন পাড়ের সৃষ্টি হয়।
শায়লা শিলার কাছে বিদায় নিয়ে বাসার পথে রওয়ানা হয়। আর মনে মনে ভাবতে থাকে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সবাই সুখে থাকার অভিনয় করে যায়। শিলা যেমন ভাবছে শায়লা অনেক সুখী কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় ওর মতো দুঃখী কেউ নেই। ওর মা অসুস্থ। ওর পাশে ওর কোন আত্মীয়স্বজন নেই। বাবার ছাদটাও মাথার উপর থেকে সরে গেলো। আর বাবা যদি বেঁচেও থাকতেন কি দিন শায়লাকে দেখতে হতো শায়লা নিজেও জানে না। ওই কাজের মহিলার সাথে বাবা যদি সম্পর্ক চালিয়ে যেতেন ঘরের পরিবেশ কত নোংরা হতো ভাবতে গেলে কল্পনায় শায়লা শিউড়ে উঠে। বাবা এখন বেঁচে নেই তাই বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু বাবা মা বেঁচে থাকা অবস্থায় সন্তানরা যখন ভালবাসা পায় না ঐ সন্তানের মতো দুর্ভাগা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এই কারনে শিলা এতো ডিপ্রেশনে থাকে। শায়লা ওর জীবনের কথাগুলো কাউকে বলতে পারছে না। শিলাতো তাও ওর কাছে বলে কিছুটা হালকা হয় কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে শায়লার কথা শোনার মতো একটা মানুষও নেই। কারণ ওযে ওর বাবাকে খুব ভালবাসে। পৃথিবীর মানুষের কাছে ওর বাবা ছোটো হোক কেউ ওর বাবার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলুক শায়লা এটা চায় না। তাই বুকের কষ্টগুলো বুকের গহীনে জমা রেখে দেয়। শায়লা ঢাকা ভার্সিটিতে আইবিএ তে চান্স পায়। ওখানে যেহেতু সেশনজট নেই তাই খুবদ্রুত ওর সময়গুলো পার হতে থাকে। সেজানও একই ডিপার্টমেন্টে ওর সাথে পড়ে। শায়লা বুঝতে পারে সেজান ওর উপরে খুব দুর্বল। কিন্তু শায়লার কিছুই করার নেই। সময়ের স্রোতে অবিশ্বাসের ঘুণপোকা যখন কাউকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তখন তার জীবনের অভিধান থেকে বিশ্বাস নামক শব্দটা হারিয়ে যায়। তাই শায়লা সেজানকে বিশ্বাস করতে পারে না। সেজান বুঝে পায় না শায়লা সব বুঝেও কেন না বুঝার ভান করে থাকে। অতঃপর
চলবে