কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৭

0
692

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৭
কলমে:ইয়াসমিন

চৌধুরী বাড়িতে অতিথি আপ্যয়নের কোনো ত্রুটি রাখা হয়না। তাছাড়া বাংলার মানুষ জানে কিভাবে অঅতিথিদের আপ্যয়ন করতে হয়। জুবায়ের মুগ্ধ হয়ে গেলো চৌধুরী বাড়ির মানুষদের ব্যবহার দেখে। ওদেরকে ডাইনিং রুমে বসতে দেওয়া হয়েছে। ঐশ্বর্য আশেপাশটা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। আদি ভাইবোনদের নিয়ে বসে আছে পাশেই। ঐশ্বর্য যে এখনে আসবে ভাবতে পারেনি। মিষ্টি ক্রমগত আদিকে খুচা দিচ্ছে এটা ওটা বলে। ডালিয়া হক শরবতের গ্লাস পাঠিয়েছেন। ইতিমধ্যে উনার বোনের ছেলে চলে এসেছে পুরো পরিবারের লোকজন নিয়ে। চৌধুরী সাহেব অতিথি আসার আগে ছেলেদের কাছে অধরার কথা বলেছেন। তবে কেউ ওকে এখানো অবধি চোখে দেখেনি। অধরা কক্ষের দরজা এটে বসে আছে কহিনুরকে নিয়ে সঙ্গে মিষ্টি আছে। বাইরের পরিবেশ ওর জানা নেই। ডালিয়া হক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানাভাবে অধরাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। শেষমেশ বললেন,
>আধু শোন তোকে বিয়ে করা লাগবে না আপাতত আমার সম্মান বাঁচা মা। ওদের সামনে গিয়ে বসবি আর চলে আসবি। বাকিটা আমি দেখে নিব। প্লিজ মা আমার এবারের মতো রক্ষা কর। সকলে বসে আছে তো।
অধরা ভেতর থেকে চিৎকার করে উত্তর দিল,
> আগে নিষেধ করেছিলাম তবুও শুনলে না। ওখানে গিয়ে বসলে যে আমার অপমান হবে এটা ভাবছো না কেনো মনিমা? বিয়ে ছাড়া কি মেয়েদের জীবনে আর কোনো কাজ নেই? একবার করেছি ফরজ আদায় হয়েছে আবার কেনো? আমার চাল চলনে কি তোমার কখনও মনে হয়েছে স্বামী বিহীন মেয়েটাকে বিয়ে না দিলে পাপ হচ্ছে?
ডালিয়া হক কপাল চাপড়ে বললেন,
> মারে আমি তোদের মতো এতো বুঝি না। ছোট থেকে শুনে এসেছি বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে বিয়ে দেওয়া ফরজ। তাছাড়া স্বামী যেকোনো বিপদে স্ত্রীকে রক্ষা করে। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য হলেও বিয়ে দেওয়া জরুরি। যাইহোক তুই এবারের মতো রক্ষা কর। এরপর আর কখনও তোকে বিরক্ত করবো না।
অধরা ধপাস করে দরজা খুঁলে বেরিয়ে এসে বলল,

> মনিমা তুমি একটু বেশি বুঝো। নিচে যাও আমি আসছি। এবারেই কিন্তু শেষবার। তোমার জন্য এখন এতগুলো লোকের সামনে আমাকে যেতে হচ্ছে।
ডালিয়া হক অধরাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন তারপর খুশি হয়ে নিচে কলে গেলেন। অধরার পরণে সাদা রঙের শাড়ি। যদিও আজ ও শাড়ি পরতে চাইছিল না তবুও পরতে হলো। এই বাড়ির লোকগুলো না থাকলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেতো তার ঠিক ছিল না। পৃথিবীতে খারাপ মানুষের অভাব নেই। অধরা কথাগুলো ভেবে কহিনুরের কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে আসলো। মেয়েটা কিছু বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অধরা সিঁড়িতে পা রাখতেই কেমন গা ছমছম করে উঠলো। ভ্রু কুচকে ফেলল। কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠেছে।তবুও কারো দিকে তাঁকালো না। সাবধানে পা ফেলে বেরিয়ে আসলো। সাদা শাড়িতে ওকে নেমে আসতে দেখে ডালিয়া হক বিস্মিত হয়ে আছেন। জুবায়ের শরবত মুখে নিয়েছিল হঠাৎ উপরের দিকে তাঁকিয়ে গ্লাস মুখে আটকে গেলো। শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে।। অধরা ধীরগতিতে নেমে এসে সবাইকে সালাম দিয়ে সামনে তাঁকিয়ে চমকে উঠলো। ওর সামনে জুবায়ের বসে আছে। ডালিয়া হক অধরাকে বসিয়ে দিলো জোরকরে। অধরার পা টলছে। ভয়ে বুক কাঁপছে। কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। জুবায়েরের চোখমুখ দেখে বুঝলো লোকটা ওর মতো করেই চমকে গেছে। ডালিয়া হক বলে উঠলেন,
> ওই হচ্ছে অধরা, আমাদের আরেকটা মেয়েই বলতে পারো। মেয়েকে কিন্তু খুব সুশীল আর ভদ্র। এতোকাল একাই স্বামী ছাড়া মেয়েকে মানুষ করছে। স্বামী ছিল আচ্ছা একটা খাটাস লোক নয়তো কি আর এমন মেয়েকে ত্যাগ করে বসে থাকে?
ডালিয়া হকের কথা শুনে অধরা চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল, “মনিমা নিজেও মরবে আর আমাকেও মারবে। চুপ করো প্লিজ।”
পাশ থেকে ডালিয়া হকের বোনের ছেলে নায়েব বলল,
> খালামনি ওকে আমার এমনিতেও পছন্দ হয়েছে। তোমাকে এতো কিছু বলতে হবে না। আমি ওকে খুব ভালো রাখবো।
লোকটার কথা শুনে জুবায়ের ঠক করে গ্লাসটা টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে অধরাও দাঁড়িয়ে গেলো। উপস্থিত সকলে কিছু না বুঝলেও চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলে বাইরে ছিল ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ভ্রু কুচকে বলল,
> মিসেস ফারুকী আপনারা আমাদের বাড়িতে? কি সৌভাগ্য আমার। চিনতে পারছেন? জুবায়ের স্যারের উপরে একবার এটাক হয়েছিল আমি চিকিৎসা করেছিলাম তাছাড়া স্যারের বোন আমার আন্ডারে ছিল।
অধরা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে ভাবলো এবার ষোলো কলা পূর্ণ হলো। জুবায়ের কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা অধরার হাত ধরে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। অধরা হোচট খেয়েও নিজেকে সামলে নিলো। মুখে কোনো আওয়াজ আসছে না। জুবায়ের ওকে রুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরজা ধপাস করে বন্ধ করলো। ডাইনিং রুমের সকলের চোখেমুখে বিস্ময়। মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে সবাই বসে আছে। ঐশ্বর্য কিছুই বুঝতে পারছে না। আদি ওর দিকে ইশারা করলো।ঐশ্বর্য ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো কিছু জানেনা।
***********
নিস্তব্ধ কক্ষে জুবায়ের অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে অধরার দিকে। অধরা ভয়ে অনবরত ঢোক গিলছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কখনও যেই ভূলটা ও করেনি আজ জুবায়েরের সামনেই সেটা করতে হলো। নিয়তি ওর সঙ্গে কি খেলা খেলছে কে জানে। নিরবতা ভেঙে জুবায়ের চাপা কণ্ঠে বলল,

> মিসেস জুবায়ের ফারুকী আপনার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। এতগুলো বছর হৃদয়ে জমে থাকা কথামালার প্রকাশ করার আগেই আপনি যেই সিনটা দেখালেন আমি জাষ্ট ভুলতে পারবো না। ভেরি নাইচ। আমার নামে এখানে বদনাম করা হয়েছে। আমি খাটাস তাই না? বর জীবিত থাকতে আরেকজনের জন্য সেজেগুজে মানুষের সামনে বসতে বুক কাঁপেনি?এখুনি শাড়ি খোলো। নয়তো পিটিয়ে তক্তা করবো আমি। কে বিয়ে করবে কার এতো সাহস দেখি আগে।

জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। ইতিমধ্যে অধরা নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। জুবায়ের এটোম বো*ম হলে অধরা কম কিসে।নিজে বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে আদেক্ষেতা করে বেড়াচ্ছে তাঁর বেলা কিছু না। অধরা শাড়ির আচল খামচে ধরে মুখ কঠিন করে বলল,
> একদম চিৎকার চেচামেচি করবেন না। আপনাকে আমি ভয় পাচ্ছি না। নিজে দোষ করলে কিছু না আর আমি করলে মহা ভারত অশুদ্ধ না? আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বিয়ে করে বউ মেয়ে নিয়ে দিব্যি আছেন। আমি আজ নেহায়েত বাধ্য হয়ে ওখানে গিয়েছিলাম। আপনার মতো ভাববেন না আমাকে।
জুবায়ের অধরার কথা শুনে ভ্রু কুচকে ফেলল। আশেপাশে তাঁকিয়ে একটা ওড়না নিয়ে অধরার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে শাড়ি টেনে খুলে দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে দিলো। অধরা বাঁধা দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জানে পারবে না তাই পরে হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। অধরার সাজ নষ্ট করে জুবায়ের গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
> শুধুমত্র নিজের স্বামীর জন্য সাজবে। আমার বউ আমার চোখের সামনে অন্য মানুষের জন্য সেজেগুজে পরিপাটি হবে এটা আমি সহ্য করবো না।আর তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে সুলতান জুবায়ের ফারুকীর চরিত্র এতটা খারাপ না যে স্ত্রীর সাময়িক দূরত্ব মানতে না পেরে আবারও অন্য নারীরে আসক্ত হবে। ঐশ্বর্যের পরিচয় পরে বলবো কিন্তু আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। ওই ছেলের সাহস কিভাবে হলো সুলতান জুবায়ের ফারুকীর বউয়ের উপরে নজর দেওয়ার? সবগুলোরে আমি আজ গু*লি করবো অপেক্ষা করো।
জুবায়ের দ্রুত বেরিয়ে আসতে গেলো কিন্তু পারলো না। অধরা ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে দুহাতে ওকে আগলে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কতকাল পর দেখা হলো। এত বছরে কত কত কথা মনের মধ্যে জমে আছে। জুবায়ের কিছুটা নরম হলো। নিজেও অধরাকে জড়িয়ে নিলো। ওর মাথায় ওষ্ঠদ্বয় রেখে বলল,
> কহিনুর কোথায়? দেখাবে না আমার মেয়েকে?
অধরা উত্তর দিলো না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। জুবায়েরের রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না অধরার জানা আছে। সব হম্বিতম্বি শেষ। এখন মেয়ের খবর নিতে এসেছে। অধরা অভিমান করে বলল,
> কেনো একা একা এই বিদেশ বিভূয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন? আপনি সঙ্গে আসলে কি হতো? কেনো আসলেন না যদি ম*রে যেতাম কি হতো?
জুবায়েরের মুখটা মলিন হয়ে উঠলো অধরার কথা শুনে। সেরাতে ওকে না পাঠালে আজকের এই মিলন পর্বটা কখনও ঘটতো না। কিভাবে বেঁচে আছে শুধুমাত্র ও জানে। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে দুজনের ধ্যান ভাঙলো। জুবায়ের অধরার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
> চেঞ্জ করে আসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
অধরা নাক টেনে মাথা নাড়ালো। জুবায়ের বাইরে এসে দেখলো ডালিয়া হক মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। জুবায়ের বেরিয়ে আসতেই উনি বলে উঠলেন,
> কি ধরণের আচরণ এটা? মেয়েটার সঙ্গে কি করেছো তুমি? এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।
জুবায়েরের চাপা পড়া রাগটা এবার দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে গেলো। এই মহিলা ওকে খাটাস বলেছিল। এরা ওর স্ত্রী কন্যার দেখাশোনা করেছে এই হিসেবে ও কৃতজ্ঞ কিন্তু তাইবলে ওর বউকে বিয়ে দিয়ে দিবে? এটা মানতে পারছে না। তাই চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
> আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কি ধরণের আচরণ করবো সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি কোন সাহসে আমার বউকে বিয়ে দেওয়ার পাইতারা করছিলেন সেটা বলুন? খুব সমস্যা না হলে আমি কখনও ওদেরকে আমার থেকে আলাদা করতাম না। আমি আর ওদেরকে এখানে রাখবো না। দূরে থাকবেন ওদের থেকে।
জুবায়ের কথাটা বলে গটগট করে নিচে নেমে আসলো। ও আসতেই ঐশ্বর্য দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
> ড্যাড তুমি এটা কি করলে? আদির বাবা ওই মহিলাকে তোমার স্ত্রী কেনো বলছে? তুমি না বলেছিলে আমার মম মারা গেছে?
জুবায়েরের ঐশ্বর্যের মাথায় হাত রেখে বলল,
> সব পরে বলবো তুমি শান্ত হয়ে বসো।
জুবায়েরের ওকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। একদিকে খুশী অন্যদিকে ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বহুকাল আগের রহস্য ক্রমগত সামনে আসতে চলেছে। জুবায়ের আপাতত সেসব ভাবছে না। মেয়টা কেমন হয়েছে দেখার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। তাঁর মধ্যেই অধরা কহিনুরকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো। জুবায়ের আর বসে থাকতে পারলো না উঠে গিয়ে কহিনুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অধরা হাসি মুখে ইশারা করলো। জুবায়ের জানতে সুলতান বংশের মেয়েরা অত্যধিক সুন্দরী হয়ে জন্ম নেয় কিন্তু কহিনুর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যাবেইতো ও যে সুলতান বংশের সর্বশেষ অভিশপ্ত উত্তরাধিকারী। ওর পরে আর কখনও সুলতান বংশে কোনো অভিশপ্ত কন্যার জন্ম হবে না।।জুবায়েরের দ্রুত কহিনুরকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
> আমার মেয়ে আমার অস্তিত্ব। বাবাকে ক্ষমা করে দিও। বাবা তোমাদেরকে কাছে রাখতে পারিনি।
কথাটা জুবায়ের ধরা গলাই বলল। কি যে শান্তি অনুভব হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবে না।
অধরা জুবায়ের পিঠে হাত রেখে বলল,
> সুলতান বংশের অভিশাপ কাটেনি। আমাদের মেয়ে বোবা বধির। কেনো এমন হলো বলতে পারেন?
জুবায়ের অবাক হলো না। এমন হবে ওর জানা ছিল। বলল,
> আমরা হব ঠিক করে ফেলবো। আমাদের মেয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তুমি চিন্তা করোনা। আমি জানি কিভাবে অভিশাপ কাটবে।
অধরার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মেয়ের জন্য ও সবটা পারবে। কাজটা যতই কঠিন হক না কেনো অধরা সেটা করবে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here