#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৮
কলমে: ইয়াসমিন
থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে অধরা। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কেউ কেউ ঘোরের মধ্যে আছে। অধরা যে বড় বাড়ির বউ এটা সকলে বুঝতো কিন্তু এতটা হবে কখনও ভাবেনি। ডালিয়া হক লজ্জিত কিন্তু উনার বোনের ছেলে অবাধ্য। ওর ধারণা যেই স্বামী সামান্য ভয় পেয়ে স্ত্রীকে অজানা দেশে একা ছেড়ে দিতে পারে তেমন স্বামীর কাছে থাকার চাইতে না থাকাই উচিৎ। অধরা বিরক্ত হয়েছে ওর মন্তব্য শুনে। জুবায়ের তো সোজা গিয়ে ওর কলার ধরে হুমকি দিয়েছে আজেবাজে কথাবার্তা না বলার জন্য। চৌধুরী বাড়িতে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও জুবায়ের এখনো পযর্ন্ত এই বাড়িতেই অবস্থান করছে। হঠাৎ কহিনুর আর অধরাকে নিয়ে বাড়িতে গেলে জামসেদ বা ওর ড্যাড কিছু করতে পারে বলে ভয় হচ্ছে। ঐশ্বর্য মিঠির সঙ্গে ওর কক্ষে থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। ঘটনা দেখে ও এইটুকু বুঝেছে সুলতান জুবায়ের ফারুকী ওর নিজের বাবা না। এক মূহুর্ত্তের জন্য ওর পৃথিবী বদলে গেছে। কিছুতেই নিজেকে শাস্ত রাখতে পারছে না। জুবায়েরের উপরে ওর সব রাগ ক্ষোভ গিয়ে জমা হয়েছে। লোকটা যদি ওকে ছোট থেকে বলে দিতো তবে আজ এই দিন ওকে দেখতে হতো না। সব সময় জেনে এসেছে ঐশ্বর্য হচ্ছে সুলতান জুবায়ের ফারুকীর মেয়ে কিন্তু কখনও সুলতান বংশের ট্যাগ ওর নামের সঙ্গে জড়াতে দেখেনি। প্রথমে বিষয়টা ভাবলেও পরে আর মাথা ঘামানো হয়নি। এতকাল বন্ধুদের মধ্যে ওকে সবাই তোয়াজ করে চলেছে কিন্তু এখন আর চলবে না। ভাবলেই ওর কান্না পাচ্ছে। তাছাড়া জুবায়ের ফারুকী নিশ্চয়ই নিজের মেয়েকে ফেলে পরের মেয়েকে বেশি আদর যত্ন করবে না? ঐশ্বর্য ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছে। আদি ওকে তীক্ষ্ণ চোখে অনুধাবন করছে। মেয়েটার ভাব ভঙ্গি কথাবার্তা এবং আচরণ সবটা ওর আয়ত্তে। ওর কেনো জানি গার্লফ্রেন্ডের এই খারাপ সময়ে হাসি পাচ্ছে। দুঃখ কেনো অনুভব হচ্ছে না বুঝতে পারলো না তবুও বলল,
> ঐশ্বর্য এভাবে কাঁদছো কেনো? তোমার বাবা এতদিন আন্টিকে ছেড়ে একা কষ্টে ছিলেন এখন যদি ওদেরকে পেয়ে সুখে থাকে তাহলে তোমার দুঃখ পাওয়ার কি আছে? তুমি একটা বোন পেলে। চারদিকে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
ঐশ্বর্য ফোস করে জ্বলে উঠে বলল,
> দরকার নেই এমন ভালোবাসার। এই মহিলাকে আমি কিছুতেই নিজের মম ভাবতে পারবো না। ড্যাডের পাশে উনাকে দেখলেই আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আমি মানতে পারছি না। ড্যাডকে আমি ক্ষমা করবো না কখনও না।
আদি ভ্রু কুচকে বলল,
> তোমার উনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ সেখানে ক্ষমা আসছে কোথা থেকে। উনি না তাকলে ঐশ্বর্য নামটা এতদিন হয়তো বিলীন হয়ে যেতো নিশ্চিত। যাইহোক মাথা ঠাণ্ডা করো পরে কথা হবে।
আদি কথা বলে বেরিয়ে আসলো। ঐশ্বর্য হাতের মুঠো শক্ত করে বসে থাকলো। চিৎকার করতে পারলে ভালো লাগতো কিন্তু আপাতত চাইছেনা। যেটা কখনও কল্পনাতীত ছিল আজ সেটাই বাস্তবে হয়ে গেছে।
************
এক দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাঁকিয়ে আছে জুবায়ের। পৃথিবী ওর থমকে গেছে। অধরা মাথা নিচু করে ফোন ঘাটাঘাটি করছে। আশেপাশের কিছু ওর খেয়াল নেই।জুবায়েব ঢোক গিলে অধরার চোখের সামনে আসা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বলল,
> ডায়েট করো কতদিন ধরে? একদম স্লিম। এই তোমার বয়স কতো? দিনদিন সুন্দরী হচ্ছো ব্যাপার কি?
অধরা দুদিন আগে খু*ন হওয়া ছেলেটার পোষ্টমটেম রিপোর্টটা দেখছিল হঠাৎ জুবায়েরের কথা শুনে ওর ভ্রু কুচকে গেলো। বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ডায়েট করা লাগেনা টেনশনে এমনিতেই খাওয়া বন্ধ।আর সুন্দরী মেয়েদের বয়স জিঞ্জাসা করতে হয়না অভদ্র বলে লোকে জানেন না?
জুবায়ের অধরার ফোনটা কেড়ে নিয়ে পাশে রেখে ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
> যেভাবে ফোন দেখছো সেভাবে নিজের বরকে দেখতে পারোনা? কত বছর পরে দেখা হলো কোথায় জড়িয়ে ধরে প্রেমালাপ করবে,কপালে চুমু টুমু দিয়ে আদর যত্ন করে অস্থির করে ফেলবে তানা ফোন নিয়ে বসে আছো। রোবটা নাকি অনুভূতি শূন্য?
জুবায়েরের কটাক্ষ শুনে অধরা ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁট গোল করে বলল,
> ও আচ্ছা। শুনুন এটা সিনেমা না বুঝলেন? যবে থেকে আমার জীবনে এন্টি নিয়েছেন তবে থেকে রহস্যের বেড়াজালে আমাকে বন্ধি করে দিয়েছেন। এত বছর পরে আলাপচারিতার আগেই আপনি আমার কপাল ফাটিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের মতো আপনি।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের অধরার কপালে অধরজোড়া রেখে বলল,
> সরি সেদিন চিনতে পারিনি। লেগেছে খুব না?
অধরা নড়েচড়ে বসে বলল,
> সেতো একটু লেগেছেই যাইহোক আপনার ভাইয়ের কি খবর? বিয়ে টিয়ে করেছে নাকি এখনো তেমনি আছে? আচ্ছা উনি কিভাবে বাইরে ঘুরতে পারছে? সূর্যের আলোতে কিছু হয়না?
জুবায়ের থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
> পঁচিশ পেরিয়ে গেছে তাই আপাতত অভিশাপ মুক্ত। বিয়ে করেনি তবে অসংখ্য মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে প্রায় ঝামেলা করে। সম্পত্তির জন্য আমাকে তোয়াজ করে চলে। পারলে খুন করতেন কিন্তু সেটা মম আর ঐশ্বর্যের মায়ের জন্য পারেনি।
অধরা অবাক হলো জুবায়ের কথা শুনে। সবটা জানার জন্য প্রশ্ন করতেই জুবায়ের খাপছাড়া ভাবে বলল,
> বলবো না তুমি নিজে থেকে খুঁজে নাও।দেখি মিসেস জুবায়ের ফারুকীর কেমন বুদ্ধি।
অধরা ভাব নিয়ে বলল,
> বলতে হবে না আমি নিজেই জেনে নিবো। মাথামোটা টাইপ আপনি। আমাকে খাটাবেন বুঝে গেছি। আচ্ছা কহিনুরকে নিয়ে কিছু ভাবছেন? জানেন ওর বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। আপাতত ঝুলছে কি করা যায় বলুন তো?
জুবায়ের অধরাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে হাটতে হাটতে বলল,
> অবশ্যই নিষেধ করে দিবে। কহিনুর ফারুকী নিজের পছন্দে নিজের পাত্র যতদিন না পছন্দ করছে ওর বিয়ে হবে না।
অধরা কিছু বলতে গেলো কিন্তু পারলো না। এতক্ষণ ওরা বেলকনিতে বসে ছিল। জুবায়ের ওকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। অধরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রাখলো। আপাতত ঘুমের বড্ড দরকার।
************
সুলতান ভিলাতে তান্ডব চলছে। জামসেদ ফারুকী আজ বড্ড খেপে আছে। বহুকাল আগে যত্নে রাখা মহামূল্যবান কহিনুর পাথরটা খোয়া গেছে লকার থেকে। যেটার সন্ধান একমাত্র ও ছাড়া কেউ জানতো না। লকারের চাবি ওর কাছে গচ্ছিত আছে কিন্তু ভেতরে কহিনুর নেই। কোথায় যেতে পারে ভেবে মাথায় কাজ করছে না। বাড়িতে যারা আছে তাদের মধ্যে কেউ নিতে পারে কিন্তু কিভাবে নিবে? এতো এতো সিকিউরিটি সবটা ব্যার্থ। সিসি ক্যামেরা বন্ধ হয়নি অথচ সেখানে কাউকে দেখা পযর্ন্ত যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই চোর জ্বিন বা ভূত না? সকলেই জামসেদ ফারুকীর ভয়ে কুকড়ে থাকলেও ওর দাদু চুপচাপ। এমন হতে পারে উনি জানতেন হয়তো। জামসেদ দাদুর কক্ষে এসে হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> পাথর গায়েব কিভাবে সম্ভব দাদু? কে নিতে পারে?
জামসেদের কথা শুনে দাদু চোখ বন্ধ করলেন। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
> পাথর মালিক কি তুমি? ওটা তোমার কাছে আমানত হিসেবে গচ্ছিত ছিল। পাথর যার সে পাথরকে স্মরণ করছে। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?
জামসেদ ফারুকী সামান্য কেঁপে উঠল। দাদুর কথা সত্যি হলে পাথর কহিনুরের কাছে কিন্তু কহিনুর কোথায় আছে? পাথর যদি সেই মেয়েটার কাছে চলে যায় তবে বিপদ আছে। মেয়েটা হিংস্র হয়ে উঠবে। কাউকে পরোয়া করবে না। ভেবেছিল ওকে খুন করে ওর র*ক্ত দিয়ে পাথরের শক্তি ফিরিয়ে ওরা ব্যবহার করবে কিন্তু এটা কি হলো? না না এমন হওয়া চলবে না। জামসেদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দাদু আবারও বলে উঠলেন,
> এমনটা নাও হতে পারে। আপাতত ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখো ওটা কোথায় আছে। আমি অনুমান থেকে বলেছি সত্যি হবে এমন না। সময় নষ্ট করোনা। এই পাথরটা আমাদের কতটা জরুরি তুমি এটা জানো। আমার বয়স হয়েছে আর কতকাল বেঁচে থাকবো। মেয়েটার সঙ্গে পাথরটা যেকোনো মূল্যে নিয়ে এসো।
> দাদু ওটা কে নিতে পারে বুঝতে পারছি না। আমি দেখছি চিন্তা করোনা। ড্যাড আমার উপরে খেপে আছে। তুমি উনাকে শান্ত করো। আমি যাচ্ছি।
জামসেদ বেরিয়ে আসলো কক্ষ থেকে। দক্ষিণ দিকের চিলেকোঠার ছোট্ট কক্ষ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে ভয়ংকর হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মেয়েটার হাসির মধ্যে মিশে আছে শত শত দুঃখ কষ্টের আহাজারি। হঠাৎ কিছুদিন এমন শব্দের উৎপত্তির অর্থ কাউ জানেনা। সুলতান পরিবারের মেয়েরা যে জন্ম থেকে বোব সেখানে মেয়েটা হঠাৎ করে কিভাবে শব্দ করে হাসছে এটা জটিল রহস্য। জামসেদ সেদিন তাঁকিয়ে কাজের মেয়ের দিকে চোখ রাঙিয়ে ওষুধের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো। আপাতত রাতটুকুর জন্য একটু শান্তি চাই। শান্তির খোঁজে নাইট ক্লাব বা হোটেল ওর ভরসা।
***************
চৌধুরী বাড়ির ডাইনিং রুমের সোফায় চুপচাপ বসে আছে আহির। কপালে চিন্তার রেখা। দুদিন ব্যবসার কাজে ঢাকায় ছিল তাই এই বাড়ির খবরাখবর কিছু জানা হয়নি। গতকাল রাতে চৌধুরী সাহেবের ছোট ছেলে ওর বাবাকে সবটা বলেছে। সেসব শুনে কিছুটা শঙ্কা নিয়ে সকাল সকাল এই বাড়িতে আসা। সুলতান পরিবারের একমাত্র মেয়েকে ওর সঙ্গে বিয়ে দিবে কি এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। তবুও ভরসা হচ্ছে মেয়ে বোবা বধির সেই তুলনায় ও একজন শিক্ষিত সুদর্শন যুবক। অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি খারাপ না বেশ ভালো। চৌধুরীদের থেকেও বলা যায় ভালো। এটাই একমাত্র ভরসা। যেভাবেই হোক কহিনুরকে ওর চাই।মেয়েটাকে পেলে রাজ্য সহ রাজকন্যা হাসিল করা হবে। আহিরের ধ্যান ভাঙলো ডালিয়া হকের কথা শুনে,
> এতো সকাল সকাল?
আহির নিজেকে প্রস্তর করে মৃদু হেসে বলল,
> এমনিতেই বাবা পাঠালেন আপনাদের খোঁজ নিতে। তাছাড়া আন্টির রিসোর্টের কর্মি খু*ন হয়েছে ওটার বিষয়ে কথা বলতাম।
ডালিয়া হক কিছু বললেন না। চায়ের কাপ সামনে দিয়ে বললেন,
> তোমার আন্টি কক্ষে আছে। লেট হবে আসতে। সময় থাকলে অপেক্ষা করো।
আদি সকাল সকাল বাইরে গিয়েছিল বাড়িতে প্রবেশ করতেই আহিরকে দেখতে পেলো। দৌড়ঝাঁপ করে ক্লান্ত ছিল তাই আহিরের পাশে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। চিৎকার করে কফির অর্ডার দিয়ে অনাকাঙ্খিত অতিথির দিকে চেয়ে বলল,
> আপনার পরিচয়?
অহির চায়ের কাপে মুখ ঢুবিয়ে অমৃত সুধা পান করার মতো সুড়ুক দিয়ে বলল,
> আমি সুলতান পরিবারের একমাত্র হবু জামাই।
আহিরের উত্তর শুনে আদি ভ্রু কুচকে বলল,
> রিয়েলি? কহিনুর আপনার বাগদত্তা?
আহির ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> কথাবার্তা চলছে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
ওর কথা শুনে আদি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
> জুবায়ের ফারুকীকে চিনেন? সাবধানে কথাবার্তা বলুন নয়তো কাচা চিবিয়ে খাবে। এসব আজগবী কথাবার্তা বাদ দিন। কহিনুর বাচ্চা মেয়ে ওকে বিয়ের আশা ছেড়ে দিন।
অদি কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা করলো না। কফির কাপ নিয়ে উপরে উঠে গেলো।
ফোনে শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো ঐশ্বর্যের। সাত সকালে কে ফোন দিতে পারে বুঝতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন আসলো,
> জামসেদ ফারুকী বলছি। জুবায়ের আর তুমি কোথায় আছো? আমি তোমাদের অপেক্ষা করছি।
ঐশ্বর্য মুখ ভাব করে উত্তর দিল,
> ড্যাড কহিনুর আর ওর মমকে না নিয়ে চৌধুরী বাড়ি থেকে যাবে না। আমার কথা শুনছে না।
ঐশ্বর্যের বলতে দেরী হলো কিন্তু ওপাশ থেকে আসছি বলতে দেরি হলো না। ফোন কেটে দিয়ে ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করলো। রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। ওদিকে জামসেদ হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসলো চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে।
চলবে